somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৩)

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৫:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১২)

যেন আমার অনেক কালের
অনেক দূরের মা।
কাছে গিয়ে হাত খানি ছুঁই
হারিয়ে-ফেলা মা যেন তুই,

পরদিন সকাল বেলা খবর এলো, মধুপুর থেকে চৌদ্দ পনের ক্রোশ দূরে পাকিস্তানি সৈন্যদের রাজশাহী থেকে বাগমারা থানা সদরে যাতায়াতের বিকল্প পথ রাজশাহী-নওহাটা-ভবানীগঞ্জ সড়কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু মুক্তিযোদ্ধারা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। যতদূর মনে পড়ে জায়গাটার নাম আলীগঞ্জ। পাকিস্তানি সেনাদের মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল রাজশাহী থেকে পূর্বে পুঁঠিয়া হয়ে উত্তরে তাহিরপুর, সেখান থেকে বাগমারা থানা সদর। কিন্তু রাজশাহী শহর থেকে উত্তর দিকে দুর্গম এলাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় তাদের নির্মূল করার জন্য পাক সেনাদের কাছে রাজশাহী-নওহাটা-ভবানীগঞ্জ সড়কের গুরুত্ব ছিল বেশি। সেতু উড়িয়ে দেওয়ার পরদিন রাজশাহী থেকে মিলিটারিরা এসে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় আলীগঞ্জসহ আশে পাশের গ্রামগুলোতে বহু মানুষকে হত্যা করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

আলীগঞ্জ সেতু উড়ে যাওয়ায় ঐ পথে বাগমারার সাথে পাক সেনাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং রাজশাহী শহর থেকে উত্তর অঞ্চলে তাদের আনাগোনা সীমিত হয়ে পড়ে। আমাদের মধুপুর গ্রাম ছিল উত্তর অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্গম এলাকায়, যেখানে যাওয়ার রাস্তাঘাট ছিল খুবই খারাপ। বর্ষা এসে পড়ায় সেই ভাঙ্গাচোরা কাঁচা রাস্তার অবস্থা আরো করুণ। এমনিতে এ অঞ্চলে পাক হানাদারদের উপস্থিতির সম্ভাবনা বরাবরই খুব কম ছিল। তার ওপর আলীগঞ্জ সেতু উড়ে যাওয়ায় সে সম্ভাবনা আরো কমে গেল। তবে আলীগঞ্জের ঘটনা এ গ্রামের মানুষের মধ্যে আলোচনার খোরাক হয়ে রইল বহুদিন।

আলমডাঙ্গা থেকে ফিরে পরদিন সকালে সরকার বাড়ির বৈঠকঘরে বসে অন্যান্যদের সাথে আমিও ঘটনার বর্ণনা শুনছিলাম। এই সময় বাড়ির এক ভৃত্য এসে এক গ্লাস গরম দুধ দিয়ে গেল আমাকে। জ্বর ভালো হবার পর থেকে শুরু হয়েছে এই অত্যাচার। প্রতিদিন সকালে নাস্তার পর এক গ্লাস গরম দুধ খেতে হবে। আলেয়ার নির্দেশ অমান্য করা যায়, কিন্তু আমার তিন মাসের পালক মায়ের কাকুতি মিনতি অগ্রাহ্য করা যায় না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঢক ঢক করে দুধ খেয়ে ফেলতে হয়। চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই, আলেয়া হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে আর মা আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। ঘণ্টাখানেক বৈঠকঘরে কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে এসে দেখি, উঠানের এক দিকে বসে মেজ ও ছোট চাচীমা দু’জন মিলে দুটো চার পাঁচ সের ওজনের রুই মাছের আঁশ ছাড়াচ্ছেন। মাছ দুটো আজ সকালে পদ্মপুকুর থেকে বেড় জাল ফেলে ধরা হয়েছে। মাছের মাথা দিয়ে মুড়োঘণ্ট পাকানো হবে। আলেয়ার দাদাজান ও মেজভাই মুড়োঘণ্ট খেতে ভালোবাসে, তাই বাড়ির খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়ে সেটা রান্না করা হবে।

