সুগন্ধী ও অতি মুল্যবান বনেদি মশলা হিসাবে জাফরান আমাদের সকলের কাছেই বেশ পরিচিত একটি শব্দ । জাফরানের আরেকটি নাম কুঙ্কুম বা কেশর, ইংরেজীতে বলে স্যাফরন saffron। বেগুণী রঙের জাফরান ফুল দেখতে খুবই সুন্দর ।
পৃথিবীর একটি অন্যতম দামী পুষ্পজাতীয় মসলা, ফুল হতেই এর উৎপত্তি। জাফরান তার সুবাস, ঔষধি, রঞ্জনবিদ্যা এবং প্রসাধনীগুণের জন্য জগৎ বিখ্যাত। অত্যন্ত মূল্যবান হওয়ায় জাফরানকে বাণিজ্যিক অঙ্গনে বলা হয় লাল সোনা ( রেড গোল্ড)।
জাফরান ফুলের সকল অংশেরই মুল্যবান প্রয়োগ উপযোগীতা রয়েছে । পরিণত জাফরান গাছে বেগুণী রঙের ফুল হয়। এই ফুলের ভিতরে থাকে লম্বা পরাগ দন্ড। এ দন্ডের রঙ হলুদ ও কমলা মিশ্রনে জাফরানি বর্ণের হয়।পরিণত ফুল শুকালেই এই দন্ড মশলা হিসেবে ব্যবহৃত করার জন্য ফুল থেকে আলাদা করা হয়। ১ পাউন্ড বা ৪৫০ গ্রাম শুকনো জাফরানের জন্য ৫০ থেকে ৭৫ হাজার ফুলের দরকার হয়, এক কিলোর জন্য প্রয়োজন একলক্ষ দশ থেকে একলক্ষ ৭০ হাজার ফুল।
পরাগ দন্ডের হলুদ অংশ ব্যবহৃত হয় রং তৈরীতে এবং ফুলের পাপড়িগুলি আরো বহুবিদ কাজে ব্যবহৃত হয়।
জাফরানের ইতিহাস
সেই প্রাচীন কাল হতেই ইউরুপ ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে জাফরান তার সুগন্ধ ও উজ্জ্বল রঙের এর জন্য গুরুত্বপুর্ণ পন্য হিসাবে গন্য ছিল । এ ফসলের আদিনিবাস গ্রীস। উল্লেখ্যযে প্রায় প্রায় চার হাজার বছর পুর্বে ( খৃষ্টপুর্ব ১৬ শতকে) আগ্নেয় ভস্মস্তুপে পরিনত প্রাচীন গ্রীস নগরী এক্রোতিরিতে খননকৃত প্রত্নতাত্বিক ভবনের দেয়ালে অঙ্কিত ফ্রেসকো শিল্প কর্মে সে সময়ের অনেক ইতিহাস্ই চিত্রিত হয়েছে ।
প্রত্নতাত্বিক সেই ভবনটির দেয়ালে অঙ্কিত ফ্রেসকো শিল্প কর্ম (fresco of the "Xeste 3" building):
দেয়ালে অঙ্কিত ফ্রেসকো শিল্প কর্মে জাফরান ফুল গাছঃ
জাফরান ব্যবহারের প্রথম চিত্রটি পাওয়া যায় প্রাক্-গ্রীক সংস্কৃতির ব্রোঞ্জ যুগের। ক্রীটের নোসোস প্রাসাদে পাওয়া জাফরান চাষের চিত্রে দেখা যায় মেয়েরা ও বাঁদররা জাফরান তুলছে। এজিয়ান দ্বীপ সান্টোরিনির আক্রোতিরি খননের সময়ে " জেস্ট-৩" ভবনে পাওয়া যায় ফ্রেস্কোচিত্রের নিদর্শন , গ্রীকরা একে "থেরে" বলত। এই চিত্রগুলি সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দীর। চিত্রগুলিতে এক মিনোয়ান দেবীকে দেখা যায় ঔষধ তৈরী করার জন্য জাফরান ফুল তুলছেন ও পরাগমুন্ড পরিষ্কার করছেন।
এইস্থানের আরেকটি ফ্রেস্কোচিত্রে জাফরান দিয়ে নিজের রক্তাক্ত পায়ের শুশ্রূষা করতে দেখা যায় এক নারীকে।
এই ফ্রেস্কোগুলিতেই যেখানে প্রথম জাফরানের ওষধিগুণের উদ্ভিদ দ্বিদ্যাসম্মত দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে।
আদি গ্রীকদের উপকথামতে অনেক দুঃসাহসী নাবিক সুদূর সিলিসিয়া অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান জাফরান সংগ্রহ করার জন্য। হেলেনীয় রূপকথার ক্রোকাস ও স্মাইলাক্সের কাহিনী সবচেয়ে জনপ্রিয়। জলপরী স্মাইলাক্সকে ভালো লাগে সুদর্শন যুবক ক্রোকাসের। পরীকে সে যতই কাছে পেতে চায় না কেন, স্মাইলাক্স ধরা দেয় না। অ্যাথেন্সের নিকটবর্তী অরণ্যে তার প্রেমের সারল্যে অভিভূত হয় স্মাইলাক্স।
তবে ক্রোকাসের ভালোবাসা ফিরিয়ে না দিতে সে ক্রোকাসকে একটি গেরুয়া রঙের ফুলে পরিণত করে দেয়। গেরুয়া রং হল অনন্ত ও অস্বীকৃত প্রেমের প্রতীক :
ক্রোকাস ও স্মাইলাক্স পুষ্পে পরিণত হয়,
ঘন বর্ষণে কিউরেটিস জন্মায়
এমন কয়েকশো রূপকথা পার হই আমি,
এই চিত্তের মাধুর্যে যদি খুশি হও তুমি।
- ওভিড, মেটামর্ফোসেস্।
প্রাচীন, মিশরে ক্লিওপেট্রা জাফরান মিশ্রিত গরম জলে স্নান করতন আর প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার করতেন জাফরান।
