somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জননেতার জন্মশতর্বষ: জ্যোতি বসুর জীবন ও র্কমকান্ড

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জন্মশতবর্ষে জননেতা
জ্যোতি বসু’র জীবন ও কর্মকাণ্ড বিষয়ক প্রদর্শনী



জ্যোতিরিন্দ্র থেকে জ্যোতি
পূর্বপুরুষের আদিনিবাস তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার বারদিতে। যদিও জ্যোতি বসুর জন্ম কলকাতাতেই, ১৯১৪ সালের ৮ই জুলাই, ৪৩/১ হ্যারিসন রোডের বাড়িতে। বাবা নিশিকান্ত বসু ও মা হেমলতা দেবী ছোট ছেলের নাম রেখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। আদরের নাম ছিল ‘গনা’। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র কী করে জ্যোতি বসু হলেন? উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘সে অনেকদিন পরে, বাবা যখন আমাকে লোরেটো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করতে গেলেন, তখন উনি নামটা ছোট করে দিলেন। আমি জ্যোতি বসু হয়ে গেলাম।’’ কিছুদিন থেকেছেন পুরানো হিন্দুস্থান বিল্ডিং-এ, ফুটনানী চেম্বারে একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া বাড়িতে। পরে ১৯২৪ সালে ৫৫এ, হিন্দুস্থান পার্কে নিজেদের বাড়িতে উঠে আসে বসু পরিবার।

রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ
ছাত্রজীবন শুরু ধর্মতলার লোরেটো কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে। ১৯২১সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে টানা দশ বছর পড়াশোনা। সেন্ট জেভিয়ার্সের পাঠ শেষ করে প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে পড়া শুরু ১৯৩১-এ। বিপ্লবীদের খবর নানাভাবে এসে বাড়িতে পৌঁছাতো। নিষিদ্ধ রাজদ্রোহী সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হলো। গোপনে পড়লেন শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। ১৯৩০ সাল। চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানে আন্দোলিত বাংলা। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে অদম্য দেশপ্রেম ও মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে বিপ্লবীদের অকুতোভয় সংগ্রাম। যেদিন গান্ধীজী অনশনে বসেছিলেন সেদিন স্কুলে গেলেন না। ওই বছরেই অক্টারলোনি মনুমেন্ট ময়দানে তাঁর দাদার সাথে খদ্দর পরে সুভাষচন্দ্র বসুর ভাষণ শুনতেও গেলেন। সার্জেন্টরা তাড়া করায় ‘‘আমরা ঠিক করলাম, পালাবো কেন? পালাবো না। পালানো মানে তো ভয় পেয়েছি। আমাদের গায়ে দু-এক ঘা লাঠি পড়ল। আমরা দ্রুত হাঁটতে লাগলাম।... সেটাই বোধহয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ।’’

বিলেতে মার্কসবাদের প্রথম পাঠ
১৯৩৫ সালে ব্যারিস্টার হবার জন্য যখন লন্ডন যান তখন ইউরোপের অবস্থা অগ্নিগর্ভ। গোটা পৃথিবীর উপর লোলুপ দৃষ্টি হিটলারের। আরেক দিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে তৈরি। হ্যারল্ড ল্যাস্কির ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ভাষণ শুনে উদ্দীপ্ত বসু যুক্ত হলেন প্রগতিশীল শক্তির সমাবেশে। ভারতীয় ছাত্রদের সংগঠিত করার ভার নিলেন জ্যোতি বসু, স্নেহাংশু আচার্য, ভূপেশ গুপ্ত প্রমুখ। লন্ডন, কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিস্ট গ্রুপসহ ভারতীয় ছাত্রদের ফেডারেশনও গঠিত হয়। হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত, ক্লিমেন্স দত্ত এবং বেন ব্র্যাডলের মতো নেতাদের কাছে মার্কসবাদের পাঠ নেন। ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে মত গঠন ও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংবর্ধনা দিতে গড়ে উঠেছিল ‘লন্ডন মজলিস’। জ্যোতি বসুই হন তার প্রথম সম্পাদক। এই সংগঠন থেকেই জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত, ইউসুফ মেহের আলি প্রমুখ নেতাদের সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল।

দেশে ফিরেই সর্বক্ষণের কর্মী
ব্যারিস্টারি পরীক্ষা দিয়ে দেশে ফেরেন ১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে। লন্ডনেই মনস্থির করেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হবেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তাঁর উপর নজর রাখছিলো। জাহাজ বোম্বাইয়ে পৌঁছালে তল্লাশি হলো। রক্ষা পায় ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস’ বইটি। তল্লাশি হতে পারে বুঝে আগেই তিনি এক মহিলা সহযাত্রীর ব্যাগে বইটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে বইটি তুলে দিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের হাতে। পার্টির নির্দেশে সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করলেন শ্রমিকদের মধ্যে। রেল শ্রমিকদের মধ্যে প্রাণপাত পরিশ্রম করে গড়ে তুললেন বিরাট সংগঠন।

সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির সম্পাদক
১৯৪১ সালের ২২জুন জার্মানির নাৎসি বাহিনী সোভিয়েতকে আক্রমণ করলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ‘জনযুদ্ধে’ পরিণত হয়। কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-এর সম্মতিতে বাংলার সেরা বুদ্ধিজীবীরা ২১শে জুলাই কলকাতার টাউন হলে ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ গঠনের আহ্বান জানিয়ে ‘সোভিয়েত দিবস’ পালন করেন। উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ মার্কসবাদী বিপ্লবী ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, গোপাল হালদার, স্নেহাংশু আচার্য, হীরেন মুখার্জি, জ্যোতি বসু প্রমুখ। ১৬ই নভেম্বর সুহৃদ সমিতির সর্বভারতীয় সম্মেলন শেষে বাংলা প্রদেশের সম্পাদক নির্বাচিত হন জ্যোতি বসু। ১৯৪৫ সালে পলিট ব্যুরোর নির্দেশে ভারতের সব প্রদেশে কয়েকজন প্রাদেশিক কমিটির সংগঠক (পি সি ও) মনোনীত করা হয়। বাংলার অন্যতম পি সি ও নির্বাচিত হন জ্যোতি বসু।

