আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১০)
কেহ উঁকি মারে নাই তাহাদের প্রাণে
ভাঙ্গিয়া দেখে নি কেহ, হৃদয়- গোপন-গেহ
আপন মরম তারা আপনি না জানে।
দুপুর আড়াইটার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম আলমডাঙ্গায়। আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল। আলেয়ার বড় মামা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন গ্রামে ঢোকার মুখে একটা মোড়ের মতো জায়গায়। দু’জন লোক নিয়ে আমাদের গরুর গাড়ির সাথে সাথে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত এলেন তিনি। আলেয়া ঘুম থেকে উঠে বোরখা পরে নিয়েছে। বাড়ি পর্যন্ত পথের দু’পাশে নারকেল আর সুপারি গাছের সারি। চারদিক আম কাঁঠালের গাছে ঘেরা ছায়া সুশীতল ছোট খাটো মাটির দোতলা বাড়ি। পাশে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। পুকুরের পানি স্বচ্ছ টলটলে। ছবির মতো সুন্দর পরিবেশ দেখে আপনা আপনি মন ভালো হয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে কোমর ও পিঠের আড়ষ্টতা ছাড়াচ্ছি আমি। আলেয়ার বড়মামার সাথে আসা লোক দু’জন গাড়োয়ানদের সাথে সাথে মালামাল নামাচ্ছে গাড়ি থেকে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে গাড়োয়ানরা গাড়ি নিয়ে ফিরে যাবে মধুপুর। আলেয়ার বড়মামা আমার কাছে এসে বললেন, ‘এত পথ আসতে বাবাজীর খুব কষ্ট হলো, তাই না?’ আমি সালাম দিয়ে হেসে বললাম, ‘না, কষ্ট কিসের?’
আলেয়ার দুই মামা। বড়মামা আলেয়ার নানীকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকেন। ছোটমামা পাশেই পৈতৃক ভিটায় আলাদা বাড়ি করে পৃথক সংসার পেতেছেন। তিন খালার সবার বিয়ে হয়ে চলে গেছেন দূরের গ্রামে। বড়মামার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের গাঁয়ে। আমাদের আসার সংবাদ পেয়ে সে তার দু’বছরের ছেলে কোলে নিয়ে চলে এসেছে দেখতে। গ্রামে এই এক ব্যাপার। আত্মীয়স্বজন কারো আসার সংবাদ পেলে সবাই ছুটে আসে। বড়মামার পরের মেয়েটি ক্লাস নাইনে পড়ে। তারপরের দুটি যমজ ভাইয়ের বয়স মোটে সাত বছর। ছোটমামার এক ছেলে, দুই মেয়ে। সবাই খুব ছোট।
দুই মামার পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও প্রতিবেশি কিছু নারী পুরুষ বাচ্চা কাচ্চাসহ আমাদের দেখতে ভিড় জমিয়েছে বাড়িতে। আমার বাবা মা ভাই বোনরা কেউ আসেনি দেখে সবারই বেশ আক্ষেপ। সব গ্রামেই একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। অপ্রত্যাশিত কেউ, বিশেষ করে শহর থেকে কোন আত্মীয়স্বজন গ্রামে এলে সবারই এক নজর দেখার কৌতূহল থাকে।
বাড়িতে ঢোকার পর কাঁসার গ্লাসে ঠাণ্ডা ডাবের পানি খেতে দেওয়া হলো আমাদের। আলেয়ার বড় মামী ননদ অন্তঃপ্রাণ সরল মানুষ। তিনি বড় চাচীমাকে জড়িয়ে ধরে অহেতুক কান্নাকাটি করছেন। আলেয়ার নানী সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা বারান্দায় মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। দেখেই বোঝা যায় চলৎশক্তিহীন। চোখেও কম দেখেন। বৃদ্ধার বোধশক্তিতে আমাদের আগমন ধরা পড়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আলেয়া আমাকে ইশারা করে ওর নানীর পাশে গিয়ে বসলো। আমিও গেলাম ওর পিছু পিছু। বড় চাচীমা তাঁর ভাবীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে দ্রুত তাঁর মায়ের কাছে এসে বসলেন। বললেন, ‘মা, ওরা তোকে দেখতে এসেছে।’
