রহমত মিয়ার মুখ হাসি হাসি। পরনে আদি কাপড়ের পাঞ্জাবি। ফুর ফুর করে সুগন্ধ বেরুচ্ছে। মেশকে আম্বরের গন্ধ। রহমত মিয়া মেশকে আম্বরে ভেজা তুলো গুজে রাখে কানে।
আগর বাতির গন্ধ আর মেশকে আম্বরের গন্ধ মিলে আজগর মিয়ার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। এই জঘন্য গন্ধ ওর সহ্য হয় না। কিন্তু প্রতিদিন সকালে এই গন্ধ দিয়েই দিন শুরু করতে হয়।
রিভলভিং চেয়ারে মোচড় দিতে দিতে রহমত মিয়া বলল,‘আজগর মিয়া, সকালে নাস্তা ঠিকমতো হইছে তো ?’
‘হইছে। ’
‘তবু আরেক বার নাস্তা খাও। আজকার দিনটা খুব ভালা। এই সকালে বিরিয়ানী পাওয়া যাইব নিহি ?’
‘যাইতে পারে।’
রহমত মিয়া দাড়োয়ানকে ডেকে ৪ প্লেট বিরিয়ানী আনতে বলল। দাড়োয়ান বিরক্ত মুখে রওয়ানা হল।
আজগর আলী বুঝতে পারছে না, সকাল বেলা বিরিয়ানী খাওয়ার মতো কী ঘটল। রহমত মিয়া রিভলভিং চেয়ার দুলাতে দুলাতে জিজ্ঞেস করল, ‘কাশেম আহে না ক্যান ?’
‘ কেন আহে না, কেমনে কই ।’
‘এইগুলা জানা দরকার। আমার দোকানের কর্মচারী কামে ফাকি দিব, এইডা তো হইব না। এইবার আইলে চাইরডা চড় দিবা। কয় দিন পর পর হারামীর বাচ্চা কই যায় ?’
কাশেম এই অফিসেরই ছোড়কা। রহমত মিয়ার ফাই ফরমায়েশ খাটে। কাস্টমারদের চা-পানি এনে দেয়। সাত দিন যাবৎ নিখোঁজ।
রহমত মিয়া টেবিলে থাকা বাসি পত্রিকা হাতে নিল। শালার ব কলম পত্রিকা পড়বে নাকি ? অনর্থক চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘বুড়া মিয়া আজকা আইব কইছে। আইলে, হেরে শুকুর আলী কাছে যাইতে কইবা। হাজার ত্রিশেক ট্যাকা আনব।’
‘জ্বি আচ্ছা। ’
রহমত মিয়া রিভলভিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ‘আমার এট্টু জরুরী কাম আছে। তোমার ভাবীজানের বাড়ি যামু। ঐখানে একটা মজমা আছে। ’
‘বিরিয়ানী আনতে পাঠাইলেন, ওইগুলার কী হবে ?’
‘ তোমরা সবাই মিল্লা খায়া লও। আজকা আমার বিয়ার দিন। হের লাইগা তোমাগো খাওয়াইলাম। আচ্ছা, আমি যাই।’
রহমত মিয়া অফিস থেকে বেরিয়ে রিক্সা নিল।
আজগর আলী অবাক হয়ে বসে রইল। এই লোকটা হঠাৎ করে এমন আন্তরিক ও ভালো মানুষ হল কিভাবে ? আজ তার বিয়ে দিন বলে ? মনে হয় না। নতুন কোন দাও মেরেছে বোধ হয়।
কিছুক্ষণ পর দাড়োয়ান এল। বিরিয়ানী পায় নি। খালি হাতে এসেছে। আজগর আলী দাড়োয়ানের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে নিল। বিরিয়ানী না পেয়ে ভালো হয়েছে। টাকাটা পকেটে জমল।
বুড়ো মিয়া এল সকাল ন’টায়। আজগর আলী বুড়োর চেহারা দেখে আঁতকে উঠল। যেন কবর থেকে উঠে এসেছে।
‘কাকা, আপনার কি শরীর খারাপ ?’
