বিষয় তনু হত্যা।কিন্তু আসলে ব্যাপারটা এখন আর "তনু হত্যা" আর "বিচার" নেই। রেপ, মার্ডার ও জাস্টিস ছাড়িয়ে এখন এটা হয়ে গেছে হিজাব, আর্মি ও ক্যান্টনমেন্ট। ভেবেছিলাম এই অহেতুক কাদা ছোড়াছুড়িতে আর নিজেকে জড়াবনা। চুপচাপই থাকব। কিন্তু হঠাৎ এডমান্ড বার্ক এর উক্তিটা মনে পড়ে গেল। তাই সিদ্ধান্ত বদল করে লিখা শুরু করলাম। চুপ থাকা যাবেনা। হয়তোবা পাঁচজনও পড়বেনা। তারপরও চুপ থাকা যাবেনা।
প্রথমে আসি হিজাব প্রসঙ্গে। মেয়েরা হিজাব কেন করে? এর উত্তরে বরঞ্চ আরেকটা প্রশ্ন করি।এই সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের গোড়ায় যে প্রশ্নটা সেটা, মানুষ ধর্ম কেন পালন করে? হোক হিন্দু, হোক মুসলিম, হোক খ্রীস্টান, কিন্তু ধর্ম পালন কেন? হিজাবটাও মেয়েরা ওই কারণেই করে যে কারণে আমার আপনার মা রাতের আরামের ঘুম ত্যাগ করে তাহাজ্জুদের, ফযরের নামায পড়ে, যে কারণে মুসল্লি মসজিদে যায়, যে কারণে আযান হয় এবং মসজিদে ও ঘরে নামায হয়, রমজান মাসে রোজা হয়, সে কারনেই মেয়েরা হিজাব পরে। ব্যাস। এর সাথে আর কিছু মেলানোর দরকার নাই।
এইবার আসি আর্মি আর ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে। সকল আলোচনা সমালোচনা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, মানুষজন সবাই একরকম নিশ্চিত যে, যেহেতু ক্যান্টনমেন্টে হয়েছে সেহেতু আর্মি করেছে, যেহেতু আর্মি করেছে সেহেতু সেনা কর্তৃপক্ষ চুপ, আর যেহেতু সেনা কর্তৃপক্ষ চুপ তাই পুলিশ বাবাজিরাও চুপটি মেরে বসে আছে আর ধামাচাপার চেষ্টা করছে। আমি এটার নাম দিয়েছি "হেতু থিওরেম"!!! মজার ব্যাপার হল, আমরা খুনি বের করে ফেলেছি, কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুলিশ এখনও ফরেন্সিক রিপোর্টই হাতে পায়নি! ফরেন্সিক রিপোর্ট ছাড়াই পুলিশ আসামী ধরবে! এখানেও আর্মিকে দোষ দেবেননা, কারন জ্ঞ্যাতার্থে জানাই, ফরেন্সিক টেস্ট সিএমএইচ এ করতে দেয়া হয়নি। সরকারী এবং সিভিল মেডিকেলেই করতে দেয়া হয়েছে। আচ্ছা, আজকে একটা নিউজ পরলাম, নুসরাত হত্যাকান্ডে ডাক্তার ভুয়া ফরেন্সিক রিপোর্ট দিয়েছে। আদালতে প্রমাণিত। তো আসেন কাতারে দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের গুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়ে দিই। যার যত গালাগাল জানা আছে আসুন, মোক্ষম সময়, ঝেড়ে দিই!কিন্তু কেউ ঝাড়বেনা!কারন ডাক্তার শালা আর্মি না, মেডিকেলও সিএমএইচ না! তাই সাত খুন মাফ। আচ্ছা, কেউ কি খবরটা পড়েন নি? হোটেলে কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ? পড়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু ক্যান্টনমেণ্টে হয়নি তো! ওর জন্য প্ল্যাকার্ড ধরে, স্ট্যাটাস দিয়ে কি হবে?