চীন, গ্রীক ও রোমানরা মূলত সুগন্ধি হিসেবে জাফরান ব্যবহার করতেন। সম্রাট নীরু যখন রোমে এসেছিলেন সমৃদ্ধশালী রোমানরা রোজ জাফরান মিশ্রিত জলে স্নান করতেন ও দেবতার কাছে অর্পণ করতেন; মাস্কারা, সুরা ও সাজসজ্জাতেও তারা জাফরান ব্যবহার করতেন।
সুমেরীয়রা তাদের ওষুধ ও জাদুবিদ্যায় জাফরান ব্যবহার করে। তারা আরো বিশ্বাস করত দৈব মহিমাই জাফরানের ওষধিগুনের কারণ।
ইউরোপের অনেক দেশ যথা স্পেন , গ্রীস, তুরস্ক , আফ্রিকার মিসর , এশিয়ায় আফগানিস্থান ও চীন এ কম বেশি জাফরানের চাষ হতে থাকে। ভারতের কোন কোন অংশে বিশেষ করে কাশ্মীরেও এ ফসলের চাষ বিস্তার লাভ করে ।
পারশ্য উপসাগরীয় অঞ্চলে জাফরান
সেই প্রাচীন কাল হতেই পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলেও জাফরান তার সুগন্ধ ও উজ্জ্বল রঙের এর জন্য গুরুত্বপুর্ণ পন্য হিসাবে গন্য ছিল । জাফরানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ধীরে ধীরে গ্রীসের গন্ডি পেরিয়ে পারশ্য ( ইরান) বিস্তার লাভ করে ।জাফরানের ইতিহাস হতে জানা যায় যে পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরপূর্বে বর্তমান ইরাকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগেকার প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রে জাফরান-রঙে রঙিন পশুদের ছবি পাওয়া গেছে । তিন হাজার বছর আগেকার ইহুদিদের কাছে তনখে কেশর বা জাফরান একটি সুগন্ধি পন্য হিসাবে ছিল গন্য ।
সোলোমনের গীতিমালায় (সং অফ সোলোমন) দেখা যায়
তোমার ওষ্ঠে মৌচাকের মতো মধু ঝরে,
হে প্রিয়, জিহ্বাতলে ভাসে মিষ্টত্বের দুগ্ধ,
আর লেবাননী সুবাস আছে তোমার বস্ত্রে
গাল যেন তোমার ডালিম ফলের বাগান,
সে বাগানের ফল যেন ওষধি আর জাফরান,
সুদূর অতীতে দেবতাদের পূজায় অর্পিত হওয়া ছাড়াও জাফরান তার অসাধারণ হলুদ রং, সুগন্ধ ও ওষধিগুনের জন্য ব্যবহার হত।
চন্দনের সঙ্গে জাফরান মিশিয়ে তা স্নানের জলেও ব্যবহার করা হত। এশীয় মহাদেশে যুদ্ধে এসে সম্রাট আলেকজান্ডার ও তাঁর সৈন্যবাহিনী বহুল পরিমাণে জাফরান ব্যবহার করেন। জাফরান মিশ্রিত চা ও ভাত ছাড়াও, সাইরাস দ্য গ্রেট-কে অনুসরণ করে আলেকজান্ডার স্বয়ং জাফরান কেশর ছড়ানো জলে স্নান করতেন। সাইরাসের মতোই তিনিও জাফরানের ওষধিগুনে বিশ্বাসী ছিলেন। ম্যাসিডোনিয়ায় ফিরে যাওয়ার পরেও গ্রীকরা এই স্নানের রীতি বজায় রেখেছিল।
দক্ষিণ পুর্ব এশিয়া
পারসি নথিপত্র অনুযায়ী, অন্যান্য মশলার মতো জাফরানও পারস্য দেশ থেকে ভারতবর্ষে আমদানি করা হয়েছিল। ভারতীয় সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন উদ্যান ও পার্কে জাফরান গাছের ফলনের পরিচর্যা করা হতো । খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ফিনিসীয়রা নতুন কাশ্মিরী জাফরানের ব্যবসা শুরু করে বেশ লাভবান হয়।
কাশ্মীরি লোককথা অনুযায়ী একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে , দুইজন সুফি দরবেশ সর্ব জনাব খাজা মসুদ ওয়ালি ও হজরত শেখ শরিফুদ্দিন কাশ্মীরে এসে জাফরান চাষ ও ব্যবহার প্রচলন করেছিলেন। আদি চাইনিজ বৌদ্ধধর্মে ভারতে জাফরানের আগমনের আরেক কাহিনী প্রদান করে। খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এক ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মধ্যন্তিকা কাশ্মীরে যাত্রা করেন। তিনিই কাশ্মীরি জাফরানের প্রথম শস্যদানাটি বপন করেন ও সেখান থেকেই ভারত উপমহাদেশে জাফরান বিস্তার লাভ করে দাবী করা হয়। কয়েকজন ইতিহাসবিদদের মতে, মঙ্গোল আক্রমণকারীরা পারস্যদেশ হয়ে চিনদেশে জাফরান নিয়ে আসে। তবে খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক তৃতীয় শতাব্দীতে চাইনিজরাই জাফরানের কাশ্মীরি উৎস স্বীকার করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও জাফরানী রংগের বস্ত্র পরিধান করে ।
