দক্ষিণ এশিয়া ভূ-অর্থনৈতিক বিবেচনায় আধুনিক পৃথিবীর অত্যন্ত গুরুত্ববহ এলাকা। কিন্তু যখন পুরো পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে তখন দক্ষিণ এশিয়া পেছনেই পড়ে থাকছে। এ বাস্তবতা মেনে নেওয়া উচিত, তারপরও আমরা ভাবতে ভালোবাসি সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছি আমরাই। কিন্তু বাস্তবে পড়ে আছি তলানিতে। আমরা সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, ধর্মোন্মাদনাগ্রস্ত, অন্দত্বের শিকার। প্রগতি অর্থ শুধু কতিপয় শহর এলাকার প্রযুক্তিগত উন্নতি নয়। কিন্তু একেই উন্নতির সূচক বলে প্রতিনিয়ত আমরা নিজেদের অপমান করে চলেছি। আর সেটা ঢাকা, করাচি, লাহোর, দিল্লি, মুম্বাই, কলোম্বো, কাঠমান্ডুর রাস্তার দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। আমরা প্রতিদিনই একে অপরকে খুন করার জন্য প্রস্থুত হচ্ছে। আমরা কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জন করলেও কার্যত শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্পায়ন, স্যানিটেশন, সাধারণ চাহিদা, প্রযুক্তি, জনকল্যাণ এমনকি ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে মৌলিক অধিকার থেকে। ১৫০০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যকার মাত্র ১ শতাংশ ধনী ও বিখ্যাতরা তাদের জীবনযাপনের ঠাঁটবাট থেকে এটা দেখাতে ভালোবাসেন যে, আমরা ইউরোপীয় বা আমেরিকানদের থেকে ভালো আছি। হয়তো তারা ইউরোপের ধনীদের চেয়ে ভালো জীবনযাপন করেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ ইউরোপের কুকুরের চেয়েও খারাপ জীবনযাপন করে। অপর কোনো এশীয় জাতির সঙ্গেই আমাদের তুলনা চলে না। আমাদের তুলনা চলে শুধু আফিদ্ধকার বিধ্বস্ত জাতিগুলোর সঙ্গেই।
আমদের আইনি ব্যবস্থাপনার অবস্থা করুণ। আইন প্রয়োগ ব্যবস্থা ক্রয়যোগ্য। কেউ চাইলেই এখানে পুলিশ এমনকি সাংসদকে পর্যন্ত কিনে নিতে পারে, প্রাইভেট সন্ত্রাসী বাহিনী বা সন্ত্রাসবাদী পুষতেই পারে, যে কেউ যে কাউকে খুন-ধর্ষণ করতে পারে, যে কেউ হতে পারে রাজনীতিক, সরকারের মন্ত্রী, দেশের নেতা বাধা দেওয়ার কেউ নেই। এ নেতারা হয় দুর্নীতিগ্রস্ত, নয়তো চোরাচালানকারী, খুনি, সন্ত্রাসের গডফাদার। এ নেতারা জনরোষকে উপেক্ষা করে, নিজেদের বাহুবল ব্যবহার করেই দিনের পর দিন টিকে থাকে। আমরা এ সমস্যাকে চেপে যেতে চাইলেও এটাই সত্য, এ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনাই আমাদের সব সমস্যার উৎস।
অতিরিক্ত জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ, দক্ষ জনবল, উপযুক্ত সমাধানের অভাব আমাদের সমস্যা নয়, আমাদের সমস্যা অবজ্ঞা। ধর্মীয়ভাবে আমরা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বাস করতে চাই কল্পনার দুনিয়ায়। এই অধিবাস্তব মন বুঝতে পারে না কীভাবে আমরা জীবনের দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে পারি।
একটি তথাকথিত দৃশ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই গণতন্ত্র নয়। ভোটাররা যদি দুইয়ের মধ্যে একজন নয়তো অন্য একজনকে পছন্দ করতে বাধ্য হয়, যদি মিডিয়ার প্রচারণার বাইরে কিছু ভাবতেই না পারে তবে গণতনে্পর অর্থ কী? ভোটাররা যদি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ে সচেতন না হয়, ভোট প্রক্রিয়া যদি দুর্নীতিগ্রস্ত থাকে তবে তা সফল গণতন্ত্র হয় কী করে?
আমাদের ব্যবস্থা পুরোটাই পচে গেছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ফটোকপি প্রতিষ্ঠানে। নিজেদের বলে কোনো কিছুই তৈরি করতে পারিনি আমরা। দর্প, ভয় আর নিরাপত্তাহীনতা আমাদের বানিয়ে তুলেছে আহাম্মক। আজ দক্ষিণ এশিয়া পরিণত হয়েছে সবচেয়ে অবমূল্যায়িত ও সবচেয়ে ভুলভাবে মূল্যায়িত জনপদে।
যেখানে আমাদেরই বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা, সেখানে প্রতিবেশীদের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাবের অভাবে নিজেদের বাজারের বিকাশ না ঘটিয়ে আমাদের দৃষ্টি দিতে হচ্ছে বাইরের দিকে। বিছানা থেকে উৎখাত হলেই কেবল আমাদের পক্ষে লড়াইয়ে নামা সম্ভব। সাউথ এশীয়রা একে অপরকে দোষারোপ করতে ভালোবাসে। সম্ভব হলে তারা পরসঙ্রের ওপর পাঁচবার করে বোমা ফেলত। আমাদের জনগোষ্ঠী এক, জনরীতি এক, সংস্কৃতি এক তারপরও আমাদের আচরণ অনেকটা রাগাল্পি্বত অবুঝ বাচ্চাদের মতো। পৃথিবীর জাঁহাবাজ শত্রুরা যখন ভেদাভেদ ভুলে আলাপ-আলোচনা করছে, বাণিজ্য-সম্পর্ক স্থাপন করেছে তখন আমরা ব্যস্ত প্রতিদিন আমাদের ট্যাঙ্ক ধোয়ামোছা আর নিউক্লিয়ার বোমায় চুমু খেতে। সহজ কথায়, আমরা খুবই নিরাপত্তাহীন, কিছু উগ্র মানুষের কারণে শান্তিতে থাকতে পারছি না আমরা। শুধু শারীরিক সহিংসতা বলে কথা নয়, আমাদের আছে গাঠনিক, আধ্যাত্দি্মক এমনকি ব্যক্তিগত সহিংসতাও।
তথ্যক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় তৈরি হয়েছে এক বড় শহৃন্যতা। গুণগত মানসম্পন্ন খুব কম তথ্যই আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সম্পর্কে। কানপুরের ভারতীয় পাঠক পাকিস্তানের খবর পায় ফদ্ধান্সের এএফপি বা বিবিসি মারফত। পাকিস্তানের একটি পত্রিকা বাংলাদেশ বা ভারত সম্পর্কে তার খবরটি তৈরি করে আমেরিকার এপি থেকে।
আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়?