somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন বস্রের আদি অন্ত কথকতা - পর্ব-১ : মসলিনের উৎসের সন্ধানে

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ৮:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সুত্র : Click This Link
বিশ্ব বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন বস্ত্রের সুনামের কথা আমরা সকলেই জানি । কালের গর্বে হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রের পুর্ণজন্মের কথাও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ।
পাট ও বস্র মন্ত্রনালয়াধীন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পের আওতায় ঐতিহ্যবাহী মসলিনের পুর্ণজন্মের সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোক্ত হয়েছে । প্রতিযোগীতামুলক বিশ্ববাজারের প্রেক্ষাপটে এই অতি বিলাসী ও ব্যয়বহুল পণ্যটি নিয়ে আর কতদুর যাওয়া যায় তা নিয়ে একটি বিশদ পর্যালোচনায় যাওয়ার প্রয়াসে এ লেখাটির অবতারনা । এ লক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী এই পণ্যটির আদি কথা ও এর উৎসের সন্ধান সঙক্রান্ত কিছু সচিত্র কথামালার অবতারনা করা হলো প্রথম পর্বে ।
পর্ব - ২ এ থাকবে পণ্যটির সোনালী দিনগুলির ইতিকথা ও এর অস্তগামীতার করুন গাথা
পর্ব-৩ এ মসলিনের উৎপাদন কর্মকান্ডের সচিত্র বিবরণ সহ এর পূর্ণজন্মের সার্থকতা ও বিকাশ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস নেয়া হবে ।

পর্ব-১ : মসলিনের আদি কথা ও উৎস সন্ধান

বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের সাথে কত যে রোমাঞ্চকর ইতিহাস জড়িয়ে আছে তা শুনলে ও দেখলে বিস্ময়াবিভুত না হয়ে পারা যায়না ।
স্বরণাতীত কাল হতেই বাংলা মুলুকে তৈরী মসলিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। মসলিন শব্দটির উৎপত্তি ইরাকের মসুল নগরী হতে বলা হলেও কতিপয় ইতিহাসবিদ মসলিন শব্দটি সে সময়কার ভারতবর্ষভুক্ত অন্ধ্র প্রদেশের মসলিপট্টম বন্দর থেকে হয়েছে বলে দাবী করে থাকেন । বলা হয় রোমানগন সেই বন্দর দিয়ে মাইসলস নামে যে সুতী বস্ত্রটি রপ্তানী করত মুলত সেটাই নাকি ছিল মসলিন । তবে ঐতিহাসিক যুগসুত্র সমুহ পর্যালোচনায় দেখা যায় মসলিন শব্দটির সাথে প্রাচীন ভারতবর্ষীয় ও ইরাকের প্রাচীন মসুল এর ক্রস কালচারাল ও বানিজ্যিক যোগাযুগের সুত্র বন্ধন রয়েছে , যার কিছু সচিত্র বিবরণ লেখাটির ঐতিহাসিক সময়ক্রম অনুযায়ী নীচে তুলে ধরা হল ।
ছবি-১ : বৃটিশ ট্রেভেলার , আর্কিউপলজিস্ট , রাজনীতি ও কুটনৈতিক স্যার অস্টিন হেনরী লেয়ার্ড কতৃক


১৮৫৩ সনে অঙ্কিত The Monuments of Nineveh চিত্রটি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় নীচে তুলে ধরা হল ।
ছবি -২: Artist's impression of Assyrian palaces from The Monuments of Nineveh by Sir Austen Henry Layard, 1853