‘বাবা গো, আমার কানাই নাই। কানাই চন্দ্র শীল। আমার দু নয়নের মণি। ভগবান তারে কেড়ে নিল। হা ভগবান, হা ভগবান।’
বুড়ো মাথায় থাপড়াতে থাপড়াতে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। চারদিকে ভীড় জমে গেল। কানাই চন্দ্র শীল বুড়োর ছেলে। অনেক দিন থেকেই এখন তখন অবস্থা ছিল। সেই ছেলে পরপারে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার ছিল, এবার সেটাই ঘটেছে।
পাশের চায়ের দোকানে মিস্ত্রিরা চা খাচ্ছিল। তারা এসে বুড়োকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। আজগর আলী বুড়োকে অফিসে এনে ফ্যানের নিচে শুইয়ে দিল।
‘কাকা, দুঃখ করবেন না। ভগবান সব কিছু মঙ্গলের জন্যই করেন।’
‘আমার মঙ্গল আমি বুঝি না, ভগবান বোঝে ? বলতে পার বাবা, আমার জন্য এত মঙ্গল চেয়ে ভগবানের কী লাভ ?’
আজগর আলী বোকা হয়ে চেয়ে রইল। পুত্রশোকে বুড়োর মাথায় গোলমাল হয়েছে। আবোল তাবোল বলছে। তার মতো ধার্মিকের পক্ষে এই সব কথা বলা সম্ভব নয়।
আজগর আলী বুড়োর গায়ে হাত রেখে তার পাশে বসে রইল। এক সময় খেয়াল করল, বুড়ো নাক ডাকছে। আজব ! এর মধ্যে ঘুমিয়ে গেল।
আজগর আলী আজকে কী কী চেড়াই অর্ডার আছে সেগুলো দেখতে লাগল। মিল ছাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। করাত ধার দেয়া হচ্ছে। আজগর আলী কত বার বলেছে করাত ধার দেয়াটা আগের রাতে সেরে রাখতে। কিন্তু হেড মিস্ত্রি আবু মিয়া এই ফালতু কাজটা সকালেই করে।
আজগর আলী অবাক হয়ে দেখল বুড়ো ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেছে। ঘুম থেকে উঠেই বুড়ো পুরো স্বাভাবিক। উঠে গিয়ে ক্যাশ খুলল। কী সব মন্ত্র ট্রন্ত্র পড়ল। নমস্কার করল কাউকে।
ক্যাশ লাগাতে লাগাতে বুড়ো জিজ্ঞেস করল, ‘রহমত সাহেব আইছিলেন ?’
‘হ্যা। সাহেব বইলা গেছেন, আপনাকে শুকুর সাহেবের কাছ থিকা টাকা তুইল্যা আনতে।’
‘কত টাকা ?’
‘ত্রিশ হাজার।’
বুড়ো ছাতা হাতে বেরিয়ে গেল। এই ছাতা বুড়োর মাথায় না উঠে বগলের নিচে ঝিমোয়।
হেড মিস্ত্রি আবু মিয়া এল। জানতে চাইল কোন কাঠ চেড়াই হবে। আজগর আলী কাঠ দেখিয়ে হিসাব দিয়ে দিল।
‘শোন আবু, এই কাঠ পাকা সাইজ চিড়াইবা। আলী আকবর সাহেবের কাঠ।’
আবু মিস্ত্রি মুচকি হেসে চলে গেল। আজগর আলীর পিত্তি জ্বলে গেল। আবু মিস্ত্রি কেন হাসল তা সে জানে।
বছর পাঁচেক আগের কথা। আজগর আলী নতুন এসেছে। এখানে চাকুরি নিয়ে প্রথম যে বিদ্যাটা শিখল, কিভাবে চেড়াইয়ের সময় এক সুতো কাঠ মেরে দেয়া যায়। নতুন শেখা জিনিস। প্রতি পিসেই এক সুতো কম দিচ্ছে। বেশ আনন্দ লাগছে।
আলী আকবর সাহেবের কাঠও সেই অবস্থা হয়ে গেল। প্রতি পিসেই এক সুতো কম। আলী আকবর সাহেব ঘাগু লোক - পাকা কন্ট্রাক্টর। পরের দিন এসে কাউকে কিছু বললেন না। আজগর আলীকে অফিসে এনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কাঠ চিড়াই করিয়েছে কে ?’