পরাধীন ভারতেই বিধানসভায়
স্বাধীনতার আগে ১৯৪৬সালে অবিভক্ত বাংলার শেষ বিধানসভা(তখন নাম ছিল বঙ্গীয় ব্যাবস্থাপক সভা) নির্বাচনে পার্টি তাঁকে রেল-শ্রমিক কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস নেতা হুমায়ূন কবীরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। ৮ ভোটে জয়ী হন জ্যোতি বসু। অবশ্য তখন একটি ভোটের মূল্য ছিল ২০০। সেই অর্থে ১৬০০ ভোটের ব্যবধান! যুক্তির প্রাধান্যে, উপস্থাপনার স্বকীয়তায় ও গভীর দেশপ্রেমের জন্য আইনসভায় তাঁর আসন ছিল বিশিষ্ট স্থানে। ১৬ই আগস্ট দাঙ্গা শুরু হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাতেও অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরে বেলেঘাটায় অনশনরত মহাত্মা গান্ধীর কাছে গিয়ে শান্তি কমিটি গড়ার প্রশ্নে আলোচনা করেন। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি শেষ সম্মেলন হয়েছিল ৮ই, ডেকার্স লেনে একটি বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল বেঁধে। সেই সম্মেলনে জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন।

প্রথমবার জেলে
কলকাতার মহম্মদ আলী পার্কে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ই মার্চ। এই পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক থিসিসের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যাঁরা, জ্যোতি বসু ছিলেন তার অন্যতম। এই কংগ্রেসের অব্যবহিত পরেই কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনী ঘোষণা করলো। ২৬শে মার্চ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হলেন জ্যোতি বসু। প্রেসিডেন্সি জেলে শুরু হয় জীবনের প্রথম কারাবাস। জুন মাসে মুক্তি পেয়ে পার্টির নির্দেশে সারা দেশে রেল ধর্মঘটের প্রস্তুতি নেন।

আন্ডারগ্রাউন্ডে নাম ছিল ‘বকুল’
শুরু হলো আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন। ছদ্মনাম হয়েছিল ‘বকুল’। ১৯৪৯ সালের ৯ই মার্চ রেল ধর্মঘটের সমর্থনে গোপনে গ্রুপসভা ও সংগঠনের কাজ করতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। হঠাৎ রেলওয়ে মেনস ফেডারেশনের মতো সর্বভারতীয় সংগঠন ধর্মঘট তুলে নেয়। এর ফলে ফলে রেল ধর্মঘটের বাস্তবতা কিছু না থাকলেও পার্টির সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার চেষ্টা করেন তিনি। রেল ধর্মঘট ব্যর্থ হলে জ্যোতি বসু, সরোজ মুখার্জি, প্রমোদ দাশগুপ্ত প্রমুখকে প্রাদেশিক কমিটির বাইরে রেখে মহম্মদ ইসমাইলকে সম্পাদক করে নতুন প্রাদেশিক কমিটি গঠন করা হয়। পার্টি আরো হঠকারী পথে অগ্রসর হয়। ১৯৫০ সালের ১সেপ্টেম্বর আবার গ্রেপ্তার হন জ্যোতি বসু।

কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্পাদক ও বিরোধী দলের নেতা
১৯৫১ সালে মুক্তি পেয়ে খাদ্য সমস্যার জেহাদ, বন্দীমুক্তি আন্দোলনের তোড়জোড় করতে করতেই এসে যায় বিধানসভা ও লোকসভার প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে পার্টির অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৩শে নভেম্বর সি পি আই এবং ইউ এস ও’র পক্ষে এক নির্বাচনী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন জ্যোতি বসু ও অশোক ঘোষ। আত্মপ্রকাশ করে কংগ্রেস-বিরোধী সংযুক্ত ফ্রন্ট। এদিকে, ১৯৫১ সালের ১৭—২১শে ডিসেম্বর পার্টির ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমজীবী মানুষের আশা-ভরসার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে গড়ে তুলতে সম্মেলন জ্যোতি বসুকেই প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করে। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি বরানগর কেন্দ্রের প্রার্থী হলেও সমগ্র প্রদেশে ছিলেন পার্টির মূল বক্তা। জ্যোতি বসু বরানগর কেন্দ্রে কংগ্রেসের হরেন্দ্রনাথ চৌধুরীকে হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য হন। ৭১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৮টিতে জয়লাভ করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। বিধানসভায় জ্যোতি বসু ‘প্রধান বিরোধী দলের নেতা’ হিসাবে স্বীকৃতি পান। এই সময় তাঁকে বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা হিসাবে এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক সম্পাদক হিসাবে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলিকে বিভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করতে হয়েছিল।