বৃদ্ধা থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে হাত বাড়ালেন সামনের দিকে। আলেয়া বোরখা খুলে ওর নানীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, ‘এই যে নানী, আমি আলেয়া।’ বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা হাতে আলেয়ার চিবুক ছুঁয়ে সেই হাত নিজের মুখে ঠেকিয়ে চুমো খেতে লাগলেন। বারান্দায় ভিড় করে থাকা নারী পুরুষ সবার দৃষ্টি ছিল এতক্ষণ আমার দিকে। আলেয়া বোরখা খোলার পর তাদের দৃষ্টি সরে গেল আলেয়ার দিকে। স্তম্ভিত হয়ে তারা দেখছে আলেয়াকে। তারা সবাই চেনে ওকে। তবু মনে হলো নতুন এক আলেয়াকে দেখছে তারা। আলেয়ার নাইনে পড়া মামাতো বোন চোখ বড় বড় করে দেখছে ওকে।
এরপর আমার পালা। বৃদ্ধা একইভাবে আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমো খেতে খেতে কাঁদতে লাগলেন। বড় চাচীমা বললেন, ‘কাঁদিস না, মা। দোয়া কর ওদের জন্যে।’
আলেয়ার বড়মামা এসে তাড়া দিলেন হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসার জন্য। অনেক বেলা হয়ে গেছে। তার ওপর এত লম্বা পথের ধকল। ক্ষিধে পেয়েছে সবারই। বাড়ির ভেতর টিউবওয়েল। সেখানে হাত মুখ ধুয়ে সবাই খেতে বসলাম বড়মামার ঘরে। মেঝের ওপর শতরঞ্জি ও দস্তরখান বিছিয়ে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। আলেয়ার দুই মামী খাওয়ার তদারকি করছেন। তাঁরা ‘এটা একটু নাও বাবা, ওটা একটু দিই বাবা’ এই জাতীয় কথাবার্তা বলছেন আর আড়চোখে একবার আমাকে আর একবার আলেয়াকে দেখছেন। বড় চাচীমা বোরখা খুলে বসে আছেন খাটে। তিনি পরে মামীদের সাথে খাবেন। আলেয়া হাত মুখ ধুলেও গয়নাগাঁটি গা থেকে খোলে নি। ওর নাইনে পড়া মামাতো বোন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছে ওকে।
খাওয়া দাওয়া শেষে দোতলার একটা ঘরে আমার বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরে চেয়ার টেবিল আর বাঁশের তৈরি বুক সেলফে মাধ্যমিকের বইপত্র দেখে আমার ধারণা হলো, সম্ভবত এই ঘরে আলেয়ার মামাতো বোনটি থাকে। খাটে শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। এমন সময় মামাতো বোনকে সাথে নিয়ে আলেয়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে ঘরে ঢুকে বললো, ‘মেজভাই, একটা মজার কথা তো তোমাকে বলাই হয়নি। এই যে আমার মামাতো বোনকে দেখছো, এর নাম আর তোমার নাম একই। এর নামও হেনা, তোমার নামও হেনা। কী দারুণ ব্যাপার, তাই না?’
আমি বিছানার ওপর উঠে বসে চোখ কচলে বললাম, ‘তাই নাকি? তাহলে তো তোর মামাতো বোন আমার মিতান হয়ে গেল আর আমি হয়ে গেলাম ওর মিতা। কী মিতান, তাই তো?’
