somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি কলেজ জীবন যেরকম আশা করেছিলাম, সেটা ঠিক সে রকম হল না ! [এসো একটা ক্লাব খুলি! অধ্যায়-১]

২১ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব


সেই ঘন্টাখানেক ধরে চিৎকার চেচামেচি হচ্ছে। এতক্ষন আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে ছিলাম। যখন হেডফোন ভেদ করে চিৎকার চেচামেচি কানের ভিতর ঢুকল তখন আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলাম না। না থাকার কারন আছে, কালকে সারা রাত আমি ঠিক মত ঘুমাতে পারি নাই, আর সকালের দিকে কেন যেন আমার এমনিতেই ঘুম আসে না। ছুটে বারান্দায় গেলাম। ওইখানেই আমাকে থামতে হল। আপি ইট হাতে নিয়ে ভয়ংকর রুপে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে, “নিচে নাম ইবলিশ, ফাইজলামি শুরু করছে।”

আর নিচ থেকে লায়লা আপু হকি স্টিক ঘুরাতে ঘুরাতে বলছে, “নিচে নাম শয়তান আজকে তোর হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙ্গে পাউডার না বানিয়েছি তাহলে আমার নাম লায়লা না।”

আশেপাশে মোটামুটি ভিড় জমে গেছে, এমন তামাশা সচারচর দেখা যায় না। আজকে আমাদের কলেজ বন্ধ, আর আপিও আজকে ছুটি নিয়েছে আর গত রাতেই লায়লা আপু এসেছিল। তারা গত রাত জেগেছিল তাই মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। আমি আপির কাছ থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে সে হতভাগার দিকের তাকালাম। দাড়িওয়ালায় লোক বয়স তিরিশের কাছাকাছি হবে, তার দুই চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। আর সেই আতঙ্কে তার কালো মুখ নীল হয়ে গেছে। সে কির করবে দিশে খুজে পাচ্ছে না। সে একটাই সমাধান পেয়েছে যেটা খাম্বা ধরে ঝুলে থাকা।

“সারারাত ক্যা ক্যা করে জ্বালিয়েছিস আজকে যদি তার চামড়া না ছিলেছি তাহলে আমি আমার নাম পরিবর্তন করে ছাড়ব,” আপি হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল।

“ছাইড়্যা দেন আমারে আপারা, মাফ করেন আমারে,” লোকটা ক্যা ক্যা করে উঠল। চোখে পানিতে ভরে গেল। যদিও সেটা সে মুছতে পারছে না, মুছতে গেলেই মাটিতে পতন, ওইখানে পড়ে হাড্ডি না ভাঙলেও নিচে যে আছে সে তার হকি স্টিক দিয়ে সেই কাজটা সম্পাদন করবে।

“নিচে নাম বেয়াদব,” লায়লা আপুর এই হুংকার শুনে দাড়িওয়ালা ককিয়ে বলে উঠল, “আল্লাহ, তুমি কি এইসব অন্যায় দেহ না, আমারে বাচাও,” তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “এইসব জুলুম আল্লায় সহ্য করত না… সহ্য করত না।”

“আয় নিচে নাম তোরে আল্লাহ দেখায় দেই,” নিচ থেকে লায়লা আপু গর্জন করে উঠল, “আল্লাহর নাম নিয়ে সব ফরজ বানানোর মতলব,” এই বলে হকি ষ্টিক দিয়ে খাম্বাতে বাড়ি দিল।

ঠাং করে শব্দ হল, এই শব্দ শুনে লোকটা আরে ভেবড়ে গেল খাম্বাটা সে আরো জোরে ঝাপটে ধরল। যেন এটাই তার জীবনের সব।

“নিচে নাম নাইলে এই ইট দিয়ে তোর মাথা ফাটাব,” আপি আবারো হুংকার দিয়ে বলল।

“না, নামুম না, নামলে মাইর দিবেন,” ককিয়ে বলল লোকটা।

আমি আশে পাশে সবার দিকে তাকিয়ে বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিচের দিকের কিছু লোকের চোখে প্রশ্ন থাকলেও আশেপাশে যেসব প্রতিবেশী আছে তারা রাগ নিয়ে ওই দাড়িওয়ালা লোকের দিকে তাকিয়ে আছে।

কারন আছে, গতকাল বিকেলে আমাদের বারান্দা থেকে মাত্র কয়েকহাত দূরে একটা ল্যাম্পপোষ্টে একটা মাইক লাগিয়ে দিয়ে যায়। যদিও আমাদের এখানকার অনেকেই সেটা খেয়াল করেনি। খেয়াল হয় রাতে দিকে, আপি আর লায়লা আপু যখন টিভি দেখতে বসেছিল, আর আমি ছিলাম তখন রান্না ঘরে। মাইকটা প্রথমে ক্যা করে একটা শব্দ করে তারপর শুরু করে বয়ান। শুরু হয় তাদের ওয়াজ মাহফিল। শুরু করে তার আল্লাহ-রাসুলের নাম করে তারপর শুরু করে তাদের পীরের বয়ান, যার কোনো শেষ নেই!