শিক্ষক আন্দোলন ও ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলন
বাংলার গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের শিক্ষক আন্দোলন ও ১৯৫৫ সালের ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলন দুটি মাইলফলক। শিক্ষক আন্দোলন দমন করতে গণ-আন্দোলনের অন্তত চারশো নেতা ও কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। জ্যোতি বসুকে গ্রেপ্তার করে সরকার শিক্ষা আন্দোলনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। গ্রেপ্তার এড়িয়ে গণ-আন্দোলনের কর্মীদের উপর ব্যাপক আক্রমণের ঘটনা বিধানসভায় তোলার জন্য সাতদিন বিধানসভাতেই থেকে নজির গড়েন জ্যোতি বসু। পরে উদ্দেশ্য সফল হলে পার্টির সিদ্ধান্তে বেরিয়ে আসেন। আবার গ্রেপ্তার হন। দিন সাতেক বিনা বিচারে বন্দী থাকেন। ঐতিহাসিক ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনও পরিচালিত হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই। আবার গ্রেপ্তার হন জ্যোতি বসু।

বাংলা—বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন
১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এক যৌথ বিবৃতিতে আচমকা দুই রাজ্যের সংযুক্তির প্রস্তাব দিলে সংযুক্তিকরণ-বিরোধী কমিটির নেতৃত্বে দাবি ওঠে—পশ্চিমবঙ্গকে বিলোপ করা চলবে না। এই ইস্যুতে উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টিসহ সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোহিত মৈত্র। পশ্চিমবঙ্গের আলাদা অস্তিত্ব থাকবে কি থাকবে না— এটাই এই নির্বাচনের মুখ্য ইস্যু হওয়ায় জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত নির্বাচনী প্রচারাভিযানের জন্য পালঘাটে চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসেও যোগদান করতে যাননি। নির্বাচনে কংগ্রেস পরাস্ত হলে সংযুক্তিকরণের প্রস্তাবও প্রত্যাহার করা হয়। এতে বামপন্থীদের প্রতি মানুষের আস্থা আরো বেড়ে যায়।

ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন
১৯৫৭ সালের নির্বাচনে কেরালার মতো সাফল্য না এলেও পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি পেলো। সেই সময় রাজ্যে খাদ্যের দাবিতে আইন অমান্য, বিধানসভা অভিযান, জেলায় জেলায় সমাবেশ মিছিল যেমন চলছিল, তেমনি বিধানসভার অভ্যন্তরে তার সার্থক প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন বিরোধীরা। এই দ্বিমুখী অভিযানকে একসূত্রে গ্রথিত ও পরিচালনার প্রধান কারিগর ছিলেন জ্যোতি বসু। বিধানসভায় বিরোধীপক্ষের নেতা হিসাবে এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয় ভূমিকা মানুষকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট করছিল। ১৯৫৯ সালের প্রথম থেকেই পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য আন্দোলন ব্যাপক চেহারা নেয়। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত ও হরেকৃষ্ণ কোঙার এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। তিনটি পর্যায়ে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। ৩১শে আগস্ট খাদ্যের দাবিতে তিন লক্ষ নরনারী জমায়েত হয়েছিলেন কলকাতার বুকে। সেদিন লাঠি চালিয়ে নৃশংসভাবে ৮০ জন নিরীহ মানুষকে খুন করেছিল কংগ্রেস সরকারের পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে সে কথা রক্তের অক্ষরে লেখা থাকবে। এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের ধর্মঘট। জ্যোতি বসু তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়ে। এই সময় পথচারীদের অসুবিধার অজুহাত দেখিয়ে গণ-আন্দোলন দমন করতে ‘পশ্চিমবঙ্গ মিছিল ও সমাবেশ নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৬০ বিল’ আনে কংগ্রেস সরকার। বছরের শুরুতেই মনুমেন্ট ময়দানে এই বিলের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করে ভাষণ দেন জ্যোতি বসু। আন্দোলনের চাপে বিলটি প্রত্যাহৃত হয়।

রাজ্য সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি
১৯৫২সাল থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর স্বেচ্ছায় সরে আসেন। ১৯৬১ সালের ১৭—২১শে জানুয়ারি বর্ধমানে অনুষ্ঠিত নবম রাজ্য সম্মেলনে সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রমোদ দাশগুপ্ত। জ্যোতি বসু রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর অন্যতম সদস্য থেকে যান। এই সময়কালে পার্টিকে মতাদর্শগতভাবে সংহত করা, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষে মানুষকে সমবেত করা এবং শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে নানা গণ-আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা ছিল জ্যোতি বসুর। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায় তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি।

তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন ও কমিউনিস্ট বিরোধী কুৎসা
১৯৬২ সালে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিকল্প সরকার গঠনের ডাক দেয় ছয় বামপন্থী দলের ফ্রন্ট। সেই আহ্বানে কমিউনিস্টদের পক্ষে ভোটের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এদিকে, চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে জ্যোতি বসুকে ‘চীনের দালাল’ বলে ব্যা পক কুৎসা চলছিল। পোড়ানো হচ্ছিলো কুশপুত্তলিকা। বিধানসভায় সীমান্ত সংঘর্ষ বন্ধে জ্যোতি বসুর নির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকলেও কুৎসা বন্ধ হয়নি। ১৯শে নভেম্বর ‘আনন্দবাজার’ সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল ‘মলিন জ্যোতি’। ২১শে নভেম্বর জ্যোতি বসু গ্রেপ্তার হলে ‘আনন্দবাজার’ লেখে— ‘সারা দেশে দেশদ্রোহীদের ধরপাকড়’। চীন—ভারত সংঘর্ষ চলে ১৪দিন। কিন্তু জ্যোতি বসুর মুক্তি হয় এক বছর পর, ১৯৬৩ সালে।