বর্তমানে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গ্রেট ব্রিটেনের উদ্যোগে আফগানিস্তানে আবার জাফরান চাষ চালু হয়েছে। হতদরিদ্র ও কপর্দকশূন্য আফগান চাষীদেরকে তাদের লোভনীয় ক্ষতিকর পপি চাষের বদলে জাফরান ফলাতে উৎসাহিত করছে । বাংলাদেশেও অতি সামপ্রতিক কালে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাপান হতে প্রায় ৪০০ শত জাফরান গাছের বালব নিয়ে এসে সফলভাবে এর থেকে ফুল ফুটাতে সক্ষম হয়েছেন ।
জাফরান একরকমের নির্বীজ ট্রাইপ্লোয়ড। বিশেষ ধরনের মিয়োসিস দ্বারা এর বংশবৃদ্ধি ঘটে। নির্বীজ ট্রাইপ্লোয়ড এর কারণে জাফরান ফল তৈরি করতে পারে না। যে কারণে এর বংশ বিস্তারের জন্য মানুষের সাহয্য প্রয়োজন হয়। ক্রোম তথা বালবগুলি মাত্র এক বছর পর্যন্ত বেচে থাকে এবং এর মধ্যেই এগুলিকে মাটিতে রোপন করতে হয়। বালব হতে চাড়া গজিয়ে বেড়ে উঠে ও তাতে ফুল ফোটায়
ছবি : বেষ্ট জাফরানী
ফুল হতে জাফরান কেশর প্রক্রিয়াকরন পদ্ধতি
পাপড়ী মেলা ফুলের পরাগদন্ড (স্টিগমা) সংগ্রহ করে তা থেকে জাফরান এর প্রাপ্তি ঘটে । প্রথম বছর রোপিত সব গাছে ফুল আসেনা, এ সময় প্রায় শতকরা ৪০-৬০ ভাগ গাছে ফুল আসতে পারে। মাত্র এক গ্রাম জাফরান পেতে প্রায় ১৫০টা ফুলের প্রয়োজন হয়। পরের বছর একেক গাছ থেকে প্রায় ২-৩টা করে ফুল দেয়। তবে তৃতীয় বছর থেকে প্রতি বছর জাফরান গাছ ৫-৭ টা করে ফুল দিতে সক্ষম।
এটা একটা ব্যয় বহুল ও প্রচুর শ্রম নির্ভর কাজ। একারণে এই দামী মসলা চাষে এখন অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু আমরা একটি অতি জনবহুল দেশ, কর্ম সন্ধানে বিপদের ঝুকি নিয়ে নৌকায় করে উত্তাল সাগর পারি দিয়ে, কেওবা দলালের হাত ধরে ভিটেমাটি বিক্রি করে পরিবার পরিজন ছেড়ে কাজের সন্ধানে বিদেশে পারি দিচ্ছি ,কেওবা আবার প্রতারনার শিকাড় হয়ে রিক্ত হস্তে দেশে ফিরে যার পরনাই দুরাবস্থায় পতিত হচ্ছি । তাই স্বল্পপুজিতে বাড়ীর উঠান সংলগ্ন খালী জায়গায় , খেতের আলে, ঘরের ছাদে , দেশের চড়াঞ্চলের বন্যামুক্ত উচুস্থানে বানিজ্যিক ভিত্তিতে এর চাষ করা যেতে পারে । চাষ প্রক্রিয়া অতি সহজ, এদেশের কৃষককুল দারুন প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশেও অনেক বিদেশী কৃষি পন্যের সফল চাষাবাদ করে চলেছেন । তাই এই শ্রম নির্ভর কিন্তু উচ্চ দামের ফসলের প্রতি কৃষকদেরকে আকৃষ্ট করতে পারলে দেশের গ্রামীন দরিদ্র জনগুষ্ঠির সকলের জন্য একটি লাভজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃস্টি হবে বলে একান্তভাবেই আশা করা যায়। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতার ।
জাফরানের ব্যাবহারিক ক্ষেত্র
খাবার সু-স্বাদু করার জন্য বিশেষ করে বনেদী পোলাও,বিরিয়ানি, কালিয়াতে জাফরানী রঙ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠানে জর্দা তৈরীতে ও তাতে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক রং আনতে জাফরান একটি অন্যতম উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয় । আমাদের দেশে জাফরান মূলতঃ ব্যবহার হয় জরদা নামের মিষ্টান্ন ও পায়েস তৈরিতে। অনেক পান বিলাসী এর পাপড়ি পানের সাথে চর্বণ করেন।
তবে খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহারের পুর্বে জাফরান কেশরকে গরম পানিতে ফুটিয়ে নীচের চিত্রের মত রংগীন নির্যাস তৈরী করে নিতে হয় ।