মুড়োঘণ্ট আমি পছন্দ করি সেটা ঠিক। কিন্তু যখন শুনলাম যে এই মুড়োঘণ্ট আজ রান্না করবে স্বয়ং আলেয়া, তখন আমার গলা শুকিয়ে গেল। সে নাকি নিজে রান্না করে সরকার বাড়ির সবাইকে দেখিয়ে দেবে মুড়োঘণ্ট কাকে বলে? বিনা কাজে ব্যস্ত হয়ে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বাড়ি। আমার মা গেছেন পাড়া বেড়াতে। সম্ভবত পাড়ার মহিলারা আলীগঞ্জের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ মায়ের কাছে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। বড় চাচীমা গোয়ালঘর থেকে লোকমান নামের একজন কম বয়সী রাখালকে ধরে এনে বকা ঝকা করছেন। লোকমান কাল বিকেলে গরুর খড় কেটে দিয়ে যায়নি। গরুগুলো সারারাত না খেয়ে থাকবে এই কারণে আলমডাঙ্গা থেকে ফিরে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে বেচারা জালাল সন্ধ্যের পর হারিকেন জ্বালিয়ে বসে খড় কেটেছে। খৈল ভুষি মিশিয়ে সেই খড় চাড়িতে তুলে গরুগুলোকে খেতে দিতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গেছে। জালালের এই কষ্টের জন্য বড় চাচীমা রাখাল ছেলেটির ওপর ক্ষেপেছেন। কিন্তু ছেলেটিকে বড় চাচীমার বকা ঝকার আওয়াজ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জালালও শুনতে পাচ্ছে কিনা সন্দেহ। বড় চাচীমার গলার আওয়াজ খুবই নিচু। তিনি বাড়িতে আছেন কিনা অনেক সময় বোঝা যায় না।

আমি আলেয়াকে হাত ইশারায় আমার ঘরের বারান্দায় ডেকে নিয়ে বললাম, ‘তুই নাকি মুড়োঘণ্ট রান্না করবি?’
‘হাঁ, করবো। কেন?’
আমি বললাম, ‘হেনা যদি পারে তো তুই পারবি না কেন? ঠিক আছে, রান্না কর।’
আলেয়া চলে যাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘এই শোন্, শোন্।’
আলেয়া ফিরে এসে বললো, ‘কী বলছো তাড়াতাড়ি বলো। আমার অনেক কাজ আছে। তোমার সাথে ফালতু বকার সময় নাই।’
‘বলছি, এর আগে তুই মুড়োঘণ্ট রেঁধেছিস কখনো?’
‘আমি তো জীবনে রান্নাই করিনি কোনদিন।’
‘সেরেছে!’ আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, ‘তো না শিখে তুই রান্না করবি কিভাবে?’
আমি যে কী পরিমান বোকা সেটা বোঝানোর জন্য আলেয়া মুখ দিয়ে ‘ধ্যাৎ’ জাতীয় একটা শব্দ উচ্চারণ করে বললো, ‘মেয়েদের রান্না শিখতে হয় না। মেয়েরা হলো মাছের মতো। মাছেদের কী সাঁতার কাটা শিখতে হয়?’
অকাট্য যুক্তি। এই যুক্তি খণ্ডানোর মতো যথেষ্ট বিদ্যা বুদ্ধি আমার ঘটে নাই। অতএব নিজেকে মনে মনে বললাম, আপাতত চুপচাপ থাকো আর বউয়ের ওপর ভরসা রাখো। যে মাছকে সাঁতার কাটা শিখতে হয় না, তার মুড়ো দিয়েই ঘণ্ট রাঁধা হচ্ছে। আর ঘণ্টটা যখন একজন মেয়ে মানুষই রাঁধছে, যার রান্না শেখার দরকার হয় না, তখন সেটা সুস্বাদু হতেই হবে।

