আইয়ুব সুলেইমান ডিলন
কোরআনে হাফেজ, আমেরিকার ক্রীতদাস।
আইয়ুব সুলেইমান ডিলনের এই প্রতিকৃতিটা ১৭৩৩ সালে এঁকেছেন বিখ্যাত ব্রিটিশ চিত্রকর উইলিয়াম হোয়ার।
ছবিতে আইয়ুব সুলেইমানের গলায় ঝুলানো তাঁর নিজের হাতে লেখা কোরআন শরীফ।
১৭০১ সালে আইয়ুব সুলেইমান ডিলন (আমেরিকান নাম জব বেন সলোমন) সেনেগালের বুন্ডুতে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি উচ্চ শিক্ষিত এবং কোরআনে হাফেজ। তিনি ক্রীতদাস হওয়ার আগে একজন নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি আমদানি-রফতানি ব্যবসা করতেন।
আইয়ুব সুলেইমান ডিলনের আব্বা ব্যবসার পাশাপাশি ইমাম এবং বড় আলেম ছিলেন। তাঁর দাদা বুন্ডুতে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার দাদা এই বুন্ডু শহরের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার দাদার নামেই এই শহরের নাম করন করা হয়ে ছিল।
১৭৩০ সালের এক দুর্ভাগ্যজনক দিনে আইয়ুব সুলেইমান ডিলন তার দুভাষী লোউমেইন ইওয়াস সহ ব্যবসায়িক সফর শেষ করে গাম্বিয়া নদী পথে বাড়িতে ফিরছিলেন (যেহেতু তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবসা করতেন তাই সবসময় তার সাথে একজন দুভাষী থাকতো)। হঠাৎ করে আফ্রিকার একদল জংলী উপজাতি মেন্ডিনগোজ এর লোকেরা তাদেরকে আক্রমণ করে এবং অপহরণ করে। পরে তাদেরকে রয়েল আফ্রিকান কোম্পানি নামে একটা কোম্পানির কাছে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়। এই কোম্পানি তাদেরকে ম্যারিল্যান্ডের রাজধানী এনাপোলিশে এনে আরেকটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়।
আবার ঐ কোম্পানির আছ থেকে ম্যারিল্যান্ডের কেন্ট আইল্যান্ডের একজন ধনী কৃষক টলস, আইয়ুব সুলেইমান ডিলনকে কিনে নিয়ে তার তামাক খেতে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করে। আইয়ুব সুলেইমান জীবনে এই ধরণের কঠিন কাজ করেন নাই। তাই তিনি এই কাজের জন্য উপযুক্ত ছিলেন না। তার মালিক এটা বুঝতে পেরে তাকে পশু পালনের জন্য রাখাল হিসাবে নিয়োগ করেন। এই সময় আইয়ুব সুলেইমান ডিলন পশুগুলিকে চড়তে দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে দীর্ঘ সময় নামাজ পড়তেন।
১৭৩১ সালে নামাজ পড়ার সময় একটা ছেলে তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে। এরপর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বেশি দূর পালাতে পারেন নাই। ধরা পরে যানা। আইয়ুব সুলেইমান ডিলন যেহেতু ইংরেজি বলতে পারতেন না, তাই বিচারককে তার পালানোর কারণ ব্যাখ্যা করে বুঝাতে পারেন নাই। কেন্ট কাউন্টি কোর্ট তাকে কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝাতে সক্ষম হন যে তিনি নামাজ পড়ার জন্য একটা নির্বিঘ্ন জায়গা চান। তার মালিক তাকে নির্বিঘ্নে নামাজ পড়ার জন্য একটা জায়গা ঠিক করে দেন। তিনি দীর্ঘ সময় নামাজ পড়তেন।
দুর্ভাগ্য চিরদিন থাকে না। ঐ কেন্ট কাউন্টি কোর্টের একজন আইনজীবী থমাস ব্লুয়েটের নজরে আসে বিষয়টা। তিনি আইয়ুব সুলেইমান ডিলনের সাথে আকারে ইঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করেন। আইয়ুব সুলেইমান আরবিতে কিছু একটা লেখেন, তারপর এটা পড়ে শুনান। আইনজীবী থমাস ব্লুয়েট দুইটা শব্দ বুঝতে পারেন এক "আল্লাহ" দুই "মুহাম্মদ"; তারপর থমাস ব্লুয়েট তাকে পরীক্ষা করার জন্য মদ খেতে দেন। আইয়ুব সুলেইমান মদ খেতে অস্বীকার করেন। তিনি বুঝতে পারেন আইয়ুব সুলেইমান একজন মুসলমান। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন নাই আইয়ুব সুলেইমান কোন দেশর নাগরিক এবং কি ভাবে এখানে আসলেন। কিন্তু তার চেহারা এবং ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝে গেলেন তিনি সাধারণ কোন মানুষ না।