সুত্র :https://en.wikipedia.org/wiki/Nineveh#/media/File:Artist’s_impression
নিনেভা ছিল টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন আশিরিয় সাম্রাজ্যের ( খৃষ্টপুর্ব ২৬০০-২০২৫) একটি জনবহুল নগরী যা সেসময়কালে বিশ্বের সর্ববৃহত নগর হিসাবে বিবেচিত হত । নিনেভা‌র আধুনিক নাম মসুল ।
বৃটিশ ট্রেভেলার , আর্কিউপলজিস্ট , রাজনীতি ও কুটনৈতিক স্যার অস্টিন হেনরী লেয়ার্ড কতৃক ১৮৫৩ সনে অঙ্কিত নিনেভার প্রাসাদ অন্দরে রাজসভাসদদের গায়ে মসলিন বস্ত্র পরিধানের দৃশ্যটি( ছবি-৩) প্রনিদান যোগ্য ।
ছবি-৩


সুত্র : Click This Link

এইচ.ওয়ালডেক অঙ্কিত বেবিলনের শুন্য উদ্দানের Hanging gardens of Semiramis চিত্রকর্মে মসলিনের মত সুক্ষ মিহি বস্ত্র পরিহিত মেসোপটিয়য়াম রমনীদেরকে (আসিরিয়ান সম্রাট নিনুর মহিয়সি স্রী সিমিরামিস ও সহচারীনীগন ) দেখা যাচ্ছে ।
ছবি – ৪ : Hanging gardens of Semiramis, by H. Waldeck


সুত্র : Click This Link
ভারতবর্ষে ঠিক কখন হতে মসলিন কাপড় তৈরীর সুচনা হয় তা নিয়ে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্যের অবতারনাও দেখা যায় ।
পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁর Glimpses of World History ( ১৯৩৪ ) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে “ চার হাজার বছর পুর্বে মিশরিয়গন মমীকে ভারতীয় মিহি মসলিন বস্ত্রে মোরিয়ে রাখত। ভারতীয়দের দক্ষতা প্রাচ্য ও পাশ্চাতে সে সময়েই নাকি ছড়িয়ে পরেছিল । এখানে উল্লেখ্য মসলিন যে শুধুই অতি মিহি বস্রকে বলা হতো তা কিন্তু নয়, অপেক্ষাকৃত ভারী সুতী বস্ত্রকেও মসলিন নামে চিহ্নিত করা হতো , বিভিন্ন লিটারেচারে সে গুলি লিলেন বা তন্তুজাত বস্ত্র হিসাবে অভিহিত হয়েছে ।

কতিপয় ঐতিহাসিক ঘটনা বা ক্রস-কালচারাল বিষয়াবলী , পৌরানিক কাহিণী এবং চিত্রকল্পসমুহ প্রাচীন মিশর ও ভারতের মধ্যে যোগসুত্রের একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সহায়তা করে ( সুত্র : https://www.arianuova.org/en/india-and-egypt )।
মিশরের প্রাচীন সভ্যতার সাথে ভারতীয় যোগাযোগের প্রামানিক দলীল হিসাবে হাতলযুক্ত মৃৎশিল্পের ফুলদানি সে সাথে সুতী বস্ত্রও যে তখন ভারত থেকে মিশরে যেতো তা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণে বিশেষ করে আসিরিয় সম্রাট অসুরবানীপালের ইতিহাস চর্চায় উঠে আসে ।
উল্লেখ্য আসিরিয় সম্রাট অসুরবানীপাল খৃষ্টপুর্ব ৬৬৮ সালে মিশর দখল করে নিয়েছিলেন ।
যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিকোর সিভিক সেন্টারের সন্মুখে আসিরীয় সম্রাট অসুরবানীপাল এর ( খৃষ্টপুর্ব ৬৮৫-৫৩১ ) একটি ব্রোজ্ঞ ভাস্কর্য(ছবি-৫) , তিনি বিশ্বসম্রাট নামেও পরিচিত ছিলেন ।
ছবি-৫


সুত্র : Click This Link

ঐতিহাসিক সুত্র হতে জানা যায় অসুরবানীপাল (খৃষ্টপুর্ব ৬৬৮- ৫২৫) ভারতের "উল বহনকারী গাছ" তথা তুলা সহ ভারতীয় গাছপালার চাষ করেছিলেন সে সময়কার তাদের অধিকৃত মিশরীয় অঞ্চলে। উল্লেখ্য পরবর্তীতে মিশরীয় তুলা গুণেমানে ভারতীয় তুলার গুনমানকে ছাপিয়ে যায় ও মিশরীয় সুতা ও সুতী বস্ত্র বিশ্বব্যপি বেশ সুনাম কুড়ায় ।
ছবি-৬ : মিশরীয় তুলার ছবি