বউয়ের ওপর ভরসা রেখে দুপুরে খেতে বসলাম। আমার সাথে আমার সব ভাই বোনরা এবং তিন চাচার ছেলেমেয়েরা খেতে বসেছে। জনসংখ্যার আধিক্যহেতু এ বাড়িতে সাধারণত একসাথে সবার খেতে বসা হয় না। যে যখন সময় পায় খেয়ে চলে যায়। কিন্তু আজ লম্বা মাটির বারান্দায় মাদুর, পাটি, শতরঞ্জি ইত্যাদি বিছিয়ে আমরা সব ভাইবোন একসাথে খেতে বসেছি। অনেকটা চড়ুইভাতির মতো মনে হচ্ছে। আলেয়া খেতে না বসে ওর মা চাচীদের সাথে তদারকি করছে।
মুড়োঘণ্ট মন্দ হয়নি। সবাই খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে। মাছের একটা মুড়ো দাদাজানের জন্য আর একটা আমার জন্য। মাছের মাথা নিয়ে অন্যদের মাথাব্যথা নেই। তারা ডালের সাথে মাছের টুকরো পেয়েই খুশি।
খাওয়া দাওয়া শেষে ঢেকুর তুলে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। কোনদিন রান্না না করে এত সুন্দর মুড়োঘণ্ট আলেয়া রাঁধলো কিভাবে? শুয়ে শুয়ে সে কথাই ভাবছি আর ভ্যাপসা গরমে হাতপাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করছি। এক সময় ঘুমে চোখ দুটো বুঁজে এল। পাখাটা পড়ে গেল আমার হাত থেকে।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম, আলেয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। সরকার বাড়িতে আনন্দের বন্যা। ঢেঁকিতে আতপ চাল গুঁড়ো করা হচ্ছে। পিঠেপুলি বানানো হবে। বৈঠকঘরের সামনে গরু জবাই করা হয়েছে। বড় বড় চুলা খোঁড়া হয়েছে। গ্রামের সব লোক আজ সরকার বাড়িতে খাবে। বাড়ির পেছন দিকে কবুতরের খোপগুলো থেকে বাক বাকুম আওয়াজ ভেসে আসছে। সবাই খুব ব্যস্ত। বিয়ের শাড়ি ও গয়না পরা আলেয়াকে আমি মাত্র এক নজর দেখার পর সে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমি তাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। আমবাগানে, বাঁশের ঝাড়ে, পানের বরজে, পুকুর পাড়ে কোথাও সে নেই। অবশেষে তাকে পাওয়া গেল গ্রামের এক প্রাচীন ভগ্নপ্রায় হিন্দু মন্দিরের সামনে। কাঁসার থালা ভর্তি জবাফুল আর ধুপ ধুনো দিয়ে ঠাকুরের পুজো করছে সে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে গিয়ে দেখলাম বিয়ের সাজে মেয়েটিকে আলেয়ার মতো দেখাচ্ছে বটে, তবে সে আলেয়া নয়। সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর পরা কালো মেয়েটি আমাকে দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো। চোখে তার অগ্নিদৃষ্টি। হাত ইশারায় সে চলে যেতে বললো আমাকে। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা দেহ শির শির করে উঠলো।