কিন্তু আর্মি কে নিয়ে এত ক্ষোভ কেন? ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দেয়না বলে? ও তো পুলিশ লাইনেও দেয়না। গনমানুষের ভোটে নির্বাচিতদের সংসদেও গনমানুষ ঢুকতে পারেনা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা সচিবালয়েও পারেনা। স্থাপনার তো অভাব নাই যেখানে access limited. কিসের জন্য? জলপাই রঙা গাড়ির জন্য? আর সব সরকারি অফিসাররাও তো সরকারী গাড়িতে চড়ে। তাহলে কি?জলপাই রঙের জন্য? ইউনিফর্মের জন্য? ভাই সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম থাকতে হয়, নইলে সিভিলিয়ানরা সব কচুকাটা হবে যুদ্ধের সময়। কয়েকটা পোস্টে দেখলাম সুন্দরী বউ এর কথাও বলা হয়েছে, জিপে করে সুন্দরী বউ নিয়ে ঘোরাতেও জন আপত্তি। জিপের কথা বললে বলব, আর সব রাম শাম যদু মধুর মত ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার হলেও আর্মি অফিসারদের জন্য ক্যান্টম্নেন্টের বাইরে ব্যাবহারের জন্য ব্যাক্তিগত গাড়ি বরাদ্দ নেই।সপ্তাহে একদিন অফিসাররা ইউনিটের গাড়ি নিয়ে বাইরে বেরোতে পারেন, তাও সীমিত সময়ের জন্য।সুন্দরী বউ?এর উত্তরে কি বলা যায় বলেন তো? বাই দা বাই, মেজর ইজ ইকুইভ্যালেন্ট টু আ এসপি। জানেন তো? এসপির সরকারী বাংলোয় গিয়েছেন কখনও?যাবেন। আর মেজর হইলে আমিও আপনাদের বাসায় দাওয়াত করব কেমন, দেখে যাবেন ক্যান্টনমেণ্টে মেজর সাহেব কি বাসায় থাকে! একজন ডিসির জন্য বরাদ্দ আস্ত এক জমিদারী বাংলো,আর একজন লেফটেনেন্ট কর্ণেল? ওই কোনরকম বিল্ডিং এর একটা ফ্ল্যাট।আমি তো দেখি সব জায়গাতেই আর্মি বঞ্চিত। সব জায়গায়। তাহলে? কিসের এত ক্ষোভ? ক্ষমতা? কিসের ক্ষমতা? একজন টিএনও, ইউএনও এর প্রতাপ দেখেছেন এলাকায়? একটা থানার ওসি তো ভাই এলাকার গডফাদার! আচ্ছা তাহলে?আর্মি কার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে? আর্মির সাথে তো আপনাদের লেনদেনও নেই যে ঘুষ দিতে হয় তাই বেজার হয়ে আছেন। বাকি জায়গায় তো পেনশানের জন্যও ঘুষ লাগে!সরকারী অফিসের লাল ফিতের চক্করে পড়েছেন কখন? কিংবা কোন অভিযোগ নিয়ে থানায় গেছেন কখনো? যান, টের পাবেন।জানি ঘুরে ফিরে তাই এক জায়গাতেই আসবেন, সবচাইতে বড় আপত্তি। যুদ্ধ নেই তো বাহিনী কেন? উত্তরটা দেবনা।
তবে প্রশ্ন করি, আর্মি যদি নাই থাকে, তবে রানা প্লাজা ধসে পরলে উদ্ধার করবে কে? সিডোরের প্রকোপে যখন সব মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছিল, ঝড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, তখন আমার ইউনিট ঝড় ঠেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল মানুষজনকে উদ্ধার করতে। গাছগুলো সব রাস্তায় আছড়ে পরছিল,আর আমার ইউনিট ওগুলো পরিষ্কার করে করে এগুচ্ছিল। ঝড় থামার জন্য অপেক্ষা করেনি তো। পরোয়া করেনি তো নিজের জীবনের? কে করবে এসব? আপনি? ন্যাশনাল আইডি কার্ড থেকে ফ্লাইওভার, দুর্গম সব জায়গার রাস্তাঘাট, কে করবে এই বাহিনী ছাড়া? আপনি? সেনাবাহিনী ছাড়া কোন অর্গানাইজেশন সময়মত কোন অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করেছে বলবেন কি? যেখানে আর সবাই থেমে যায়, ব্যার্থ হয়, আর্মি শুরু করে সেখান থেকেই।।