somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৯)

১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৮)

নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে
দেখিতে পাইবি কখোনো পাশেতে
কভু সম্মুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া।

আমি আছি, অথচ আলেয়া আমার আশে পাশে নেই, এমন ঘটনা দাদার বাড়ি আসার পর থেকে একদিনও ঘটেনি। অথচ বাঁশঝাড়ের সেই ঘটনার পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আলেয়াকে একবারও দেখলাম না। এতদিনে আলেয়ার সাথে আমার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সম্ভবত বাড়ির সবাই কমবেশি বুঝতে পেরেছে। আর আমিও বুঝতে পারছি যে,এতে সবারই প্রশ্রয় রয়েছে। কারণটা তো শুধু এ বাড়ি নয়, এ বাড়ির সাথে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী কিছু পরিবারও জানতো। পরে জেনেছি, আমাদের কাছের অনেক আত্মীয়স্বজনও তা’ জানতো। তারপরেও সামাজিক রক্ষণশীলতা ও সরকার বাড়ির মান সম্মানের দিকে খেয়াল রেখে আমি নিজে থেকেই আলেয়ার সাথে মেলামেশার ব্যাপারে যতটা সম্ভব সতর্ক ও সংযত হয়ে চলার চেষ্টা করতাম।

কিন্তু আলেয়া ছিল আমার ঠিক উল্টো। তার চপলতা ও অসংযত আচার আচরণ বাড়ির সবার কাছে ছিল বয়সের দোষ। অপরিণত একটি কিশোরী মেয়ের বেপরোয়া চলাফেরা এ বাড়িতে ছিল অনুমোদনযোগ্য বিচ্যুতি, যা আমাদের দু’জনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের নিশ্চয়তার নিরিখে সবার কাছে স্বাভাবিক বলেই গন্য হতো। যেমন আলেয়াকে ডাকাডাকি করে বাড়িতে না পাওয়া গেলে বড় চাচীমা যখন বলতেন, ‘এই মেয়েটা যে এতই চঞ্চল! এখনই দেখলাম চাপকলে হাত মুখ ধুচ্ছে, আবার এখনই গায়েব’, তখন আমার বড়ভাই বলতেন, ‘আপনার ওই পাগলিকে দেখলাম আমাদের পাগলটার সাথে বাহির বাড়িতে একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে বদন খেলছে।’
আমার বড় বোন আনন্দে গদ গদ হয়ে বলতেন, ‘আলেয়ার সাথে থেকে থেকে হেনা মেয়েদের সব খেলা শিখে ফেলেছে।’ যেন মেয়েদের খেলা শিখে ফেলাটা তাঁর ভাইয়ের এক বিশাল কৃতিত্ব।

যাহোক, সেদিন সারাদিন আলেয়াকে দেখতে না পেয়ে আমি খুব অস্থির হয়ে গেলাম। শেষে থাকতে না পেরে মগরেবের নামাজের পর লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বড় চাচীমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, আলেয়া কোথায়? আজ সারাদিন ওকে দেখছি না।’
বড় চাচীমা জায়নামাজ গুটিয়ে ঘরের এক কোনায় রেখে আমার হাত ধরে খাটের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর হারিকেন তুলে খাটের একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা আলেয়াকে দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ দেখ বাবা, সারাদিন ওভাবে শুয়ে আছে। দুপুরে ভাতও খায়নি। সকালে এক মুঠো বাসি ভাত খেয়েছিল, ব্যস।’
আমি আলেয়াকে উদ্দেশ্য করে কঠিন গলায় বললাম, ‘এই ওঠ্।’
আলেয়া সাথে সাথে বিছানায় উঠে বসে আমার দিকে না তাকিয়ে বললো, ‘দুপুরে ভাত খাইনি কেন মাকেই জিজ্ঞেস করো।’
‘হায় আল্লাহ!’ বড় চাচীমা হতাশ গলায় বললেন, ‘সকাল থেকে ঘরে বসে আছে। তোমাকে নাস্তা পানি দিতে বললাম, গেল না। দুপুরে চাপকল থেকে তোমার গোসলের পানি, লুঙ্গি গামছা দিতে বললাম, তাও গেল না। তুমিই বল বাবা এসব সহ্য হয়? তাই হাল্কা করে একটা চড় দিয়েছি, তাতেই দুপুরে ভাত না খেয়ে এভাবে ঢং করে শুয়ে আছে। এখন তুমি ওর চুলের ঝুঁটি ধরে কষে একটা চড় মারো তো বাবা। ওর সব ভুত ছুটে যাক। বদমাশ মেয়ে কোথাকার! বাপের বেশি বেশি আদর পেয়ে বাঁদর হয়ে গেছে।’
আলেয়া ওর মায়ের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘মেজভাই তোমার মতো ছোটলোক না যে আমাকে চড় মারবে। শহরের মানুষ ভদ্রতা জানে, তোমাদের গাঁয়ের মানুষের মতো অসভ্য না। কী মেজভাই, তুমি আমাকে চড় মারবে? বলো।’
‘অবশ্যই মারবো। তুই যদি এখনই উঠে ভাত না খাস তো অবশ্যই চড় মারবো।’
আলেয়া লাফ দিয়ে উঠে বিছানা থেকে নেমে ওর মাকে বললো, ‘ভাত দাও।’