ঘুম ভাঙ্গার পর অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় বসে রইলাম আমি। বাড়ির ভেতর থেকে হাসাহসির শব্দ আসছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শেষ। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম আমি? আশ্চর্য তো! কোন কোন দিন দুপুরে খাওয়ার পরে একটু তন্দ্রা মতো লাগে ঠিকই, কিন্তু সেটা এমন লম্বা ঘুমে রূপ নেয় না। আজ কী হয়েছিল আমার?
ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নটা নিয়ে ভাবছি। দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিল আলেয়া। বললো, ‘বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে মানুষের এমন ঘুম হয় এই প্রথম দেখলাম। বাব্বাহ্, পেটের ওপর দিয়ে গরু মোষ হেঁটে গেলেও ঘুম ভাঙ্গে না।’
আমি হাত ইশারায় ওকে চলে যেতে বললাম। আলেয়া না গিয়ে বরং ঘরে ঢুকে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে তোমার? অমন করছো কেন?’
স্বাভাবিক হতে আমার একটু সময় লাগলো। বারান্দায় হাত মুখ ধোয়ার পানি দিতে বললাম আলেয়াকে। সেই সাথে খাওয়ার জন্য এক গ্লাস পানিও। আলেয়া হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

হাত মুখ ধুয়ে পানি খেয়ে বারান্দায় হাতলওয়ালা একটা পুরাতন কাঠের চেয়ারে আমি বসে আছি। আলেয়া হাতপাখা দিয়ে আমাকে বাতাস করছে। বড় চাচীমা বৈকালিক নাস্তা চিঁড়া, দুধ আর পাকা আম মাদুরের ওপর সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। আমি আলেয়াকে বললাম, ‘মাকে গিয়ে বল আমার পেট ভরা আছে। এখন কিছু খেতে পারবো না।’
‘তোমার কী হয়েছে মেজভাই?’ আলেয়া আগের চেয়ে আরো বেশি উদ্বিগ্ন। ওর দুঃশ্চিন্তা দূর করার জন্য আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘তোর রাঁধা মুড়োঘণ্টই হলো সব নষ্টের গোড়া। মুড়োঘণ্টে লবণ বেশি, ডালের কাঁচা গন্ধ। তবু তোকে খুশি করার জন্য গলা পর্যন্ত বোঝাই করে খেলাম। আর তাতে এমন ঘুম হলো যে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে আমি ভয়ে অস্থির।’
আলেয়ার উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল। বললো, ‘কী ভয়ের স্বপ্ন দেখলে?’
‘দেখলাম এরকম বিশ্রী স্বাদের মুড়োঘণ্ট আমাকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। আমি ‘খাবোনা’ ‘খাবোনা’ বলে চিৎকার করলেও কেউ আমার কথা শুনছে না। জোর করে আমার মুখ ফাঁক করে বাটি ভর্তি মুড়োঘণ্ট গলার ভেতর ঢেলে দেওয়া হচ্ছে।’
স্বপ্নের বর্ণনা শুনে আলেয়ার মুখে হাসি ফুটলো। বললো, ‘তুমি মিথ্যা কথা বলছো।’
আমি আলেয়ার কথায় দুঃখ পাবার ভান করে বললাম, ‘আচ্ছা, তুই কী করে ভাবলি যে আমি মিথ্যে কথা বলছি?’
‘সত্যি? এমন স্বপ্ন সত্যি তুমি দেখেছো, মেজভাই?’ এবার আলেয়ার মুখ ফসকে আসল কথাটা বেরিয়ে এল, ‘মুড়োঘণ্ট আমি রাঁধিনি বাবা। মা রেঁধেছে।’
‘কী বললি?’
আলেয়া থতমত খেয়ে বললো, ‘হাঁ, না, মানে আমারই রাঁধার কথা ছিল, কিন্তু মা আমাকে কিছুতেই রাঁধতে দিল না। জানোই তো, রান্নাঘরে ঢুকলে ধোঁয়া আর আগুনের আঁচে আমি কালো হয়ে যাবো বলে মা আমাকে রাঁধতে দেয় না। আমি কী করবো বলো?’
‘আচ্ছা! এই ব্যাপার?’
আলেয়া ফিস ফিস করে বললো, ‘মেজভাই, বউয়ের হাতে রান্না খেতে পাওনি বলে আফসোস করো না। আর একদিন রান্না করে খাওয়াবো তোমাকে।’
‘সেদিন যদি মা তোকে রান্নাঘরে ঢুকতে না দেয়?’
‘তুমি বললে মা আপত্তি করবে না।’
‘আমি বলবো কেন? আমার ফর্সা বউ কালো হয়ে যাবে না!’
‘তাহলে তোমার কপালে বউয়ের হাতে রান্না খাওয়া নাই।’
‘আচ্ছা বেশ, নাই, নাই। তুই এখন আমার ঘরে আয় তো। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।’

