রাতে অর্ধেক কাউয়া ক্যাচাল দেইখ্যা হুর বইল্যা— মোবাইল ফোনের পাওয়ার বাটনে একটা চাপ দিয়া, স্ক্রিন লক কইরা, বিছানার কর্নারে মোবাইলটারে ছুইড়া রাখলাম।
ল্যাপটপের লিড তুইল্যা সার্ভারে প্রবেশ। বৃহস্পতিবারের রাইত কাইল্কা শুক্রবার। আইজকার লিষ্টে বিক্রান্ত ম্যাসির সিনেমা সেক্টর থার্টি সিক্স (Sector 36)। সে কি বীভৎস ভয়ঙ্কর ব্যাপার-স্যাপার।
ছোট্ট একটা শহর। শহরে ছড়িয়ে পড়েছে একের পর এক বাচ্চাদের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে নিখোঁজদের পোস্টার। ছোট্ট শহর হওয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ লোকবলের অভাবে প্রায় দায়িত্বহীন কর্তব্যবিমূঢ় পুলিশ। থানায় প্রতিনিয়ত ফাইল হচ্ছে একের পর এক নিখোঁজ মামলা। অনেকের মামলা নিতে প্রত্যাখ্যান জানাচ্ছে থানা ইন চার্জ ইন্সপেক্টর।
এক রাতের কথা। রাবণ দশেরা উদযাপন ঘিরে চলছে যাত্রাপালার আয়োজন। মঞ্চে রামায়ণের সেই বিখ্যাত অংশের নাট্যায়ন। যেখানে রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে লংকায়। দশ মাথার রাবণের চরিত্রে অভিনয় করছে ইন্সপেক্টর। নাটক দেখতে ইন্সপেক্টরের সাথে এসেছে তার স্ত্রী এবং ছোট কন্যা। হঠাৎ ব্যাক স্টেজে বাঁধলো বিপত্তি। পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট গ্রহণ না করা নিখোঁজ এক কিশোরীর পিতার আগমন। কেন তাঁর নিখোঁজ কন্যাকে খুঁজে দিচ্ছেনা ইন্সপেক্টর। এই নিয়ে শুরু হলো তুখোড় বাকবিতণ্ডা। প্রায় হাতাহাতির এক পর্যায়ে নিখোঁজ সেই কন্যার পিতা বলে উঠলো, আপনারও তো একজন মেয়ে আছে। সেও যদি আমার মেয়ের মতো নিখোঁজ হতো। তখনও কি আপনি এভাবে চুপ থাকতে পারতেন।
শেষ হলো যাত্রাপালা। ইন্সপেক্টর মঞ্চ থেকে নেমে তাঁর স্ত্রীর কাছে আসলো। তাঁর মেয়েকে দেখা যাচ্ছে না। ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলো আমার মেয়ে কোথায়। স্ত্রীর সরল উত্তর বাথরুমে গিয়েছে। ইন্সপেক্টরের কপালে পড়লো চিন্তার ভাঁজ। ধমক দিয়ে স্ত্রীকে বললেন, শহরের অবস্থা তুমি জানো না। কেন আমার মেয়েকে একা ছেড়েছ। জলদি যাও। গিয়ে দেখো ও কোথায়। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ইন্সপেক্টরের মেয়েকে। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ ইন্সপেক্টর দেখলো রাবণের মতো তার কন্যাকেও হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। চিৎকার দিয়ে প্রাণপণ দৌড়ে ছুটলো ইন্সপেক্টর তাঁর কন্যার দিকে। তাঁর কন্যাকে মাটিতে ফেলে অপহরণকারী দিলো ভোঁ দৌড়। অনেক চেষ্টা করেও ইন্সপেক্টর ধরতে পারলো না তাঁকে। এই যাত্রায় বেঁচে গেল ইনেসপেক্টরের কন্যা ও অপহরণকারী। চোখের সামনে এমন সব দৃশ্য দেখে আত্মগ্লানি থেকে শুরু হলো ইন্সপেক্টরের সেই অপহরণকারীকে খোঁজার মিশন।
শহরে বাচ্চাদের গুমের পিছনে অপহরণকারী ছিল একজন সাইকোপ্যাথ কিলার। সে একজন নরপিচাশ। মানুষ খাওয়া তার শখ। একের পর এক ২২ থেকে ২৪ জন শিশুর দেহাংশ ভক্ষণ করে যাচ্ছে সে। কসাইখানায় কিংবা কুরবানীর সময় পশু কাটার দৃশ্য নিশ্চয়ই আপনারা দেখেছেন। ঠিক তার থেকেও ভয়ানক ভাবে কেটেকুটে রান্না করে খাওয়া হচ্ছে মানবদেহ। সে কি নির্মম ঘটনাবলীর চরিত্রায়ন। যা দেখে আপনার রুহু পর্যন্ত কেঁপে উঠতে বাধ্য।
