somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১২ই আগস্ট, ২০০০ সাল। কুর্সক টাজেডি। মাত্র 10.5 বিলিয়ন US$ -এর বিনিময়ে ঠেকানো গিয়েছিলো এক ভয়াবহ পারমানবিক যুদ্ধ।

০৬ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্যারেন্ট সাগরে তখন চলছিল অতি গোপনীয়তায় ছয় দিন ব্যাপী রাশিয়া, চিনের যৌথ নৌ মহড়া।
দুর্বল অর্থনীতি আর ক্রমঃপত্তনশীল সামরিক শক্তির রুশদের এই বিশাল মহড়া তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, এই ছিল বিশ্বাস।
কিন্তু সহসায় আসে দুঃসংবাদ। মহড়ায় অংশ নেয়া ছয়টা বিশাল অস্কার ক্লাস সাবমেরিনের একটা ( কুরস্ক ) এর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষন পর জানা গেল সেখানে দুর্ঘটনা সম্বন্ধে। মহড়ায় রুশ কমান্ডার ছিলেন এডমিরাল পাপভ, যিনি অবস্থান করছিলেন ওয়ার ভেসেল পিটার দা গ্রেট-এ। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই দুর্ঘটনা্র খবর পেয়েছিলেন। খবর পেয়েই মেইনল্যান্ডে চলেযান উর্ধবতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায়। ফিরে এসে কুরস্কের অবস্থান বের করতে আদেশ দেন। প্রায় আট ঘন্টা পর জানা গেল ১৪০ কিমি দূরে ৩৬০ফুট গভীরে ডুবে গেছে কুর্সক, ভেতরে আটকা ১১৮জন অফিসার।
এর পর কদিন চলল অফিসারদের উদ্ধার তৎপরতা। খারাপ আবহাওয়ার জন্য পর পর তিনবার রুশ রেসকিউ দল ব্যার্থ হল। এদিকে ব্রিটিশরা উদ্ধার অভিযানের প্রস্তাব করল, কিন্তু তাতে করে অতি গোপনীয় সফিস্টিকেটেড বিশাল অস্কার ক্লাস সাবমেরিনের প্রযুক্তি ফাঁস হয়ে যেতে পারে বলে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তা প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে উত্তেজনা বাড়োছে, জাহাজে রিজার্ভ অক্সিজেন ফুরিয়ে আসে। অবশেষে চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট নরওয়ের রেসকিউ টিমকে উদ্ধার কাজ পরিচালনার অনুমতি দেয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার ৯ দিন পর তারা গিয়ে সেখানে কাউকেই জীবিত পায়নি। মর্মান্তিক ভাবে প্রাণ হারায় রুশ নেভির ১১৮জন অফিসার। সাড়া বিশ্বকে নাড়া দেয় এই মর্মান্তিক ঘটনা

এরপর প্রেসিডেন্ট পুতিন কিছু অবাক করা পদক্ষেপ নেয়, যার মধ্যে ছিল রুশ নেভির ৯জন শীর্ষ এডমিরালকে বরখাস্ত করা, এদের ভেতর সেই মহড়ার কমান্ডার এডমিরাল পাপভও ছিলেন।

এই হল বাইরের দৃশ্যমান ঘটনা। কিন্তু ভেতরের রহয় ছিল আরও গভীর, যা তাৎক্ষনাত বের হয়নি। প্রথমে রুশ কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার কারণ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি কিংবা বলেনি। তারা এক এক বার এক এক তত্ব হাজির করছিল, যার মধ্যে অতি হাস্যকর কিছু কারণও ছিল। যেমন একটা তত্ব ছিল, সেই নিহ ১১৮ জন অফিসারের মধ্যে দু'জন মুসলিম, তাদের একজন আবার দাগেস্তানি, যেখানে এন্টিরুশ মিলিটান্টদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি, ইত্যাদি। কিন্তু তার সহকর্মীদের নিন্দা এবং প্রতিবাদের মুখে উড়ে যায় সেসব তত্ব। কিন্তু আসল ঘটোনা রুশ কর্তৃপক্ষ কখনও প্রকাশ করেনি।

তাহলে প্রশ্ন হল, আসলে কী ঘটেছিল সেখানে? কেন এই দুর্ঘটনা। কেনই বা রুশরা সত্য গোপন করেছে?