ঘরে ঢুকে খাটের ওপর বসে আমার স্বপ্নের কথা সব খুলে বললাম আলেয়াকে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, এই গাঁয়ে এমন কোন হিন্দু মেয়ের কথা কী তুই জানিস?’
আলেয়া গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললো, ‘না তো মেজভাই। তবে দক্ষিণ পাড়ায় অনেক পুরাতন একটা হিন্দু মন্দির এখনো আছে। সেখানে পুজা অর্চনা কিছু আর এখন হয় না। তা’ ছাড়া এ গাঁয়ে মনি ডাক্তার ছাড়া আর কোন হিন্দু পরিবারও নাই। মনি কাকার তো বউ ছেলে মেয়ে নাই।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এ নিয়ে এত ভাবার কিছু নাই। স্বপ্ন স্বপ্নই।’
আমি বললাম বটে, কিন্তু আলেয়ার উৎকণ্ঠা তাতে দূর হলো না। সে গিয়ে তার মাকে সব বলে দিল। বড় চাচীমা মগরেবের নামাজ শেষে আমাকে সাথে নিয়ে দাদাজানের ঘরে গেলেন। পায়ের আওয়াজ পেয়ে অন্ধ দাদাজান জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’
‘আমি বাপজান।’
‘ও, আলেয়ার মা? কিছু বলবে?’
বড় চাচীমা আমার স্বপ্নের কথা খুলে বললেন দাদাজানকে। তারপর বললেন, ‘ছেলেটা আমার স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। আপনি একটু দোয়া দরূদ পড়ে ফুঁ দিয়ে দেবেন ওকে?’
বিছানায় উঠে আমি দাদাজানের কাছে গিয়ে বসলাম। হাতের তসবিহটা নামিয়ে রেখে দাদাজান হাতড়ে হাতড়ে আমার নাগাল পেয়ে টেনে নিলেন তাঁর বুকের মধ্যে। কিছুক্ষণ আমার বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করলেন। তারপর চোখ বুঁজে অনেকক্ষণ দোয়া দরূদ পড়ে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত তিন বার ফুঁ দিয়ে বললেন, ‘ভয় নাই, ভাই। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বড় চাচীমা সেই রাতে আর আমাকে একা থাকতে দিলেন না। বড় চাচাকে আমার ঘরে শুতে দিয়ে আমাকে তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে নিলেন। আলেয়া বরাবরই তার দাদীমার সাথে শোয়। ওর ছোট ভাই দুটো মায়ের সাথে থাকে। আজ রাতে মায়ের সাথে থাকা ভাইয়ের সংখ্যা হলো তিন। এদিকে আমার নিজের মা এসে বড় চাচীমার ঘরে উঁকি দিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এত বছর পর তোর বুড়ো ছেলেকে আবার কাছে নিয়ে শুচ্ছিস! তোর ভাগ্য রে আলেয়ার মা!’