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। বাইরে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারদিক ঝক ঝক করছে। পৃথিবীটা যেন ঢেকে গেছে রূপালী আলোর চাদরে। আলেয়া ভাত খাওয়ার পর আবদার ধরলো পূর্ণিমার চাঁদ দেখবে সে। সরকার বাড়ির গোয়াল ঘরের পাশে উঁচু ভিটার ওপর দুটো গরুর গাড়ি পাশাপাশি হেলান দিয়ে রাখা থাকে। প্রয়োজনে গরু বা মোষ জুড়ে গাড়ি দুটো ব্যবহার করা হয়, প্রয়োজন না হলে ওভাবেই পড়ে থাকে। আলেয়ার ইচ্ছা, গাড়ির ওপর বসে বসে আকাশের চাঁদ দেখবে। আমার হাত ধরে সে টানাটানি শুরু করলো।
আমি বললাম, ‘সারাদিন তো একা একা ভালোই ছিলি। এখন আমাকে কী দরকার? একা একা বসে পূর্ণিমার চাঁদ দেখগে,যা। আমি যাবো না।’

আলেয়ার পীড়াপীড়ি আরো বেড়ে গেল। বড় চাচীমাও রাতের বেলা মেয়েকে একা একা বাড়ির বাইরে যেতে দেবেন না। তাঁর কথা হলো, হেনা সাথে গেলে যাও, নইলে ঘরে বসে থাকো। শেষে রাজী না হয়ে উপায় কী? সারাদিন আলেয়ার সাথে কথা না বলে আমারও পেট ফুলে আছে। কিন্তু আমরা ঘর থেকে বেরোবার আগেই বড় চাচীমা হৈ হৈ করে উঠলেন, ‘আলেয়া চুলটা বেঁধে যা মা। খোলা চুলে রাতের বেলা বাইরে যেতে হয় না।’
কে শোনে কার কথা! আলেয়া রেগে কাঁই হয়ে আছে। সে শুনবে মায়ের কথা? মাকে পাত্তাই দিল না। বড় চাচীমা আমাকে বললেন, ‘ওকে একটু থামাও বাবা, চুলটা বেঁধে দিই।’
শেষে আমার ধমক খেয়ে গজর গজর করতে করতে ওর মায়ের সামনে পিঁড়িতে গিয়ে বসলো আলেয়া। ওর মা অগোছালো চুলগুলো চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে উঁচু করে খোঁপা বেঁধে কয়েক গাছি চুলে গিঁট দিয়ে দিলেন। গ্রাম্য সংস্কার। হিন্দু মুসলিম সবাই মেনে চলে। এতে নাকি মেয়ের অমঙ্গল দূর হয়। চুল বাঁধা শেষ হলে আলেয়া বিরক্ত কণ্ঠে বললো, ‘ভালো লাগেনা ঘোড়ার ডিম! দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে রাজ্যের যত ঘাস আল্লাহ আমার মাথাতেই দিয়েছে। একদিন কাঁচি দিয়ে যখন ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে চুলগুলো সব কেটে ফেলবো, সেদিন থেকে মায়ের অত্যাচার বন্ধ হবে।’

