আর এই পার্থক্যকে পুঁজি করে যে বৈষম্যের সূত্রপাত, সেটা কি ‘ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি’, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নাকি ‘সমাজ কাঠামো কর্তৃক মননের উপর প্রথিত প্রভাব’?
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ, এখানে সকল সম্প্রদায় মিলেমিশে বাস করে। কোন প্রকার নির্যাতন বা অত্যাচারই হয় না। যার যার ধর্ম সে পালন করে শান্তিপূর্ণ ভাবে। - এই কথাগুলি বলার সময় আমাদের বুক নির্ঘাত একহাত ফুলে যায়। এবার একটু ভিতরে যাই। যাই আমজনতার জীবন যাপনের কাতারে।
৮মে, ২০১১ :: খাগড়াছড়ি জেলায় মানিকছড়ি উপজেলার অন্তর্গত হাফছাড়ি ইউনিয়নে ‘স্থানীয় বাঙালি’ কর্তৃক মারমা জনগোষ্ঠীর ভূমি দখলের পাঁয়তাড়া। একই সময়ে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় ত্রিপুরা গোষ্ঠীর বাসভূমি দখলে উদ্যোক্তা হন চেয়ারম্যান নূর ও প্রাক্তন চেয়ারম্যানের ভাই মো: শামশু।
১৩মে, ২০১১ :: ১১ বছরের জুম্মা কিশোরী ধর্ষিত ও ধর্ষনের পর হত্যাকাণ্ড। ঘটনাটি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনলা উপজেলার বোয়ালখালি ইউনিয়নের। একই বছরের ১৪ এপ্রিলও এই কিশোরীর উপর attempt of rape সংঘটিত হয়! সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটিকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি প্রশাসনের। আর নামে বেনামে ঘটে যাওয়া ঘটনায় প্রশাসন তো নীরব থাকেই।
১৩জুন, ২০১১ :: ২০০ বছরের পুরাতন ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে শিবমূর্তি ভাংচুর। আক্রান্ত এলাকা- নড়াইল সদর।
২৭ জুলাই, ২০১১ :: ১৩ বছরের আরেক জুম্মা কিশোরী ধর্ষিত। ধর্ষক আব্দুল মজিদের মুক্তির দাবিতে ‘বাঙালি ছাত্র পরিষদ’ বাঘাইছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা-র বাসভবন ঘেরাও করে !!! ঘটনার বিশ্লেষণ এরূপ- আব্দুল মেয়েটিকে ৫০টাকা হাতে দিয়ে যৌনমিলনে আহ্বান জানালে মেয়েটি তা প্রত্যাখান করে। আর তারপর নিষ্পাপ বালিকা শিকার হয় ধর্ষনের।
আর নতুন পাওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে, নওগাঁর আওয়ামী সংসদ সদস্য এম. এ. জলিল, তার সমর্থকদের নিয়ে ভাংচুর করে দুশো বছরের পুরনো ‘রঘুনাথ মন্দির’। এই মন্দিরের সম্পত্তি দখলপূর্বক সেখানে ‘মার্কেন্টাইল ব্যাংক হসপিটাল’ গড়ার পাঁয়তাড়া চলছে।
শুধুমাত্র এই হাতে গোণা কয়টি তথ্যই আমাদের কি নিদারুণ বিভীষিকার সামনে উপস্থিত করছে! আরো আরো অনেক তথ্য পেশ করা যায়, কিন্তু তথ্যভাণ্ডারের বিপুলতা আমাকেই ভীত করছে।
শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরিসংখ্যানই যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যায়-
পূর্ব বাংলায় ১৯০১ সালে হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণ ৩৩%, ১৯৪১ এ সেটা কমে দাঁড়ায় ২৮%, ১৯৫১ সালে সেটা কমে আসে ২২% (দেশবিভাগের দরুন), ১৯৭৪ এ সেটা হয় ১৩.৫%। আর সর্বশেষ জানামতে ২০০১ সালে এই পরিসংখ্যান এসে ঠেঁকে ৯% (!) তাহলে এখন যে কি অবস্থা সেটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন বা নিউটন হবার প্রয়োজন নাই। পাশাপাশি অন্য সংখ্যালঘু(!)দের অবস্থা তো আরো শোচনীয়। তাহলে যারা বিঁভুই পাড়ি দিচ্ছে তারা সকলেই কি নিজের দেশ স্বেচ্ছায় ছাড়ছে? তারা কি অন্যান্য দেশকে নিজের দেশ ভাবছে? নাকি- এই ধর্মান্ধ কাঠামো তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে এই মানসিকতার দিকে? একটি উগ্র ধর্মান্ধ অনুভূতির শোষণের শিকার এরা? ভাবা প্রয়োজন এখনই।
বাংলাদেশে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে যে কয়েকটি রিপোর্ট পাওয়া যায় (এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ) তারাও প্রত্যেকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পেশ করেছেন।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘু(!) সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন চলে তা এককথায় বর্বর, মধ্যযুগীয়। দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নির্বাচনী এলাকায় স্লোগানের রূপ এমনও ছিল যে ‘এবারের লড়াই, হিন্দু আর মুসলিমের লড়াই!’ এই হল আমাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রকাশ। যারা মনে মনে আওয়ামী করেন বলে সন্তুষ্টির ঢেঁকুড় তুলছেন তাদের জন্য উপরের কয়েকটি তথ্যই যথেষ্ট, যেগুলো কিনা শুধুমাত্র ২০১১ তে সংঘটিত নির্যাতনের কিছু অংশ- সামগ্রিক নয়! নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের উপর অকথ্য বর্বরতা চালানো হয় কিনা তা একজন সংখ্যালঘু ছাড়া যে কারো জন্যই জানা ও বোঝা কষ্টসাধ্য। একদিকে গণমাধ্যমের নির্বিকারতা, আরেক দিকে আমাদের সংখ্যাগত সেন্টিমেন্ট আমাদেরকে ঠেলে দেয় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের দিকে! আসলেই তা কতটুকু সত্য সেটা খুঁড়লে রীতিমত সাপ বেরিয়ে আসে!