তারা দুইজন ঘন্টাখানেক ধরে সেটা সহ্য করলেও পরে আর সহ্য করতে পারেনি, তারা বারান্দায় গিয়ে দেখে আমাদের ফ্ল্যাট বরাবর মাইকটা, বন্দুকের মত তাক করা। তারা দুইজনেই থম মেরে গিয়েছিল। তারপর তারা বিভিন্ন জিনিষ ঢিল মার মাইকটাক তাক করে, শেষ কালে আপি একটা ইট ঢিলে মেরে সেটার বারোটা বাজিয়ে দেয়। ইট সে কই পেল জানিনা তাদের পক্ষে অসম্ভব বলতে কিছু নাই ।কিন্তু পীরের লোকেরা তো একটা মাইক লাগিয়ে ক্ষান্ত দেয়নি তারা আরো কয়েকটা লাগিয়ে রেখেছে।

নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আরেকটা দাড়িওয়ালা মুখ, অবশ্য সেটা বাড়ীওয়ালার, উনি বলে উঠল, “আম্মাজানেরা, দয়া কইরা ছাইরা দেন, এইডাতো চ্যালা-চামুন্ডা আসলগুলারে ধরেন।”

আমাদের বাড়ীওয়ালা পরহেজগার মানুষ, উনি প্রতিদিন পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন আর আশেপাশের সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলে খোজখবর নেন। আর উনি ছেলেদের আব্বাজান আর মেয়েদের আম্মাজন বলে ডাকেন।

“খালুজান, শুধু একটা বাড়ি মারতে দেন তারপর কিছু বলব না, সারারাতের না ঘুমানোর জ্বালাতো মেটাতে হবে,” লায়লা আপু বলে উঠল।

“আম্মাজানে কি মারাত্মক কথা বলে, মারামারি-হানাহানি খারাপ জিনিষ। এইসব মাইয়া মানুষের করতে নাই।”

“আপনি ছেড়ে দিতে বলেছেন দেখে ছেড়ে দিব, তবে একটা বাড়ি না না দিয়ে যেতে দিব না আমি, ” আপি বলে উঠল।

বাড়ীওয়ালা দেখলাম কি যেন ভাবলেন, তারপর বলে উঠলেন, “ঠিক আছে আম্মাজানেরা একটা বাড়ি দিয়েন, কালকে অবশ্য এই বয়ানের কারনে আমার তাহাজ্জুদের নামাজ বাদ গেছে।”

এটা শোনার পর দুইজন একটু ঠান্ডা হল। আপি দেখলাম হাতের ইট নিচে নামিয়ে রাখল। নিচে লায়লা আপুও তার হকি স্টিক নিচে নামিয়ে রাখল।যাক একটা সমাধান হল। যদি কেউ না বাধা দিত তাহলে এটা মনে হয় সারাদিন চলত। যাক বাড়ীওয়ালা চাচার কথায় সব কিছু ঠান্ডা হল। বড়সড় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

আপি আমাকে দেখে বলে উঠল, “কিরে হাতের অবস্থা কেমন?”

“ভাল।”

“ঠিক আছে বিশ্রাম নে, আর আমি একটু নিচ থেকে আসছি,” এই বলে সে চলে গেল।

বেচারা একটা কি আর কয়েকটা কি, ওই দুইটার মাইর অনেক ভংয়কর জিনিষ। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি!

*

কম্পিউটারে বসে বসে মুভি দেখছিলাম এই সমইয় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আপা ফোন করেছে মনে করে কলটা না ধরারই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কি মনে করে যেন মোবাইলটা হাতে নিলাম, মোবাইলের স্ক্রিনে সজলের নাম ফুটে উঠছে, রিসিভ বাটন টিপ দিতেই, “কিরে ফোন ধরস না ক্যান?”

“ধরলাম তো!”

“… তোর বাসার ঠিকানা আবার বলতো।”

“কেন?”

“আরে আমি তোর এলাকায় এসেছি, ঠিকানা বল, ভুলে গেছি।”

“তুই জানলি কিভাবে আমি এই এলাকায় থাকি?”

“নির্জন বলছে, আরে বাপ এত প্যাকর প্যাকর না করে ঠিকানা বল, মোবাইলের টাকা চলে যাচ্ছে।”

কি আর করা বাসার ঠিকানা দিলাম। আপি আর লায়লা আপু সকালে বিশাল এক নাটক করার পর কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। আপি আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, “দুপুরে রান্না-বান্না করার দরকার নাই, বাইরে থেকে কিছু এনে খাবি।”

দুজনেই চলে যেতেই নিজের রুমে গিয়ে দিলাম এক এক ঘুম, ঘুম থেকে উঠে দেখি তিনটে বেজে গেছে। বাইরে যাবার ইচ্ছে ছিল না তাই ফ্রীজে চেক করে দেখলাম পাউরুটি আছে সাথে ডিম। ওইগুলা দিয়েই আমি দুপুরের খাবার সারলাম।

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে আমি দরজার দিকে গেলাম, সজলে মনে হয় এসেছে, দরজা খুলতেই দেখলাম সজল হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার পিছনে দাড়িয়ে আছে নুশরাত আর রুপা। ওরাও দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, রুপা বলে উঠল, “হাউ কিউট রানা, চশমা পড়াতে তোমাকে খুব কিউট দেখাচ্ছে।”

“ফাজলামি করছ নাকি?”

“সিরিয়াস!”

“ভিতরে ঢুকো,” এই বলে আমি সজলের দিকে তাকালাম, “কিরে তুই না একা এসেছিস?”

“সরি দোস্ত একা আসারই ইচ্ছা ছিল কিন্তু নুশরাত আর রুপা আমাকে যেভাবে ধরল যে না করতে পারলাম না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে, তা আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবি?”

“কি?”

“বাইরে থেকে কেক আর চা পাতা আর একটা এক লিটারের সেভেন আপ নিয়ে আসবি, টাকা দিচ্ছি।”

সজল আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমার মত খারাপ বন্ধু সে জীবনে দেখে নাই। আমি অবশ্য তাকে টাকা ধরিয়ে দিলাম, “যা বাকী থাকবে তার তোর টিপস।”

আমি অবশ্য নিশ্চিত যে টাকা বাচবে খুব কম পরিমানে।

“বান্দর!” এই বলে সজল বাইরে চলে গেল।

ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই রুপা বলে উঠল, “চশমা চোখে তোমাকে কিউট লাগে।”

“তো, এখন কি করব?” বলে উঠলাম।

দুজনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল, নুশরাত জিজ্ঞেশ করল, “তোমার সাথে কে থাকে?”