৩২জন জাতীয় পরিষদের সদস্যের ডাকে তেনালী কনভেনশন
কমিউনিস্ট পার্টিতে মতাদর্শগত বিতর্ক চলছিল পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই। রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র ও রাষ্ট্র ক্ষমতা কাদের হাতে, এই বিবাদ চরম আকার নেয় ১৯৬২-৬৪ সালে। জেলেই শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। এই বিতর্কে অংশ নিয়েও পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন জ্যোতি বসু। পরে জেল থেকে তাঁর লেখা ‘শোধনবাদী ও সংকীর্ণ গোঁড়া হঠকারীদের হাত থেকে পার্টিকে রক্ষা করো’ একটি নিবন্ধ সেই সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ১৯৬৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের বৈঠকে সংশোধনবাদী ডাঙ্গেপন্থীরা ঐক্যের সমস্ত শর্ত অস্বীকার করলে জ্যোতি বসুসহ ৩২জন সদস্য ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। এই ৩২জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের আহ্বানে ১৯৬৪ সালের ৭-১১ই জুলাই সারা দেশে পার্টির ১৪৬জন প্রতিষ্ঠিত নেতা অন্ধ্র প্রদেশের তেনালীতে এক কনভেনশনে মিলিত হন। এই কনভেনশন থেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। রক্তপতাকা উত্তোলন করে কাকাবাবু বলেছিলেন—‘‘আসুন, আমরা প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের শপথ গ্রহণ করি’’। কনভেনশন পরিচালনা করেছিলেন এ কে গোপালন, শিব ভার্মা ও জ্যোতি বসু।

ঐতিহাসিক সপ্তম কংগ্রেস
তেনালী কনভেনশনের সিদ্ধান্ত মতো ৩১শে অক্টোবর থেকে ৭ই নভেম্বর কলকাতার ত্যাগরাজ হলে ঐতিহাসিক সপ্তম কংগ্রেস থেকে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। স্বাগত ভাষণে জ্যোতি বসু বলেন, ‘‘কলকাতায় সপ্তম পার্টি কংগ্রেস আহ্বান করে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আপনারা স্বীকৃতি দিয়েছেন।’’ পি সুন্দরাইয়া পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জ্যোতি বসুসহ নয়জন পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এঁরাই ‘‘নবরত্ন’’ বলে খ্যাত। ৭ই নভেম্বর জ্যোতি বসুর সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সপ্তম কংগ্রেসের প্রকাশ্য সমাবেশ। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’’। জ্যোতি বসুই ছিলেন পার্টি মুখপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

বন্দীমুক্তি ও দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদ্য আন্দোলন
১৯৬৫-৬৬ সালে বন্দীমুক্তি আন্দোলন ও খাদ্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কারাগার থেকেই জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীকে এক পত্রে লিখেছিলেন—কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে বন্দীমুক্তি দিবস পালিত হবে। রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। তাঁর নেতৃত্বে জেলের অভ্যন্তরেও পালিত হয়েছিল বন্দীমুক্তি দিবস (২৫শে ফেব্রুয়ারি)। পরে ১৯৬৬ সালের ১৪ই মার্চ মুক্তি পেয়ে তিনি বলেছিলেন— ‘‘তখন গণ-আন্দোলন না করলে আমরা জেলেই পচতাম, কারণ কর্তৃপক্ষ বা সরকার তখন একটা ভাষাই বুঝত, সেটা হলো প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ভাষা।’’

প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন
বামপন্থীদের নেতৃত্বে উত্তাল গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয় ১৯৬৭ সালের ২রা মার্চ। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি, উপমুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ৯ই এপ্রিল ব্রিগেডের জনসভায় যুক্তফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন জ্যোতি বসু। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের শরিকী বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগে রাজ্যপাল যুক্তফ্রন্টকে খারিজ করে দেয়। প্রফুল্ল ঘোষকে অবৈধভাবে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে দিলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাংলা। ২৯শে নভেম্বর প্রফুল্ল ঘোষ সরকারকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে সভা মুলতুবি করে বেরিয়ে আসেন অধ্যক্ষ বিজয় ব্যানার্জি।

সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
১৯৬৭সালে নকশালবাড়িতে কৃষক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে উগ্র বাম হঠকারীরা পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেয়। গণসংগ্রামের কঠিন ও দীর্ঘ পথ পরিত্যাগ করে তারা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে দুর্বল করার চেষ্টা করে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৮ সালে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত মতাদর্শগত প্লেনাম অতি-বাম হঠকারীদের লাইন খারিজ করে দেয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মূল্যায়নের ভিত্তিতে জ্যোতি বসু সেদিন বলেন, ‘‘আমরা চীন ও রাশিয়া উভয় দেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি, কিন্তু কারো নির্দেশে চলি না।’’

দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার
একদিকে মতাদর্শগত লড়াই, অপরদিকে জনস্বার্থবাহী কর্মকান্ড পরিচালনার প্রেক্ষাপটে এগিয়ে আসে ১৯৬৯ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ৩২দফা কর্মসূচী পেশ করে। পুনরায় বরানগর কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন জ্যোতি বসু। কিন্তু ঐক্যের স্বার্থে এবারেও মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্তে তিনি হন উপমুখ্যমন্ত্রী। তবু যুক্তফ্রন্টবিরোধী চক্রান্ত থামেনি। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি নিজেই কার্জন পার্কে রাজ্যে ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ চলছে বলে অনশন শুরু করলে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের ১৬ই মার্চ অজয় মুখার্জি পদত্যাগ করেন। এভাবে ১৩মাসের শাসনের সমাপ্তি হয়, শুরু হয় রাষ্ট্রপতি শাসন।