আর এই আর্মি সাফল্য আর সম্মান ছাড়া দেশকে আর কিছু দেয়নি। এই আর্মি দেশের আর্মি, দেশের জন্য জান লড়িয়ে দেয়ার আর্মি। ব্যাপারটা ভুলবেননা। দেশের জন্য এই বাহিনীর প্রতিটা দিন কাটে উদয়াস্ত কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। কারণ এই বাহিনী প্রস্তুত, এরা লাশ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দেশ ও দেশের মানুষের গায়ে আঁচড় লাগতে দেবেনা, তা যতই গালাগাল আপনি দেন না কেন।
দেশ, যুদ্ধ, আত্মত্যাগ, এসব বাইরের মানুষের কাছে কেবল একটা পাঞ্চ লাইন। বুলি। তাই সবশেষে বলব, আর্মির বিষদগার করার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলেন, হাতে একটা অস্ত্র নিন, তারপর পাহাড় আর জংগলের মাঝে কোন এক পোস্টে দাঁড়ান পাহাড়া দিতে। লোডেড রাইফেল। প্রস্তুত ফায়ারের জন্য।যখন জানবেন নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে গুলির প্রথম শব্দটা হয়ে যেতে পারে আপনার জীবনের শেষ শব্দ, তখনই বুঝবেন, কোনটা পাঞ্চলাইন আর কোনটা বাস্তবতা। কিংবা চলেন পেট্রলিংয়ে, ক্যাম্প থেকে দূরে ওই ঘন পাহাড় আর জংগলের মধ্যে, যেখানে গুলি খেলে হেলিকপ্টার দিয়েও উদ্ধার সম্ভব না, এমন জায়গায় যখন হঠাত বৃষ্টির মত গুলি নেমে আসবে, গুলির আঘাতে আশেপাশের গাছের ডালপালা আর মাটির টুকরো ছিটকে ছিটকে এসে পরতে থাকবে গায়ে, তখনই বুঝবেন, কোনটা পাঞ্চ লাইন আর কোনটা বাস্তবতা। ফেসবুকে এত গালাগাল দিচ্ছেন, চলেন না একটা ক্যাম্পে, ইলেক্ট্রিসিটি নেই, পাহাড়ি ছড়ার পানি খাবেন, বৃষ্টির সময় যদিও ঘোলা হয়ে যাবে, তারপরও বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট ছেড়ে চোখ নাক বন্ধ করে খেয়ে ফেলবেন। বর্ষায় হেলিকপ্টার রেশন নিয়ে আসতে পারবেনা প্রায়ই, ক্যাম্পের আসে পাশের কচু শাক খেয়ে থাকতে হবে। ক্যাম্পের বেড়ার ব্যারাক, ঝড়বৃষ্টিতে প্রায়ই চাল উড়ে যাবে, ওগুলো আবার খুঁজে এনে ঠিকঠাক করে নিয়ে থাকতে হবে এই আরকি। মোবাইল নেটওয়ার্ক ও না থাকতে পারে। এমন অনেক ক্যাম্পই আছে। তো ফেবুর সাথে ডিভোর্স তো বটেই, পরিবার পরিজনদের সাথেও দুটো কথা বলতে পারবেন না দিনের পর দিন। পাঞ্চ লাইন!!!
এতক্ষন যা বললাম, ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললাম। একদম তরতাজা অভিজ্ঞতা। সবাই আর্মি হতে পারেনা। এর জন্য গাটস লাগে, লাগে যোগ্যতা, লাগে সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা। লাগে রক্ত পানি করা পরিশ্রম আর প্রশিক্ষন। লাগে চোয়ালবদ্ধ সংকল্প। তাই, সেনাবাহিনীর সমালোচনা করার আগে নিজের দিকে তাকান, চারপাশে থাকান, দুইদন্ড ভাবুন, তারপর কিছু বলার থাকলে, সম্মানের সাথে মার্জিত ভাষায় বলবেন।
তনু হত্যার বিচার আমিও চাই। হত্যাকারী যেই হোক, নিজে ফায়ারিং রেঞ্জে নিয়ে ট্রিগারটা চাপতে চাই। কোন সন্দেহ নাই।
সবশেষে বলব, রেপ কে না বলুন, হত্যা কে না বলুন, সেনাবাহিনী কে না।