“আপির সাথে থাকি, সে বাইরে গেছে।”

“আপি, মানে তোমার ছোট বোন?”

“হ্যা।”

“তা হাতের কি অবস্থা?”

“আছে ভালই, হালকা ব্যাথা ছাড়া আর কিছু নাই।”

“আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম,” রুপার বলে উঠল, “ভাগ্যিস টেবিলের উপরে পড়েছিল নাইলে আরো বড় কিছু হয়ে যেতে পারত।”

কথা সত্যি, যদি সেই বীকার টেবিলে না পড়লে সরাসরি সেটা আমার পিঠে উপর পড়লে খরব ছিল… থাক সে কথা।

“তা আমাকে দেখতে এসেছ নাকি?” জিজ্ঞেশ করলাম।

“হুম, গত পরশু এর কথা আর কালকে কলেজে আসো নাই, তাই তো দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।”

নুশরাতে কথা শুনে মনটা উড়ুউড়ু করে উঠল, মেয়েটা আমার জন্য চিন্তা করছে ভাবতেই পুলকিত হয়ে উঠলাম।

“যদিও আমি এত দুশ্চিন্তা করি নাই।”

হাহ~ বলে কি মেয়েটা! আমার জন্য এতটা টেনশন হয় নাই।

“সুমনা মেয়েটা এত টেনশন করছে তাই আসলাম, সুমনাও আসবে একটু পরে,” রুপা বলে উঠল।

“ও, আচ্ছা সজল আসুক ওকে চা নাস্তা আনতে পাঠিয়েছি।”

“তাই নাকি?”

“মেহমানদারিত্ব করতে হবে না! আমার বাসায় এসেছ।”

“আচ্ছা পুরো বাসা ঘুরে দেখি ?” রুপা জিজ্ঞেশ করল।

“কর সমস্যা নাই, তবে আপির রুমে না ঢুকলেই খুশি হব, সে পছন্দ করবে না যে কেউ তার রুমে ঢুকুক।” সাবধান করে দিলাম।

“আপি কে মনে হয় অনেক ভয় পাও?” নুশরাত ভ্রু কুচকিয়ে জিজ্ঞেশ করল।

“সামনা সামনি দেখা হোক তখন দেখ কেমন ধরনের মানুষ সে,” এই বলে আমি রান্না ঘরে গেলাম। চায়ের পানি বসাতে।

ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখলাম দুজনই বারান্দার দিকে গেল, আমিও তাদের পিছু পিছু গেলাম। আমাকে দেখে নুশরাত বলে উঠল, “তোমাদের বাসা দেখছি অনেক ছিমছাম ভাবে গোছানো।”

“দেখতে হবে না কে করে এইসব,” আমি গর্বের সাথে বলে উঠলাম।

“হুম, তাহলে তো তুমি আদর্শ ঘরজামাই হতে পারবে,” ফোড়ন কেটে বলে উঠল রুপা। কড়া করে কিছু বলতে চাইছিলাম তখনই আবার কলিং বেল বেজে উঠল। আমি দরজা খুলতে গেলাম, দরজা খুলতেই আমি থ খেয়ে গেলাম। কাধ পর্যন্ত চুল নিয়ে একটা পুতুলের মত চেহারার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম প্রথম চিনতে ভুল করলেও সেই ধারালো মার্কা চেহারা চিনতে আমার সময় লাগল না। সে সুমনা। চুল কাটাতে তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। গোলগোল চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখ মনে হচ্ছে একটা বিড়াল আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার কপালে চুল হাত দিয়ে সরিয়ে কিছু মনে হয় বলতে যাবে তখম আমি, “একটা মিউ করে ডাক দিবে?” বিড়বিড় করে বলে উঠলাম

“কিছু বলেছ নাকি?”

থ ভাবটা কেটে উঠলাম, “তুমি? দেখা করতে এসেছ নাকি?”

“হ্যা নুশরাত আর রুপা এসেছে নাকি?”

“তারা ভিতরে বসে আছে,” এই বলে আমার খেয়াল হল আমি দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছি।

কিভাবে সম্ভব! এইটা কি সেই মেয়ে যে কিনা দুই বেনী করে থাকে আর হ্যারি পটার টাইপের চশমা পড়ে থাকে। যাকে দেখলে পুরানকালের দাদী-নানীদের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু এখন যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যারপুতুলের মত চেহারা এবং তার মধ্যে একটা বিড়াল বিড়াল ছায়া আছে। সত্যি কথা আমি চাইছিলাম সে একটা ‘মিউ’ করে ডেকে উঠুক, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম আর এক বাটি দুধ দিতাম!

“ওই সামনে থেকে সর অনেক দাড়োয়ানগিরি করেছিস।”

সজলের কথা আমার চমক ভাঙল। দেখলাম হাতে খাবারে প্যাকেট। আমি সরে তাকে ভিতরে ঢুকতে দিলাম। ভাবলাম সুমনার কথা আপাতত মাথা থেকে সরাতে হবে। কিন্তু সেই গোলগোল চোখ আর ‘মিউ’ ডাক!

