ট্যাবলেট পিসি বানাবে টেশিস
সাশ্রয়ী মূল্যের দেশী ব্রান্ডের ল্যাপটপ দোয়েল সর্বসাধারণের হাতের নাগালে না পৌঁছলেও এবার ট্যাবলেট পিসি উৎপাদনের কাজ শুরু করছে টেলিফোন শিল্প সংস্থা –টেশিস। এজন্য ইতিমধ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার দরপত্র খোলার পর দোয়েল ল্যাপটপের চলমান সঙ্কট হ্রাসের পাশাপাশি শুরু হবে নতুন এ প্রকল্পের কাজ।
বাজারে দোয়েলের আকাল, বিদ্যমান ল্যাপটপগুলোর নানা ক্রটি, হার্ডডিস্ক সঙ্কটে উৎপাদন বন্ধ থাকা এবং বাজার চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য পদেক্ষেপ সম্পর্কে আলাপকালে এসব কথা জানিয়ছেন টেশিসের মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যান্ট) আ আ মো. মোয়াসির।
বার্তা২৪ প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নিজেদের নানা সীমাবদ্ধতা এবং অপারগতার সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে তিনি জানান, ‘‘এমন একটি বৃহৎ প্রকল্পে আমরা একেবারেই নতুন। বাংলাদেশে এর আগে এতো বড় পরিসরে প্রযুক্তি খাতে কোনো কাজ হয়নি। ফলে প্রথম পর্যায়ে আমরা অনেক কাজই জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী করতে সক্ষম হইনি। তবে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হয়নি। এজন্য আমরা এখাতে সকলের সহায়তা কামনা করি। আশা করছি চলতি বছরের মাঝামাঝি আমরা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবো।’’
আর এ জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আশা করছি আগামী জুলাই মাস নাগাদ আমরা ল্যাপটপের চেয়েও কম মূল্যে ট্যাবলেট পিসি বাজারে ছাড়তে সক্ষম হবো। সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে।’’
দোয়েল ট্যাবলেট পিসির দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলে, ‘‘আশা করছি এগুলোর দাম ১০০ ডলার কিংবা নয় হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।’’
কিন্তু দোয়েল ল্যাপটপই তো এখনো সর্বসাধারণের হাতের নাগালে পৌঁছেনি এমন পরিস্থিতিতে আবার ট্যাবলেট পিসি উৎপাদনে যাওয়াটা কি প্রহসন নয়, এমন প্রশ্নের জবাবে টেশিস মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যান্ট) বলেন, ‘‘দোয়েল ল্যাপটপ সাধারণ মানুষের হতে পৌঁছে দিতেই টঙ্গীর টেশিস উৎপাদন কারখানা ছাড়াও ইতিমধ্যে আমরা গুলিস্তানের বিটিসিএল এক্সচেঞ্জ ক্যাম্পাস রমনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের দ্বিতীয় তলায় একটি সেলস সেন্টার চালু করেছি। আগামী মাসে শেরেবাংলা নগর টেলিফোন ভবন থেকেও এর বিক্রির কাজ শুরু হবে। একই সঙ্গে ঢাকার বাইরেও বিক্রি শুরুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’’
টঙ্গী এবং রমনা বিক্রয় কেন্দ্রের কোথাও তো দোয়েল প্রাইমারি মডেলের ল্যাপটপ পাওয়া যাচ্ছে না এমন অভিযোগ স্বীকার করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়ে লিখেছেন, দোয়েল ল্যাপটপ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। আসলে উৎপাদানের কাজ বরাবরই সচল রয়েছে। মূলত সংসদীয় কমিটির সুপারিশের কারণেই সাময়িকভাবে প্রাইমারি মডেলের দোয়েল ল্যাপটপ বাজারজাত না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। আর ল্যাপটপটি অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম হওয়ায় এবং এটা আমাদের দেশে ব্যবহারবান্ধব না হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, ১০ হাজার টাকা ল্যাপটপে (প্রকৃত দাম ১০ হাজার ৮০০ টাকা) বেশি সমস্যা দেখা দেয়ায় এটির উৎপাদন ভবিষ্যতেও আর করা হবে না।
অবশ্য এ বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে টেশিসের মহাব্যবস্থাপক জানান, টেশিশের বোর্ডসভায় ২৩ হাজার পিস হার্ডডিস্ক ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়েছে। তবে অন্তবর্তীকালীন সংকট মেটাতে ৭ হাজার পিস হার্ডডিস্ক ক্রয় করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, সেকেন্ডারি মডেলের জন্য (দাম ১৩,৫০০ টাকা) ৫ হাজার এবং অ্যাডভান্স মডেলের জন্য (দাম ২৬ হাজার ৮০০ টাকা) ২ হাজার হার্ডডিস্ক ক্রয় করা হবে। বোর্ড সভায় সেকেন্ড অ্যাসেমব্লিং লাইন (কনভেয়ার বেল্ট) ক্রয়েরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব শিগগিরি কনভেয়ার বেল্ট এলে ল্যাপটপের উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে টেশিস কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, গতবছর