বড়ভাই সারা বাড়ি ঘুরে শুধু ‘ধুর, ধুর’ করছেন আর স্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়ার জন্য আমার পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। কলেজে পড়া ছেলে স্বপ্ন দেখে ভয় পায় এটা তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। আব্বার কোন মন্তব্য নাই। তিনি ঘরের ভেতর বসে লো-ভলিউমে বিবিসি শুনছেন। বড় চাচা একবার এসে আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘ভয় নাই, বাবা। বাপজান যখন দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিয়েছে তখন আর কোন চিন্তা নাই। তোমরা হয়তো জানো না, তোমাদের দাদাজান বিরাট কামেল মানুষ। তিনি বেঁচে থাকতে তার নাতি নাতনির কেউ ক্ষতি করবে এমন বান্দার জন্ম হয়নি এ গাঁয়ে। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’
আমি বললাম, ‘চাচা, আমার কোন ক্ষতি কেউ করছে না তো! একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি মাত্র। এর বেশি কিছু না। আমি এটা নিয়ে ভাবছি না।’
‘সাবাস বেটা, সাবাস!’ বলে আমার পিঠ থাবড়ে দিয়ে বড় চাচা চলে গেলেন।
আমি আলেয়াকে বললাম, ‘তুই একটা রামছাগল। মানুষ স্বপ্নের মধ্যে কত কী দেখে। সবই কী সত্যি হয়? তোকে স্বপ্নের কথা বললাম, আর তুই বাড়ি সুদ্ধ কী সব রটিয়ে দিলি! এখন সবাই ভাবছে আমি একা একা শুতে ভয় পাচ্ছি। কী কেলেঙ্কারি!’

বড় চাচীমার ঘরে মাঝখানে ফাঁকা রেখে দু’পাশে দুটো খাট। তার একটাতে আলেয়ার ছোট দুই ভাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে আর একটাতে আমি শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি। বড় চাচীমা মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে এশার নামাজ শেষ করে বিরামহীন নফল নামাজ পড়ছেন। আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেলে আমার সহজে ঘুম আসে না। এমনকি এক ঘর ছেড়ে আরেক ঘরে শুতে গেলেও এমন হয়। মধুপুর আসার পর প্রথম প্রথম কয়েক রাত ঘুমের খুব সমস্যা হয়েছিল। আলমডাঙ্গাতেও দু’রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। আজ এ ঘরে শুয়েও একই অবস্থা।
আমাকে এপাশ ওপাশ করতে দেখে বড় চাচীমা জায়নামাজ গুটিয়ে রেখে আমার কাছে এসে বসলেন। হাতপাখা দিয়ে আমাকে বাতাস করতে করতে তিনি আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আমি বড় চাচীমার একটা হাত আমার হাতের মধ্যে নিয়ে নিচু স্বরে বললাম, ‘মা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
‘কী কথা বাবা, বলো।’
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমার যখন জন্ম হয়, তখন তোমার বয়স কত ছিল মা?’
‘কত হবে?’ বড় চাচীমা একটু ভেবে বললেন, ‘এই এখন আলেয়ার যে বয়স এরকমই। দু’এক বছর বেশিও হতে পারে। কিন্তু এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছো, বাবা?’
‘আমার জন্মের পর তিন মাস তুমি ওই অতটুকু বয়সে আমার আর আমার মায়ের জন্যে যে কষ্ট করেছ, সে কষ্টের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নাই। আমার জন্মদাতা মা তোমার এই ঋণ শোধ করার জন্যে তোমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। আগে না জানলেও এখন আমি সবই জানি। আমার মায়ের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমি জান দিয়ে হলেও রক্ষা করবো। আমি এই দুনিয়াতে বেঁচেই তো আছি তোমার জন্যে, মা। তুমি নিজের সন্তান মনে করে সেদিন যদি আমাকে বুকে তুলে না নিতে তো আমি কখনোই বাঁচতাম না।’
‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা, বাবা।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু মা, তোমার চেহারায় আমি সব সময় উৎকণ্ঠার ছাপ দেখতে পাই। তুমি কেন এত চিন্তার মধ্যে থাকো মা, বলো তো?’
বড় চাচীমা আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘ওরে আমার কলিজার টুকরা! আমার কাছে তোমার কোন ঋণ নাই বাবা। যেদিন তুমি আমাকে মা বলে ডেকেছ, সেদিন থেকে তোমার সব ঋণ শোধ হয়ে গেছে।’
বড় চাচীমা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে চললেন, ‘ আমি পল্লী গ্রামের অশিক্ষিত মা। অনেক কিছুই বুঝি না বাবা। এক ফোঁটা বয়সে সরকার বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম। তোমাকে পেটে না ধরেও তোমার মা হয়েছিলাম। তোমাকে কখনো আমার ছেলে ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি, বাবা। আমার আলেয়া লেখাপড়ায় ভালো না। জেদী একরোখা মেয়ে। তোমাকে কখন কী বলে মনে কষ্ট দেয়, তাই সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি।’
আমি বড় চাচীমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে বললাম, ‘আলেয়া আমাকে কখনো কষ্ট দিয়ে কোন কথা বলেনা, মা। বরং আমি কিসে ভালো থাকবো, সে চেষ্টাই সে করে সব সময়। ওকে নিয়ে তুমি ভেবো না তো মা।’