পর্দার পেছনের ঘটনা আরও জটিল।
এই নৌ মহড়া ছিল নতুন রাশিয়ার ইতিহাসের অন্যতম বড় সামরিক মহড়া। মহড়ার ব্যাপ্তী, আকার; ইত্যাদি বাইরের বিশ্বের কাছে কঠোর ভাবে গোপন রেখেছিল রাশিয়া। কিন্তু আমেরিকানরা মহড়ার খবর আগেভাগেই জেনে গিয়েছিল! তারা আগে থেকেই ব্যারেন্ট সাগরে দুটি ছোট আকারের গোয়েন্দা সাবমেরিন (ইউএসএস মেম্ফসিস), (ইউএসএস টলিডো) পাঠিয়েছিলো!

ঘটনার দিন(১২ই আগস্ট) তারা খুব কুর্সকের কাছে থেকে সতর্কভাবে গতিবিধি পর্যবেক্ষন করছিল। তাদের মিশন ছিল ইউএসএস মেম্ফসিস নজরদারী করবে সামুদ্রিক জায়ান্ট কুর্সকের, আর শ্যাডো সাপোর্টিং হিসেবে থাকবে ইউএসএস টোলিডো, যে ম্যাগনেটিক সিগনালের মাধ্যমে দুই আমেরিকান সাবমেরিনের অবস্থান ধরতে বিভ্রান্ত করবে রাশিয়ান জায়ান্ট সাবমেরিনকে, কারন যৌথ মহড়ায় চায়না সাবমেরিনও অংশ নিয়েছিল। স্বল্প দূরত্বে এরকম রণকৌশল সবসময়ই খুব বিপজ্জনক। এরকমই এক অসতর্ক ঘূর্ণনের সময় এক পর্যায়ে টোলিডো খুব নিকটে চলে আসে এবং একটা কুরস্কের সম্মুখভাগের সাথে একটা সংঘর্ষ হয়।

১৫৪ মিটার বিশাল রাশিয়ান সাবমেরিন কুর্সকের সাথে সংঘর্ষে ছোট ইউএস টোলিডো দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সংঘর্ষের পর পরই কুর্সকের ক্রু-রা বাইরে বিদেশী সাবমেরিনের অস্তিত্ব টের পেয়ে যায়। একই সাথে উপরে থাকা জাহাজ পিটার দা গ্রেট এই কোলিশন রেকর্ড করে। তক্ষনাত বাকি সাবমেরিনকে দ্রুত কুর্সকের নিকটে যাবার নির্দেশ প্রদান করে। কাছাকাছি এয়ার বেস থেকে উপরিভাগে ফাইটার জেটও পাঠানো হয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের জন্য।

সংঘর্ষের পর পরই টোলিডো স্থান ত্যাগ করে, তাকে কভার করে মেম্ফসিস। এদিকে কুর্সকের ক্রুরা শত্রু সাবমেরিনের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের শাকভাল ভিএ-১১১ টর্পেডো ছোড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কুর্সকের টর্পেডো লঞ্চিং ইউনিট একটিভেটেড করার প্রক্রিয়া শুরু হলে ইউএস মেম্ফসিসের ক্রু-রা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেননা অতি দ্রুত গতির শাকভাল তাদের টর্পেডোর চাইতে দশ গুন বেশী গতিসম্পন্ন এবং সর্বাধিক ধ্বংসাত্বক টর্পেডো। আর শাকভাল লঞ্চ করে ফেললে তারা যে দুরত্বে ছিল, তাতে ডাইভ দেওয়া বা স্থান ত্যাগ করার কোনও সুযোগ ছিলনা। সুতরাং খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মেম্ফসিসের কমান্ডার কুর্সকের টর্পেডো লঞ্চিং ইউনিট একটিভেটেড হওয়াতে পাল্টা টর্পেডো ফায়ার করার সিদ্ধান্ত নিলেন!