সুত্র : Click This Link
মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াস্থ ভারতীয় পণ্ডিতবর্গ যথা ক্রাইস্টোমাস (১০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং ক্লেমেট (২০০ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখের একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে মেসোপটেমিয়ার মাধ্যমে প্রাচীন ভারত ও মিশরের মধ্যে বেশ কিছু যোগাযোগ ছিল । তবে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রমানের বিষয়ে তারা ছিলেন দ্বিধান্বিত । জার্মান ইন্ডোলজিস্ট পিটার ভন বোহলেন ( ১৭৯৬-১৮৪০) প্রাচীন মিশরের সাথে ভারতকে তুলনা করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন প্রাচীন যুগে দুটি দেশের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সংযোগ ছিল ।এটাও উপজিব্য যে সে সময়ে এ অঞ্চলের বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলের লোকশিল্প, ভাষা এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির উপাদানগুলি মিশরীয় অংশগুলির সাথে সখ্যতা রয়েছে মর্মে আর্য, মঙ্গোলিয়ান বা তথাকথিত দ্রাবিড় প্রভাবের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়েছে মর্মে সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করা যাযনা। তবে বাংলা মুলুকের ও মিশরের কতক স্থানের নামের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে মর্মে সম্প্রতি একজন মিশরীয় পণ্ডিত আল মনসৌরি উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে সে সময়ে মিশর এবং ভারত উভয় দেশেই গরু, সূর্য, সাপ এবং নদীর উপাসনা প্রচলিত ছিল(ছবি-৭) ।
ছবি-৭ :


ছবি-৮


ছবি-৯


সম্প্রতি, ভারত ও মিশরের মধ্যকার যোগাযোগের আরও কিছু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। লোথালের একটি পোড়ামাটির মমি অস্পষ্টভাবে মিশরীয় মমির মতো এবং একই রকম পোড়ামাটির মমিও পাওয়া গেছে মহেঞ্জো-দারোতে। এসকল প্রেক্ষিতে মিশরের মমিগুলি ভারতীয় মসলিনে আবৃত ছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে ।

এটা মনে করা হয় যে দক্ষিন পুর্ব ভারতীয়রা মিশরে গিয়ে সেখানে তার সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। অবশ্য মিশরীয়রা ঐতিহ্যগত ভাবে মনে করে তারা মূলত পুন্ট (Pun At times Punt is referred to as Ta netjer, the "Land of the God") নামে একটি ভূমি থেকে এসেছিল এবং সকল ঐতিহাসিক ও গবেষকগনই পুন্টকে ইথিউপিয়া ও ইরিত্রিয় এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন( সুত্র : https://simple.wikipedia.org/wiki/Land_of_Punt )
অশুরবানীপালের গ্রন্থাগারে পাওয়া ‘সিন্ধু’ শব্দটি ভারতীয় তুলা অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং তুলা হতেই তৈরী হতো হালকা মিহি সুতী বস্ত্র ।
ছবি-১০: পবিত্রতা ও সম্পদের প্রতিক হিসাবে মিশরীয়রা মমিগুলিকে মিহি সুতি বস্ত্রে মোরিয়ে সমাধি ক্ষেত্রে নিয়ে যেতো ।


সুত্র : The Egyptian Book of the Dead: The Book of Going Forth by Day by James Wasserman et al.
১৮৩১ সালে খ্রিস্টপূর্ব ১২১৩ সালে মারা যাওয়া দ্বিতীয় ফেরাউন রামেসিসের সমাধির সন্ধান পাওয়া গেলে, সেখানে সুতি বস্ত্রে মোরানো প্রায় ৩০০০ বছরেরও বেশি সময় পুর্বকার মমি (ছবি-১১) অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় ।
ছবি-১১