ধ্যাপ~ এই বলে আমি আমার মাথায় হালকা করে চাটি মারলাম।

চা-নাস্তা সব কিছু গুছিয়ে আমি সেগুলো ড্রয়িং রুমে গেলাম। সবাই দেখলাম গোল হয়ে বসে আছে শুধু সুমনা আমাদের বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি টি-টেবিল তাদের কাছে নিয়ে যেতেই, সজল, “আরে আমাদের রানা দেখছি অতিথি আপ্যায়নে কম যায় না।”

“সে আদর্শ ঘর জামাই হবার যোগ্যতা রাখে সে,” রুপা মাঝখান দিয়ে বলে উঠল।

“ওই ফাইজলামির একটা সীমা আছে।”

“আমি শিউর সে রান্না করতে পারে, একশ টাকা বাজী,” রুপা সবার দিকে তাকাল, কেউ তার ডাকে তেমন সাড়া দিল না।

“আমি জানি সে রান্না করতে পারে, মানে ধারনা করেছি আরকি,” নুশরাত বলল, “আর রান্না করতে পারা এক ধরনের গুন, তা রুপা তুমি কি রান্না করতে পার?”

রুপার চেহারা দেখে মনে হলে সে রান্না করতে পারে না। এবার আমার পালা, “রুপারে তাড়াতাড়ি রান্না শিখে ফেল, নাইলে শ্বাশুড়ী আর জামাইতো প্যাদানি দিবে।”

এটা শুনে নুশরাত আর সজল হেসে উঠল।

রুপা মুখ বেকিয়ে বলল, “হাউ ফানি!”

আমি সুমনার খোজে তাকালাম দেখলাম সে আমার বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার কাছে গেলাম, “বই পড়ার অভ্যাস আছে?”, জিজ্ঞেশ করলাম।

“মাঝে মধ্যে পড়ি।”

“কি ধরনের বই?”

“গোয়েন্দা টাইপ আমার পছন্দ, তিন গোয়ান্দা, মাসুদ রানা…”

“ও আচ্ছা তাই নাকি?”

“হুম তা তোমার হাতের অবস্থা কি রকম?” সে জিজ্ঞেশ করল।

আমি বইটা খুজতে খুজতে, “হালকা ব্যাথা ছাড়া তেমন কিছুই না।”, আরে বইটা রাখলাম কোথায়, বইয়ের তাকে এত গুলো বই। তাকে একটা বই দিই, ভবিষ্যতে আমারই লাভ হবে।

“আমি খুবই চিন্তায় ছিলাম, বড় কিছু হতে পারত,” সে অই রসায়ন ল্যাবের ব্যাপারের কথাটা তুলতে লাগল। যদিও আমি চাচ্ছিলাম না সেটা নিয়ে কথা হোক।

“পারত… তবে হয় নাই ভাল হয়েছে। তোমার চুলে মনে হয় কিছুটা লেগেছে।”

“হু, এই কারনে কেটে ফেলতে হয়েছে,”গলা শুনে মনে হল চুল কেটে ফেলাতে তার দুঃখ লাগছে।

“তোমাকে এইভাবেই ভাল মানায়,” এটা বলার পর আমি বইটা পেলাম।

“হুম তোমাকে এইভাবেই অনেক মানায়।”

“তাই নাকি?” আমার দিকে বোকার মত তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করল।

“হ্যা,” এই বলে আমি আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্রটা বইটা তার হাতে দিয়ে “এইটা নিয়ে যাও, অনেক ভাল মানের থ্রিলার লেখিকা।”

বইটা হাতে নেয়ার পর তার চোখ চকচক করে উঠল, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে। সে আমার দিকে তাকাল, একটা হাসি দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ তোমাকে।”

সুমনার উচ্ছ্বল স্বর আমি এই প্রথম শুনলাম, মেয়েটাকে হাসিমুখে অনেক মানায় তবে কেন যেন সে গোমড়া হয়ে থাকে সেটা বুঝতে পারলাম না। দেখি নির্জনকে জিজ্ঞেশ করব। হঠাৎ মনে হল আমাদের দিকে কেউ তাকিয়ে আছে, পিছনে তাকাতেই দেখলাম তিনজনেই তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। আমি সুমনার দিকে তাকালাম, সে এখনো আগাথা ক্রিস্টির বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক একটা বাচ্চা ছেলে নুতুন খেলনার দিকে যেভাবে তাকায়।

সে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করল, “কোন সমস্যা হবে না তো, মানে তোমার বাসার কেউ…”

“আরে বাদ দাও, এটা আমি কিনেছি, আপি কোনো সমস্যা করবে না।”

“আপি?”

“আমার ছোট বোন, আমরা দুজন একসাথে থাকি,” আমি বললাম, “আমার আব্বা-আম্মা খুলনায় থাকে।”

“ও আচ্ছা, আমি সরি ওই দিনের ঘটনার জন্য আমার কারনে দুর্ঘটনাটা ঘটল,” সে মাথা নিচু করে বলল।

আমি সুমনা দিকে তাকিয়ে থাকলাম, ওর মধ্যে অপরাধবোধটা অনেক কাজ করে, সেটাকে কাটানো দরকার আমার। আমি হালকা গলায় বললাম, “আরে বাদ দাও ওসব কথা, তোমার যদি দোষ থাকে তাহলে আমারো দোষ ছিল, আমার উচিত ছিল তুমি যেখানে বীকার রেখছ সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা, আর তুমি তো জানতে না সেটাতে আসল এসিড ছিল, বাদ দাও এইসব, এত দুশ্চিন্তা করার দরকার নাই আমরা সবাই ভাল আছি সেটাই এখন দেখা উচিত।”

আমার কথা শোনার পর সুমনা আমার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকল। মেয়ে এভাবে তাকায় না, আমি আবার বিড়ালে উপর খুবই দুর্বল। আচ্ছা সে কি এখন ‘মিউ’ করে ডেকে উঠবে?!