বড় চাচীমা অসহায়ভাবে আমার সমর্থন পাওয়ার আশায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছু বললে তিনি মেয়ের তোপ থেকে রক্ষা পান।
আমি বললাম, ‘আল্লাহর কী দোষ আর মায়েরই বা কী দোষ? যেখানে গোবর বেশি থাকে, সেখানে ঘাসও বেশি হয়, জানিস না?’
আলেয়া আমার ইয়ার্কি বুঝতে না পেরে বললো, ‘আমি কী মাথায় গোবর মাখি যে এত ঘাস গজাবে?’
‘আরে বোকা, তুই গোবর মাখবি কেন? তোর মাথার ভেতরে ঘিলুর বদলে গোবর ঠাসা। তা’ না হলে এক ক্লাসে কেউ দু’বার ফেল করে?’
‘দেখ মেজভাই’ আলেয়া রেগে আগুন, ‘আর একবার যদি তুমি এ কথা বলো না, তাহলে, তাহলে.........।’
তাহলে কী হবে, অতিরিক্ত উত্তেজনায় সেটা আর বলতে পারছে না আলেয়া। আমি ক্ষমা চাওয়ার মতো ভঙ্গী করে বললাম, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, আর বলবো না বাবা। এখন চল।’
আমি হাসি লুকিয়ে আলেয়াকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। বড় চাচীমা পেছন থেকে হাত ইশারায় আমাকে বোঝাতে চাইলেন যে, আমি যেন এভাবে ওকে শাসন করি। বুনো ওলের চুলকানি এমন বাঘা তেঁতুল না হলে সারে না। বড় চাচীমার খুশি দেখে মনে হলো, তিনি বুঝে ফেলেছেন যে আল্লাহ জোড়া মেলাতে ভুল করেননি।

পূর্ণিমার রুপালী আলোয় চারদিক সয়লাব। পূর্ণ চাঁদের মিষ্টি আলোয় বিশ্ব চরাচর যেন হাসছে। দূরে কোথাও ডাহুকের ডাক শুনে মনটা উদাস হয়ে যায়। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে ভালোবাসার ডাক দিচ্ছে।
আলেয়ার মন খারাপ। সে এসব কিছুই দেখছে না। গরুর গাড়ির বাঁশের পাটাতনে বসে মাথা নিচু করে বিড় বিড় করছে সে। বোঝা যাচ্ছে, ওর রাগ এখনো পড়েনি। এ ক’দিনে ওর রাগ ভাঙ্গানোর কিছু ওষুধের খবর আমার জানা হয়ে গেছে। তারই একটা খুব সাবধানে প্রয়োগ করলাম। কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব মিষ্টি মিষ্টি করে বললাম, ‘আলেয়া, আমি তো সাঁতার জানিনা। তুই কী আমাকে সাঁতার শেখাবি?’
ফলস্ ওষুধে কাজ হলো না। আলেয়া বিড় বিড় করা বন্ধ করে একদম চুপ হয়ে গেল। ওর ডান হাতটা টেনে আমার নিজের হাতের মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে দু’হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে বসে রইল। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘আলেয়া, তুই যে সুন্দরী তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তুই নিজেই জানিস না যে তুই সুন্দর কেন? তোর সৌন্দর্য হলো তোর মাথা ভর্তি ঘন কালো চুলে আর তোর মুখের হাসিতে। অথচ এই সুন্দর চুলগুলো তুই কেটে ফেলতে চাচ্ছিস। আর এখন তুই মুখ গোমড়া করে বসে আছিস। তাহলে তোর সৌন্দর্যের আর কী থাকলো বল? তোকে গোমড়া মুখে দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না।’
কম ডোজের এই আসল ওষুধে একটু কাজ হলো। মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নিল সে। কিন্তু কোন কথা বললো না।