প্রায় ২৫০০ বছর পুর্বকার ধর্মযাজক আমুন এর কন্যা তাকাবুতির মমিটিটিও বস্ত্রে মোরানো অবস্থায় নিখুতভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ।
বেলফাস্টের আলসস্টার মিউজিয়ামে রক্ষিত তাকাবুতির মমী (ছবি-১২)
ছবি-১২


সুত্র : Click This Link
গ্রীক ঐতিহাসিক Megasthenes ( খৃ:পুর্ব ৩২১-২৯৭ ) লিখিত বিবরণ হতে জানা যায় যে Indians wore ‘ flowered garments made of the finest muslin and trinkets of gold on their fingers and in their ears’
উল্লেখ্য মেগাস্থিনিস ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের একজন পর্যটক এবং ভূগোলবিদ। তিনি এশিয়া মাইনরে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সিরিয়ার রাজা সেলিয়াকাস ১-এর রাজকীয় দূত হিসেবে ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজদরবারে দায়িত্ব পালন করেন। তখন চন্দ্রগুপ্তের রাজদরবার ছিল ভারতের পাটালিপুত্র নামক স্থানে।

রোমান রমনীগাত্রে মসলিন

ইতিহাস হতে জানা যায় প্রথম খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকেই রোম সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে অভিজাত রোমান রমনীগন মসলিন জাতীয় বস্ত্র/পোশাক পরিচ্ছদ পরে দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শন করতে ভালোবাসতেন।
ছবি – ১৪ : Greek and Roman Life" by Ian Jenkins from the British Museum


সুত্র - Click This Link
একই শতকে রচিত ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ শীর্ষক গ্রন্থে মসলিন সম্পর্কে বিশেষ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।
মিশরবাসী জনৈক অজ্ঞাতনামা গ্রীক নাবিক ৮০ খ্রিষ্টাব্দে " Periplus of the Erythraean Sea " বা "ভারত সাগরে ভ্রমণ " নামে একটি মুল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন । গ্রন্থটি হতে তৎকালীন ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলের বিভিন্ন সমুদ্র বন্দর, যোগাযোগ পথরেখা এবং ভারত রোম আমদানি ও রপ্তানি বানিজ্য পণ্য সম্ভার সম্পর্কে বিশদ বিবরণ জানা যায় ।
ছবি-১৫ : তৎকালীন ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলের বিভিন্ন সমুদ্র বন্দর,


বুদ্ধিস্ট মেনুসক্রিপ্ট এ ১২-১৩তম শতাব্দিতে মহিলারাদেরকে মসলিন দুপাট্টা পরিহিত দেখা যায় (ছবি-১৬) ।
ছবি-১৬


সুত্র -https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_clothing_in_the_Indian_subcontinent#/media/File
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ অঞ্চলের লেহ জেলার আলচি গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহারে থাকা ১১শতকের তারা দেবীকে নিয়ে শায়মা তারা অঙ্কিত থ্রি -পিছ শাড়ী পরিহিত একটি চিত্র কর্ম ।
ছবি -১৭: কাশ্মীরের লাদাখ এলাকায় আলচি বৌদ্ধ মনাসটারিতে থাকা চিত্র কর্ম ।


সুত্র : Click This Link
ছবি-১৮ : শিল্পীর হাতে গড়া লাদাখে দেবী তারার হাতে ধরে রাখা মসলিন


ছবি - ১৯ : Famous Holy Spoken Green Tara in Nyanang Phelgyeling Monastery, Nepal.