মুখমন্ডল আকর্ষণীয় করতে ও ত্বকের উজ্জ্বল রং আনার জন্য স্বচ্ছল সচেতন রমণীরা প্রাচীন কাল থেকেই জাফরান ব্যবহার করে আসছে। এখনকার বিউটি পার্লারেও রূপচর্চায় জাফরান অন্যতম উপাদান হিসাবে সমাদৃত। বনেদী পার্লারগুলোতে নান্দনিক সাজসজ্জায় এর রঙ মেহেদিও সাথে সংমিশ্রণে মোহনীয় উজ্জ্বল রং এর উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জাফরানী রঙ বিভিন্ন হারবাল ওষুধ প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হয় । জাফরান যেমন অর্থকরী একটি মসলা তেমনি এটি স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক উপকারী। এটি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ও অন্য অনেক শারীরিক সমস্যা নির্মূলে ঔষধি হিসেবে কাজ করে থাকে বলে আয়ুর্বেদিকগন উল্লেখ করেন । এক সময় দেহসৌষ্ঠব বাড়ানোর জন্য গায়ে মাখা হতো জাফরান যা জাফরানের ইতিকথা অধ্যায়ে বলা হয়েছে । ত্বকের লাবন্য বাড়াতে জাফরানের জুড়ি নেই। এটি ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং অবসাদের চিহ্ন দূর করে ত্বককে সতেজ ও সজীব করে তোলে। এর ভেষজ গুণ এতই সমৃদ্ধ যে, এটি মানবদেহে অন্তত ১৫টি সমস্যা দূর করতে সক্ষম। জাফরানে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদপিণ্ডের সমস্যা দূর হয়। স্মৃতিশক্তি ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিতেও এটি বেশ সহায়ক। প্রসাধন সামগ্রীতে জাফরানের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
তবে আসল জাফরান চেনা জরুরি, জাফরান কেনার সময় ক্রেতাদের অনেক ক্ষেত্রে ঠকিয়ে দেন বিক্রেতারা। কারণ, বাজারে নকল জাফরান বিক্রি হয়। কুসুম নামের ফুলের পাপড়ি দিয়ে নকল জাফরান তৈরি করা হয়। কুসুম (ইংরেজি Safflower) একটি কমলা- হলুদ রংএর ফুল যা প্রায় ১ থেকে ২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। এটা অনেক সময় জাফরানের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবী বহুদেশে এটাকে জাফরান নামে বিক্রি করে মানুষ ঠকানো হয়। মসলা হিসাবে এটার কোন মূল্য নাই । এই ফুলটিও এখন অবশ্য বিলুপ্তির পথে । কুসুম গাছ দুই ধরনের- একটি বেশ বড় এবং উঁচু, অন্যটি খুবই ছোট ও ঝোঁপালো ধরনের। পরিত্যক্ত মাঠ কিংবা ঘাসবনে আপনা আপনিই জন্ম নেয়া এই উদ্ভিদটির নৈর্সগিক সৌন্দর্য্যে বিমোহিত করে তোলে সবাইকে। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ এলাকায় এটির সাক্ষাত এখনো মিলে। উদ্ভিদটির সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে সময়ের করালগ্রাসে এক সময় বিলুপ্তির তকমা লাগবে এর গায়ে।
অন্য জাতের আরো একটি কুসুম ফুল
কুসুম ফুল থেকে তৈরি গুড়ার রঙ জাফরানের মত হওয়ার কারণে নকল আর আসল জাফরানের পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। জাফরান কেনার সময় ক্রেতাকে অবশ্যই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশে জাফরান চাষাবাদের একটি পর্যালোচনা
আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাশ্মীরে ও হিমাচল প্রদেশে জাফরানের বানিজ্যিক চাষাবাদ হয় । যদিউ কাশ্মীরের ও হিমাচলের জলবায়ুর সাথে আমাদের দেশের জলবায়ুর বেশ পার্থক্য রয়েছে তথাপি সে এলাকার জাফরানের চাষাবাদের চিত্রটি আমাদের জন্য কিছুটা দিক নির্দেশনা দিতে পারে বিবেচনায় সেখানকার চাষাবাদের কিছু চিত্র এখানে তুলে ধরা হল ।
উপযোগী আবহাওয়ার কারণে কাশ্মীর উপত্যকায় পুলওয়ামা ও বুদগম জেলায় জাফরান বেশী উৎপন্ন হয়।
ফসল তোলার সময় এটি সেখানে একটি উৎসবে পরিনত হয়, সেখানে নারীরা লোকগান গাইতে থাকে এবং বয়স্ক লোকেরা বাচ্চাদের কাছে স্থানীয় কাহিনী বর্ণনা করে।
কৃষকরা সকাল সকাল ঘর হতে বেরিয়ে যায় আর শিশির ঝরে পড়ার পর গাছ হতে জাফরান ফুলগুলি তুলতে শুরু করে।
পাপড়ি মেলা জাফরানের ফুলে ফুলে মৌমছিদের গুঞ্জরণ শুনতে শুনতে কৃষকেরা গাছ হতে ফুলগুলি তুলে ঝুরীতে ভরে ।
বাগান হতে ফুল তুলার পরে কৃষক তার পরিবারের সকলকে নিয়ে দাওয়ায় কিংবা ঘরে বসে নিজ হাতে ফুল হতে পরাগ দন্ডগুলি (কেশরগুলি) পৃথক করে ।
