somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১২)

১৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১১)

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার

পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মিলিটারিদের মতো আমাকে পাহাড়া দিয়ে রাখলো আলেয়া। বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে দিল না আমাকে। বললো, ‘এই গ্রামে কী আছে যে তুমি দেখতে যাবে? তোমার বাইরে যাবার দরকার নাই।’
বড় চাচীমা বললেন, ‘কেন, তোর মামাদের জমি জমা, পানের বরজ, আমের বাগান এসব দেখিয়ে নিয়ে আয়।’
আলেয়া ক্ষেপে গেল ওর মায়ের ওপর। বললো, ‘কেন, মধুপুরে কী মেজভাই এসব দেখেনি? নতুন করে দেখার কী আছে? তোমার ভাইদের জমিতে কী সোনার ধান ফলে? পানের বরজে কী রূপার পান হয়? আমের গাছে কী হীরার আম ধরে? এমনিতে মেজভাই দুর্বল মানুষ, রোদ বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। এত রোদে বাইরে টো টো করে ঘুরলে মেজভাইয়ের আবার অসুখ হয়ে যাবে। তখন সব দোষ হবে আমার।’
বড় চাচীমা বললেন, ‘ছাতা নিয়ে যা।’

আলেয়া এমন কঠিন চোখে ওর মায়ের দিকে তাকালো যে ওর মা পালাতে পারলে বাঁচে। আর ওর মায়ের কথা কী বলবো, আমি নিজেই আলেয়ার চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেলাম।
হেনা ঘরে ঢুকলে আলেয়া আমার পাশে এসে বসে পড়ে। বুক সেলফ থেকে হেনার পাঠ্য বইগুলো নিয়ে দেখতে লাগলে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সে রেখে দেয়। বলে, ‘কলেজ ছেড়ে নতুন করে স্কুলে ভর্তি হবে নাকি যে এসব বই দেখছো?’

এ বাড়িতে ধর্মীয় অনুশাসন খুব কড়া। সন্ধ্যে বেলায় যে যার মতো ঘরে ঘরে মগরেবের নামাজ পড়ছে, এমন কী হেনাও। ঘরে শুধু আমি আর আলেয়া। সুযোগ পেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর কী হয়েছে বল্ তো? এমন করছিস কেন?’
আলেয়া নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো। বললো, ‘এখানে আমার ভালো লাগছে না, মেজভাই। চলো আমরা কালকেই চলে যাই।’
আমি চিন্তিত মুখে বললাম, ‘কেন, এত তাড়াতাড়ি কেন? সবে তো কাল দুপুরে এলাম। আর দু’একটা দিন থেকে যাই।’
‘না, না, না।’ আলেয়ার তীক্ষ্ণ চিৎকারে বড় চাচীমা তড়িঘড়ি নামাজ শেষ করে ছুটে এলেন আমাদের ঘরে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
আলেয়া ওড়না দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, ‘মেজভাইয়ের এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। আমরা কাল সকালেই চলে যাবো। তুমি জালালকে এখুনি মধুপুর পাঠিয়ে দাও। দু’পহর রাতে রওনা দিয়ে গরুর গাড়ি নিয়ে যেন কাল সকালেই এখানে পৌঁছে যায়। দেরি হলে আমি কিন্তু জালালের দাঁতগুলো সব নোড়া দিয়ে ভেঙ্গে ফেলবো বলে দিও।’
বড় চাচীমা হতভম্ব হয়ে একবার আমাকে দেখছেন, একবার আলেয়াকে। কী বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। আলেয়া ধমক দিল ওর মাকে, ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? জালালকে পাঠাবে, নাকি পাঠাবে না?’
বড় চাচীমা ‘যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি’ বলতে বলতে পালিয়ে বাঁচলেন। আলেয়া হলো বড় চাচার বড় ও একমাত্র মেয়ে। সে ক্ষেপে গেলে তার বাপ মাও তাকে ভয় করে। আলেয়া যাই বলুক তাদের মেনে নিতে হয়, কাজটা যতই কঠিন হোক। যেমন, জালাল এখন তার দাঁতগুলো হারানোর ভয়ে প্রায় দৌড়ানোর মতো করে হাঁটা দেবে মধুপুরের উদ্দেশ্যে। পৌঁছাবে মাঝরাতে। তারপর সে বড় চাচাকে ঘুম থেকে তুলে তাঁর মেয়ের বিগড়ে যাওয়ার কথা বলবে। সাথে যোগ করবে তাঁর ভাতিজার আলমডাঙ্গায় থাকতে অনীহার কথা। বড় চাচা জালালকে পাঠিয়ে মাঝরাতে দুই গাড়োয়ানকে ডেকে পাঠাবেন তাদের বাড়ি থেকে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি প্রস্তুত করে গরু জুড়ে দেওয়া হবে। আলমডাঙ্গায় পৌঁছাতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে গরুর বদলে মোষ। মোষের শক্তি বেশি, দ্রুত চলতে পারে। অতএব, গাড়ি ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবে আলমডাঙ্গায়। নোড়া দিয়ে জালালের দাঁত ভাঙ্গার আর প্রয়োজন হবে না।