বড় চাচীমা বিড় বিড় করে দোয়া পড়লেন। তারপর ওপর দিকে তাকিয়ে প্রার্থনার মতো করে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ, ইয়া রহমানুর রহিম। আমার এই দুই ছেলে মেয়ের জোড়া তুমি সহি সালামতে রেখো, আল্লাহ।’
বড় চাচীমা নতুনভাবে ওজু করে এসে আবার নফল নামাজে বসলেন। গভীর রাত পর্যন্ত নামাজ পড়ে বড় চাচীমা কখন যে নিঃশব্দে আমার পায়ের নিচে এসে শুয়েছেন আমি টের পাইনি। আমার সামান্য তন্দ্রার মতো হয়েছে। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে হারিকেনের মৃদু আলোয় খাট থেকে বেরিয়ে আসা তাঁর পায়ের ছায়া চোখে পড়তেই আমি বিছানায় উঠে বসলাম। বড় চাচীমাও উঠে বসেছেন। আমি বললাম, ‘তুমি আমার পায়ের নিচে শুয়ে আছো?’
‘হাঁ। কেন, তাতে কী হয়েছে?’
‘কী হয়েছে মানে? তোমার মাথায় যদি আমার পা ঠেকতো!’
বড় চাচীমা হেসে বললেন, ‘মেয়ের মাথা তো বাপের পায়ের নিচেই থাকে, বাবা।’
‘না, না, এসব কথা রাখো। ওই খাটে গিয়ে তোমার ছোট ছেলে দুটোর কাছে শোও। ওরা মা ছাড়া শুয়ে আছে। আমি তো ভেবেছিলাম নামাজ শেষ হলে তুমি ওদের কাছে গিয়ে শোবে।’
‘ওদের কাছে শোবার দরকার নাই। ওরা ওভাবেই একঘুমে রাত পার করে দেবে। সারাদিন ছুটোছুটি করে খেলে তো! গাঁইয়া ভুত। ওদের কানের কাছে এখন ঢোল বাজালেও ঘুম ভাঙবে না।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তাহলে ঐ খাট থেকে তোমার বালিশ এনে আমার পাশে শোও। পায়ের নিচে তোমাকে আমি শুতে দেব না।’

বড় চাচীমা বাধ্য মেয়ের মতো তাই করলেন। আমার তন্দ্রা ছুটে গিয়ে ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। আমি বড় চাচীমাকে বললাম, ‘আমাকে আমার ছোটবেলার গল্প শুনিয়ে ঘুম দাও। তোমার ঘরে আমাকে নিয়ে আসার শাস্তি ভোগ করো। আজ রাতে তোমার ঘুম নাই।’
বড় চাচীমার মুখে স্বর্গের হাসি। আমার মাথায় তাঁর মমতা মাখা হাতের স্পর্শে ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম আমি।
*******************************************************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৪)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:২১
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×