আজগর আলী মুখ কাচুমাচু করে হাসার চেষ্টা করল। বলল, ‘জ্বি, আমি । আমি করিয়েছি।’
ব্যাস, আর যায় কোথায় ? অফিস বন্ধ করে শুরু হল মার। ভয়ঙ্কর মার। মারের চোটে আজগর আলী চোখ মুখ ফুলে গেল আর আলী আকবর সাহেবের জুতা খণ্ড বিখণ্ড। সে দিন রহমত মিয়া সময় মতো এসে পড়ায় জানটা বেঁচেছে।
বুড়ো মিয়া ফিরে এল। এত দ্রুত ফিরে আসার কথা নয়। নিশ্চয়ই টাকা পায় নি। কিন্তু আজগর আলীকে অবাক করে দিয়ে বুড়ো পকেট থেকে তিনটা বাণ্ডিল বের করল। টাকাটা ক্যাশে রেখে বুড়ো বেরিয়ে গেল।
বুড়ো ক্যাশ লাগিয়ে যায় নি। এই তো সুযোগ। আজগর আলীর কলজে কাঁপতে লাগল। ইস্, এত বড় সুযোগ। তার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। সে চট করে একটা বাণ্ডিল পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
অফিস থেকে বেরিয়ে সে আবুকে বলল, ‘টেবিলের উপর চিড়াইয়ে হিসাব রাইখ্যা গেলাম। কাকারে নিয়া একটু বাইরে যাইতাছি।’
আবু অফিস রুমের দিকে গেল। আজগর আলী দেখতে পেল বুড়ো রাস্তার টিউবওয়েল থেকে মাথায় পানি দিচ্ছে। সে ভাবল, এখন তো পানি দিচ্ছে, কতক্ষণ পর বরফ দিতে হবে। সে বুড়োকে বলল, ‘কাকা, আমি একটু ব্যাংকে যাইতাছি। সাহেব বিশ হাজার টাকা তুলতে কইছে। ’
‘সাহেব তো তোমাকে চেক দেয় না। হঠাৎ দিল যে ! ’
‘এইটা সাহেবরে গিয়া জিগান।’
‘রাগ করো না। এম্নি বললাম।’
আজগর আলী রিক্সা নিয়ে সোজা ব্যাংকে চলে এল। রহমত মিয়া কাল রাতে যে চেকটা দিয়েছিল, সেটা ভাঙ্গাতে দিয়ে বসে রইল। ভাবতে লাগল, টাকাটা কোথায় সরানো যেতে পারে। তার নিজের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। টাকাই নাই, আর ব্যাংক একাউন্ট। আপাতত টাকাটা অন্য কোথাও সরিয়ে রাখতে হবে। তারপর গোপনে ব্যাংক একাউন্ট খুলে রেখে দিলেই চলবে।
চেক ক্যাশ করে আরও দুটো বাণ্ডিল হল। রিক্সায় উঠে সে পকেটের বাণ্ডিলগুলো খামোখাই ধরে বসে রইল। তার অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে। জীবনে উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, পরিষ্কার।
হঠাৎ মনে হল, রহমত মিয়া বাড়ি নেই। শুধু রহমত মিয়া না, ভাবীজানও নেই। থাকলে শাহিদার মা থাকতে পারে। কেউ না থাকলেও সমস্যা নাই, তার কাছে একটা ডুপ্লিকেট চাবি আছে। এখনকার মতো টাকাটা বাড়িতেই রাখা যেতে পারে। কেউ সন্দেহ করবে না।
ফ্লাটে ফিরে এসে দেখল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতরে শাহিদার মা আছে। শাহিদার মাকে স্বাক্ষী বানিয়ে লাভ নেই। সে দরজা নক না করে চাবি দিয়ে দরজা খুলল। শাহিদার মা যেন শুনতে না পারে তাই পা টিপে টিপে নিজের রুমে চলে এল। সাবধানে ট্রাঙ্ক খুলে টাকাটা লুকিয়ে রাখল। কাজ সমাধা হওয়ার পর বুঝতে পারল, তার অসম্ভব ক্লান্তি লাগছে। একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভালো লাগত।
কিন্তু দ্রুত অফিসে ফিরে যাওয়া দরকার। নইলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আজগর আলী এক গ্লাস পানি খাওয়ার জন্য পা টিপে টিপে ডাইনিং টেবিলের কাছে চলে এল। খুব সাবধানে পানি ঢালল।
রান্না ঘরের দিক থেকে কথা বলার ফিস ফিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। শাহিদার মা কার সাথে কথা বলছে ? আবার হাসছে মনে হয়।
আজগর আলী সাবধানে উকি দিল। সে আতঙ্কে জমে গেল। রহমত মিয়া ! সাথে ওটা কে ? শাহিদা ! রহমত মিয়া শাহিদাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে।
আচ্ছন্নের মতো আজগর আলী বাইরের দরজার দিকে এগুল। অসাবধানতায় দরজায় শব্দ হয়ে গেল। উহ, তার কলজেটা বুঝি ফেটেই যাবে। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় এবং এই দৃশ্য দেখে তার মাথা ঘুরছে। সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে চলে এল।
চলবে ..........
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । পঞ্চম পর্ব

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