রাতে খাওয়ার সময় আলেয়ার দুই মামা মামীসহ বাড়ির প্রায় সবাই হাজির। বড়মামা বললেন, ‘শুনলাম, কাল সকালেই নাকি তোমরা চলে যাচ্ছো?’
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আলেয়া চট্ করে বললো, ‘মামা, হয়েছে কী, মেজভাই তো কোনদিন বাপ মা ভাই বোন ছেড়ে কোথাও থাকেনি। তাই এখানে এসে তার ভালো লাগছে না। দেখছেন না, সারাদিন মনমরা হয়ে ঘরে বসে আছে, কোথাও বেড়াতে যাবার কথা বললে রেগে যাচ্ছে। আমি কতবার বলছি, চলো মামদের ক্ষেত খামার, পানের বরজ দেখে আসি। মেজভাই কিছুতেই যাচ্ছে না। বলছে, ওসব তো মধুপুরেই দেখেছি। আবার নতুন করে কী দেখবো? আর তা’ ছাড়া হয়েছে কী, মেজভাইয়ের রোদ একদম সহ্য হয় না। এই তো ক’দিন আগে মধুপুরে আমাদের জমি জমা পানের বরজ দেখতে গিয়ে রোদে পুড়ে মেজভাই জ্বর বাধিয়ে বসলো। সে কী ঠা ঠা জ্বর! গায়ে হাত দিলে নিজের হাতেই ফোস্কা পড়ে। তাই না, মা?’
বড় চাচীমা তাঁর বাচাল মেয়ের কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। আলেয়ার কথা তখনো শেষ হয়নি। সে বললো, ‘শহরের ছেলে তো! রোদ বৃষ্টিতে লবণের মতো গলে যায়। শহরে ওদের বাড়ির পাশে বাজার, ঘরের মধ্যে পায়খানা। বাড়িতে ভাত খেয়ে কুলি ফেলে কলেজে। হাঁটাহাঁটি নাই। হাঁচি হলেও বড় বড় ডাক্তার ডাকে। গ্রামের মতো চার পাঁচ ক্রোশ হেঁটে হাট বাজার করলে তবে না শরীর শক্ত হতো, তাই না মামা?’
বড়মামা বললেন, ‘সে তো ঠিকই মা। তবে আমি বলি কী, আর দু’চারটা দিন থেকে গেলে হয় না? এই তো তোমরা এলে, আর এই চলে যাচ্ছো। আমাদের যে সবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে!’
আমার কিছু বলার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আলেয়া আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঝট্ পট্ বললো, ‘আসা যাওয়ার দিন তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না মামা। দেশের অবস্থা খারাপ। মেজভাইরা তো আসলে বেড়াতে আসেনি গাঁয়ে, মেলেটারিদের ভয়ে পালিয়ে এসেছে। মেলেটারিরা কলেজের ছাত্র পেলেই গুলি করে মেরে ফেলছে। তাই না, মেজভাই?’
বুঝলাম, আমার এখন চুপ থাকাই ভালো। আলেয়ার বড় মামী মিন মিন করে বললেন, ‘আমাদের কোন কথাবার্তায় বাবাজী অসন্তুষ্ট হলো নাকি.........।’
‘আরে না, না।’ আমার হয়ে সব কথা বলছে আলেয়া, ‘অসন্তুষ্ট হবে কেন? মেজভাই তোমাদের ব্যবহারে খুব খুশি। আমাকে বলেছে তোর মামামামীদের মতো মানুষই হয় না। দেশের অবস্থা ভালো হলে মেজভাই আবার বেড়াতে আসবে। কী মেজভাই, ঠিক না?’
আমি বোকার মতো হেসে মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানালাম। দেখে অবশ্য মনে হলো না যে আলেয়ার দেয়া প্রতিশ্রুতি এবং আমার মাথা দোলানো সমর্থনে কেউ আশ্বস্ত হয়েছে। বরং হঠাৎ আমরা চলে যাচ্ছি কেন এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না পেয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।