সেই সাইকোপ্যাথ কিলারের জীবন এবং তাঁর সাথে জড়িত কিছু পাওয়ারফুল ব্যক্তির সংযোগ। হত্যার ভিতরে হত্যা। এক কাহিনীর ভিতর থেকে আর এক কাহিনীতে পেঁচিয়ে যাচ্ছে সব। কিভাবে এসব রহস্যের ইন্দ্রজাল সমাধান করলো ইন্সপেক্টর। রয়েছে সিনেমার শেষে সবচেয়ে বড় একটা ধাক্কা। যেটা বললে সিনেমাটার পুরো মজাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই যাদের দেখার ইচ্ছা রয়েছে তারা দেখতে পারেন সেক্টর থার্টি সিক্স।
যাইহোক, কোন কাহিনীর মধ্যে থেকে আমি কোন কাহিনীর ভিতর ঢুকে গিয়েছিলাম। দুঃখিত। সিনেমার একটু আলোচনা করতে গিয়ে নিজেই মনে হয় সিনেমার একাংশ লিখে ফেললাম। সিনেমাটা রাতে শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে তাড়াতাড়ি চোখ খুলে যায়। বিছানা ছেড়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে একটু ধাক্কার মত খেলাম। দেখি মুরুব্বী।
মুরুব্বী সারারাত ধইরা ফেসবুক স্ক্রল কইরা আউলা চুলে বইসা আছে।
কাহিনী কী?
ও আচ্ছা। গতকাল রাতের ঘটনা এখনো চলছে। বিষয়বস্তু বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) চট্টগ্রাম শহরে একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ইসলামি সংগীত পরিবেশন করে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা। সেই অনুষ্ঠানে গাওয়া ইসলামীক সংগীতের ভিডিও মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পরে সব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম গুলোতে। শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। সেকি সর্বনাশের কথা..! দুর্গা পূজার মন্ডপে ইসলামী সংগীত। এক দল বলে উঠলো, নিশ্চয়ই এর পিছনে জড়িত রয়েছে জামাত-শিবিরের কর্মীরা। তাদেরকে আবার কাউন্টার করার জন্য দাঁড়িয়ে গেল আরেকটি দল। যারা বলতে শুরু করলো, এইসব নকল ভিডিও। আসল ভিডিওর গাওয়া গান নাকি মিউট করে অন্য গান বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে জড়িত রয়েছে আফসোস লীগ।
ফেসবুকে জুড়ে শুরু হলো একের পর এক পোস্ট এবং পাল্টা পোস্ট। পুরো ফেসবুক তখন এসবের ভিডিও দিয়ে সয়লাব। এক অংশ দাবি করে বসলো, এইসব ভুয়া ভিডিও যারা ছড়াচ্ছে। তাদেরকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হবে। এরা ইসলামের শত্রু। এরা জাতির শত্রু। ইসলামের নামে অপপ্রচার করাই এদের কাজ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফেসবুকে কিছুক্ষণ স্ক্রল করার সময় আমার চোখে এতটুকুই পড়েছিল। হয়তো আরো অনেক রখমের কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছিল কিন্তু আমি এসব বিষয়ে অনিচ্ছুক থাকায় বিষয়টা এড়িয়ে যাই। তবে ব্যাপারটাতে মুরুব্বী বেশ ইন্টারেস্টেড ছিল। তুমুল তুখোড় জোরালো প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুরুব্বী। বিশ্বস্ত লোক মারফত মুরুব্বী শুনেছিল ভিডিওগুলো সব ভুয়া। অপপ্রচার করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে মুরুব্বী তখন যাদের পোস্ট চোখের সামনে পাচ্ছিল তাদেরকেই ধুয়ে দিচ্ছিল। একের পর এক লম্বা লম্বা নসিহত দিয়ে যাচ্ছিল। আমি অবশ্য মাঝ রাতের দিকে