জ্যোতি বসুকে খুনের চেষ্টা
১৯৭০ সালের ৩১শে মার্চ পাটনায় জ্যোতি বসুকে হত্যার চেষ্টা করা হলেও গুলিতে মারা যান তাঁর সঙ্গে থাকা কমরেড আলি ইমাম। জ্যোতি বসুকে স্টেশন থেকে নিতে এসে তিনি জীবন দিয়ে গেলেন। পরদিন, ১লা এপ্রিল দমদম বিমানবন্দরের সামনে এক তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সভায় জ্যোতি বসু বলেছিলেন— ‘‘মৃত্যুর জন্য আমরা সবসময় প্রস্তুত। তবে মৃত্যুর আগে যেন বলতে পারি পৃথিবীর মহত্তম কাজ মানবমুক্তির জন্য আমরা জীবন দিয়ে গেলাম।’’ কিন্তু আক্রমণ বন্ধ হয়নি। বসিরহাট, বারুইপুরেও তাঁকে আবার হত্যার চেষ্টা করা হয়।

গড়ে উঠলো সি আই টি ইউ
পার্টি বিভাজনের পর এস এ ডাঙ্গে ও আরো কিছু নেতা এ আই টি ইউ সি-র মধ্যে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা শাসকশ্রেণীর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপও চালাচ্ছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে জ্যোতি বসুসহ শ্রেণীসংগ্রামের পক্ষে থাকা শ্রমিক নেতৃত্ব ১৯৭০ সালের ২৮-৩০মে কলকাতায় নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সি আই টি ইউ গঠন করলেন। জ্যোতি বসু সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি সি আই টি ইউ-র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

প্রতিক্রিয়ার কোয়ালিশন ও প্রহসনের নির্বাচন
১৯৭১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের মুখে হেমন্ত বসুকে খুন করে সি পি‌ আই (এম)-র উপর দোষ চাপানো হলেও বামপন্থী ফ্রন্ট পায় ১২৩টি আসন, যার মধ্যে সি পি আই (এম) একাই পায় ১১১টি। একক সংখ্যায়গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে ডাকা হয়নি সি পি আই (এম)-কে। অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে গঠিত হলো প্রতিক্রিয়ার কোয়ালিশন সরকার। অল্পদিনের মধ্যেই এই সরকার ভেঙে গেলে ১৯৭২ সালে আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হয় রাজ্য। আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের ভয়াবহ রূপ উন্মোচিত হয় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে ক্ষমতায় বসে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। প্রতিবাদে ১৮ই মার্চ জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে ৮বাম দল এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে সাজানো বিধানসভা বয়কট করে। এই সময় বিধানসভায় জ্যোতি বসুর কন্ঠস্বর ধ্বনিত না হলেও ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে অসামান্য ভূমিকা ছিল তাঁর। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পাশেও বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ছিলেন তিনি।

আধা-ফ্যা সিবাদী সন্ত্রাস ও জরুরী অবস্থা
ক্ষমতায় এসেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কলকাতা কর্পোরেশনসহ সমস্ত নির্বাচিত পৌরবোর্ড ভেঙে দেয়। ট্রেড ইউনিয়নগুলির উপরে নেমে আসে নির্মম আঘাত। একদিকে নকশালপন্থীদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ ও অন্যদিকে পুলিশ-কংগ্রেস যৌথ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হলেন সি পি আই (এম) নেতা-কর্মীরা। আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের দিনগুলিতে ১১০০জন বামপন্থী নেতা-কর্মী শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। এলাকাছাড়া ১০হাজারের বেশি কমরেড। গণতন্ত্রের রক্তঝরানো দিনগুলিতেই ১৯৭৪ সালে সংগঠিত হলো ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘট। গণআন্দোলন দমনে আরো মরিয়া হয়ে উঠলো কংগ্রেস। গোটা দেশে জরুরী অবস্থা জারি হলো ১৯৭৫সালের ২৫শে জুন। পার্টিনেতারা অধিকাংশই গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন অথবা আত্মগোপনে। স্বৈরতন্ত্র পাকাপাকি ভিত্তি পেয়ে যাবার আগেই তাকে সমূলে উৎপাটিত করতে গঠিত হয়েছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটি, যার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন জ্যোতি বসু। জরুরী অবস্থার অবসানের পর কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলো জনতা সরকার।

প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গঠন
গণ-আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষে ১৯৭৭ সালে অষ্টম বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের মানুষ নিরঙ্কুশভাবে রায় দিলেন ছয় দলের বামফ্রন্টের পক্ষে। সাতগাছিয়া থেকে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বিধানসভায় ফিরে এলেন জ্যোতি বসু। হলেন মুখ্যমন্ত্রী। ২১শে জুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি কেন্দ্র–রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবিতে শুরু হয় বামফ্রন্ট সরকারের পথচলা। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘আমাদের প্রথম কাজই ছিল মানুষের লুন্ঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনা।’’