তারপর আইনজীবী থমাস ব্লুয়েট এক সেনেগালি ক্রীতদাস, যে আরবি ভাষা জানতো, তার মাধ্যমে আইয়ুব সুলেইমানের কথা শুনে বুঝতে পারলেন যে আইয়ুব সুলেইমান এক অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। থমাস ব্লুয়েটের অনুরোধে আইয়ুব সুলেইমানের মালিক তাঁকে তাঁর আব্বার কাছে চিঠি লেখার অনুমতি দিলেন। এই চিঠি তাঁর আব্বার হাতে না পৌঁছে, পৌঁছল সেই রয়েল আফ্রিকান কোম্পানির পরিচালকের হাতে। তিনি আরবিতে লেখা চিঠিটা অনুবাদের জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান ওগলেথর্পকে দিলেন। ওগলেথর্প চিঠিটা পড়ে আইয়ুব সুলেইমানের দুঃখ কষ্টের কথা জানতে পেরে আবেগ আপ্লুত হয়ে পারেন। তিনি তাকে মুক্ত করার জন্য ৪৫ পাউন্ড দিয়ে তাঁর মালিকের কাছ থেকে কিনে নেন।
১৭৩৩ সালে আইয়ুব সুলেইমান, আইনজীবী থমাস ব্লুয়েটের সাথে লন্ডন যাত্রা করেন। জাহাজে করে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডের দীর্ঘ যাত্রায় আইয়ুব সুলেইমান আইনজীবী থমাস ব্লুয়েটের কাছে ইংরেজি শিখেন। লন্ডনে আসার পর সেই রয়েল আফ্রিকান কোম্পানি আইয়ুব সুলেইমানকে আবার দাস হিসাবে বিক্রির ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তিনি সেটা বুঝতে পেরে ভয় পেলেও বুদ্ধি করে আইনজীবী থমাস ব্লুয়েট এবং জাহাজে পরিচয় হওয়া এক লোকের সাথে যোগাযোগ করেন। তখন আইনজীবী থমাস ব্লুয়েট এবং জাহাজে পরিচয় হওয়া সেই ভদ্রলোক ৫৯ পাউন্ড ৬ সিলিং ১১ পেন্স এবং আধা পেনি দিয়ে আইয়ুব সুলেইমানকে ষড়যন্ত্রকারীদের কবল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। কোন দাস আইনগত ভাবে মুক্ত হলে “freedom in form” একটা সার্টিফিকেট লাগতো। ঐ আইনজীবী এবং আরো কয়েকজন লোক অনেক টাকা পয়সা খরচ করে আইয়ুব সুলেইমানকে ঐ সার্টিফিকেটে জোগাড় করে দেন।
এরপর আইয়ুব সুলেইমানের ভাগ্য ঘুরে যায়। তিনি ইংল্যান্ডে রাজ পরিবার সহ অভিজাত পরিবারের বন্ধুতে পরিণত হন। তিনি লন্ডনে আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদকের কাজ করতেন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত অনেক আরবি পাণ্ডুলিপি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
তিনি যেহেতু কোরআনে হাফেজ ছিলেন তাই লন্ডনে থাকা অবস্থায় মুখস্থ থেকে তিনি নিজ হাতে কোরানের তিনটা কপি লেখেন। তার নিজের হাতে লেখা কোরআনের একটা কপি তার গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন।
১৭৩৪ সালে প্রথমে গাম্বিয়া পরে সেখান থেকে নিজ দেশ সেনেগালে ফিরে যান। দেশে ফিরে দেখেন ইতোমধ্যে তাঁর আব্বা মারা গেছেন, আর তাঁর স্ত্রীর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি তার আত্মজীবনী লেখেন, যা ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়।
১৭৭৩ সালে আইয়ুব সুলেইমান ডিলন মারা যান।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০২০ রাত ১০:৫৬