আমার বিশ্বস্ত সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারি ভিডিওটি আসলেই সত্য ছিল। আসলেই পূজামণ্ডপে ইসলামী সংগীত গাওয়া হয়েছিল। একটা রিপোর্ট অনুযায়ী, "চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছয় সদস্য পূজামণ্ডপের অনুষ্ঠানে দুটি গান পরিবেশন করেন। তার মধ্যে একটি গান ছিল 'শুধু মুসলমানের লাগি আসেনিকো ইসলাম'। সংগঠনটি জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।" যা জামায়াতে ইসলামী অস্বীকার করেছে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম রাতেই পূজামণ্ডপে গিয়ে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আশ্বাসও দিয়েছেন।
মূল কথা হলো কেউ বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক। একটা ভুল করে বসেছে। এখন সেই ভুলকে ডিফেন্ড করার জন্য আরও অনেক ভুলের জন্ম দেওয়া কোন ভাবেই কাম্য নয়। তারা ভুল করেছে এবং হয়তো তারা তাদের ভুল ইতিমধ্যে বুঝতেও পেরেছে। ভুল শুধরানোর দায়িত্ব কিন্তু অনেকটা আমাদেরও। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ির করে রাজনীতি করার মতো কিছু নেই। ভবিষ্যতে এইসব বিষয়ে আমাদের আরোও অনেক বেশি কেয়ারফুল হতে হবে। হাজার হলেও ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার।
মুরুব্বীরে কাইল্কা বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম। সত্যি কিংবা মিথ্যা যাইহোক। কোন কিছু দেখার সাথে সাথেই ঝাঁপাইয়া পইড়া সবার আগে পোস্ট, শেয়ার কিংবা আবেগী স্টেটমেন্ট দিয়েন না। কিন্তু মুরুব্বী উল্টা আমারেই বুঝ দিয়া থুইয়া দিলো। কি আর করার। ভালো কথা যখন হুনলো না, ভাবলাম তাইলে মুরুব্বীর উপ্রে একটু তাপাই। রাইতে মুরুব্বীর সিরিয়াস টাইপ একটা পোস্টে মুরুব্বীরে খোঁচা মাইরা কইছিলাম, "এআই এর যুগ মুরুব্বী। এআই এর যুগ। সব ফেইক। খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা। সে জন সোনা চেনে না। মুরুব্বী আপনি সোনা চেনেন তো?"
বুঝলাম না। শুনেছিলাম উচিত কথা কইলে নাকি হাজী সাহেবের মুখ খারাপ। আইজক্যা নিজ চোক্ষ্যে দেখলাম। মুরুব্বী আমারে রিপ্লাই দিয়া বসলো, "বাইঞ্চোদ"।
সারা রাত যাদের ভুল তথ্য এবং উস্কানিতে পড়ে মুরুব্বী বাংলাদেশের ইসলাম এবং মুসলিম উম্মার ডিফেন্ডে নেমে পড়েছিল। কাহিনীর সত্যতা জানার পর থেকে মুরুব্বী এখন, ইগো প্রবলেমে পুরা ফ্রাস্টেটেড।
আমি পানির বোতলে চুমুক দিতে দিতে মুরুব্বীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, মুরুব্বী এই দেখেন আপনারে একটা জিনিস দেখাই... বইল্যা মুরুব্বীর সামনে মোশাররফ করিমের একটা মিম ছাইড়া দিলাম। মিমের মধ্যে মোশাররফ করিম গান গাচ্ছিল, তুই পাগল তোর বাপে পাগল। পাগল করিস না...
এইডা দেইখ্যাই মুরুব্বী আমারে, মাদা... তোর মোবাইল ভাইব্রেশনে দিয়া তোর বিপের ভিত্রে হান্দায় দিব।
বিপ.. বিপ.. বিপ..
বুঝলাম না। একটা ফানি জিনিস দেখাইলাম। এইবার সত্যি কিন্তু আমি মুরুব্বীরে খোঁচাই নাই। কছম..! জিনিসটা আমার কাছে ফানি লাগছে বইল্যাই মুরুব্বীরে দেখাইছিলাম। তাইলে... এক রাইতের মাঝেই কি মুরুব্বী আসলেই পাগল হইয়া গেল..?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