১.
"স্বপ্ন দেখার মাঝে কোনো সমস্যা নেই, বাস্তবে তার আক্ষরিক পূর্ণতা খুঁজে ফিরলেই সমস্যা ".....
কথাগুলো পড়েই, কিছুটা চুপ হয়ে গেলাম। মনের কথাগুলো তাকে বলে ভূল করলাম কিনা, সেই নিয়েই উল্টো মাথাবেথ্যা শুরু হলো। অনেকদিন থেকেই তাকে বলবো বলবো করেও বলা হচ্ছিলো না, মাঝে মাঝে তার অদ্ভূত প্রিয় চোখগুলোর দিকে তাকালে মনে হতো আমার সমস্ত না বলা কথাগুলো ও পড়ে চলেছে। চোখে চোখ পড়লেই সমগ্র আমিতে অদ্ভূত একটা শিহরণ বয়ে যেতো। এখন মনে হচ্ছে, কল্পনার ভাবনার সাথে সত্যিই বাস্তবের অনেক পার্থক্য। অতি ক্ষুদ্র একটা লাইন তাকে লিখে পাঠিয়েছিলাম
" জলরং মেশানো সমূদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো তোমার ঠোঁটজোড়া আমায় একটু ছুঁতে দাও, কথা দিচ্ছি সমূদ্রের ঢেউয়ে চেপে জোয়ার ভাটার সঙ্গী হবো।"
আমার এলোমেলো কথা শুনে তার এই ফিলোসফিকাল উত্তর। কিছুদিন থেকেই আমার একাকিত্বের কথা তাকে শুনিয়ে যাচ্ছি, আকারে ইঙ্গিতে তাকেই পাশে চাইছি সেটার বহিঃপ্রকাশ। গতদিন খুব ভোরে তাকে একখান প্রেমের চিঠি পাঠিয়ে ছিলাম ফেইসবুকে। চিঠিটা ছিলো এইরকম :
এই যে তুমি,
রাত্রির আঁধার কেটে সকালের সিগ্ধ ভোর নিয়ে আসুক, কিছু ঝরে পড়া বেলী ফুলের সুবাস। মাটির নির্যাস মেশানো সেই শিশির ছুঁয়ে থাকা ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ুক তোমার ঘরময়। রাত্রির আগোছালো বিছানার ন্যায় তোমার এলোমেলো চুলগুলো আমায় একবার ছুঁতে দাও। তোমার স্বপ্ন মাখানো সেই চুলের সৌরভ, আমি চড়িয়ে দিবো আমার জগৎময়। চাঁদের জোছনা মাখা তোমার হাতটা আমায় ধার দাও, কথা দিচ্ছি জোছনা ছুঁয়েই তোমায় ফিরিয়ে দেবো। নক্ষত্র ঘেরা তোমার চোখের উপর আমার ঠোঁটগুলো রাখতে দাও, কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমায় এই মহাবিশ্ব ছুঁয়ে থাকতে দাও। তোমার হৃদয়ের ঠিক উপরে আমায় হাত রাখতে দাও, কথা দিচ্ছি নিমেষে মহাজগতের সমস্ত সময় আমি থামিয়ে দেবো । হ্যা, এবার চোখ খোলো, কথা দিচ্ছি আমার পৃথিবীর সমগ্র আলো নিভা পর্যন্ত তোমারি পাশে থাকবো।"
সকাল গড়িয়ে দুপূর, এরপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আঁধার, মেসেজের কোনো রিপ্লাই আসে না। ধরেই নিলাম, এই মেয়েকে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়েই বলতে হবে " ভালোবাসি ", এরপর যা হবার হবে। ক্লান্তিহীন অপেক্ষা আর মোটেই সয্য হচ্ছে না। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে রাতে সুবিশাল চাঁদ দেখে তাকে পূনরায় মেসেজ পাঠালাম :
"ধরে নাও, চাঁদের সচ্ছ আলোর মাঝে দুজন দাড়িয়ে, আলোর জোছনায় স্নান করার অদ্ভূত খেয়াল তাদের। বিশাল কোনো অট্টালিকার চাঁদের ছায়া পড়েছে রাস্তায়, তাই দেখে একজন বলে উঠলো 'দেখো, বিশাল এক ছায়া ঘেরা চন্দ্র জাহাজ আসছে আমাদের নিবে বলে, জোছনার আলোক সমূদ্র পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে অজানা কোনো নক্ষত্রের দেশে।' ভাবনাটা কেমন লাগলো ?
একটু পরেই তোমার উত্তর " তোমার ভাবনার রং অনেক সুন্দর"
নাহ, চন্দ্র আলোয় একসাথে আর হাঁটা হলো না। কি করবো ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার অতীব চমৎকার প্রেমের লিখা হয়তো মেয়েটির কাছে অতীব বাজে মনে হচ্ছে। এই বেপারটাই আমাকে বেশি কষ্ট দেয়, যখন তুমি যা চাইবে সেটা কখনোই সেই মুহূর্তে পাবে না। অনন্তহীন অপেক্ষা শেষে একদিন ঠিকই হয়তো হাতের মাঝে ধরা দিবে, কিন্তু ততদিনে এই আমি অনেক পরিবর্তিত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঘেরা ভালোবাসার জগৎ এখন, পুরানো প্রেমিকের ন্যায় রোমান্টিক চিঠি এখন তেমন একটা মুল্য পায় না। নিজকে আরেকটু মডারেট করবো নাকি পুরানো আঙ্গিকে ভালোবাসার জগতে ঘুরে বেড়াবো, সেই চিন্তা ভাবনা মাথার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তার মাঝখানেই ফোনটা বেজে উঠলো, মেয়েটির নাম স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।
-- তুমি, কি রাতের আঁধার পছন্দ করো ? " হ্যালোর পরিবর্তে মেয়েটির প্রথম কথা
-- আঁধার ভালো লাগে, কারণ এর মাঝে আলোর জন্য অদ্ভূত এক অপেক্ষা আছে
-- জোনাকি ?