প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন : ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো’
১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন করা বামফ্রন্ট সরকারের এক বড় সাফল্য। কায়েমী স্বার্থের মেরুদন্ড ভেঙে দিতে গ্রামের মানুষের স্লোগান ছিল ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো’। ৫৫,৯৫২ জন প্রতিনিধি গ্রামের মানুষের রায়ে নির্বাচিত হন। জেলা, ব্লক ও গ্রামস্তরে তিনটি পর্যায়ে এত ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে এই প্রথম। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রামের অবহেলিত মানুষ পেয়েছিলেন মানুষের মর্যাদা। তাঁরা বামফ্রন্টকে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে দেখেছিল। ১৯৭৮-এর ভয়ঙ্কর বন্যা মোকাবিলায় বামফ্রন্টের পাশে থেকে সে প্রমাণ তারা দিয়েছিলেন। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতীব্য বস্থার মাধ্যমে ব্যা পক ভূমি সংস্কার করে গোটা দেশে নজির সৃষ্টি করেছিল বামফ্রন্টের পঞ্চায়েত। একই সঙ্গে ‘অপারেশন বর্গা’-র মাধ্যমে গ্রামের গরিব কৃষক ও ভাগচাষী তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরলো কংগ্রেস
প্রথম অ-কংগ্রেসী সরকার হিসাবে জনতা সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও অভ্যন্তরীণ সংকটে মোরারজী সরকারের পতন ঘটায় সপ্তম লোকসভা নির্বাচন অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে সি পি আই (এম) স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ৯টি রাজ্যে অকংগ্রেসী সরকারকে ভেঙ্গে দেন। প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করে বক্তব্য রেখেছিলেন জ্যোতি বসু।

স্বৈরতন্ত্রের বিপদ ও দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার
পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি ইন্দিরা সরকারের আচরণ ছিল চরম বৈষম্যমূলক। গান্ধীর ক্ষমতা লাভে উল্লসিত সমাজবিরোধীরা পুনরায় খোলস ছেড়ে হিংসার অভিযানে শামিল হয়। ১৯৮১ সালের ৩রা এপ্রিল তাদের উন্মত্ততা চরম আকার নেয়। প্রতিবাদে ৬ই এপ্রিল দেশপ্রিয় পার্ক থেকে দেশবন্ধু পার্ক পর্যন্ত এক ঐতিহাসিক মহামিছিল অনুষ্ঠিত হয় যার পুরোভাগে ছিলেন জ্যোতি বসু। এর কিছুদিন পর ৩১শে মে দেশের মধ্যে প্রথম এরাজ্যেই পৌরসভা নির্বাচনে ১৮ বছর বয়সে ভোটদানের অধিকার দেওয়া হয়। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ডাক দিয়ে ১৯৮২ সালে রাজ্যে নবম বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পেশ করা হয় ৩৪দফা কর্মসূচী। এবারের বামফ্রন্টের শরিক ছিল ৯টি দল। ২৯৪টি আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট পায় ২৩৮টি আসন, সি পি ‌আই (এম) পায় ১৭৪টি আসন। ২৬শে মে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার শপথ নেয়।

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যা্সের দাবি
রাজ্যগুলির হাতে আরো অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবিটিকে সারা দেশে জনপ্রিয় করতে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা বিভিন্ন মহলে সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছিল। কার্যত এর ফলেই ১৯৮৩ সালের ৯ই জুন গঠিত হয়েছিল সারকারিয়া কমিশন। এই প্রেক্ষাপটেই সেবছর অক্টোবরে অকংগ্রেসী রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত শ্রীনগর সম্মেলনে জ্যোতি বসু বললেন, ‘রাজ্যগুলিকে পৌরসভায় পরিণত হতে দেওয়া যায় না।’ এরপর ১৯৮৪ সালের ১৩-১৫ই জানুয়ারি অকংগ্রেসী বিরোধী দলগুলির নেতাদের নিয়ে কলকাতা সম্মেলন সারা দেশকে আন্দোলিত করলো। এই আলোচনাকে মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে বসুর নেতৃত্বে সমাবেশ হলো ব্রিগেডে।

‘ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়বো’
কেন্দ্রের লাগাতার বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু হলো। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাতল কমপ্লেক্স ও বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প রূপায়ণের বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো। এই দুটি বৃহৎ প্রকল্পের ছাড়পত্র নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার অহেতুক বিলম্ব ও অসহযোগিতা করায় এই দাবিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের স্তরে নিয়ে গিয়েছিল বামফ্রন্ট। ঠুনকো অজুহাতে খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল সল্টলেক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স-ও। রাজ্যজুড়ে আওয়াজ উঠলো ‘ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়বো’। এদেশের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে সৃষ্টি হলো এক নতুন নজির। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির উন্নয়নের ১২দফা দাবিকে সামনে রেখে ১৯৮৪ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি—১৫ই মার্চ সংগঠিত হলো কোচবিহার থেকে কলকাতা ৮২৬ কিলোমিটার এক ঐতিহাসিক পদযাত্রা। সল্টলেক থেকে হলদিয়া আরেকটি ঐতিহাসিক পদযাত্রা। রাজ্যের জরুরি দাবি ও কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রতিবাদে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে এ রাজ্যের সংগঠিত আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল সর্বভারতীয় স্তরেও।

জনবিরোধী রাজীব সরকার
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর সহানুভূতির কারণে বিপুলভাবে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জনবিরোধী বাজেট পেশ করেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনাও বর্ধিত হয়। সারা দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপও বেড়ে চলে। ২১শে মার্চ রাজীব গান্ধী ‘‘কলকাতা মুমূর্ষুনগরী’’ মন্তব্য করায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে দিল্লিতে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে জ্যোতি বসুর ভাষণ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকার
১৯৮৭ সালে দশম বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে যান। ৩১শে মার্চ শপথ নেয় তৃতীয় বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা। এই সময়ে বোফর্স কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ায় জাতীয় স্বার্থেই রাজীব সরকারের অপসারণের জন্য দেশব্যাপী আন্দোলন জরুরী হয়ে পড়ে। রাজ্যে ১৬ই সেপ্টেম্বর ৩লক্ষ মানুষের সভা, ৯ই ডিসেম্বর দিল্লিতে ১০লক্ষ মানুষের জমায়েত— এই প্রেক্ষাপটে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর।