সুত্র : Click This Link
উল্লেখ্য তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে দেবী তারা হলেন দয়া ও কার্যের একজন বোধিসত্ত্ব। তিনি হলেন অবলোকিতেশ্বরের নারী মূর্তি। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে তিনি একজন নারী বুদ্ধের মর্যাদা প্রাপ্ত বোধিসত্ব।তিনি "নির্বাণ-জননী" হিসেবেও পরিচিত। তিনি শুক্লতারা, (সীতাতারা) দয়া, দীর্ঘজীবন, আরোগ্যদান ও শান্তির দেবী হিসেবেও পরিচিত। তাঁর হাতে ধরা মসলিন তার ঐতি্হ্যের কথাই তুলে ধরে ।
ছবি-২০ বৌদ্ধ দেবী রূপে তারা


সুত্র : Taken in the shrine room of a Karma Kagyu centre in South London

সপ্তদশ শতকের সংস্কৃত কবি বাণভট্ট তাঁর হর্ষচরিত্র , সম্রাট হর্ষবর্ধনের জীবনী ( ৫৯০-৬৪৭ খৃ: ) গ্রন্থে ভারত বর্ষের বস্ত্র শিল্পের চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায় । বাভনট্ট দেবী লক্ষীর পোষাকের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন লক্ষী সফেদ ফেনাসদৃশ্য শ্বেত বস্ত্র পরিধান করতেন যা ;দেখে মনে হতো যেন শিশিরের বোনা পট্ট , যা লতা পাতা ও ফুলের নস্কায় ছিল অলংকরিত (ছবি-২১) ।
ছবি-২১


সুত্র: Click This Link

বাণভট্ট ছিলেন খ্রিষ্টাব্দ সপ্তম শতাব্দীর ভারতীয় সংস্কৃত পণ্ডিত। তিনি বাণ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন উত্তর ভারতীয় রাজা হর্ষবর্ধনের আখ্যান কবি । বাণ হর্ষবর্ধনের জীবনী হর্ষচরিত ও বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উপন্যাস কাদম্বরী রচনা করেছিলেন।
ছবি-২২


প্রীতিকূট গ্রামে বাৎস্যায়ন গোত্রীয় এক মগ ব্রাহ্মণ পরিবারে বাণের জন্ম।

মসলিনের বিস্তৃতি ঘটে দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কাতেও

ছবি -২৩:মসলিনে তৈরী নীমা (Tunic dress)পরিহিত ৫ম শতকে শ্রীলংকার শিগিরিয়ান বিখ্যাত পেইন্টিং এ থাকা রমনীদের ছবি


সুত্র - Click This Link
ছবি-২৪


ছবি -২৫ :ইউনেসকো কতৃক বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকা ভুক্ত শ্রিলংকার সিগিরিয়া


https://en.wikipedia.org/wiki/Sigiriya#/media/File:Sigiriya.jpg
উল্লেখ্য সিগিরিয়া হচ্ছে শ্রীলংকার একটি অপূর্ব সুন্দর গুহামন্দির। ছয়শত ফুট উঁচু এক পাথর কেটে দুর্ভেদ্য প্রাসাদ বানিয়েছেন এক রাজা। প্রাসাদ অনেকটা মৌচাকের চাকের মতো। এই পাথর 'সিগিরিয়া রক' নামে ভুবন বিখ্যাত। সিগিরিয়া রকের আরেক নাম 'লায়ন রক'।
ছবি- ২৬ : 'সিগিরিয়া রক


থাইল্যান্ড ও চীনেও মসলিন রপ্তানী হতো । বৃটিশ ইতিহাসবিদ জন গে বলেছেন Pagan in Burma , mural paintings
of the 11th to 14th centuries ( ছবি- ২৭) show princely figures dressed in ‘ fine diaphanous white fabric is presumably the much-prized Bengali muslin.~’’
ছবি-২৭ :


এখন দেখা যাক বিশ্ববিখ্যাত ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বহুবিদ শৈলী নিয়ে পরিহিত এই ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মসলিন বস্ত্রের মুল উৎপাদন স্থানটি ভারতের কোন অংশে অবস্থিত ছিল ।