এই সময় কাছে কোথাও থেকে ভেসে এল পাপিয়া পাখির ডাক। আমি কান খাড়া করে পাপিয়ার মিষ্টি ডাক শুনে পাখিটার অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছি। আমাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে আলেয়া বললো, ‘এ পাখির নাম জানো?’
আমি বললাম, ‘পাপিয়া।’
আলেয়া একটু নড়ে চড়ে বসে বললো, ‘ও তো তোমাদের শহরের নাম। আমাদের গ্রামে বলে ‘বউ কথা কও’।’
‘বুঝলাম। কিন্তু বউ তো কথা বলছে না। মুখ কালো করে বসে আছে।’
আলেয়া নিশ্চুপ। আমি পাটাতন থেকে নেমে ওর মুখোমুখি হয়ে বললাম, ‘আজ সারাদিন তোকে দেখতে না পেয়ে আমার খুব খারাপ লেগেছে। একটা দিন তো গেল না, যেন একটা বছর গেল।’
আমার কোন সমস্যা হলে আলেয়ার দ্রুত বিচলিত হওয়ার প্রবণতা আছে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘কালকের ঘটনার পর থেকে তোমার সামনে আসতে আমার খুব লজ্জা করছিল। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মেজভাই। এরকম আর কখনো হবে না।’
আচ্ছা, এই ঘটনা! দুষ্টামি করার সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘কী হবে না? কালকের সেই বাঁশ ঝাড়ের ঘটনা, নাকি আজ সারাদিন লুকিয়ে থাকার ঘটনা? কোনটা?’
আমার দুষ্টামি ধরে ফেলেছে আলেয়া। বললো, ‘দু’টাই।’
‘উঁহু!’ গরুর গাড়ির পাটাতনে উঠে বসে আমি বললাম, ‘বাঁশ ঝাড়ের ঘটনাটা রোজ রোজ ঘটলেও আমার আপত্তি নাই। তবে আজকের ঘটনাটা যেন আর না ঘটে।’
আমার কথাটা হজম করতে একটু সময় নিল আলেয়া। তারপর বুঝতে পেরে আমার হাতের কনুইতে একটা রাম চিমটি কেটে রাগ কমাতে ব্যর্থ হয়ে পিঠে দুম করে একটা কিল বসালো সে। আমি ব্যথায় ‘উহ্’ করে উঠলেও হাসি থামাতে পারলাম না। আলেয়া গাড়ি থেকে নেমে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘বিয়ের আগে আর না।’
আমি ওর একটা কান ধরে হালকা করে টান দিয়ে বললাম, ‘বিয়ের আগে কী আর পরে কী সবই তো জানিস দেখছি! তুই তো কাঁচামিঠা না রে, কাঁচাপাকা মেয়ে।’

আলেয়া পাটাতনের ওপর উঠে আমার পাশে গা ঘেঁষে বসলো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘মেজভাই, বিশ্বাস করো, তুমি আসার আগে আমি এমন ছিলাম না। রাজশাহী থেকে আমার স্বামী আসছে, দাদীমার কাছে এ কথা শোনার পর থেকে আমার কী যে হলো তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না।’
আমি মনোযোগ দিয়ে আলেয়ার কথা কথা শুনছি। সে আমার গায়ের সাথে হেলান দিয়ে আদুরে গলায় বললো, ‘মনের মানুষ কাছে এলে মেয়েরা এভাবেই বদলে যায় গো। আমাকে তুমি ছোট বলছো, নাবালিকা বলছো। কিন্তু গ্রামে আমার বয়সী কত মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর কাছে যাওয়ার পর তারা কী আর ছোট থাকে?’
একটু থেমে আলেয়া আবার বললো, ‘আমার এসব কথা শুনে আমাকে তোমার হয়তো খারাপ মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তোমার দোহাই লাগে, আমাকে খারাপ ভেবো না মেজভাই। কাল আমার ওপর শয়তান ভর করেছিল বলে অমন একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি কিন্তু খারাপ মেয়ে না, মেজভাই। বিশ্বাস করো।’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ‘তোকে আমি খারাপ মেয়ে ভাববো কেন? তুই যা করেছিস, তোর অধিকার আছে বলেই করেছিস। এতে ভালো খারাপের কিছু নাই। এ নিয়ে এত মন খারাপ করিস না তো!’
‘কিন্তু বিয়ের আগে এ কাজ করলে পাপ হয়।’
‘কে বলেছে তোকে?’
এবার মোল্লাদের মতো ভয় দেখানো শুরু করলো আলেয়া। বললো, ‘নামাজ তো পড় না। হাদিস কোরানও বোঝো না। পাপ হয় কী না তুমি জানবে কোত্থেকে? বিয়ের আগে এসব করলে কঠিন গুনাহ হয়। তুমি দাদীমাকে জিজ্ঞেস করে দেখো।’
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, ‘তুই দাদীমাকে বাঁশঝাড়ের কথা বলেছিস নাকি?’
‘বলিনি। তবে বললে কোন ক্ষতি নাই। দাদীমা আমার সই। সইয়ের কথা সই জানলে ক্ষতি কী?’
‘ক্ষতি থাক আর না থাক, তুই দাদীমাকে এসব কথা বলবি কেন?’ আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। এই বোকা মেয়েটা তো দাদীমার কাছে সব কথা ফাঁস করে দিয়েছে দেখছি।
আলেয়া মিন মিন করে বললো, ‘বলছি তো বলিনি।’
‘উঁহু, তুই মিথ্যে কথা বলছিস। তুই নিশ্চয় দাদীমাকে সব কথা বলে দিয়েছিস।’

