সে দিন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একজন লিখেছে যে, প্রথম চৌধুরী নাকি চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষাকে কটাক্ষ করে বলেছেন বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে গিয়ে। এমনিতে ফেইসবুকে কিংবা ব্লগে আসা হয়ে উঠেনা, কাল লগইন করে নিউজফিডে চোখ বোলাতেই দেখি ফ্রেন্ডলিস্টে সিলেটের একজন বন্ধু আমাদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে কটাক্ষ করে স্টাটাস দিয়েছেন নিম্মরুপ-
কুইজ কুইজ কুইজ
প্রশ্নঃ চিটাগাং র মানুষ কোন ভাষায় কথা বলে?
ক) চায়না
খ) জাপানী
গ) তামিল
ঘ) পাপুয়ানিউগিনি
বাংলা ভাষা কে জীবন্ত দাফন করছে এই চিটাগাং র চিটিংবাজ মানুষেরা।।।
আমি চট্টগ্রামের হওয়াতে, সেটা আমার স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ লেগেছে, এবং ইন্টারনেটে দুই দিন ধরে খুঁজে এবং বন্ধুর স্টাটাস থেকে সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের ভাষার মূল স্থান যখন তাকে দেখিয়ে কমেন্ট করেছি তখন কাপরুষটা তা ডিলিট করে দেয়। তাই তার মতই যারা চট্টগ্রামের ভাষাকে ছোট করে দেখেন তাদের জন্যই অনেক্ষণ সময় নিয়ে নিজে কিছু লিখলাম মোবাইলে এবং কিছু সংগ্রহ করেছি ওয়েবসাইট থেকে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা কথাটি শুনতেই অনেকের আবার কেমন জানি লাগে, অনেকে অসভ্যের মত বিভিন্ন মন্তব্যও ছুঁড়ে থাকেন গোপনে। ভাবটা এমন এটা গেঁয়ো-অশিক্ষিতদের ভাষা। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে পৃথিবীর ৬ হাজারেরও অধিক আঞ্চলিক ভাষা আছে, তার মধ্যে আবার আমাদের চট্টগ্রামের ভাষার স্থান ৬৫ তম (Wikianswer এর মতে) !! আর পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে চট্টগ্রামের ভাষার স্থান ১ম ( একেবারে 1st ) !! ২০০৯ সালের সারণি অনুযায়ী পৃথিবীর ১৭ মিলিয়ন লোক এই ভাষাভাষী, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ০.২৪% চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে । কোন কোন ভাষাবিদ একে পালি ভাষার সঙ্কর বলতে চান। চট্টগ্রামের ভাষায় প্রচুর পর্তুগিজ, স্পানিশ, অ্যারাবিয়ান ও ফরাসি ভাষার শব্দ আছে কারণ তৎকালীন বণিকেরা সওদাপাতির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরেই প্রথম আসত। নাসিক্য উচ্চারণের প্রাধান্যের জন্য এসব বিদেশি শব্দ ও অধিকাংশ দেশি শব্দ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে আঞ্চলিক ভাষা গুলোর মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রামের ভাষাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সংবলিত মৌলিক ভাষা, যা বাংলা ভাষা সহ অন্য কোন আঞ্চলিক ভাষার সাথে মিলে না। সুবিখ্যাত গ্রিক ভাষার ক্রমিক স্থান চট্টগ্রামের ভাষার আরও ১১ টির পরে (এহেম এহেম) !!।
চট্টগ্রামের অঞ্চলিক বাংলা বহু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় যা মূল বাংলায়ও বিরল। এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে সাধারণত ৪ ভাগে ভাগ করা যায়।
১. উচ্চারণ বৈশিষ্ট
২. শব্দার্থ বৈচিত্র
৩.শব্দায়ব সংক্ষেপ পদ্ধতি
৪.শব্দ যোজন রীতি
চাঁটগাঁ ভাষা হল ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠির একটি সদস্য ভাষা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। বাংলা-অসমীয়া ভাষার সাথে চাঁটগাঁমী ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও একে প্রায়ই বাংলা প্রমিত ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয় যদিও ভাষাদ্বয় পারস্পরিক একই অর্থে বোধগম্য হয় না।[২] তারপরও প্রধানত বাংলাদেশে ১.৩ কোটি মানুষ চাঁটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে।
চাঁটগাঁইয়া ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্যের উপশাখা বাংলা-অসমীয়ের সদস্য। সমগোত্রীয় অন্যান্য ভাষাসমূহ হল সিলেটী, রোহিঙ্গা, বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া এবং বিহারি ভাষা তাছাড়া ইন্দো-আর্যের হিন্দির সাথে চাঁটগাঁমাী ভাষার পরোক্ষ মিল রয়েছে। অন্যান্য বাংলা-অসমীয়া ভাষাসমূহের মত চাঁটগাঁইয়া পালি ভাষা থেকে এসেছে যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের একটি কল্পিত পূর্বসূরী প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা এর উত্তরসূরী।.
চাঁটগাঁমী ভাষায় ব্যাকরণের ব্যবহার বাংলা ভাষার অনুরুপ তবে উপস্বর্গ, অনুস্রর্গ এবং অন্যান্য উপায়ে শব্দের কলেবর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য রয়েছে।
বাংলা ভাষার চট্টগ্রাম ও সিলেটি উপভাষা মান্য চলিত বাংলা থেকে যথেষ্ট আলাদা এবং এগুলিকে আলাদা ভাষা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সুতরাং আমরা চাঁটগাঁ এর মানুষরা বাংলা ভাষাকে বিকৃত করছি না বরং এটি বাংলার ভাষার মতই ইন্দো আর্যীয় ভাষা তবে একে বাংলার প্রমিত ভাষা হিসেবেও জানা যায় এবং আমরা বাংলাভাষা থেকে ভিন্ন ও নিজস্ব মৌলিক ভাষাকেই বাংলার পাশাপাশি লালন করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৬