“ওই দুইজন, চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,” সজল বলে উঠল।

তিনজনে দেখলাম আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। আমরা দুজন ওদের কাছে গেলাম, তারপর ডুবে গেলাম আড্ডাতে।

*

বিশাল এক হাই তুলে ক্লাসে ঢুকলাম। ব্যাগটা ডেস্কের ভিতর ঢুকাতে টের পেলাম অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাত্তা দিলাম না। বেঞ্চে বসে আরেকটা বিশাল হাই তুললাম। গতকাল রাত জেগে মুভি দেখেছি চোখে এখনো ঘুম লেগে আছে। আরেকটা হাই তুলতেই দেখি নুশরাত সামনে দাঁড়িয়ে আছে, “কি ব্যাপার এত ঘন ঘন হাই তুলছ কেন?” জিজ্ঞেশ করল সে।

“রাত জেগে মুভি দেখেছি তাই।”

“ও, তা এই অভ্যাস কবে থেকে শুরু করেছ?”

“আরে না গত কাল ঘুম আসছিল না তাই মুভি দেখছিলাম,” এই বলে আমি ক্লাসরুমের ঘড়ির দিকে তাকালাম, ক্লাস শুরু হতে পাচ মিনিট বাকী আছে মাত্র। অনেকেই ক্লাসরুমের ঢুকা শুরু করেছে। আরেকটা হাই তুলে হেলান দিয়ে বসলাম। আজেক প্রথমে কার ক্লাস? আক্কাস স্যারের মনে হয়।

“ওই, রানা অ্যাটেন্ডেন্স খাতা নিয়ে আস।”

“কি? সুমনা নিয়ে আসেনি এখনো?”

“সে এখনো কলেজেই আসেনি।”

নুশরাতে এই কথা শোনার পর হতবাক হয়ে গেলাম। বলে কি? সুমনা কলেজে আসেনি! এক মাসের বেশী হবে কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আমি একদিনও দেখি নাই সুমনাকে কলেজে অনুপস্থিত থাকতে কিংবা দেরী করে আসতে। আজকে হঠাৎ করে কি হল যে এখনো তার চেহারা কলেজে দেখা যাচ্ছে না। সেই যাই হোক আমাকে এখন অ্যাটেন্ডেন্স খাতা নিয়ে আসতে হবে। বের হতে মন চাচ্ছিলনা কিন্তু কি করা স্যার যদি এসে দেখে অ্যাটেন্ডেনশ খাতা নাই তখন জবাবদিহি ক্যাপ্টেনকেই করতে হবে।

আমি ক্লাসরুম থেকে বের হতেই দেখলাম সুমনা আসছে আর তার পিছে পিছে নির্জন। সুমনা বড় করে একটা হাই তুলল। তার চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছিল সে ঠিক মত ঘুমায়নি। সে আমাকে দেখতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল, কাছে এসে বলল, “গতকাল আগাথা ক্রিষ্টির যে বই দিয়েছ তা অর্ধেকের মত শেষ করে ফেলেছি,” ঠিক যেন রিপোর্ট দিচ্ছে একজন অফিসার তার উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে।

সে অর্ধেক শেষ করে ফেলেছে! তার মানে সে রাত জেগে পড়েছে। আমি তার হাতের দিকে তাকালাম দেখলাম সে অ্যাটেন্ডেন্স খাতা নিয়েই এসেছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, “ধন্যবাদ এত ভাল একটা বই দেয়ার জন্য, আমি জানতাম না এত সুন্দর থ্রিলার গল্প আছে।”

“মাত্রতো শুরু করলে…”

“চল ক্লাসে সময় হয়ে যাচ্ছে,” এই বলে সে ক্লাস রুমের ভিতর ঢুকল।

চুল কাটার পর তার চেহারার মধ্যে এক ধরনের নমনীয়তা এসে পড়েছে, তবে ধারাল ভাবটা এখনো যায় নি। বাঙালী মেয়েদের চুল বড় রাখলে ভাল দেখায় তবে সুমনাকে ছোট রাখাতে অনেক ভাল দেখাচ্ছে, বাচ্চাদের মত কমনীয়তা এসে পড়েছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি ক্লাস রুমে ঢুকলাম, এবং ঢুকে যা দেখলাম তাতে একটু আগে ভেবে রাখা কথাগুলো সব ফিরিয়ে নিলাম। কারন সুমনা একটা খাম হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে, গোলাপী রঙের। তবে খামের দিকে আমার নজরটা বেশীক্ষনের জন্যে থাকল না। সুমনার দিকে তাকালাম, তার চেহারা লাল হয়ে আছে। লজ্জায় না রাগের কারনে।

সে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কে এই চিঠি দিয়েছে? সাহস থাকলে সামনে আসো।”

কার এমন বুকের পাটা যে সামনে আসে! ছেলেদের মধ্যের এক ধরনের নীরবতা কাজ করছে কিছু মেয়ে এক একজনের কানে ফিস ফিস করছে। বাস্তবিকভাবে কোন কিছু ঘটে যাওয়ার আগে আমাকেই কিছু করতে হবে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেবার আগে।

“তুমি কি শিউর যে তোমাকেই এই চিঠি দেয়া হয়েছে ?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।

“তোমার কি তাতে কোন সন্দেহ আছে?”