-- কয়েকটা জোনাকি হাতের মুঠোই নিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে, মনে হয় এক টুকরো আলোক কণা হাতে নিয়ে হাঁটছি, ইচ্ছে হলেই আঁধার মাঝে উড়িয়ে দেয়া যাবে ক্ষনিকের নক্ষত্র।
-- রাতের আকাশ ?
-- আঁধার মাঝে আকাশের সাদা মেঘগুলো বেশ ভালো লাগে, কেমন জানি বড্ড আপন মনে হয়
-- চাঁদ ?
-- সেতো সবারই পছন্দের !!
-- আঁধারে ঢাকা বৃক্ষ ?
--চন্দ্র আলোয় তাদের ছায়ার মাঝে বসে থাকতেই ভালো লাগে
-- জানো, রাতের আঁধার আমার মোটেই পছন্দের নয়
এই বলে হুট করে ফোন কেটে দিলো। আমি পুরোই কনফিউজড হয়ে গেলাম।
২.
" হারিয়ে যেতে চাও " ......ফেইসবুকে মেয়েটার ছোট্ট একটি মেসেজ দেখে চমকে উঠলাম। আমি মোটামুটি হাল ছেড়ে দিয়ে দিয়েছিলাম, প্রায় কয়েক সপ্তাহ পর হটাৎই এই অদ্ভূতেড়ে মেসেজ।
-- হারিয়ে যাবো বলেই যে পথে নেমেছি " ...আমার সোজাসাপ্টা উত্তর
-- কাব্য নয়, সত্যিই হারিয়ে যেতে চাও ? আমার উত্তরে অপেক্ষা না করে মেয়েটা একনাগাড়ে বলে চললো,
" বর্ষার প্রথমদিকের বৃষ্টির পানিতে পুকুরগুলো ভর্তি হতে থাকে, এইরকম ছোট্ট একটা পুকুর পাড়ে গিয়ে বসবো। টলটলে সেই পানি দেখে হয়তো মনের মাঝে ইচ্ছে হবে ঝাপিয়ে পড়ার। না, সেটা করা যাবে না। প্রথমে আলতো করে হাতের তালু দিয়ে পানি ছুঁয়ে দিবো, এরপর পায়ের গোড়ালি ডুবিয়ে অনেকটা সময় বসে থাকবো। তোমার কাজ হবে, আশপাশ থেকে সবুজ দুটো পাতা আর ইঞ্চি সমান একটা কাঠি খুঁজে আনবে। প্রথম পাতাটার পিছনের অংশে লিখবে 'ভালোবাসি' আর পরের পাতাটায় 'ভালোবাসিও'। এরপর একটু দুরুত্ব থেকে দুটি পাতা পুকুরে ভাসিয়ে দিও। বাতাসের ঢেউ যদি ভাসমান দুটি'পাতা এককরে ছুঁয়ে দেয়, ঠিক তখনি তুমি আমার পাশে এসে বসো। "
একনাগাড়ে কথা বলে থেমে গেলো সে। আমি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললাম
-- এরপর ?
-- খাঁচায় বন্দী পাখিকে যদি তুমি ছেড়ে দাও ! দেখবে, কিছুক্ষণ থেমে থেকে কিছুটা অবিশ্বাস আর বিস্ময় নিয়ে পাখিটি এক ছুটে আকাশ ছুঁতে উড়ে যাবে। এরপর, কি হবে জানা নেই পাখিটার। মুক্তির আনন্দ আর আকাশ ছোয়ার ইচ্ছে তাকে পরমূহুর্তে কি হবে সেটা ভাবায় না।
-- "একটি পাতার ইচ্ছে হলো আকাশটাকে ছুঁবে
পাখির সাথে মেললো ডানা, সূর্য উঠলো পূবে " ...
.....থেমে থেমে কবিতার মতো করে গানের কথাগুলো বললাম তাকে। ফোনের মাঝেই তার দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট শুনলাম, বলে উঠলো
-- আসবে তুমি ?
-- " হয়তো আসবো " এই বলে লাইনটা কেটে দিলাম।
৩.
ব্যাগ গোছাতে হবে, এই মেয়ে ঠিক কি চাইছে জানা নেই। শুধুই কি একটি দিনের জন্য মুক্ত পাখি হতে চাইছে, নাকি সত্যিই আমার সঙ্গী হয়ে অদূর আকাশ ছুঁতে চাইছে। এতোকিছু ভাবার সময় নেই, ঝটপট রেডি হয়ে বের হলাম। ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছে, শহর ছেড়ে ঠিক কোথায় গেলে পানিতে পরিপূর্ণ ছোট্ট একটা পুকুর পাওয়া যাবে আমার জানা নেই। এরপরও মুঠোফোনে তাকে লিখে পাঠালাম
" তোমার সাথে প্রথম যেখানে দেখা হয়েছিলো, সেখানে ফানুস হাতে দাড়িয়ে আছি, তুমি আসলেই আকাশে ছেড়ে দিবো "
এবার অপেক্ষার পালা। ফোটা ফোটা বৃষ্টি ছেড়ে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে, এভাবে চলতে থাকলে শহর তলিয়ে যাবে কয়েক ঘন্টার মাঝেই। শহর ছেড়ে চিন্তায় হারিয়ে গেলাম নিমেষে, ছায়া ঘেরা ছোট্ট একটা পুকুর, যার মাঝে আঁকা হবে নতুন কোনো প্রেমময় গদ্য।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


