somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দর্শনা হল্ট স্টেশনে একরাত

০১ লা মার্চ, ২০১৯ রাত ৮:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দর্শনা হল্ট স্টেশন। গভীর রাত, আমরা পাঁচজন বসে আছি, গন্তব্য সৈয়দপুর অভিমুখী। কেউ কাউকে চিনিনা। দূরে অদূরে আরও অনেকে বসে আছে। কোনো নিরাপত্তা প্রহরী কিংবা ডিউটিরত পুলিশ নেই। বাংলাদেশ পুলিশের জি আর পি ফাঁড়ি আছে, তবে দরজা বদ্ধ। স্টেশনে কোনো স্টেশনমাস্টার নেই (হয়তো দরজা বন্ধ করে ভিতরে আছেন)। ট্রেন কখন আসবে কেউ সঠিক সময় জানে না। সবাই ধারণার উপর ঢিল ছুড়ছে।

কিছুক্ষণ আগেই আব্বা এসেছিল আমাকে রাখতে। আমাকে ছেড়ে যাবেই না। আমি জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম।

দর্শনা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং দর্শনা হল্ট স্টেশনও অতি পুরোনো একটি স্টেশন। এই স্টেশন ছাড়াও দর্শনাতে আরও একটি আন্তর্জাতিক রেল স্টেশন রয়েছে।

পাঁচজন মানুষ বসে আছি, গল্প করি, লুডু খেলি। আমাদের ট্রেনের সময় ছিল রাত ১১.২৪ মিনিট। রাত ২টা বাজে এখনো ট্রেন আসেনি। আমাদের সাথে আরও কিছু প্রাণী কোনোমতে পড়ে আছে। কিছু ছিন্নমূল মানুষ কমদামি কম্বলের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে যাদেরকে প্রায় সবসময়ই এই স্টেশনে দেখতে পাওয়া যায়।

আমাদের গল্প বাড়ে রাতও বাড়তে থাকে। আমাদের সাথে যোগ দেয় স্টেশনে অবস্থানরত একজন অর্ধ বিকারগ্রস্ত মধ্যবয়সী পুরুষ। তিনি জানান, ১৯৯২ সালে তিনি এসএসসির ক্যান্ডিডেট ছিলেন, ম্যাট্রিক পাস মানুষ। যোগাযোগের অভাবে চাকরি হয়নি তবে খুব শীঘ্রই চাকরি হয়ে যাবে। তিনি বিকেলে ঘুমান আর সারারাত জেগে থাকেন। যখন ট্রেন আসে তিনি স্টেশন সংলগ্ন রেলগেটের গেট ফেলে দেন, ট্রেন চলে গেলে তুলে দেন।

লোকটা বলতে শুরু করে, যদি এই গেটে একজন গেটম্যানের চাকরি পায় তবে সেটা আমি। আমি সবার সাথে কথা বলে রেখেছি চাকরি আমার নিশ্চিত। চাকরিটা পেলে আমি বিয়ে করে ফেলবো। আমরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, আপনি এখনো বিয়ে করেননি?
বিয়ের ভাগ্য এখনো হয়নি, তবে খুব তাড়াতাড়ি চাকরি পেলেই বিয়ে হবে। চাকরি পেলে লোকে বলবে রেলস্টেশনে চাকরি করে বিয়ে করাই যায়।

প্রচন্ড শীত। শীতের কামড় সহ্য করে বসে আছি। কখন ট্রেন আসবে ঠিক নেই। রাত ৪ টা বাজে। সবার ঘুম কেটে গেছে, শুধু একজন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। মশার কয়েলের ধুয়ায়  বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে, তবুও মশার হাত থেকে নিস্তারের কোনো উপায় নেই। শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে সিগারেটের পালাবদল চলে। সিগারেটের ধুয়ায় আমার শরীরে নেশা জাগে, নেশা প্রকট থেকে প্রকট হতে থাকে। শুধুমাত্র প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের অপরাধবোধ থেকে সিগারেট ছুঁই না।