থাইল্যান্ডের বন্যায় সে দেশের হার্ডডিস্ক শিল্প-কারখানায় পানি ঢুকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিশ্ববাজারে হার্ডডিস্কের সংকটের কারণে বাংলাদেশ টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) দোয়েলের উৎপাদন কাজেও প্রভাব পড়েছিলো। দোয়েল ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা চীনা কোম্পানি ইয়াং মিল ওয়ার্ল্ড টেকনলোজি সম্প্রতি স্বল্প সংখ্যক হার্ডডিস্ক পাঠিয়েছে। উৎপাদন কাজ ১৫ থেকে ২০ দিন বন্ধ থাকার পর গত ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই পূর্ণোদ্যমে অ্যাসেম্বেল কাজ চলছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রথম স্লটে ১০ হাজার ৭০০ হার্ডডিস্ক আমদানি করা হয়। ওই হার্ডডিস্কের মজুদ শেষ হয়ে গেলে চীনা প্রতিষ্ঠানের ৪ হাজার ৫০০ হার্ডডিস্ক পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পাঠিয়েছে এক হাজার ৭০০ পিস হার্ডডিস্ক। টেশিস এই সংখ্যক হার্ডডিস্ক গ্রহণ করবে কি করবে না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে। অবশেষে এই সংখ্যক হার্ডডিস্কই ছাড় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে স্বল্পমূল্যের কারণে দোয়েল ইতিমধ্যেই ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও মোটেই স্বস্তিতে নেই ব্যবহারকারীরা। অপারেটিং সিস্টেম কাজ না করা, অল্প ব্যবহারে ল্যাপটপ গরম হওয়া, জিপিআরএস মডেম ব্যবহারে সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোয়েল ব্যবহারকারী জানান, দোয়েল অল্প সময় ব্যবহার করলে অনেক গরম হয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছে।
তিনি জানান, তার এক বড় ভাই দোয়েল ব্যবহার করতে না পেরে তার কাছে রেখে গেছেন। তিনি যেহেতু দোয়েল ব্যবহার করছেন, তাই কারা কারা এটি ব্যবহার করছেন সেসবেরও খোঁজ রাখেন তিনি। তিনি বলেন, অনেকেই অভিযোগ করেছেন। কেউই দোয়েল ব্যবহার করে সন্তুষ্ট নন। তাদের দোয়েল মোহ কেটে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আ আ মো. মোয়াসির বলেন, ‘‘ল্যাপটপ যত গরম হোক না কেন, কোনো সমস্যা নেই। হিটসিঙ্ক আছে। ওটা তাপ নিয়ন্ত্রণ করবে।’’
মডেমের বিষয়ে তিনি বলেন, এর সফটওয়্যারে সমস্যা আছে। আমরা গ্রামীণফোনের সঙ্গে আলাপ করেছি। এটার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি জানান, আমরা দোয়েলের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি। শিগগিরই এসবের সমাধান করা সম্ভব হবে।
তারপরও দেশি ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ ‘দোয়েল’ নিয়ে দেশের সাধারণ প্রযুক্তিপ্রেমীদের প্রত্যাশা বাড়ছেই। বাস্তবে এ ব্র্যান্ড নিয়ে তৈরি হয়েছে গ্রাহক হতাশা। চারটি মডেল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এরই মধ্যে সবচেয়ে কমমূল্যের ‘দোয়েল-২১০২’ মডেল কার্যত বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে। কেবল উদ্বোধনের জন্য এই মডেলের হাতে গোনা ১০টি স্যাম্পল পিস তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ৫টি বণ্টন করা ছাড়া একটিও আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রি করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে টেশিস।
কিন্তু দোয়েল উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ সংস্থা টেশিস দোয়েল বিক্রির জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া না হলেও প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার এর স্বত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠান আনন্দ কম্পিউটার্স এর মাধ্যমে বাজারে টেশিস ছাড়াও দোয়েল বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগের পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুইটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিজেদের দায় স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর থেকে সরকারের নির্ধারিত দুইটি আউটলেট থেকে দোয়েল ‘অ্যাডভান্সড-১৬১২’ মডেল ২৬ হাজার ৮০০ টাকা (কালো রঙ) এবং দোয়েল ‘স্ট্যান্ডার্ড-২৬০৩’ মডেল ২০ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোয়েল ল্যাপটপে বিপণন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এরপরই ১০ হাজার টাকায় স্বল্পসংখ্যক নেটবুকের বিতরণ শুরু হলেও কার্যত এর নাগাল পায়নি সাধারণ মানুষ।
বার্তা২৪ ডটনেট