এই পরাগ দন্ডগুলিই জাফরানে পরিনত হয় ।
প্রায় ১৩০ থেকে ১৬০ টি ফুল হতে ১ গ্রামের মত জাফরান পাওয়া যায় । ফুলের ঘন লাল রংগের পরাগমুন্ড পৃথক করার পরে সেগুলিকে ঘরের ভিতর শুকানো হয় , রোদের তাপে শুকালে এর রং ফেকাশে হয়ে যায় ।
কৃষকগন সাধারণত ফরিয়াদের কাছে শুকনো জাফরানগুলি বিক্রি করে, যারা পরে সেগুলি ফার্মগুলিতে বিক্রয় করে।
পরবর্তীতে ফার্মগুলি সংগৃহীত জাফরান থেকে মংরা বা মগ্রা নামে পরিচিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং শ্রেষ্ঠ মানের জাফরান তৈরি করে।
কাশ্মীরে সাধরনত তিন ধরনের জাফরান তৈরী হয় , এর মধ্যে মংরা সবচেয়ে দামী, দ্বিতীয় গ্রেডেরটি দামী তবে খাটি জাফরানের নাম লাচা , এবং তৃতীয় গ্রেডেরটি হল জারডা , এটা সবচেয়ে কম দামী , ভারতীয় কাশ্মীরী জাফরান যা আমাদের এখানে বৈধ কিংবা অবৈধভাবে এসে থাকে তা এই গ্রেডের জাফরানই বটে । তার পরেতো কুমকুমের ভেজাল আছেই । ভেজালের বিষয়টি একটু পরেই আলোচনায় উঠে আসবে ।
কাশ্মীরের পলেমা এলাকার কৃষকদের কাছে জাফরানের চাষাবাদই আয়ের মুল উৎস ।
জাফরানের সাথে কাশ্মীরীদের একটি ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ও রয়েছে, এটি কাশ্মিরের সকল বিখ্যাত রন্ধনশিল্পে ব্যবহৃত হয় এবং বিবাহ উৎসবের সময়ে সেসমস্ত খাদ্যদ্রব্য অতিথিদেরকে পরিবেশন করা হয় ।
জাফরানের চাষাবাদ পদ্ধতি
প্রায় সব ধরনের জমিতে জাফরান ফলানো যায়। তবে বেলে-দোঁআশ মাটি এ ফসল চাষে বেশি উপযোগী। জলাবদ্ধ সহনশীলতা এ ফসলের একেবারেই নেই। পর্যাপ্ত রোদ ও আলো-বাতাস প্রাপ্তি সুবিধা আছে এমন স্থানে এ ফসল আবাদ ব্যবস্থা নেয়ার কথাই কৃষি বিশেসজ্ঞগন বলে থাকেন।
পরিবারিক প্রয়োজন মেটাতে গৃহকোণের বাগানের প্রান্ত এলাকাতেও এ ফসল চাষের প্রচলন আছে। অনেকে ছাদে, পটে বা ছোট ‘বেড’ তৈরী করে নিয়েও সেখানে সীমিত আকারে জাফরান চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করে থাকে। পারিবারিক পরিসরে বসতবাড়ি এলাকায় এ ফসল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ ফসল একবার রোপন করা হলে ৩-৪ বছর পর্যন্ত ফুল দেয়া অব্যাহত থাকে। তবে গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেয়া যাবেনা । উচু ঢালু জায়গা হলে ভাল হয় ।
গাছের বৃদ্ধি ও ফুল
বসন্ত শেষে মাটিতে বালব রোপনের পর এই জাফরান বাল্বগুলিতে কয়েক সপ্তাহ পর হতেই ফুলের কুড়ি দেয়া শুরু করে ।
গাছে শীতের প্রারম্ভে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ফুল আসে।
অক্টোবর মাস থেকে গাছ ফুল দেয়া আরম্ভ করে এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। তবে মৌসুমী তাপমাত্রার উপর এ ফুল ফোটা অনেকটা নির্ভর করে। পাপড়ি মেলা ফুলের গন্ধে পুরা এলাকা মৌ মৌ করে। ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ফুল তুলে তার থেকে পরাগদন্ড ছেঁটে সংগ্রহ করা প্রয়োজন। জাফরান সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজ অতি ধৈর্য্যের সাথে করতে হয় যা অনেকটা চা পাতা সংগ্রহের মত। ফসল সংগ্রহ, পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন এ কাজগুলো উৎপাদনকারী সব দেশেই মহিলারা করে থাকে।
বাংলাদেশে জাফরানের ব্যবহার , প্রাপ্যতা ও চাষাবাদ সম্ভাবনা
আমাদের দেশে জাফরান উৎপাদন হয় না বলে দেশের সব বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট, হোটেল ও মিষ্টান্ন সম্ভারেই কেবল প্রতি বছর ছত্রিশ থেকে চল্লিশ কেজি জাফরান আমদানি করা হয় ( সুত্র :বাংলাদেশ প্রতিদিন, তারিখ ২রা নভেম্বর ২০১৮)। বাংলাদেশে আমদানিকৃত জাফরান বাইতুল মোকাররম মার্কেট, গুলিস্তানের খদ্দর মার্কেট ও সুপার স্টোরে পাওয়া যায়। জাফরান' প্রতি কেজি’র মূল্য গ্রেড অনুযায়ী প্রায় ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ।