২০০১ এর অক্টোবরে ভোলার চরে হিন্দু জনপদের উপর ধর্ষণ, হত্যা আর লুটপাটের যে নারকীয় উল্লাস চলেছিল সে খবর কয়জন রাখে? আশেপাশের জলাশয়ে সম্ভ্রম রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়া কিশোরী-যুবতী-গৃহবধুরা যখন নিজের ভাই, সন্তান, বোনের জীবন বাঁচাতে পুনরায় ডোবা থেকে উঠে আসতে বাধ্য হয়েছিল, বাধ্য হয়েছিল বর্বরতার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে- তখনকার খবরে কারও কি বুক কাঁপে? যখন একজন মা ধর্ষকদের কাছে মিনতি জানায়, ‘বাবারা একে একে যাও, আমার মাইয়াটা ছোট!’ তখন আমরা অসাম্প্রদায়িকতার সোফায় হেলান দিয়ে থাকি, আর ওই মা যখন ভিনদেশে পার হবার কথা মনে করে তখন আমরা বলি, ‘ওই মহিলা আসলে এই দেশরে নিজের মনে করে না!’ কি অবাক করা আমাদের এই মেনে নেওয়া, অবাক করা আমাদের নীরব অভিনয়ে অসাম্প্রদায়িকতা। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, এই অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন দেশেও ১০বছর অতিবাহিত হলেও এরা ন্যায়বিচার পায় নি! ৯% এর অন্তর্ভুক্তির জন্য কাঠামোব্যবস্থার কি নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচারের শিকার এরা।
এতক্ষণ উল্লিখিত FACTS & PROBLEMS এর পর এবার দেখা যাক কেন এরূপ মানসিকতার উদ্ভব? মানসিকতা কি ব্যক্তির? নাকি ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন? এই দুইটি যদি উত্তর ধরে নেই তাহলে আসলেই আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িক! কিন্তু স্বীকার করুন আর নাই করুন, রাষ্ট্রকাঠামো মানুষের মননের উপর প্রভাব ফেলেই। স্বার্থবাদী রাষ্ট্র যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এ হল সংখ্যাগুরু আর এ হল সংখ্যালঘু, তখন শোষণ অনিবার্য। ধর্ম নামক সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে ব্যবসা আর রাজনীতি এখন common একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবিধানের মতো স্থানে সংখ্যাগত ধারনার উপর ভিত্তি করে কাউকে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, কাউকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানো হচ্ছে। অর্পিত সম্পত্তি আইন নামক একটি কালাকানুন এখনও রেখে দেয়ার পাশাপাশি বলা হচ্ছে দেশ অসাম্প্রদায়িক! এটি প্রহসন ছাড়া আর কি!? সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দিয়ে, সংবিধানের প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহ’ রেখে বলা হচ্ছে সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ! শিক্ষানীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের পরিবর্তন ঘটিয়ে সেই স্থলে বসানো হয়েছে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’। অথচ এই বিষয়গুলি কি মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ INJECT করে না? লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শাসকগোষ্ঠী এই অসাম্প্রদায়িক(!) কথাগুলি বললেও সাম্প্রদায়িক নিপীড়নে তারাই অংশ নেয় নেতৃত্বদানকারী হিসেবে! সেটা আওয়ামী হোক, বা বিএনপি, জামাত, এরশাদ! একইভাবে আদিবাসী সংস্কৃতি ও অধিকার প্রশ্নেও নীরব শাসকগোষ্ঠী। কেউ বলেন, দেশে আদিবাসী নেই, সবাই বাঙালী! কেউ আবার আদিবাসীদের বাঙাল হবার আহ্বান জানান! তাদের এই ফ্যাসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি কি আদিবাসীদেরকে অকথ্য নির্যাতনের দিকে ঠেলে দেয় না? সমাজের স্তরে স্তরে কি আদিবাসী প্রশ্নে বাঙালীয়ানার জাত্যাভিমান গড়ে তোলে না? তোলে এবং অবশ্যই তোলে।
আমরা আমাদের দেশকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে আরো একটি উদাহরণ দেই- পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকাতে বলি। আমরা বলি, তাদের তুলনায় তো কিছুই হয় না। আমি একটি জিনিস বুঝি না, যারা এই প্রসঙ্গ টেনে আলোচনার মর্মবস্তু এড়িয়ে যেতে চান, তারা আসলে কি চান? মোদ্দা কথাটাই বা কি? ব্যাপরটা কি এরূপ যে- ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ছায়া আছে বলে বাংলাতেও তা থাকতে হবে!? এর মাধ্যমে কি আমরা সংখ্যালঘু নির্যাতনকে justify করার হীন প্রয়াসে লিপ্ত হই না??? এই তুলনাভিত্তিক উদাহরণ টেনে আলোচনার সমাপ্তিপূর্বক আমরা যে সাম্প্রদায়িকতার চারার গোড়ায় জল ঢালি- সেটা কি আমরা বুঝি??? ভারতসহ সকল দেশেই ধর্মগত পার্থক্যের দরুন শোষিত সাধারণের মুক্তি চাওয়াটাই কি আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়???