আলেয়ার হাসি খুশি মুখ মুহূর্তের মধ্যে কালো হয়ে গেল। গয়নাগাঁটি খুলে পোশাক বদলে এসেছে সে। আমার কথায় ওর চেহারাটাও যেন বদলে গেল। হেনাকে ইশারায় চেয়ারে বসতে বলে আলেয়া সরাসরি বিছানায় আমার পাশে এসে বসলো। বললো, ‘ও ক্লাস নাইনে পড়ে।’
বললাম, ‘জানি।’
আলেয়া বললো, ‘এখানে আসার আগেই সব জেনে বসে আছো? তাহলে নিশ্চয় এটাও জানো যে হেনা নাইনে পড়লেও আমার মতো ভালো ছাত্রী না। ইংরেজিতে কাঁচা।’
আমি বললাম, ‘তাই নাকি? ও!’
এমনিতে গরমের দিন। তার ওপর ঘরের পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট। আমার কপালে ও গলায় ঘাম দেখা দিল। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা নকশা করা তালপাখা নামিয়ে এনে আমাকে বাতাস করতে শুরু করলো হেনা।
আলেয়া বললো, ‘পাখাটা আমাকে দে। আমি বাতাস করি।’
হেনা বললো, ‘তুইও তো ঘামছিস আলেয়া। আমি তোদের দু’জনকেই বাতাস করি।’
‘না, আমার বাতাস লাগবে না। পাখাটা আমাকে দে।’
হেনার হাত থেকে পাখাটা একরকম কেড়ে নিল আলেয়া। তারপর আমাকে জোরে জোরে বাতাস করা শুরু করলো সে। কিন্তু পাখার বাতাসে আমার ঘাম না শুকিয়ে আরো বেড়ে যেতে লাগলো।
বিকেল বেলা বাড়ির পাশে পুকুর ঘাটে বসে গল্প করছি আমরা তিনজন। রাজশাহী শহরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ হেনার। সে এ বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চাইছে আমার কাছে। আমিও যথাসম্ভব ওর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। ফলে কথাবার্তা মূলত আমাদের দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আলেয়া এসব আলোচনায় খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছে না। আমার আর হেনার কথাবার্তা ওর পছন্দ হচ্ছে না। সম্ভবত কথাবার্তার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজে নেই বলে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। ফোকাসটা নিজের ওপর আনার জন্য এক পর্যায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সে বললো, ‘হেনা জানিস, মেজভাই সাঁতার জানে না।’
‘ওমা! তাই নাকি?’ হেনা হেসে ফেললো। বললো, শহরের ছেলেরা অনেকেই সাঁতার জানে না। সেখানে তো গ্রামের মতো খালবিল পুকুর টুকুর নাই। সাঁতার শিখবে কোত্থেকে?
‘সে তো আমিও জানি।’ আলেয়া বললো, ‘কিন্তু মেজভাই সাঁতার জানে না শুনে তুই হাসলি কেন? এর মধ্যে হাসার কী আছে?’
হেনা গম্ভীর হবার চেষ্টা করেও আবার হেসে ফেললো। আলেয়া বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ধুর ঘোড়ার ডিম! মেজভাই, চলো তো বাড়ির ভেতর যাই। এখানে বসতে ভালো লাগছে না। পুকুরের পানি থেকে বোঁটকা গন্ধ আসছে। চলো, ওঠো।’
আমি বললাম, ‘এই জায়গাটা খোলামেলা। আর কিছুক্ষণ বসে যাই না! বাড়ির ভেতর গিয়ে এখন কী করবি?’