আছে বইকি! কে যায় সেচ্ছায় বাঘিনীর মুখে, মনে মনে বললাম।

“আচ্ছা সে যাই হোক একটু পরে স্যার আসবে, এটা ক্লাসে পরে জান যাবে…”

“না আমি এক্ষুনি জানতে চাই,” আমার কথাটাকেই সে পাত্তাই দিল না, “কার এত বড় সাহস আমাকে চিঠি দেয়।”

ধ্যাত, মেয়েটা রাগলে তার কোন হুশ জ্ঞান থাকে না। ক্লাসের আর বাকী সবার দিকে তাকালাম। তারপর আমি সুমনার কাছে গিয়ে বললাম, “একবার তো বলেছি ক্লাস শেষে জানা যাবে কে করেছে, এখন নিজের বেঞ্চে গিয়ে বস,” তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে, “ইচ্ছে হল পড় না হলে কোনায় ডাস্টবিন আছে সেটাতে ফেলে দাও। একটাইতো চিঠি সেটা নিয়ে এত কিছু করার দরকার নাই।”

সে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল তারপর চুপ করে নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসল, তবে হাতে সে চিঠিটা রাখল, আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কে এই কাজ করেছে তাকে আমি খুজে বার করব।”

সুমনার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, আজিব একটা মেয়ে, কোথায় একটা লাভ লেটার পেয়েছে, সেটা নিয়ে একটু খুশি হবে না তা সে সেটা নিয়ে পুরো ক্লাসে হইহই করতে লাগল। কে এই লাভ লেটার দিয়েছে তাকে খুজে বের করতে হবে। আরে যে কাহিনী করলা তাতে তো ঐ ছেলে জীবনে আর কাউকে লাভ লেটার দিবে নাকি সন্দেহ আছে।

আচ্ছা আমাকে যদি কেউ দেয়! ভাবনাটা আমার মাথায় খেলল।

… উহু সম্ভব না। এই ভেবে আমি আমার বেঞ্চের দিকে গেলাম। বেঞ্চে বসতেই দেখলাম নুশ্রাত সুমনাকে কি যেন বুঝানো শুরু করেছে। ভাল কিছু বললেই হল।

ক্লাসটা শেষ হতেই আড়মোড়া দিয়ে শরীরের জড়তা কাটানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ঘুম ঘুম ভাবটা এখনো কাটেনি আমার। এখন ম্যাথ ক্লাস হবে, ভেবেছিলাম প্রথম ক্লাসটা শেষ হলে ক্লাস রুমের বাইরে কিছুক্ষন হাটাহাটি করব কিন্তু এখন আলসেমি লাগছে তাই বের হবার চিন্তাটা বন্ধ করে দিলাম। স্যার যতক্ষন না আসবে ততক্ষন ঝিমানোর প্ল্যান আছে মাথায়।

চোখটা মনে হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখনই ডেস্কের মধ্যে ঠাস করে আওয়াজ হল। আমি ঝট করে সিধে হয়ে গেলাম। দেখলাম সুমনা আমার সামনে দাড়িয়ে।

“কি হয়েছে?” আমার কথার মধ্যে বিরক্তি ভাবটা লুকানো থাকল না।

“ম্যাথ স্যার এখনো আসে নাই তাকে ডেকে আনতে হবে,” আমার বিরক্তি ভাবটা উপেক্ষা করে বলল।

আরে বাপ! সে তো কাজটা নিজেই করতে পারত। তা না করে আমাকে পাঠানোর মতলব কিসের।

“তুমি যেতে পারো নাই।”

“আমার অন্য কাজ আছে।”

কি লাভ লেটার কে দিয়েছে সেটা খুজে বের করার জন্য নাকি, মনে মনে বললাম।

“আমি ক্লান্ত এখনো, তুমি যাও।”

আমার এই কথাটাও পাত্তা না দিয়ে বলল, “তাহলে বোর্ড পরিষ্কার কর, তারপর টিচারস ডেস্ক গোছাতে হবে আর স্যার যে আসাইনমেন্ট দিয়েছে সেগুলো তুলতে হবে আর… ”

“হয়েছে হয়েছে, আমি যাচ্ছি স্যারকে ডাকতে।”

এই বলে আমি ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। টিচারস রুম হল সিড়ির পাশে। আমি যখন সিড়ির কাছে আসলাম একটা পরিচিত গলা শুনতে পেলাম, “এটাতো গলা কাটা দাম।”

কিসের কথা হচ্ছে?

“কিন্তু চশমা পড়া ছবি, একদম রেয়ার, তাই দাম কমানো সম্ভব না।”

রুপার গলা শুনলাম মনে হয়। আমি একটু কাছে যেতেই দেখলাম মাশফিয়া আর রুপা দুজনই মোবাইল হাতে নিয়ে কি যেন দেখছে আর কথা বলছে। আমার কৌতুহল হচ্ছিল তারা কি বিষয় নিয়ে কথা বলছিল কিন্তু তাদের কথার মাঝে ব্যাঘাত না ঘটানোই আমি ভাল মনে করলাম।

আমি সিড়ি পার পার হবার পরেও তাদের কথা শুনতে পেলাম, “ঠিক আছে আমি রাজী তবে, তবে আমি ছবি নেয়ার পর সেটা ডিলিট করে দিতে হবে,” মাশফিয়া বলে উঠল।

তার এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা এই দুনিয়াতে নাই। আমি যে তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি সেটা তারা মনে হয় এখনো টের পায় নি।

“দিব, ব্যাবসা-বানিজ্যের মধ্যে চিটিং আমি পছন্দ করি না,” রুপার দৃড় গলায় বলল, “আর হ্যা নগদ পেমেন্ট।”

“জানি।”

আচ্ছা কি নিয়ে কথা বলছিল, আর কিসের ছবি নিয়ে তারা এত দরদাম করছিল? যাকগে সেটা নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল কারন মেয়েলী ব্যাপারে নাক গলালে ফলাফল সবসময় ভাল হয় না। আমি এইসব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে টিচারস রুমে ঢুকলাম, দেখলাম লায়লা আপু, আরে ধ্যাত লায়লা ম্যাডাম বসে আছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেশ করল, “কি হয়েছে?”