মসলিন বস্ত্রের উৎপাদন কেন্দ্রভুমি

বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে দক্ষিণের সাগরদ্বীপ সুন্দরবন থেকে উত্তরের সমগ্র উত্তর বঙ্গ এলাকা জুড়ে গঙ্গার প্রবাহ পথে প্রাচীন গঙ্গারিডিরাজ্য বিস্তৃত ছিল এবং চন্দ্রকেতুগড় ছিল গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী।
ছবি - ২৮ : শিল্পীর তুলিতে আঁকা গ্রিক গণিতবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, ও জ্যোতিষ টলেমি এবং টলেমির মানচিত্রে থাকা 'গঙ্গারিডাই'একটি ছবি


এই প্রত্নস্থলটির সঙ্গে জলপথে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত মেসপটমিয়া ও রোমের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের সুনিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে বলে দাবী করা হয়ে থাকে ।
( সুত্র : A Lost Civilization - Gourishankar De and Shubhradip De. Kolkata, Sagnik Books, 2004, 109 p)

গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী চন্দ্রকেতুগড়ে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নস্থল এর সন্ধান পাওয়া যায় । এ স্থানটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় এবং কলকাতা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এর অবস্থান।
ছবি-২৯ : চন্দ্রকেতুগড়ের প্রত্নস্থল


সুত্র : A Lost Civilization - Gourishankar De and Shubhradip De. Kolkata, Sagnik Books, 2004, 109 p)
এই প্রত্নস্থলটি আনুমানিক ৩ হাজার বছর পুর্বে তথা ৪০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে গড়ে উঠেছিল।

ছবি -৩০ : চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত টেরাকোটায় নির্মিত পঞ্চচূড় অপ্সরার চিত্র দেখে ধারণা করা হয় তাদের গাত্র বিখ্যাত ঢাকাই মসলিনে ছিল পরিবৃত্ত ।


সুত্র : Click This Link

এখানে বিশেষভাবে লক্ষনীয় যে, ঢাকাই মসলিন শব্দটি থেকে বুঝাই যায় যে বস্ত্রটির উৎপাদন কেন্দ্র বলতে এখনকার বাংলাদেশের ঢাকাকেই বুজানো হয়েছে ।

এই বিশেষ বস্ত্রটি তৈরীর কলা কানুন ও মুল উপাদান তথা বিশেষ ধরনের ফুটি কার্পাস তুলা হতে তৈরী মিহি সুতা ও এর কারিগরের বাসস্থান সকলি ছিল ঢাকার মেঘনা ও শীতলক্ষা নদী অববাহিকায় । তাই এর উৎপাদন কেন্দ্র ঢাকা ভিত্তিক ছিল বিধায় এটাকে ঢাকাই মসলিন হিসাবে অভিহিত করা হত ।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়। তাঁদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে–সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না। আর এর জন্য প্রয়োজন ফুটি কার্পাস নামক সেই বিখ্যাত তুলার । ফুটি কার্পাস থেকে বাকা ডাকা ভোরে শিশির শিক্ত পরিবেশে অতি দক্ষহাতের অঙ্গুলী চালনায় চরকি দিয়ে অতি মিহি সুতা তৈরী হতো যা প্রায় ৫০০ কাউন্টের মত সুক্ষ ও উন্নতমানের টেনসাইল স্ট্রেংগ্থ সম্পন্ন ছিল।
ছবি-৩১ : বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তত্বাবধানে পূর্ণজন্মিত ফুটি কার্পাস তুলা


উৎস : বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড , ঢাকা বাংলাদেশ
ছবি-৩২ : লন্ডনের Victoria & Albert Museum এ সংরক্ষিত মসলিন বস্ত্র


উতস : Sheer muslin gown, 1800. Image @Victoria & Albert Museum
ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সমৃদ্ধতম প্রদেশ হিসাবে বাংলার পরিচিত ছিল। বাংলার বিখ্যাত এবং বিভিন্ন ধরণের টেক্সটাইল এবং কৃষিজাত পণ্যের জন্যই 'পৃথিবীর স্বর্গ' হিসাবে খ্যাতি অর্জনের প্রধান কারণ ছিল। বিশ্বের মোট শিল্প উৎপাদনে বাংলার শেয়ার ছিল ৫-৬% এর মত । এককালে বিশ্বমাঝারে একটি ধনবান অঞ্চলের দাবীদার হয়েও ১৯৭১ সনে একটি দরিদ্র দেশের তকমা বুকে নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এমন একটি পরিস্থিতি কিভাবে ব্যখ্যা করা যা!!

