শাহবাগ থানার সাথে লাগোয়া ফুলের দোকানগুলোর সামনে আজকে সারি সারি চারটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথম দুইটি টিয়ার শেল ছোড়া হয় এমন সাঁজোয়া যান, পরেরটা জলকামানের, পরেরটি আটককৃতদের নিয়ে যাওয়ার ভ্যান। অসংখ্য পুলিশ ছিল। কড়া নজরদারি ছিল। তারা কাউকেই জড়ো হতে দেয়নি। আর হলে হলে ছাত্রলীগ ছিল। সোনার ছেলেরা গতকাল মহসিন হলে আন্দোলন ফেরত কয়েকজকে মেরেছে। অনেককে বলেছে রুম ছেড়ে দিতে। আজকে অনেকের ফেসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভেট করতে বাধ্য করেছে। শাসক গোষ্টির চোখ রাঙ্গানি দেখার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। পরিকল্পনা মাফিক সকালে বুয়েটে কিংবা বিকালে শাহবাগে কোন জায়গার কর্মসূচি হয়নি। খুশি হয়েছেন আপনারা? সুশীলরা? গুজবে কান পেতে দেয়া রথী মহারথীরা?
গতকাল সোনার ছেলেদের আর পুলিশি হামলার পর আন্দোলনের অপমৃত্যু দেখেছিলাম। সবাই সাধারণ ছাত্র। এদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন। তারপরও আশা করেছিলাম আজকের কর্মসূচি হবে। শাহবাগকে ‘ওয়াটার লু’ বানিয়ে যুদ্ধংদেহী পুলিশের আর সোনার ছেলেদের তৎপরতায় তা হয়নি। খুশি হয়েছেন আপনারা? সুশীলরা? গুজবে কান পেতে দেয়া রথী মহারথীরা?
গনজাগরণ মঞ্চের শুরুর দিকের কাহিনী। প্রতিদিন গিয়ে বসে থাকতাম। দুই মামা দেশের বাইরে থাকে। একদিন একজনের ফোন। শাহবাগে যাই কিনা জিজ্ঞেস করল। পজিটিভলি বললাম। উনি দিল একটা ঝারি। ‘কি দরকার এই সব ঝামেলায় জড়ানোর?’।
কিছুদিন পর আরেকজনের ফোন। আগের অভিজ্ঞতায় ঝামেলা না বাড়িয়ে বললাম ‘না মামা, তেমন একটা যাওয়া হয় না’। উনিও দিল এক ঝারি। ‘তোরা ইয়াং জেনারেশন, তোরা যদি যুদ্ধাপরাধীদের, রাজাকারদের বিরুদ্ধে না দাঁড়াস তাহলে কিভাবে হবে’। প্যারাডক্স।
আমরা প্যারাডক্সে নিয়ত’ই পড়ি। আওয়ামী আমলে কোটা বিরোধী আন্দোলন করেন, আপনি শিবির আখ্যা পাবেন। বিএনপির আমলে করেন তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। আমরা নিয়ত ‘মাননীয় স্পীকার’ হয়ে যাই।
সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা কোথায় যাবে? কোথাও যাবেনা। তারা পুলিশের টিয়ার শেলে নাকের পানি চোখের পানি ঝরাবে, সোনার ছেলেদের মার খেয়ে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকবে। খবরদার, টিয়ার শেল থেকে বাঁচতে আপনারা তিনমাসের পুরোনো জরাজীর্ন কাগজ-কাঠের মংগল শোভাযাত্রার রেপ্লিকায় আগুন জ্বালাতে পারবেন না। উনাদের ভাস্কর্যানুভুতিতে আঘাত লাগবে। হেফাজতের ঘোষনায় একবার ভাস্কর্য ভাঙা হবে বলে বলা হয়েছিল। তখন গনজাগরন মঞ্চের সব পেইজ আপডেট দিল ‘ঢাবি দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের জায়গা। কোন অন্যায় বরদাশত করবে না এরা। অপরাজেয় বাংলার দিকে হাত বাড়ালে সে হাত ভেংগে গুড়িয়ে দিবে’।
আমরা লাইক দিলাম, শেয়ার দিলাম। আজকে বোয়ান এর পেইজে সেই ঢাবির ছাত্রছাত্রীদের ‘ফকিরনির পুত’ বলে আপডেট দেয়া হল। তালিয়া। খুশি হয়েছেন আপনারা? সুশীলরা? গুজবে কান পেতে দেয়া রথী মহারথীরা?