“রহমান স্যার আসে নাই? এখন উনার ক্লাস।”

“না উনি আসে নাই, উনার জ্বর তাই আজকে আসতে পারবে না।”

এটা শোনার পর আমি রুম থেকে বের হতে যাব তখন লায়লা ম্যাডাম বলল, “হাতের কি খবর? এখনো কি ব্যাথা-ট্যাথা আছে নাকি?”

“না কমে গেছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে যাও।”

আমি টিচারস রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। বের হতেই আবার মাশফিয়া আর রুপার দেখা পেয়ে গেলাম। তাদের চেহারায় এক হাজার ওয়াটের বাতির মত জ্বলছে। তার দুজন এত ঘনিষ্ঠ হল কবে?

“হাই~ রানা কি খবর?” মাশফিয়া জিজ্ঞেশ করল।

“ভাল।”

এই বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম, মাশফিয়া আমার সামনে এসে দাড়াল বলে উঠল, “আজিব ব্যাপার আমি তো এখনো কথাই শেষ করি নাই, চলে যাচ্ছ কেন।”

“আমার অনেক কাজ আছে।”

“কি কাজ জানতে পারি?”

“বোর্ড পরিষ্কার করা, টিচারস ডেস্ক পরিষ্কার করা, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ম্যাথ ল্যাবের শীট তোলা আরো কত কাজ!”

“কেন? তুমি কি তোমার ক্লাসের চাকর নাকি?”

“না”, আমি চেচিয়ে বললাম, “আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন।”

“সহকারী ক্লাস ক্যাপ্টেন,” রুপার সুধরে দিল।

“একই কথা।”

আমি দুইজনের দিকে তাকালাম। তাদের চেহারা থেকে ঠিকরে যেন আলো বের হচ্ছিল। আমি আমার কৌতুহল আর চেপে রাখতে পারলাম না, জিজ্ঞেশ করে ফেললাম, “কি হয়েছে তোমাদের এত খুশি খুশি লাগছে।”

“বলা যাবে না এতা সিক্রেট,” মুচকি হেসে মাশফিয়া বলে উঠল।

সেকেন্ড ইয়ারের এই মেয়েটাকে উপেক্ষা করাই আমি ভাল মনে করলাম। এটা ঠিক মাশফিয়া সুন্দরী একটা মেয়ে, তবে স্কুল, কলেজ কিংবা ভার্সিটি যেখানেই হোক না কেন এই ধরনের মেয়েরা ঝামেলার কারন। এদের সাথে কথা বললেও ঝামেলা আবার না বললেও ঝামেলা। আর বড় ভাইরা আগেই বলে দিবে, এ হচ্ছে তোদের ভাবী বুঝেছিস, সালাম দিয়ে কথা বলবি। তারপর মাথায় হালকা একটা চাটি মারবে আর হাসবে। মানে বুঝিয়ে দিল মেয়েটার উপর চোখ তাদের অনেক আগেই গেছে এবং এর সাথে লাইন না মারাই ভাল।

জানা কথা ওই বড় ভাইদের এই মাশফিয়া টাইপের মেয়েরা দুই পয়সার পাত্তা দিবেনা। হালকা মিষ্টি কথা বলে কাজ উদ্ধার করে দিতে বলবে আর বড় ভাইরা হাসিমুখে দুনিয়া জয় করার ভঙ্গিতে সেসব কাজ করবে। তারপর মেয়েটা যখন হাসি মুখে বলবে ‘ধন্যবাদ’। তখন তারা সেটা নিয়ে বানাবে নিজেদের ভালবাসার গল্প অথবা কবিতা! তারপর আর কি সেই সব বড় ভাইদের দুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে সেই মেয়ে বিয়ে করবে বড় কোনো ইঞ্জিনিয়ার কিংবা কোনো ব্যাবসায়ীর ছেলেকে।

“ওই কোন দুনিয়ায় চলে গেলে?”

মাশফিয়ার কথা শুনে আমার হুশ ফিরল। আরে হ্যা আমি কোন দুনিয়ায় চলে গেলাম! আমার তো এখন ক্লাস রুমে যাওয়া দরকার। সবাইকে জানিয়ে দিয়ে ভাবছি আমি লাইব্রেরীতে ঢু মারব কিনা। আমি চলে যেতেই মাশফিয়া আবার রুখে দাড়াল। আমি বলে উঠলাম, “কি সমস্যা? কোন কথা বলবে।”

“না, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে আরো কিছুক্ষন থাক না,” মাশফিয়া হেসে বলল।

আমি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালাম, সে কি আমার সাথে মজা করছে। সে কি মনে করছে সে যদি আমার সাথে এইভাবে কথা বলে তাহলে আমি মোমের মত গলে যাব। আমি তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলাম। আমি চাচ্ছি না ওর সাথে খারাপ ব্যাবহার করতে, কিন্তু সে যদি বাড়াবড়ি করে তাহলে…

আমি তাকে পাশ কেটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মাশফিয়া আমার হাত ধরে ফেলল, “কোথায় যাচ্ছ?”