বাংলা দখলকারী রবার্ট ক্লাইভ, যিনি পলাশির যুদ্ধের পরেই বিজয়ী দেশের কোষাগারকে শুন্য করে দিয়ে নীজে উপকৃত হয়েছিলেন, তিনি নিজের লাভের দায় মোচনের প্রশ্নে ১৭৭২ সালে হাউস অফ কমন্সে একটি ভাষণে বলেছেন যে-
…. The country of Bengal is called, by way of distinction, the paradise of the earth. It not only abounds with the necessaries of life to such a degree, as to furnish a great part of India with its superfluity, but it abounds in very curious and valuable manufactures, sufficient not only for its own use, but for the use of the whole globe. The silver of the west and the gold of the east have for many years been pouring into that country, and goods only have been sent out in return. This has added to the luxury and extravagance of Bengal.
(From D. B. Horn and Mary Ransome, eds., English Historical Documents, 17141783 (London: Eyre and Spottiswoode, 1957), pp. 809-811.)

বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ, শতাব্দীকাল ধরে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান হাতে বোনা সুপারফা্ইন সুতি কাপড়ের কেন্দ্র ভুমি ছিল। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে সুনামের সাথে ঐতিহ্যমন্ডিত যে সমস্ত অতি উন্নতমানের সুতি এবং সিল্ক বস্ত্র তৈরী করতেন তা কেনার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বনিকগন এসেছিলেন। এই অঞ্চলে বহিরাগত বহু পরিভ্রমনকারী এবং ক্রেতারা বেঙ্গল টেক্সটাইলের গুণমান এবং খ্যাতি সম্পর্কে অনেক মুল্যবান কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সে সময় বাংলার খ্যাতি যে কতদূর প্রসারিত হয়েছে তার একটি উদাহরণ ইতিহাসবিদ ক্যাম্পাসের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি থেকে পাওয়া যেতে পারে:
“ একটা সময় ছিল যখন রোমান মহিলাদের জন্য ঢাকাই মসলিন সাথে মসলা ও আন্যান্য ভোগ্য সামগ্রী সাতগাঁও হতে জাহাজে তুলে মিশর হয়ে রোমে পাড়ী দিত তখন সেগুলি সেখানে উচ্চ প্রসংসিত ও ভাল দাম পেতো‍‌‌‌‌‌‍‌. ।
(সুত্র :History of the Portuguese in Bengal. By J. J. A. Campos. Calcutta, 1919. - Volume 52 Issue 2.)

ছবি-৩৩ : মসলিনের সোনালী দিনের পিঠস্থান বাংলার সে সময়ের রাজধানী সোনারগাঁও


সুত্র : বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ,ঢাকা , বাংলাদেশ
ছবি -৩৪ : ঔপনিবেসিক নিপীড়নে ঐতিহ্যবাহী মসলিনের মতই সে সময়কালে
কর্মমুখর সোনারগাঁও এর মসলিন উৎপাদন ও কেনা বেচার আড়ং এর ভগ্নদশা


ছবি সুত্র : প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম/ DRIK

লেখাটির দ্বিতীয় পর্বে থাকবে মসলিলেন অতীত সোনালী দিন এবং কালের গর্বে এর অস্তগামীতার করুন চিত্রগাথা ।

ছবি ও কথা সুত্র : পোষ্টের লেখার মধ্যে যথাযথ স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে ।

এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ৩:১৮
৩০টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×