আমার ধমক খেয়ে শেষে আলেয়ার পেট থেকে সত্যি কথাটা বেরোলো। দাদীমার সাথে এক খাটে শোয় আলেয়া। অনেক রাত অব্দি দু’জন গুজুর গুজুর করে গল্প করে। আমার সাথে আলেয়া কখন কোথায় যায়, কখন কী কথা হয়, আমি আলেয়াকে ভালোবাসি কী না ইত্যাদি এমন কোন কথা নাই যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুড়ি জিজ্ঞেস করে না। আর এই বোকা মেয়েটা তার বুড়ি সইকে সব কথা বলে দেয়। শুনে বুড়ি খুব আনন্দ পায়। ফোকলা মুখে বুড়ি ফিক ফিক করে হাসে। শুধু বাঁশঝাড়ের ঘটনাটা নাকি বুড়িকে এখনো বলেনি আলেয়া, আর বলবেও না। এটা খুব শরমের কথা, সইকেও বলা যায় না।
আলেয়ার কথা আমার বিশ্বাস হলো না। দাদীমাকে সে বাঁশঝাড়ের কথাও বলে দিয়েছে। আর বুড়ি মুখে হাদিস কোরানের ভয় দেখিয়ে আলেয়াকে শাসন করলেও মনে মনে খুশিতে আটখানা। এই নির্বোধ মেয়েটা হলো এক বেকুব আর ঐ বুড়িটা হলো বদ গাছের শেঁকড়।

রাতে বিছানায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুম এল না। কলেজের বন্ধুদের কথা মনে পড়লো। আমি রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলাম। যৌবনের দরজায় পা রাখা ছেলে মেয়েদের কো-এডুকেশনের পরিবেশে মানিয়ে নিতে গিয়ে প্রথম প্রথম আমি বেশ বিভ্রান্ত ছিলাম। মেয়েদের সাথে কথা বলতে সংকোচ হতো। অথচ মেয়েরা কী অবলীলায় কথা বলতো ছেলেদের সাথে! এই মেয়েদের অনেকেই গ্রামের স্কুল থেকে পাশ করে আসা। কলেজের হোস্টেলে বা শহরে আত্মীয়স্বজনের বাসায় থেকে তারা পড়াশুনা করে। আলেয়াও গ্রামের মেয়ে। বয়সের হিসাবে সে আমার চেয়ে খুব বেশি ছোট নয়। পড়াশুনায় নিয়মিত হতে পারলে এতদিনে তার ক্লাস এইট নাইনে থাকার কথা। কিন্তু পড়াশুনার প্রতি ওর খুব ভয়। তার ওপর ওর স্বামী (?) এসেছে কাছে। এ অবস্থায় ওর প্রগলভতা, উচ্ছলতা কোন কিছুই অস্বাভাবিক বা অপ্রাকৃতিক নয়।

আলেয়ার কথাই ঠিক। স্বামীর সাহচর্য বয়স ভেদে গ্রাম বা শহরের যে কোন মেয়েকেই প্রাকৃতিকভাবে বদলে দেয়। সৃষ্টিকর্তার এও এক রহস্য। এখনো বিয়ে হয়নি আমাদের। কবে হবে আমরা কেউ জানি না। শুধু বিয়ে হবে এই বিশ্বাসের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এই বিশ্বাস থেকে আমরা এক চুল নড়তে রাজী নই। ঘুমোবার আগে আমার শুধু মনে হলো, আলেয়া বা আমি ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি তো? প্রচণ্ড কোন ঝড় এসে আমাদের দু’জনের এই মজবুত বিশ্বাসের ভিত কাঁপিয়ে দেবে না তো?
না, তা’ কী করে হয়? আকাশের ঈশান কোনে ঝড়ের কোন লক্ষণ নেই। বাতাসে নেই কোন মাতামাতি। আগাম কোন সংকেত না দিয়ে তো কখনো ঝড় বৃষ্টি আসে না। আমি শুধু শুধু ভাবছি কেন? ভাবছি, আমার মনটা হয়তো মানুষের বলেই।
**********************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১০)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:০৬
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×