দুবাই হতে কিছু ইরানী জাফরান দেশে এনে বিপণন করা হয় বলে বেশ কিছু অনলাইন এডে দেখা যায়
২৫ গ্রামের একটি ইরানী জাফরনের প্যকেটের দাম ৩৯৯৯.০০ টাকা ( সুত্র - Click This Link )। এটা যে কতটুকু খাটি তা সরবাহকারী ও ব্যবহার কারীই কেবল বলতে পারবে তবে এটা যে জাফরানী ফ্লেবার সমৃদ্ধ একটি পন্য তাতে কোন সন্দেহ নাই । ভারত হতেও প্রতিবছর প্রায় ৫০ কেজির মত পন্য জাফরান ফ্লেবার (সুত্র: Click This Link) নাম দিয়ে ও জাফরান সমৃদ্ধ কসমেটিক দ্রব্য হিসাবে আরো কিছু জাফরান পন্যসামগ্রী বাংলাদেশে প্রতি বছর আমদানী ঘটে ।
জাফরানের উপর থেকে আমদানী নির্ভরশীলতা কমিয়ে ও উচ্চমুল্যমানের এ্ই ফসল দেশেই ফলানোর লক্ষ্যে ২০০০ সালে বাংলাদেশের ৯ টি বিএডিসি উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে জাফরানের চাষ শুরু করা হয়েছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ ভাষ্য হতে জানা। তবে এ সমস্ত তথ্যের কোন নির্ভরযোগ্য বিস্তারিত বিবরণ কোথাও দেখা যাচ্ছেনা । তবে একথাও শুনা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের মাটি জাফরান চাষের জন্য মোটামুটি উপযোগী। তাই অতি মুল্যবান এই জাফরান চাষাবাদের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে । জাফরান চাষের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে দেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব কেননা অতি শ্রমঘন এ ফসলটির উৎপাদন সীমিত হলেও সারা দুনিয়াব্যপী এর চাহিদা রয়েছে ব্যপক ।
সম্প্রতি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) এক প্রায়োগিক গবেষনায় দেশে জাফরান উৎপাদন সফলতার মুখ দেখেছে বলে দাবী করা হয়েছ । গবেষকদলের প্রধান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম জামাল উদ্দিন জানান, তাঁরাই দেশের মাটিতে প্রথম সফলভাবে জাফরান উৎপাদন করেছেন (সুত্র Click This Link )।
বাংলাদেশে জন্মানো জাফরান ফুলের চিত্র
বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বলে এখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রা জাফরান চাষের জন্য অনেকটা অনুপযোগী বলে শেকৃবির গবেষক দল মনে করেন । তাই সার্বিক দিক খেয়াল রেখে গ্রিন হাউস এর মাধ্যমে দেশে জাফরান সম্পূর্ণ সফলভাবে উৎপাদন সম্ভব বলে জানান শেকৃবির এই গবেষক দল। তাঁদের মতে ব্যক্তিপর্যায়ে দেশে জাফরান চাষ এমহুর্তে বেশ ঝুকিপুর্ণ ও ব্যয়বহুল ।এ জন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে জাফরান চাষ বিস্তারে প্রয়োজনীয় সহায়তার লক্ষ্যে কমপক্ষে ২০০০ বর্গফুটের একটি গ্রিনহাউস প্রয়োজন যা মাতৃ বিজাগার হিসাবে কাজ করবে আর এর জন্য খরচ হবে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি এই সম্ভাবনাময় গবেষণায় বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেন, তবে তা সম্প্রসারণমূলক প্রায়োগিক গবেষনায় আরেকটি ধাপ উন্মোচিত করবে বলে তাদের ধারনা। জাফরান চাষাবাদকে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী করে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এর প্রয়োগিক গবেষনা খুবই প্রয়োজন । কেউ বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে চাইলে শেকৃবী তাদের প্রয়োজনীয় কারিগরী সহায়তা দিতে প্রস্তুত বলেও সংবাদ ভাষ্যে দেখা যায় ।
জাফরান চাষাবাদের জন্য আমাদের আশু করণীয়