দ্বিতীয়বার না ভেবেই মেম্ফসিস ফায়ার করে বসে কুর্সক লক্ষ্য করে। আমেরিকান মার্ক-৪৮ টর্পেডোর প্রথম আঘাতে কুর্সকের সামনের ভাগে টর্পেডো ইউনিটে থাকা অন্যান্য ডেটনেটর বিষ্ফোরিত হয়, দ্বিতীয় টর্পেডো কুর্সকের মাঝ বরাবর সরাসরি আঘাত করে। বিষ্ফোরন এততাই ভয়াবহ ছিল যে শক ওয়েভে আক্রমনকারী মেম্ফসিসও ভারসাম্য হা্রিয়ে ফেলে।
তলিয়ে যেতে থাকে রুশদের অহঙ্কার সমুদ্র জায়ান্ট বিশাল কুর্সক।

এই ঘটনার খবর শুরুতেই জেনে যায় রুশ নৌবাহিনী এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, কিন্তু কৌশলগত কারণে তা গোপন রাখা হয়, কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে শুধু বলাহয় একটা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। নিউইয়র্ক টাইমস পরবর্তীতে আমেরিকান সাবমেরিনের গোয়েন্দাগিরির তথ্য ফাস করে দেয়।
রাশিয়ানরা ইউএসএস মেম্ফসিসের পালানোর সময় তার গতিবিধি লোকেট করতে সক্ষম হয়। প্রায় সাত দিন পর এটা রুশ সমুদ্রসীমা অতিক্রম করে নরওয়ের সমুদ্রসীমায় পৌঁছে। আর এর ফাঁকে ক্ষতিগ্রস্থ ইউএসএস টোলিডো অতি গোপনে সরাসরি আটলান্টিক হয়ে আমেরিকায় পৌছে।

এই ঘটনা রাশিয়ানদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। রুশ নৌবাহিনী এর প্রতিশোধ নেবার জন্য উন্মুখ হয়ে যায়। প্রেসিডেন্টের উপর যুদ্ধ ঘোষণার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। পরবরতী ঘটনাপ্রবাহের ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেন, যে কোনওভাবে সম্ভাব্য যুদ্দ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য। তিনি সিআইএ-র প্রধানকে জরুরি ভিত্তিতে এক গোপন সফরে মস্কো পাঠান, যা ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। দুঃখপ্রকাশ করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে ফোনালাপ করেন। রাশিয়ার সমস্ত ঋণ মওকুফ করে দেন। উলটো আরও সাড়ে দশ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের ছাড় করেন।

এদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন পড়েন উভয়মুখি সংকটে। একদিকে এর জবাব দেবার জন্য ভেতরের চাপ, আরেকদিকে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য বাইরের চাপ। কিন্তু শেষমেশ তিনি আমেরিকানদের সাথে সরাসরি সংঘাতে না যাবার সিদ্ধান্ত নেন। বরখাস্ত করেন শীর্ষ এডমিরালদের।

কিন্তু কেন আপোষ করলেন?
একদিকে ভঙ্গুর অর্থনীতির রাশিয়ার জন্য মাত্র সাড়ে দশ বিলিয়ন ডলার তখন ছিল আদতেই 'বিরাট কিছু', সাথে সব ঋন মওকুফ।
আরেকদিকে পুতিন বুঝে গেছিলেন, খর্ব শক্তির রুশ শক্তি আমেরিকানদের সাথে পেরে উঠবে না। সুতরাং যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নিতান্ত্বই আত্মঘাতী।

কুর্সক ট্রাজেডি নিয়ে ২০০৫-এ ফরাশি পরিচালক জেন মাইকেল কারে একটা ডকুমেন্টারি তৈরী করেন, Kursk: a Submarine in Troubled Waters।
২২টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×