লিমিট ক্রস করে ফেলেছে, আমি তার বয়ফ্রেন্ড না যে তার কথা মত থাকতে হবে, খুবই কড়া কথা মুখ থেকে বের হতে যাচ্ছিল, তখনই সুমনা গলা শুনতে পেলাম, “যা ধারনা করছিলাম,” এই বলে কোমড়ে হাত দিয়ে আমাদের তিনজনের দিকে তাকাল, “রানা, তোমাকে আমি একটা কাজ দিয়েছিলাম সেটার কি খবর।”

“স্যার আসে নাই, আজকে ম্যাথ ক্লাস হবে না।”

“তা ক্লাস রুমে গিয়ে সেটা জানাতে হবে না, তা না করে এখানে গল্প করছ।”

“আচ্ছা ঠিক আছে ভুল হয়ে গেছে।”

সুমনা এবার দেখল মাশফিয়া আমার হাত ধরে আছে। সে এবার মাশফিয়ার দিকে তাকাল তারপর আমার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেশ করল, “কি ব্যাপার, কি হচ্ছে এখানে?”

রুপা কি যেন বলতে যাবে তখনই লায়লা ম্যাডামের গলা শোনার গেল, “কি ব্যাপার কখন থেকে টিচারস রুমের সামনে ক্যাচড়-ম্যাচড় শুরু করেছে, ক্লাস নাই নাকি?”

এটা শোনার পর আমরা চুপ মেরে গেলাম। মাশফিয়া সুমনার দিকে তাকাল তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ক্লাসরুমে গেলাম,” তারপর রুপার দিকে তাকিয়ে, “তোমার কাছ থেকে বিজনেস করে আমি মজা পেলাম, আশা করি সামনে সেটা আমরা চালিয়ে যেতে পারব।”

“অবশ্যই,” রুপার বলে উঠল।

সুমনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়েটা কে?”

“সেটা অনেক বড় গল্প,” তারপর রুপার দিকে তাকিয়ে, “রুপার কাছে জিজ্ঞেশ কর সে বলবে সব।”

“… হ্যা আমি ?” রুপা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। এখন আমার দিকে চোখ বড় করে তাকানো হচ্ছে কেন, একটু আগেই তো কি যেন বলতে চাইছিলে।

“আমি লাইব্রেরীতে যাচ্ছি কোনো দরকার হলে সেখানে আমাকে পাবে,” আমি সুমনাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। গন্তব্য লাইব্রেরী।

*

“দোস্তো ভাবীতো ছুইট্যা গেল,” বেটে মত একটা ছেলে বলল। তার সামনে চারজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একজন খুবই সুদর্শন। বেটে ছেলেটার কথা শুনে সবাই তারদিকে তাকাল, চুল খাড়া একটা শ্যামলা ছেলে বলে উঠল, “কার কথা বলিস তুই?”

“তোর কথারে বাপ, মাশফিয়াতো ফার্ষ্ট ইয়ারের এক পোলার লগে লাইন মারা শুরু করছে।”

“সত্যি নাকি?”

“হ, সত্যি, রাজু তোর খারাপ রে।”

সেই সুদর্শন ছেলেটা সামনে এসে বলল, “করিম তুই কি সত্যি কথা বলছিস নাকি।”

“আরে বাপ তোগো লগে কি মিছা কথা কইয়া আমার লাভ আছে, আমি নিজের দেখছি মাশফিয়া এক মাইয়ার কাছ থিকা ওই পোলার ছবি নিছে মোবাইলে।”

রাজু নামের ছেলেটা এবার বলে উঠল, “ওই ফার্ষ্ট ইয়ারের পোলাডারে আমি খাইছি।”

তখন সুদর্শন ছেলেটা রাজুকে থামিয়ে বলল, “আরে পুরো কথা না শুনে আগে ভাগে লাফাতে শুরু করছে, করিমকে পুরো কথা শেষ করতে দে,” এই বলে করিমের সে করিমের দিকে তাকাল।

করিম তখন একে একে সব বলা শুরু করল।

*

মাশফিয়া মনে মনে খুবই খুশি, সে আজকে রানার একটা ছবি পেয়েছে। তার চশমা পড়া ছবি। সত্যি কথা চশমা পড়াতে তাকে অনেক মানিয়েছে। মোবাইলে রানা ছবির দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিল সে। সে হল আমার স্বপ্নের রাজকুমার, মনে মনে বলল সে।

রানা তো একটা মেয়েকে পছন্দ করে, সে তো নিজেই বলল তাকে ওইদিন। আচ্ছা যে মেয়ে আসল তাদের সামনে সে কি সেই মেয়ে? মেয়েটার চেহারাতো খারাপ না। সে হার মানবে না, রানা যদি ওই মেয়েকে পছন্দ করুক আর নাই করুক সে রানাকে নিজের করবেই।

মাশিফিয়া নিজের ক্লাসরুমের সামনে আসতেই তার মুখে আবার হাসি ফুটল। তার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু তার সামনে দাঁড়িয়ে। রোগা পাতলা একটা ছেলে, নাম মিনহাজ। মাশফিয়া কোনো কথা মিনহাজের কাছে গোপন রাখে না। আজকেও রাখবে না, কারন সে তার স্বপ্নের রাজকুমার পেয়ে গেছে। সেটা কি তার বেষ্ট ফ্রেন্ডকে জানাবে না?

মাশফিয়া মিনহাজের সামনে গেল, মিনহাজ তাকে দেখ বলল, “কি ব্যাপার আজকে এত খুশি খুশি লাগেছে কেন?”

“তাই নাকি।”

“হ্যা, তা খুশির কারন কি জানতে পারি,” মিনহাজ হাশিমুখে জিজ্ঞেশ করল।

“তোমাকে বলতে আমার সমস্যা নাই,” এই বলে মাশফিয়া বলতে লাগল রানার কথা।

একটু দূরে একটা বেটে মত ছেলে সব শুনতে লাগল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:৫৫
৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×