শোষণের মাথায় ছাতা দিতে আমরা এও বলে থাকি- শোষকরা শিক্ষিত নন! অর্থাৎ ‘শিক্ষা নেই’ নামক অপ্রাসঙ্গিকতার অবতারণা করে আমরা রাষ্ট্রধর্ম ও আদিবাসী প্রশ্ন এড়িয়ে যাই এবং একই সাথে শোষিতের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার এক দুর্দান্ত অভিনয় করি। আদিবাসী কিশোরী ধর্ষন ও হত্যাকারী আব্দুল মজিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ‘বাঙালি ছাত্র পরিষদ’! ছাত্ররা নিতান্তই অশিক্ষিত নন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নপূর্বক খুব ভালোভাবে অবগত কিছু ছাত্রের মানসিকতার সাথে যারা মনে করেন- সংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু ধারণা ঠিকই আছে, মনে করেন- দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হলে সমস্যা কি! অথচ এতটুকু বিশ্লেষণী ক্ষমতা তাদের নেই যে, সমাজে এই ধারনার বিরূপতা কি!? স্তরে স্তরে এই ধারণা কি করে বৈষম্যের ডালপালা মেলে!? আর বাদবাকি শিক্ষার্থীদের ভূমিকাটা নিতান্ত অভিনয়ভিত্তিক যেটা আগেই বলেছি। (৫-৬% প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ বাদে)। যেখানে ব্যাপক ছাত্রজনতার ভিতরই এই কাঠামো অন্ধত্ব inject করতে সক্ষম, সেখানে আমজনতার ভিতর তা কতখানি সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছড়াতে পারে ভাবুন!
তাহলে এই ঘরানার পার্থক্যকে পুঁজি করে যখন কাঠামোব্যবস্থা বৈষম্যের সূত্রপাত করে, সাধারণের মাঝে শুধুমাত্র ধর্মীয় পার্থক্য কে কেন্দ্র করে একটি বিবাদময় পরিস্থতি সৃষ্টি করে বা সাধারণকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে- সেটা আসলে কার সুবিধা? আমাদের নাকি শোষণকারীর? আমাদের কি উচিত নয় এই ধর্মীয় বৈষম্যের বিপক্ষে লড়া? বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা শিক্ষার দোহাই দিয়ে subject এড়িয়ে যাওয়া কি কাপুরুষতা বা নিজের হীনমন্যতা চরিতার্থ করা নয়? সেই সিদ্ধান্ত নিতান্তই আপনার। শুধু এতটুকু বলা যায়, একদিকে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে সম্বল করে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক গোষ্ঠী, আরেকদিকে আমাদের জনগণের নীরবতা, অসাম্প্রদায়িকতার লেবাশ- ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী নির্যাতনের পথ করে সুপ্রশস্ত, মননে আর চিন্তায় এই রাষ্ট্রকাঠামো সুকৌশলে বুনে চলে সাম্প্রদায়িকতার বীজ।
সুমনের একটি গানের কয়েকটি লাইন মাথাচাড়া দিচ্ছে ::
“.......
আমি দেশ ভেঙে ভেঙে দু’খান করেছি- হিন্দু মুসলমানে!
মুখের ভাষায় দেয়াল তুলেছে ,এই জল ওই পানি।
আমি সবই মানি, সবই মানি ... শুধু মানি না যখন রহিম পরাণ ভায়েরা মুক্তি চায় ...
তারা দুবেলাই খেতে চায় ।
আহা, পাকস্থলিতে ইসলাম নেই, নেই কো হিন্দুয়ানী।
আহা, পাকস্থলিতে ইসলাম নেই, নেই কো হিন্দুয়ানী।
তাতে যাহা জল তাহা পানি ......”
বৈষম্যের দেয়াল ভাঙো সাধারণ। শীর্ষে তোল মানবতার ঝাণ্ডা।।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




