দুই
আজগর আলীর শরীরের অবস্থা খারাপ। অসুখ-টসুখ কিছু না - কিন্তু কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না। শরীর কামড়াচ্ছে। কাউকে দিয়ে মালিশ করালে ভালো হত। কাকে দিয়ে মালিশ করাবে ? বৌ থাকলে মালিশ করানো যেত। হায় রে বৌ ! এক হাজার টাকা মাইনের চাকুরি করে বৌ রাখা যাবে না, লাথি মেরে চলে যাবে।
শাহিদার মা এসে বলল, ‘ভাইজান, উডেন। আর কত ঘুমাইবেন ?’
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সকাল সাতটায় ‘কত ঘুমাইবেন’ বলার কী হল ? আজগর আলী পাশ ফিরে শুল। আজকে সে আটটার আগে উঠবে না। আটটায় উঠে রহমত মিয়ার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজবে। চাকুরি থাক বা যাক। একটা দিন কিছু একটা করতে হবে। ব্যাটা মানুষকে মানুষ মনে করে না - কথায় কথায় ধমক।
‘কী অইল, উডেন না ?’ - শাহিদার মা তাড়া দেয়।
‘চুপ কর মাতারী’, আজগর আলী ধমকে উঠল, ‘সকাল বেলাই চিল্লাবি না।’
শাহিদার মা খানিকটা ভয় পেল। অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। সকাল বেলাই মানুষটার মেজাজ নষ্ট। ব্যাপার কী ? রাতের বেলা নিশ্চয়ই ঘুম হয় নি।
শাহিদার মা শান্ত পায়ে রান্না ঘরে চলে গেল। তার মনে হল, আজগর আলীকে না ঘাটানোই ভালো। এই ব্যাটা সুবিধার না।
আজগর আলী শুয়েই রইল। নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাবতে লাগল। এসএসসি পাশ করার পর অভাবে পড়াশোনা বন্ধ। গ্রামের মধ্যে টো টো করে ঘুরে বেড়ায় আর গৃহস্থ বাপের ধোলাই খায়। পড়াশোনা যে কত অর্থহীন সেটাই তার বাবা বার বার বোঝায়। অবশেষে বেকার জীবনে এক বড় ভাইকে ধরে এই চাকুরি। স মিলের শিক্ষানবীশ ম্যানেজার। বেতন সামান্য কিন্তু থাকা খাওয়া ফ্রি। মালিকের ফাটের বারান্দায় এই মাথা গোঁজার ঠাইটার জন্য চাকুরিটা সে নিয়ে নিল।
বারান্দার গ্রিলে পলিথিনের শিট লাগিয়ে আড়াল করা। তার মধ্যে তেল চিটচিটে একটা চৌকি। পাশে ছোট একটা কাঠের টেবিল। দেয়ালে স্ক্রু মেরে লাগানো একটা হ্যাঙ্গার। মাথার উপর ছোট একটা ফ্যান। এই হল তার থাকার ঘর। গত ৫ বছর ধরে এই ঘর এবং এই চাকুরি তার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে।
কিছুক্ষণ গড়াগাড়ি করে সে উঠে বসল। আর শুয়ে থাকা উচিত হবে না । প্রায় ৮টা বাজে। ৮ টা বাজে মিস্ত্রিরা এসে পড়বে, তার আগেই স মিলে পৌঁছানো দরকার। তাছাড়া চট রহমত মিয়া উঠে গেলেই মুশকিল।
ক’ দিন আগে রাতে সামান্য জ্বর এসেছিল। সারা রাত ঘুম হয় নি। সকালে মাত্র চোখ লেগেছে, রহমত মিয়া এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
‘হ মিয়া, তুমি বেলা পর্যন্ত ঘুমাইবা। আমার ব্যবসার লালবাত্তি জ্বালাইবা। তোমারে কি মাগনা রাখছি নিহি ? ট্যাকার দাম নাই ?’