দেশের প্রত্যেক হর্টিকালচার সেন্টারের সুবিধামত স্থানে ২- ৩ টা স্থায়ী বীজ তলায় এ দামী গুরুত্বপূর্ণ হাইভ্যালু ফসলের আবাদ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। পার্শ্ববর্তী যে কোন দেশ থেকে দু-একশত জাফরান বালব সংগ্রহ করে চাষের উদ্যোগ নেয়া জরুরী। জাফরান বালব সংগ্রহ করে প্রত্যেক হর্টিকালচার সেন্টারে বিশেষ করে গাজীপুরে অবস্থিত নূরবাগ জার্মপ্লাজম হর্টিকালচার সেন্টারে চাষ ব্যবস্থা নিয়ে মাতৃ বাগানের উৎস সৃষ্টি করা যেতে পারে।
গাজীপুরের নূরবাগ জার্মপ্লাজম হর্টিকালচার সেন্টার
জার্মপ্লাজম হর্টিকালচার সেন্টারের হুপ/গ্রীণ হাউজের বীজ বেদিতে যে ভাবে জাফরানের বালব রোপন করা যেতে পারে
প্রতি বালবের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ ইন্চি করে দুরত্ব রাখতে হবে
গ্রীন হাউজে রোপনের পর যথাযথ পরিচর্যায় কি ফল দিবে নীচে দেখা যেতে পারে
জাফরান আবাদ খুবই সহজ , সকাল বেলায় গাছ হতে শীতের শিশির ঝড়ে যাওয়ার পর গাছ হতে শুধু ফুলটি তুলে নিতে হবে যেমনটি কাশ্মীরি কৃষকেরা করে থাকে বলে পুর্বেই দেখানো হয়েছে । তারপর ফুল হতে পরাগদন্ড পৃথক করে তা শুকিয়ে জাফরান পাওয়া যাবে ।
সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেলে এবং আধুনিক উদ্যান নার্সারী সমৃদ্ধ ব্রাক বাংলাদেশের মত কৃষক বান্ধব এনজিওগুলি এগিয়ে আসলে আশা করি দেশের অনাচে কানাচে জাফরান চাষ একটি গতি পাবে । অপরদিকে জাফরান বিপনন ও সরবরাহ নিয়োজিত বানিজ্যিক ফার্মগুলি এগিয়ে এসে দেশে বিরাজমান সহজলভ্য গ্রামীন জনবল নিয়োগ করে লাভজনক বানিজ্যিক জাফরান চাষাবাদ শুরু হতে পারে । ফলে দেশের মাটিতে জাফরান চাষ কর্মসুচীটি তৈরী পোশাক শিল্প খাতের মত একটি যুগান্তকারী বিপ্লব বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করা যায় ।
জাফরানের কমার্শিয়াল গার্ডেন এর জন্য একটি মডেল প্লান্ট এর ছবি
জাফরানের আরো বিবিধ ব্যবহার
জাফরন এর মত এর ফুলের পাপড়িগুলিউ মুল্যবান । ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পশুরোগ নিরাময়ের জন্য জাফরনের পাপড়ি হতে ঔষধ তৈরী হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্তের অনেক দেশে জাফরান পুপষ্পদল হতে গৃহসয্যার জন্য বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন মুল্যবান পটপুরী তৈরী হয় ।
জাফরান পুষ্পদামের একজোড়া পটপুরীর দৃশ্যঃ
বিশ্ববাজারে জাফরানের বড় ভোক্তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট, তবে তারা এটা মসলা হিসাবে ভোগ করেনা, বরং মুল্যবান জীবন রক্ষাকারী ঔষধ তৈরীতে বেশী ব্যবহার করে । এর সৌন্দর্য পর্যবসিত হয় জীবন রক্ষাকারী ঔষধে । তাই সেখানে এটি একটি বিশেষায়ীত ঔষধি পুষ্প হিসাবে গৌরবের আসনে অধিস্ঠিত। উন্নত বিশ্বের সকল দেশই বিবিধ প্রকারের জাফরানজাতীয় পন্য সংগ্রহ/আমদানী করে। জাফরানের এই বৈশ্বিক বানিজ্যিক সুযোগ কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা কৃষি প্রধান বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্ব নিয়ে এখনই ভাবার দাবী রাখে ।
উল্লেখ্য যে , জাফরান ফুলের পরাগ দন্ডের ( কেশর ) মানের উপর জাফরানের মান নির্ভর করে
ফুল থেকে পরাগ দন্ড ( কেশর) পৃথক করে শুকনোর প্রক্রিয়ার উপরও ভিত্তি করে এর গুনগতমান নির্ভর করে
কিছু ইরানী ও কাশ্মীরি উন্নতমানের জাফরান কেশরের ছবি নীচে দেখানো হল :
ইরানে জাফরানের বাজার
ইরানী হলুদ ও লাল রঙের জাফরান কেশর
I
একটি কাশ্মীরি জাফরান কেশর প্যাকেজ
জাফরান হতে আহরিত রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার
জাফরান পুষ্পের পরাগদন্ড হতে রাসানিক আহরণ করা সবচেয়ে বেশী কঠিন তবে খুবই মুল্যবান কর্মকান্ড কারণ এই পরাগ দন্ড হতে উদ্ভূত রাসায়নিক পদার্থগুলি ঔষধি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। পরাগদন্ডে বিদ্যমান রাসায়নিকের মধ্যে তিনটি রাসায়নিক উপাদান যথা পিক্রোক্রোকিন (picrocrocin), ক্রোকিন (, crocins) এবং সেফ্রানাল (safranal )অন্যতম । পরাগদন্ডে যতবেশী উচ্চতরের এই রাসায়নিক উপাদান থাকবে পরাদন্ডটি ততই, ভাল মানের। এই রাসায়নিকগুলি খুব মূল্যবান এবং তাদের অ্যান্টিকার্কিনোজেন প্রভাব রয়েছে, তাই তারা সত্যিই ব্যয়বহুল। প্রতি এক গ্রাম সাফরনে ৭ মিগ্রগ্রাম পিক্রোক্রোকিন পাওয়া যেতে পারে এবং পিক্রোক্রোকোসিনের প্রতি মিলিগ্রামের দাম ৩০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে সুতরাং এটা খুবই মুল্যবান জাফরান জাতীয় একটি পদার্থ (সুত্র- Click This Link )
বিজ্ঞানীরা ক্যান্সারের চিকিৎসার বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে পিক্রোক্রোকোসিন ব্যবহার করার বিষয়টি অনুসন্ধান করছেন ।
পরিশেষে বাংলাদেশে জাফরান চাষের বিষয়ে দেশের জলবায়ুর বিষয়টি একান্তভাবেই অআমলে নিতে হবে । আআমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে যখানে সাফল্যের সাথে বানিজ্যিক ভিত্তিতে জাফরানের চাষাবাদ হেচ্ছে বিশেষ করে কাশ্মীর উপত্যকায় একটি মধ্যপন্থী জলবায়ু রয়েছে। গ্রীষ্ম সাধারণত হালকা এবং মোটামুটি শুষ্ক , প্রায় সারা বছর জুড়ে বৃষ্টিপাত হয় এবং কোন মাসে বিশেষ করে শুষ্ক হয় না।
সেখনে জুলাই মাসে সর্বাধিক তাপমাত্রা ৩২ ° সেন্টিগ্রেড এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি সবচেয়ে শীতলতম (সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -১৫ ° সেন্টিগ্রেড আর সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রা ০ ° সেন্টিগ্রেড)। গত কয়েক বছরে অবশ্য কাশ্মীর উপত্যকায় আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি সম্ভবত বাণিজ্যিক বনায়ন প্রকল্পের কারণে । পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। বছরে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ১৫০০-২৫০০মি.মি./৬০-১০০ইঞ্চি; গড় তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াস। নভেম্বর হতে মার্চ পর্যন্ত হালকা শীত । মার্চ হতে জুন মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল । জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে বর্ষা মৌসুম। আমাদের দেশে জাফরানের চাষাবাদ সম্ভাবনা প্রসঙ্গে উপসহাদেশে জাফরানের তীর্থভুমী কাশ্মীরের জলবায়ুর সাথে আমাদের দেশের জলবায়ুর তুলনামুলক পর্যালোচনা প্রাসঙ্গিগ। কেননা বাংলাদেশের জলবায়ুর সাথে সঙ্গতি রেখে গবেষনার মাধ্যমে আমাদের দেশে চাষাবাদের জন্য জাফরানের যথাযথ জাত নির্বাচনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। লাগসই গবেষনা ফলাফল ও কৃষকদের উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল কর্মকান্ডের ফলে সামপ্রতিক কালে মরুভুমির ফল খেজুর দেশর সব জায়গায় ও শীতের দেশের ফল স্ট্রেবেরী বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও অনেক দিন স্থায়ী হয় সেসব এলাকায় সাফল্যের সাথে এর চাষ হচ্ছে । তেমনি ভাবে এই আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির যুগে একটি বহুগুনের আধার মুল্যবান সন্মানজনক ও প্রকৃতির শোভাবর্ধনকারী শ্রমঘন জাফরান চাষেও একসময় আমরা সাফল্য লাভ করতে পারি বলে দৃঢ় ভাবে আশা করতে পারি ।
জাফরান সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছি বললাম। অনেকে আরও বিস্তারিত জানেন। বিশেষ করে যারা জাফরান চাষ করতে দেখেছেন অথবা চাষ করেছেন। ভুল হলে আশা করছি সংশোধন করে দেবেন।
ধন্যবাদ লম্বা সময় নিয়ে ধৈর্য ধরে সাথে থাকার জন্য ।
তথ্য সুত্র :লেখার সাথে লিংক করে দেয়া হয়েছে
ছবি সুত্র : গুগল অন্তরজাল
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ১০:৪১