যা হোক, খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমার জন্যে বরাদ্দ করা হেনার ঘরে গিয়ে বসলাম। আলেয়া তখনো ওর মামা মামীদের কী সব বোঝাচ্ছে। বড় চাচীমা আমার পিছে পিছে ঘরে এসে ঢুকলেন। আমি বললাম, ‘মা, এক গ্লাস পানি খাবো।’ পেছন থেকে হেনার গলা শোনা গেল, ‘আমি নিয়ে আসছি ফুপু।’
হেনা পানি আনতে গেলে বড় চাচীমাকে বললাম, ‘আমার মাথাটা খুব ধরেছে। আলেয়াকে একটু আসতে বলো না মা। মাথাটা একটু টিপে দিক।’
আলেয়াকে ডাকতে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন তিনি। একটু পরে পরিস্কার কাঁচের গ্লাসে পানি নিয়ে ঘরে ঢুকলো হেনা। তার হাত থেকে গ্লাসটা নেয়ার সময় আলেয়া আমার মাথা টেপার জন্য হন হন করে ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে একটু থমকে গেল। পানি খাওয়ার আগেই গ্লাসটা সে কেড়ে নিল আমার হাত থেকে। তারপর গ্লাসের পানির দিকে এক নজর তাকিয়ে হেনাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘পানিতে যে এতবড় একটা পোকা মরে পড়ে আছে সেটা কী তোর চোখে পড়লো না? এই পানি তুই খেতে দিচ্ছিস মেজভাইকে?’
বলাও সারা, গ্লাসের পানি ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলাও সারা। খালি গ্লাসটা নিয়ে নিজেই পানি আনতে চলে গেল আলেয়া। পানি এনে আমাকে খাইয়ে হেনার সামনেই সে আদুরে গলায় বললো, ‘তোমার নাকি খুব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে মেজভাই?’
আমি হাঁ সূচক জবাব দিলে সে আরো আদুরে আদুরে গলায় বললো, ‘শুয়ে পড় তো। আমি সুন্দর করে মাথা টিপে দিচ্ছি।’
আমি শুয়ে পড়লাম। আলেয়া বিছানায় উঠে আমার মাথার কাছে বসে অত্যন্ত আনন্দের সাথে মাথা টিপে দিতে লাগলো। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম হেনা ঘরে নেই।

পরদিন সকাল থেকে আকাশে হালকা মেঘ জমার সাথে সাথে মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো। এ সময় এমন আবহাওয়া ঝড় বৃষ্টির লক্ষণ। আলমডাঙ্গা থেকে মধুপুর ফেরার পথে প্রায় এক ক্রোশ রাস্তা পার হবার পর প্রথমে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। তারপর দমকা বাতাসের সাথে সাথে প্রবল বর্ষণ। বড় চাচীমা গাড়োয়ানদের নির্দেশ দিলেন গাড়ি থামিয়ে ছইয়ের খোলা দুই মুখে টিন বেঁধে দিতে। এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ছইয়ের ওপর মাপ মতো কয়েকটা টিন বেঁধে রাখা থাকে। গাড়োয়ানরা গাড়ি থামিয়ে সেই টিন গুলো খুলে নিয়ে ছইয়ের দুই মুখে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। আমি আর আলেয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম বাইরের জগৎ থেকে। ছইয়ের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সামান্য আলো ঢুকলেও ভেতরটা বেশ অন্ধকার।