আজগর আলী কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে পড়ে রইল। এতে রহমত মিয়ার মাথা আরও গরম হল।
‘কী হইল, জব দেও না ক্যা ? বোবায় ধরছে নিহি ?’
আজগর আলী শুয়ে থেকেই বলল, শরীরটা খারাপ। জ্বর আইছে।’
‘জ্বর কয়া পইড়া থাকলে হইব নিহি ? সোজা গদিত যাও গা। আর যদি না পার, সাফ সাফ কইয়া দাও, আমি অন্য মানুষ দেহি। সকালের সাইত ঠিক মতো না হইলে ব্যবসা টিকব নিহি ?’
সে দিনের কথা স্মরণ করে আজগর আলী মনে মনে বিশ্রি গালি দিল। রহমত মিয়ার ব্যবহার ভালো না, চামার। শুয়ে শুয়েই দেখল, শাহিদার মা তার খাটের পাশে নাস্তা দিয়ে গেল।
হঠাৎ করে তার গত রাতের প্লানের কথা মনে পড়ে গেল। সে যেন অকস্মাৎ শরীরে বল ফিরে পেল। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াল। পাশের টেবিল থেকে টুথপেস্ট নিল। ব্রাশে লাগিয়ে দ্রুত দাঁত ব্রাশ করতে লাগল।
মুখ ধুয়ে গপাগপ নাস্তা গিলে ফেলল। রুটি আর হালুয়া। নাস্তা গিলে সোজা রওনা হল গদির দিকে।
উহ, বিরাট মিস হয়ে গেছে। অনেক কাস্টমার চলে গেছে। সকালের ইনকামটা কমে গেল। নাহ, আজ হবে না। আগামীকাল থেকে বেশ পকেটমানি আসবে। এই প্লানটা আরও আগে মাথায় আসা উচিত ছিল। কিছুই হবে না এই জীবনে। বোকাদের হয়ও না।
রহমত মিয়ার বিশাল কাঠের ব্যবসা। স মিলসহ কাঠের আড়ত। এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি কাঠ তার আড়তেই। আগে নাকি এই রকম ছিল না। বিয়ে করে হঠাৎ ফুলে ফেপে উঠেছে। শ্বশুর বাড়ির পয়সা - ব্যবসার মোক্ষম মূলধন।
আজগর আলী মন খারাপ করে গদিতে বসে রইল। দাড়োয়ানকে চাবি দিয়ে গিয়েছিল। ইমাম সাহেবের জন্য অফিস রুম খুলে দিয়েছে। ইমাম সাহেব প্রতিদিন সকালে আসেন। আগরবাতি জ্বালান, গোলাপ জল ছিটান। তারপর অফিস রুমে বসে নাকি সুরে কোরান তেলোয়াত করেন। বিনিময়ে তার জন্য তিন বেলার খাবার যায় রহমত মিয়ার বাড়ি থেকে।
ইমাম সাহের নাকি সুরে কোরান পড়ছেন। আগরবাতির গন্ধে ঘরটা ম ম করছে। আজগর আলী মন খারাপ করে বসে বসে তেলোয়াত শুনল। মিহি গলা - শুনতে ভালো লাগে। কেমন যেন ঝিম মেরে যায় শরীরটা । এক সময় ইমাম সাহেব তেলোয়াত শেষ করেন। তারপর আজগর আলীকে একটা লম্বা সালাম দিয়ে ইমাম সাহেব চলে যান। তাকে কেন এই রকম সালাম দেয় ইমাম, এটা ভেবে পায় না আজগর আলী ? ইমাম কি মালিক কর্মচারীর পার্থক্য বোঝে না ?
দাড়োয়ান এসে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, মিল খুইল্যা দিমু ?’
‘দাও, আর শোন, ভুষি নিতে কেউ আসে নাই ?’