কয়েকজন মহিলা আর ছোটছোট বাচ্চা পাশের কোনো চেনাপরিচিত বাড়িতে গিয়েছিল ফ্রেস হতে। ওরা এসে আবার ট্রেনের অপেক্ষায় বসে পড়ে। আমাদের অপেক্ষার পালায় ক্লান্তি আসে। কয়েকটা ভ্যানচালক হাঁটাহাঁটি করে, কখন ট্রেন আসবে, কিছু লোক পেলে তারা যাত্রীর গন্তব্যে রওনা হবে।

লোকটা বলতে থাকে, আমি সারারাত জেগে থাকি। বিকেলে ঘুমাই রাতে জাগি। লোকেদের ব্যাগবোঁচকা মাথায় নিই, আবাসিক হোটেল দেখিয়ে দিই, পথ চিনিয়ে দিই এসব করে ২০/৫০ টাকা পাই। মাঝেমধ্যে ২০০ টাকাও হয়। যদি কাজ না পাই ভিক্ষে চাই। তবে চাকরি পেয়ে গেলে আর ভিক্ষে করবো না। চাকরি পেয়ে গেলে আমি ম্যালাগুলো টাকা পাবো, তখন আর ভিক্ষে করা লাগবে না।

লোকটা আরও বলে, আমার কোনো বাজে নেশা নেই, শুধু বিড়ি খাই। আমরা জিজ্ঞেস করি, কতোগুলো বিড়ি খান? দিনে তিন প্যাকেট। প্যাকেটে ২৫ টা করে বিড়ি থাকে। কেউ বিয়ে করলে বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দেবো। আমার তো দাঁত নেই, কী আর খাবো? বিড়িটা ভালোমতো খেতে পারি।

একটু ঘুরেফিরে দেখা গেলো একজন গেটম্যান কর্মরত আছেন তবে গেটম্যান বের হওয়ার আগেই গেট ফেলা আর তোলার কাজটি সেরে ফেলেন মধ্যবয়সী লোকটা। লোকটার এমন কর্মকাণ্ড বুঝিয়ে দেয় লোকটা পাগল। তবে তার চেয়ে বড় পাগল আমরা যারা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। রাত ৪.৩০ মিনিট। এখনো ট্রেন আসেনি।

আগের দিনের ৯টার ট্রেন পরের দিন ৯টায় আসার গল্প বহুবার শুনেছি, বিশেষকরে যারা দেশকে অপছন্দ করে তাদের মুখে এধরণের গল্প শোভা পায়। আজ রাতটা আমাদের কেটে যাচ্ছে ট্রেনের অপেক্ষায়। ট্রেন কি আদোও আসবে, প্রশ্ন তোলে একজন। আরেকজন বলে, ট্রেন আসলেই হবে, সেটা আজ আসলো না কাল আসলো সেটা ব্যাপার না।

৬.০০ টা বাজে। আমি আবার একটা সকাল পেলাম। মা বাবা ছোট ভাইকে দেখতে ইচ্ছে করে। ছোট ভাইকে ফোন দিলাম। ও ঘুম থেকে উঠে সাইকেল নিয়ে স্টেশনে আসে। মা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে। সত্যিই আমার ক্ষুধা নেই। খাবার না খেয়ে আমি সাইকেল নিয়ে দ্রুত চলে গেলাম বাড়ি। ব্যাগের কাছে ছোট ভাইকে রেখে গেলাম। কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ি গিয়ে মা-বাবার সাথে দেখা করে আবার চলে আসলাম।

সকাল ৭.০০ টা বাজে। ট্রেন এসে পৌঁছাল স্টেশনে। আমি ট্রেনে উঠলাম। ছোট ভাইকে বললাম বাড়ি চলে যেতে।

© আলমগীর কাইজার
২৮.০২.২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৯ রাত ৯:০৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×