এক পশলা মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর একটানা টিপ টিপানি বৃষ্টি চলতে থাকলো। বৃষ্টির মধ্যে গরুর গাড়ি ধীর গতিতে চলছে। কাঁচা কর্দমাক্ত রাস্তায় চলতে গিয়ে গরুগুলোর হাঁটার গতি কমে গেছে। গাড়োয়ানরা খুব সতর্ক হয়ে রাস্তার উঁচু নিচু দেখে গাড়ি চালাচ্ছে। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তায় গরুর গাড়ি হাঁকানো পাকা গাড়োয়ানের কাজ। আমাদের দুই গাড়োয়ানই খুব দক্ষ। তারা বংশানুক্রমে সরকার বাড়ির গাড়ি চালায়। এর চেয়ে কঠিন রাস্তাতেও তারা গাড়ি চালিয়েছে। কখনো কোন বদনাম হয়নি।

আমি আর আলেয়া ছইয়ের ভেতর অনেকক্ষণ ধরে নিশ্চুপ বসে আছি। আসলে এভাবে হঠাৎ করে চলে আসাটা ঠিক স্বতঃস্ফূর্ত নয় বলে আমাদের দু’জনের মনেই অস্বস্তির কাঁটা খচ খচ করছে। আলেয়া জেদ করে চলে আসায় হয়তো ওর মনে কিছু অপরাধবোধ কাজ করছে। আর আমার কাছে মনে হচ্ছে, মেয়েরা বোধহয় সব কিছুর ভাগাভাগি মেনে নিলেও মনের মানুষের ভাগ মেনে নিতে পারে না। ব্যাপারটা যদিও ভাগাভাগি পর্যন্ত গড়ায়নি এবং তার প্রশ্নও ওঠে না, তবুও অপরিণত মানসিকতার কারণে আলেয়ার অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়া একটু বেশি বেশিই হয়ে গেছে। একটা অবাস্তব আশংকাকে অহেতুক মনের মধ্যে ধারণ করে সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের অনাকাংখিত ঘটনা মানুষকে সাময়িকভাবে নির্বাক করে দেয়। অতি বাচাল শ্রেনির মানুষের কথাবার্তাও তখন বন্ধ হয়ে যায়। আলেয়া হয়তো সে কারণেই চুপচাপ আছে। তবে আমি জানি, সে এক সময় ঠিকই কথা বলবে। ঘটনা পরবর্তী প্রাথমিক ধাক্কাটা শুধু সামলে নেয়ার ব্যাপার। আর হলোও তাই। আলেয়া আমার দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললো, ‘তোমার কী মন খারাপ, মেজভাই?’
আমি হেসে বললাম, না তো!

আমার হাসি দেখে সে সাহস পেল। এতক্ষণ সে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল, এবার একটু নড়ে চড়ে বসে তার মাউথ পিস চালু করে দিল, ‘আলমডাঙ্গার চেয়ে আমাদের মধুপুর গ্রাম অনেক ভালো। এই জন্যে নানীবাড়ি যেতে আমার একদম ভালো লাগে না।’
‘কিন্তু আমি তো শুনেছি উল্টো কথা। বছরে চার পাঁচ বার নানীবাড়ি না গেলে তোর নাকি পেটের ভাত হজম হয় না।’
‘এসব বাজে কথা কে বলেছে গো?’ আলেয়ার প্রতিবাদের সুর একটু দুর্বল।
‘নানীবাড়ির এত টান যে স্কুলে পরীক্ষা দেয়ার কথা পর্যন্ত তোর মনে থাকে না।’
আলেয়া আমার কথায় একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেও তার স্বভাবজাত চপলতার কারণে কথাটা গায়ে মাখলো না। তার উচ্ছলতা ও চিত্তচাঞ্চল্য এত বেশি যে কোন কথারই গভীরে সে বেশিক্ষণ অবস্থান করতে পারে না। আমাকে স্বামী মেনে স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেই শুধু তার চেষ্টা বিরামহীন। দুনিয়ার অন্য সব কিছু তার কাছে গৌণ। আবার বয়সের অপরিপক্কতা সত্ত্বেও আমাদের দু’জনের এই ঝুলে থাকা সম্পর্কের ব্যাপারে তার কথাবার্তা অনেক বেশি দার্শনিক, অননুমেয় ও রহস্যময়। দুটো ব্যাপার একসাথে যায় না। আমি মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। আর সত্যি বলতে কী, সে সময় আমার নিজের বয়সই বা কত? সবে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বয়সের হিসাবে তখন আমিও তো নাবালকদের দলে। এ যুগে এই বয়সী ছেলেমেয়ের সাথে অনেক অভিভাবক কলেজে যায়। সেখানে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে নারী চরিত্রের এই জটিল দিকগুলো বোঝার মতো যথেষ্ট মানসিক পরিপক্কতা আমার ছিল না। আমি আলেয়াকে বুঝতাম, আবার বুঝতামও না।