আলেয়া ইতিমধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার হাত ধরে টান দিয়ে সে বললো, ‘না, না, চলো। ওঠো তো! এখানে বসে পুকুরের পচা পানির গন্ধ শোঁকার চেয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়া ভালো।’
হেনার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমি উঠে পড়লাম। বললাম, ‘বেশ চল।’
আলেয়া বিড় বিড় করে বললো, ‘আমাদের পদ্মপুকুরের পানি কত পরিস্কার! এটা কোন পুকুর হলো? এটা তো ডোবারও অধম। পচা পানির গন্ধে ভূত পালায়।’
রাতে ভাত খেতে বসে আলেয়া খুব আনন্দের সাথে বললো, ‘মেজভাই, আমার বড় মামীর হাতের রান্না যে একবার খায় সে জীবনে কোনদিন ভুলতে পারে না। আশে পাশের এক কুড়ি গ্রামের মধ্যে এমন রান্না কেউ রাঁধতে পারে না। এই মুড়োঘণ্টটা খেয়ে দেখ, মনে হবে তুমি ফেরেশতাদের রান্না করা বেহেশতের মুড়োঘণ্ট খাচ্ছো।’
‘তাই নাকি? আমি বললাম, ‘তাহলে একটু দে তো খাই।’
আলেয়া দেওয়ার আগেই বড় মামী মাছের মাথাসহ পুরো এক বাটি মুড়োঘণ্ট আমার পাতে ঢেলে দিলেন। বললেন, ‘খাও বাবা, তোমাদের জন্যেই তো রান্না করা।’
আলেয়া বাড়িয়ে বলেনি। আসলেই খুব চমৎকার। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা সোনামুগ ডাল দিয়ে রান্না করা মুড়োঘণ্টের স্বাদ সত্যি অতুলনীয়। ফেরেশতাদের রান্না করা বেহেশতের মুড়োঘণ্ট বলে কথা। আমি বললাম, ‘হাঁ রে আলেয়া, তুই ঠিকই বলেছিস। খুব স্বাদ।’
আলেয়া বিজয়ের হাসি হেসে বললো, ‘বলেছিলাম না! বড় মামীর হাতের রান্না যে একদিন খাবে, সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। আমার কথা ঠিক হলো?’ বলে সে নিজেও মুড়োঘণ্ট দিয়ে ভাত মেখে অভদ্রের মতো হাপুস হুপুস করে খেতে লাগলো।
বড় মামী বললেন, ‘আজকের মুড়োঘণ্ট কিন্তু আমি রাঁধিনি মা। এই মুড়োঘণ্ট আর কাঁচা আমের টকটা হেনা রেঁধেছে।’
মেয়ের রন্ধনশৈলীর কৃতিত্বে বড় মামীর মুখে তৃপ্তির হাসি। কিন্তু ওদিকে আলেয়ার খাওয়া থেমে গেছে। হারিকেনের আলোয় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হেনার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তার অভিব্যক্তি বোঝা মুশকিল। আলেয়া বিড় বিড় করে কিছু বলে থেমে গেল। বড় মামী বললেন, ‘আলেয়া, তুই কিছু বললি মা?’
‘বলছি মুড়োঘণ্টতে লবন একটু চড়া হয়ে গেছে মামী। তা’ ছাড়া ডালটা বোধহয় ভালো করে ভাজা হয়নি। কাঁচা ডালের গন্ধ আসছে নাকে।’
আগেই বলেছি, আলেয়ার বড় মামী সাদা সরল মানুষ। একটু আলা ভোলা টাইপের। তিনি থতমত খেয়ে বললেন, ‘তাই? তাহলে থাক, খাওয়ার দরকার নাই।’
দুটো আলাদা থালায় নতুন করে ভাত বেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘মুরগির ঝোল আর মাছভাজা দিয়ে খাও বাবা। এগুলো আমার রাঁধা।’
আলেয়া চট করে আমাদের আগের থালা দুটো একপাশে সরিয়ে রেখে মুরগির ঝোল দিয়ে নতুন করে ভাত খাওয়া শুরু করলো এবং খেতে খেতে ‘উফ্ কী দারুন! মেজভাই, খাও খাও’ বলতে লাগলো। আমি কোন রকমে কিছু খেলাম বটে, তবে আলেয়ার মতো ‘কী দারুন’ মনে হলো না। আমার জিভ থেকে খাওয়ার স্বাদ আগেই উবে গেছে।
**************************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১২)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:১৪