দার্জিলিং সমস্যা
দার্জিলিং-এ সুবাস ঘিসিং-এর নেতৃত্বে সশস্ত্র মিছিল করে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৮৬ সালে। সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রকাশ্যেই তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। তবুও রাজীব গান্ধী কলকাতায় ‘গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন জাতীয়তাবিরোধী নয়’ উল্লেখ করে পরিস্থিতি ঘোরালো করে তোলেন। পরে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অনেক রক্তের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের জন্য জ্যোতি বসুকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। অবশেষে ১৯৮৮-র ২২শে আগস্ট কলকাতায় ‘দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতই সারা দেশে মডেল
১৯৮৯ সালের ৩—৭ই এপ্রিল কলকাতায় অনুষ্ঠিত উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রীদের সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন বসু। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বলেন, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের সাফল্য দৃষ্টান্তমূলক। এটাই সারা দেশে মডেল হওয়া উচিত। অন্যদিকে, বোফর্স দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে শিখরে পৌঁছে দিতে বামপন্থীরা সর্বতোভাবে সচেষ্ট ছিলেন। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রতিবাদে অজস্র সভা করেছিলেন জ্যোতি বসু। রাজীব গান্ধীর পদত্যাগের দাবিতে লোকসভার বিরোধী সদস্যদের একযোগে পদত্যাগও ছিলো সংসদীয় রাজনীতিতে এক বিরল ঘটনা। নবম লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে ভি পি সিং-এর নেতৃত্বে শপথ নেয় রাষ্ট্রীয় মোর্চা সরকার। এর পিছনে জ্যোতি বসুর ভূমিকা এবং বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনায় তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল।

স্বাগত নেলসন ম্যান্ডেলা
১৯৯০ সালের ১৮ই অক্টোবর। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শুরু হয়েছিল উন্মাদনা। আসছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। যাঁর মুক্তির দাবিতে বিরাট বিরাট সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে কলকাতায় সেই বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আপোসহীন যোদ্ধা নেলসন ম্যান্ডেলা কলকাতায় এসেই জয় করে নিয়েছিলেন বাংলার হৃদয়। জ্যোতি বসু তাঁকে ‘মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক’ হিসাবে অভিহিত করায় ম্যান্ডেলা প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, কলকাতা তাঁর সহযোদ্ধার ঘর। তিনি এসেছেন নিজের জায়গায়। সেদিন ইডেন তাঁকে বন্দী করেছিল লক্ষ প্রাণের বন্ধনে।

চতুর্থ বামফ্রন্ট সরকার
১৯৯১ সালের ২৫শে জুন রাজ্যে টানা চতুর্থবারের জন্য বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করলো। তার আগে বি জে পি-র বিশ্বাসঘাতকতায় ভি পি সিং সরকারের পতন ঘটে যায়। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয় কংগ্রেস। এই সময় কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতির ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে একটা বিকল্প নীতি নিয়ে একটা দলিল প্রস্তুত করা হয়, যার অন্যতম কারিগর ছিলেন জ্যোতি বসু।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বাংলা
ভি পি সিং সরকারের পতনের পর ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি ও সংঘ পরিবারের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ভেঙে ফেলা হলো বাবরি মসজিদ। শুরু হয় দাঙ্গা। সারা পৃথিবী জুড়েই প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ দাঙ্গা প্রতিরোধে সংসদের বাইরে ও ভিতরে বামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শান্তি, সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন জ্যোতি বসু। ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতা শহরের মহামিছিলের পুরোভাগেও সামিল ছিলেন তিনি। পরে ২০০১ সালের ২৯শে জানুয়ারি ও ১৫ই মার্চ লিবেরহান কমিশনের সাক্ষ্যে তিনি বলেছিলেন— ‘‘আমি থাকলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে মসজিদ বাঁচাতাম।’’

মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা
পূর্ব-ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর ১৯৯৩ সালে সি পি আই(এম)র উদ্যোগে ‘সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি এবং মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা’ নিয়ে কলকাতায় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছিল। একুশটি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। চার সদস্যবিশিষ্ট সি পি আই(এম) দলের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন জ্যোতি বসু। প্রতিনিধিদের বিশেষ আগ্রহ থাকায় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনায় সি পি আই(এম)-র অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। এই বছরের ২১শে সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডন যান। সেখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দুশো বছর পূর্তি উপলক্ষে ভাষণ দেন।

বামফ্রন্টের শিল্পনীতির রূপরেখা
ডাঙ্কেল প্রস্তাব থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরত থাকার জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব গ্রহণ, কলকাতায় গ্যাটচুক্তির বিরুদ্ধে মহামিছিল, বিভিন্ন সমাবেশে জ্যোতি বসুর বক্তব্য, ১৯৯৪ সালের ১৩ই এপ্রিল মানবপ্রাচীর নির্মাণে অগুণতি মানুষের ঢল ইত্যাদি অসংখ্য কর্মসূচী সর্বভারতীয় স্তরে এই লড়াইকে প্রভাবিত করলেও দেশকে বিপথে ঠেলে দিয়েছিল কংগ্রেস। এই প্রেক্ষাপটে শ্রেণী অভিমুখ ও অগ্রাধিকার ঠিক রেখে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পোন্নয়নের রূপরেখা সংক্রান্ত একটি নীতি বিবৃতি রাজ্য বিধানসভায় পেশ করেন জ্যোতি বসু।

জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
১৯৯৬ সালে একাদশ লোকসভা নির্বাচনের মুখে জ্যোতি বসুর উপস্থিতিতে গঠিত ১৩দলীয় সংযুক্ত মোর্চা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কংগ্রেস এই জোটকে বাইরে থেকে সমর্থন জানিয়েছিল। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে সংযুক্ত মোর্চা জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে যোগ দিতে অনুরোধ করলেও পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে সে পদ গ্রহণ করেননি তিনি, কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে স্থায়ী প্রভাব রেখে যান। তাঁরই পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন দেবেগৌড়া।

কমিউনিস্ট আন্দোলনের দলিল সম্পাদনা
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস রচনার প্রাথমিক উপাদান হিসাবে পার্টি দলিলের গুরুত্ব অপরিসীম। সেকথা বিবেচনা করে ১৯৯৭ সালে জ্যোতি বসুকে প্রধান সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের সম্পাদকমন্ডলীর উপর দলিল সংগ্রহ ও সংকলনের দায়িত্ব তুলে দেয় পার্টি। মোট ২৬টি খন্ড প্রকাশিত হয়। জ্যোতি বসু প্রতিটি খন্ডের জন্য পৃথক পৃথক ভূমিকা লেখেন। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস অনুধাবনে তাঁর লেখা ভূমিকাগুলি কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে কোন ছাত্রের কাছেই অসীম তাৎপর্যবাহী।

মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে নজিরবিহীন অবসর
স্বাস্থ্যের কারণে বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি অবসর নিতে চাইছিলেন। ২০০০ সালের ২০-২৩শে অক্টোবর তিরুবনন্তপুরমে সি পি আই (এম)-র বিশেষ সম্মেলনে পার্টি কর্মসূচীকে সময়োপযোগী করার প্রশ্নে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ফিরে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই জানিয়ে দিলেন অবসর নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে। ৩১শে অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শেষবারের মতো রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। ৩রা নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শেষবার এলেন মহাকরণে। ৬ই নভেম্বর টানা সাড়ে ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে অবসর নেন তিনি। পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

‘প্রশংসা বিষবৎ, নিন্দা অমৃতসমান’
সারা জীবন এই মন্ত্রেই বিশ্বাস করেছেন তিনি। ২০০১ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাজ্য বিধানসভায় শেষবারের মতো এসেছিলেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মাঝে ৭২-৭৭ ছাড়া দীর্ঘ ৫০বছর বিধানসভায় মুখ্য ভূমিকা পালনের জন্য তাঁকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনায় তিনি বলেছিলেন—আমি নির্বাচনে দাঁড়াব না। কিন্তু রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছি না, আমরা কমিউনিস্টরা বলি যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা অবধি মানুষের মুক্তির জন্য যেন আমরা কাজ করতে পারি। বিধানসভার অধিবেশনে শেষ বক্তৃতায় বলেন, ‘প্রশংসা বিষবৎ, নিন্দা অমৃতসমান’।

‘সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার দেখে যেতে চাই’
মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পরও পার্টি ও গণসংগঠনের কাজে তাঁর ব্যস্ততার কিছু কমতি ছিল না। পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সাপ্তাহিক বৈঠক এবং রাজ্য কমিটির মিটিংগুলিতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন তিনি। পার্টির রাজ্য সম্মেলন ও পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত থেকে মুল্যবান মতামত ও পরামর্শ প্রদান করা ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সি আই টি ইউ-র অষ্টম রাজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনও করেন তিনি। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন। জ্যোতি বসু বললেন, ‘মৃত্যুর আগে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার দেখে যেতে চাই’। মানুষ তাঁকে নিরাশ করেননি। বিপুলভাবে আবার জয়ী হলো বামফ্রন্ট।

‘আমার সম্মান, পার্টিরই সম্মান’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডি লিট দেওয়া হলো। অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘আমাকে সম্মান দেওয়া মানে আমার পার্টিকেই সম্মানিত করা। কারণ আমি তো সারা জীবন ধরে পার্টি আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেই কাজই করেছি।’

পলিট ব্যুরোয় স্থায়ী আমন্ত্রিত
তখন তাঁর শরীর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। যোগ দিতে পারেননি ১৯তম পার্টি কংগ্রেসে। পলিট ব্যুরো থেকেও অব্যাহতি চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে রেখে দেয়। স্বাস্থ্যের কারণে ২০০৯-এ কলকাতায় অনুষ্ঠিত পার্টির পলিট ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও তিনি যোগ দিতে পারেননি।

চির অবসরে
২০১০ সালের ১৭ই জানুয়ারি, রবিবার, সকাল ১১টা ৪৭মিনিট। এই প্রথম বিশ্রাম নিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। স্তব্ধ হলো তাঁর হৃদস্পন্দন। তিনি বলতেন, ‘জনগণের স্বার্থ ছাড়া কমিউনিস্টদের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকতে পারে না। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কমিউনিস্টদের মানুষের স্বার্থেই কাজ করে যেতে হবে।’ নিজের জীবনের মধ্যে দিয়েই সেকথা প্রমাণ করে গেছেন তিনি। আর মানুষও তাঁকে সেই কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন অকৃপণভাবে। জীবিত থাকাকালীন এই কিংবদন্তী নেতা যেখানেই গিয়েছেন, উদ্দাম জনস্রোতে তাঁর পথ গিয়েছে ভেসে। ১৯শে জানুয়ারি বিধানসভা ভবন থেকে তাঁর মরদেহ নিয়ে শেষযাত্রাতেও জনস্রোতেই বিদায় নিলেন জননেতা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৫৯
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×