‘আইছিল । কয় জন আয়া ঘুইরা গেল।’
আজগর আলীর নিজের উপর রাগ হল। প্রথম দিনেই এমন ভুল ! তার জীবনে কিচ্ছু হবে না। এক হাজার টাকা মাইনে পেতে পেতেই মরতে হবে। খামোখা সে মেট্রিক পাশ করেছে। রহমত মিয়ার মতো ব কলম থাকলেই ভালো হত।
দু’টো ছোকড়া এসেছে। ভূষি নিবে। দাড়োয়ানকে দু বস্তা ভরতে বলল আজগর আলী। মাত্র দু বস্তায় হবে না। কমপে দশ বারো বস্তা বিক্রি হলে কিছু পকেটে রাখা যেত।
ম্যানেজার বুড়ো চার দিন আগে দেশের বাড়িতে গেছে। আজ ফিরে আসার কথা। এ বুড়ো কখনও ফিরতে দেরি করে না। বরং তাড়াতাড়িই ফেরে। লোকমুখে শোনা যায়, বুড়োর বুড়ি নাকি ভয়ানক পাজি।
৫ বছর আগে যখন সে চাকুরি নেয়, তখন রহমত মিয়া আড়ালে নিয়ে বলেছিল, বুড়ো এখন তখন যায় অবস্থা। যে কোন সময় বুড়ো মরে যাবে আর ম্যানেজার হিসেবে আজগর আলী পদোন্নতি পাবে। ৫ বছর ধরে সে বুড়োর মরার অপেক্ষা করছে। বুড়ো দিব্যি সুস্থ অবস্থায় বেঁচে আছে এবং সেও ম্যানেজার হতে পারছে না। বুড়ো বোধহয় ইহ জনমে আর মরবে না।
ছ সাত জন ছোকড়া বস্তা নিয়ে হাজির। আজগর আলী দাড়োয়ানকে সিগারেট আনতে পাঠাল। এই মোক্ষম সুযোগ। কমপক্ষে দু বস্তার দাম মেরে দেয়া যাবে। দু জনকে বস্তা ভরে আগেই ভাগিয়ে দিতে হবে। আজগর আলী নিজে বস্তা ভরতে লাগল।
দাড়োয়ান ব্যাটার খবর নেই। সিগারেট কিনতে গিয়ে কোন জাহান্নামে গেছে। এ ব্যাটা আড্ডায় পড়লেই হল। হুশ জ্ঞান থাকে না।
দাড়োয়ান এল আধ ঘণ্টা পরে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে। কাছে এসে কৈফিয়তের সুরে বলল, ‘ভাইজান, মটর সাইকেলের তলে পইড়া গেছিলাম। আরেকটু হইলে পাওডা ভাইঙ্গাই গেছিল। অল্পের লিগা বাইচ্যা গেছি। ’
‘বাইচ্যা গেলি ক্যান ? মইরা গেলেই ভালো হইত।’
‘এইডা কেমুন কতা কন, ভাইজান ?’
‘ঠিক কথাই কই। তোর মতো কানা চোখের মরাই উচিত। ’
‘কানা চোখ আমি না। হেই মটর সাইকেলওয়ালাই কানা। কালা চশমা লাগায়া ঘুরতাছিল।’
আজগর আলী সিগারেট ধরাতেই রহমত মিয়া এসে উপস্থিত। সে সিগারেট ফেলে দিল। দুটো টাকা মাটি। এত টাকা নষ্ট হলে জীবনে কিচ্ছু হবে না।
রহমত মিয়া বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে রিভলভিং চেয়ারে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘আজগর আলী, সকালে কেমুন বেচা হইল ?’
‘হইছে দশ বস্তার মতো।’
যাহ, সত্যি কথাটা বলে ফেলল। তাছাড়া দু বস্তার টাকাও আলাদা করে রাখা হয় নি। কী ভীষণ ভুল ! এ রকম ভুল হলে তো জীবনে কিচ্ছু হবে না। আলী আজগর অতি ভদ্রতায় টাকাটা রহমত মিয়াকে দিল। ক্যাশ খাতা খুলে হিসাবটা তুলে রাখল। দিনটাই খারাপভাবে শুরু হল।
চলবে .......
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