যা হোক, আমি অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে আছি দেখে আলেয়া অস্থির হয়ে উঠলো। বললো, ‘তুমি কথা বলছো না কেন, মেজভাই? এত চুপচাপ তো কখনো থাকো না! কী হয়েছে তোমার?’
আলেয়ার উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আমি বুঝতে পারছি। প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য আমি হালকা কথাবার্তা শুরু করলাম। বললাম, ‘আচ্ছা আলেয়া, তুই এত সুন্দর করে, এত মধুর করে মিথ্যা কথা বলতে শিখলি কোত্থেকে, বল্ তো? আমাকে একটু শেখাবি? আমিও বলবো।’
আলেয়া মাথা নিচু করে নিস্তেজ গলায় বললো, ‘মিথ্যে কথা আবার কী বললাম?’
‘বলিস নি? তোর নানীবাড়িতে আমার থাকতে ইচ্ছে করছে না, পুকুরের পানিতে গন্ধ, মুড়োঘণ্টে লবণ বেশি, গ্লাসের পানিতে মরা পোকা এসব তাহলে সব সত্যি কথা?’

আলেয়া অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল। আবার ঝমাঝম বৃষ্টি শুরু হয়েছে বাইরে। বাঁকানো বাঁশের মোটা বাতার ওপর দু’পরল চাটাই বিছিয়ে তার ওপর টিনের আচ্ছাদন দিয়ে বানানো গরুর গাড়ির ছই। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ছইয়ের ওপর তুমুল শব্দ। আমি আলেয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি, সে কাঁদছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘এই তুই কাঁদছিস কেন? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস?’

আলেয়া দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘শোন শোন। আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস? ঠিক আছে, আর বলবো না। এখন কান্না থামা। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।’
আলেয়ার কান্না আরো বেড়ে গেল। আমাকে শক্ত করে ওর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মেজভাই, তুমি শুধু আমার। আর কারো না, আর কারো না। আমাকে ছাড়া তুমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারো না।’
আমি ওকে আদর করতে করতে বললাম, ‘আমি তো তোরই। আমি আর কারো হতে যাবো কেন? কী আবোল তাবোল কথা বলছিস?’
আলেয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, ‘তাহলে একবার বলো, তুমি আমার ছাড়া আর কারো না। তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসো না।’
দুর্গাপূজার সময় শহরের পুজা মণ্ডপগুলোতে মাইকে একটা ভারতীয় সিনেমার গান খুব ঘন ঘন বাজানো হতো। “তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার। কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার।” আলেয়ার কথা শুনে গানটার কথা মনে পড়ে গেল। আসলে ভালবাসার দাবি সবকালে সবযুগেই এক। এ ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহর, শিক্ষিত অশিক্ষিত, ছোট বড়, বুঝ অবুঝ কারো মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কোন মেয়ের কাছে তার মনের মানুষ একান্তভাবেই তার নিজের। এ ব্যাপারে সন্দেহ ও সংশয়ের দোলাচল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে সর্বদাই ব্যাকুল।

‘আলেয়া।’ আমি বললাম, ‘একবার কেন? আমি লক্ষ কোটি বার বলছি, আমি তোর ছাড়া আর কারো না। আমি তোকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না।’
একটু থেমে আমি ভেজা গলায় বললাম, ‘যেদিন তোর জন্ম হয়েছে, সেদিন থেকেই আমি তোর স্বামী। আমাদের এই জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক, এই ভালোবাসার কথা কে না জানে বল্? কেন মিছে মিছি ভয় করিস তুই বল্ তো? আমি শুধু তোরই, আর কারো না।’
আলেয়া কেঁদেই চলেছে। প্রকৃতিও কী কাঁদছে? অবিরল বর্ষণে আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে অশ্রু। মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান। সন্তানের কষ্টে মা কাঁদবে না কেন?
***************************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৩)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:১৮
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×