প্রতিবছর মংগল শোভাযাত্রার রেপ্লিকা চারুকলার চিকেন বিক্রির গেটের ভিতর পঁচে মাটির সাথে মিশে যায়। তখন অনুভুতি ঘুমিয়ে থাকে। কালকের আগুন নাকি সহিংসতার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিল। যারা আগুন দিয়েছিল তারা অকর্মা নাহলে এখনো কিভাবে এত বিরাট বিরাট দুইটা রেপ্লিকা গেইটের ভিতর আজকেও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। কাগজ-কাঠের এই রেপ্লিকা আজকেও বিকালের ৫ মিনিটের বৃষ্টিতে ভিজেছে। তাদের উপর ছাতা ধরার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। যারা আগুন দিয়েছিল তারা নিশ্চিত অকর্মা নাহলে উল্টা পাশে এত গুলো টংয়ের দোকান, এতগুলো ভ্যান পড়ে আছে। কত সুন্দর করে জ্বলত। তাতে আগুন দিল না। পরিত্যাক্ত রেপ্লিকায় আগুনের চেয়ে ওই আগুনের তাপ আরো বেশি তীব্রতর হত। কিছু মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হত। তাতে কিছুটা পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া যেত। ঠিক না?
ছাত্রদের বাঁচাতে ব্যর্থ ভিসি, প্রক্টরের বাসভবনে হামলা না করে এসব জায়গায় হামলা হলে উনারা ত্যানাটা আরো ভালোভাবে প্যাচাইতে পারতেন। শিবিরের সাথে তখন জনগণের জানমালের শত্রু উপাধিও পাওয়া যেত।
আন্দোলনকারীরাদের আরেকটা প্রব্লেম আছে। মুখ থেকে বের হওয়া ‘হাঁস’ যেমন ‘বাঁশ’ হয়ে যায় তেমনই তাদের ‘পিএসসির দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’ মুখ থেকে বের হলেও ফেসবুকে এসে পিএসসির জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা বসে যায়। কার দোষ? কার প্রব্লেম? কানের না মুখের? ফেসবুকে এ নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের চৌদ্দ দুগুনে আটাশ গোষ্টি উদ্ধার হয়। সবাই জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়। ঘরে বসে অনেক কিছুই অনুমান করা যায়। সত্যটা রাস্তায় এলে টের পেতেন।
শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম দিকে জামাত-শিবির একটা গুজব রটিয়ে দেয় যে শাহবাগে ইসলাম অবমাননা হচ্ছে। যদিও মাইকে ধর্ম নিয়ে কখনোই কিছু বলা হয়নি। এটা নিয়ে বাঁশের কেল্লা খেল দেখাল। ঘরে বসে সবাই গুজব শুনে আপনারাও খেল দেখালেন। আপনারা কেন তাদের মত হতে গেলেন? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে শাহবাগ আন্দোলনে ছিলাম তার মানে এ না যে যখন যা ইচ্ছা অনুমান নির্ভর বলে যাবেন আর আমরা তা সমর্থন করে যাব।
সাধারণ ছাত্রদের শান্তিপূর্ন আন্দোলনে পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়তে ছুড়তে শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত নিয়ে গেলে আপনি ক্যাম্পাসের অভিভাবক হিসেবে ভিসি, প্রক্টর কিংবা প্রশাসনের সহযোগিতা আশা করতেই পারেন। লাত্থি মারি তোর আশা। উনারা নির্বিকার। নির্যাতিত হয়ে ক্ষোভে, রোষে সাধারণ ছাত্ররা ভিসির গেট ভাংচুর করেন। বাগান উপড়ে ফেলেন। এধরনের কাজকর্ম একদম সমর্থন যোগ্য না। কিন্তু পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে কিছুই করার থাকে না।
হেফাজতের শাপলা চত্বরের সমাবেশ শেষে একদল লোকের শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসার খবর পাওয়া গেল। সবাই ব্যানার, ফেস্টুনের বাঁশ, কাঠ খুলে নিল। ফুলের দোকানের সামনের বাঁশ তুলে নিয়ে, ইট ভেঙে হাতে নিয়ে প্রতিরোধের জন্য শাহবাগের পূর্বপাশের ওভারব্রিজ পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েছিল সবাই। প্রতিরোধের জন্য। আর বিনা দোষে টিয়ার শেল ছোড়া পুলিশের দিকে সাধারণ ছাত্ররা ইট ছুড়েছিল প্রতিরোধের জন্য। কিন্তু এটা নাশকতা। সেটা ছাত্রদের গোল্লায় যাওয়ার লক্ষণ। কেন? ছাত্রদের অবস্থান, আন্দোলনে কি অযৌক্তিক কিছু ছিল? প্রথমদিনের শান্তিপূর্ন অবস্থানের পর দ্বিতীয় দিনের মত শান্তিপূর্ন শাহবাগ অভিমুখী মিছিলে পুলিশের হামলা কেন? আচ্ছা বাদ দেন। প্রতিরোধ, নাশকতা কোনটাই করব না। একজোট হয়ে প্রশাসনের নির্লিপ্ততার জবাব চেয়ে স্লোগান দিব। কালকে ঠিক এই সময়টাতে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের বেধড়ক পেটালো। আজকের প্রথম আলোর প্রথম পেইজেটা দেখুন। ঘটনাটা নিজেই দেখেছি। কারো মুখে শুনে, ফেসবুকে দেখে তারপর বলছিনা। ছাত্রলীগের এই কাজের প্রতিবাদ করেছেন কেউ?
ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। আমরা ‘মাননীয় স্পীকার’ হয়ে যায়।
মোট জনসংখ্যার ০.১২% এর জন্য ৩০% কোটা রাখার বিরুদ্ধে কথা বললে আপনি জামাত-শিবির হয়ে যাবেন। অতিরিক্ত কোটার বিরুদ্ধে কথা বললে আপনি স্বাধীনতা বিরোধী হয়ে যাবেন। বাকি ৯৯% যারা মাত্র ৪৪% সিটের সুবিধা পায় তাদের মধ্যে গরীব ঘরের কোন সন্তান নাই? ছোট পাঁচ বোনের একমাত্র কোন বড় ভাই নাই? চুপ, তোরা শিবির। আবারো আমরা ‘মাননীয় স্পীকার’ হয়ে যায়।
আপনাদের সত্য আন্দোলনে আমরা ছিলাম কিন্তু আমাদের এই দাবি এমন কি অযৌক্তিক ছিল যে আপনারা আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেলেন, প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গেলেন, গুজবে কান দিয়ে সবার গুষ্টি উদ্ধার করলেন।
-‘ভাই, আপনার মতের সাথে আমার মত মিলে গেছে আসেন কোলাকুলি করি’,
-‘ওই তোর মতামত ভালো লাগে নাই, পেছন ফির, একটা লাত্থি মারি’।
সাধারন ছাত্রদের এই আন্দোলনের সাথে অনেকে বাঁশের কেল্লার পোস্টের সাযুজ্য খুঁজে ফেরেন। তাদেরকে বলতে চাই এই আন্দোলনের ইনিশিয়েটর কিন্তু সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাই। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য জামাত-শিবির এটার সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করতে পারে।
হেইট দৌজ বাস্টার্ডস। ইগনোর দেম।
কেন, আপনারা তো গুজবে কান না দিয়ে, ত্যানা না প্যাঁচিয়ে দাবির যৌক্তিকতা একটু ভেবে দেখতে পারতেন। নিরপেক্ষ ভাবে চিন্তা করলে যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষে এই অসামঞ্জস্যতা চোখে পরতে বাধ্য। এই সব স্বাধীনতা বিরোধীদের বারবার সুযোগ করে দেওয়ার দায় আপনাদেরকে নিতে হবে।
কোটা প্রথা বাতিল বলা হলেও বাস্তবতার নিরিখে এটা সম্ভব না। কিন্তু সংস্কার করা তো যেতে পারে। আশা করি তা হবে। এবার না হলে কোন একসময়। না হলেও সমস্যা নাই বৈষম্যের দায় নিয়ে যদি কখনো প্রশ্ন উঠে তাহলে আমরা বলতে পারব ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম’।
অন্যরা মনে হয়না দায় ভাবে। তাদের আবার দায়ের বদলে আয়। দুই লাখ চার হাজার আটশ জন লিস্টেড মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৪৪ হাজার ভুয়া। এ দাবি স্বয়ং মুক্তিযদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রানলেয়র প্রতিমন্ত্রীর।
আরেকটা খবর আছে, বীরশ্রেষ্ট রুহুল আমিনের ছেলে চায়ের দোকানে পানি টানে। খুশি হয়েছেন আপনারা? সুশীলরা? গুজবে কান পেতে দেয়া রথী মহারথীরা?
Shahriar Riad