তিন
ফাহমিদা কাঁদতে পারছে না । অদ্ভুত এক আক্রোশে তার কান্না বন্ধ হয়ে আছে। রহমত মিয়াকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এ রকম তো সে আগেও বুঝিয়ে দিয়েছে। কাজ হয় নি।
রহমত মিয়ার সাথে বিয়ে হয়েছে সাত বছর। এ সাত বছরে কোন বাচ্চা কাচ্চা হল না। বরং সাত বছরে ওজন বাড়ল চৌদ্দ কেজি। এখন ফাহমিদাকে যে কেউ চট করে ধুমসি বলে ফেলে। তাতে কী , সে তো নারী। নারীর দেহে যা চাই - সব আছে। কোথাও কম নেই, বরং চৌদ্দ কেজি বেশি।
তবু রহমত মিয়ার মন তার দিকে নেই। প্রথম প্রথম মনে হত, মানুষটা এই রকমই। বোঝে শুধু ব্যবসা। চেনে শুধু টাকা । কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যে তার ভুল ভেঙ্গে গেল। রহমত মিয়া নারী দেহও চেনে। খুব ভালোভাবেই চেনে।
ব্যাপারটা প্রথমে বিশ্বাস হত না। লোকটাকে দেখত সময় মতো বিছানায় যেতে এবং ঠিক সময়ে বিছানা ছাড়তে। নিয়মিত পরিচ্ছন্ন পোশাকে ঝকঝকে কিন শেভড। সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতিশীল পুরুষ। একেবারে নিখুঁত হিসেবী ও ব্যবসায়ী।
রমিজা নামের এক কাজের মেয়ে রেখে প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারল সে । রমিজা কুচকুচে কালো। গোলগাল পোটকা পাটকা মুখ। সুগোল বাহু। শক্ত-সমর্থ দেহ।
একদিন বিকেলে ফাহমিদা শপিং সেরে এসে অবাক। রহমত মিয়া ঘরে। সদাব্যস্ত ব্যবসায়ী আরামে ভিসিপি দেখছে। ফাহমিদা বিস্মিত।
‘তুমি এই সন্ধ্যা বেলা ঘরে ! ’
‘মাথাটা ধরছে। জ্বর আইতাছে মনে হয়,’ কৈফিয়ত দেয় রহমত আলী।
ফাহমিদা কপালে হাত দিয়ে দেখে।
‘কোথায় জ্বর , কপাল তো ঠাণ্ডা।’
রহমত মিয়া আহ্লাদ করে বলল, ‘কপাল ঠাণ্ডা হইলে কী হইব । ভিতরে ভিতরে জ্বর আইতাছে।’
ফাহমিদা তার স্বামীকে খুব আদর যত্ন করে খাওয়াল। আহা, বেচারা ব্যস্ত মানুষ। হঠাৎ যদি কোন অসুখ বাঁধিয়ে বসে, এত বড় ব্যবসার অনেক ক্ষতি হবে। এই ব্যবসা তার নিজেরও ব্যবসা। এই ব্যবসার অনেক টাকাই তার বাবার।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে আসল ব্যাপার ধরা পড়ে গেল। মশারি গুঁজতে গিয়ে ফাহমিদা তোষকের নিচ থেকে একটি ওড়না পেল। সে প্রথমত হতভম্ব হয়ে রইল। এই ওড়না কার ? তার নিজের এই রকম কোন ওড়না নেই। চট করে সে বুঝে ফেলল ওড়নাটা কার। রমিজার। রমিজাকে সে নিজে এই ওড়না কিনে দিয়েছে।
রমিজাকে ধরে ছিঁড়ে খুড়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। দেহের নানা জায়গায় খুন্তি দিয়ে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হল। তার ঘরের ভেতর এ কী সর্বনাশা ঘুন !
কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝতে পারল, এত বড় সাহস রমিজার হবে না। রমিজার মতো শান্ত সুবোধ মেয়ের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব না। তার স্বামীই এ কাজের মূল হোতা।
সে দীর্ঘক্ষণ নিজের সাথে চুপচাপ বোঝাপড়া করল। রহমত মিয়াকে ছেড়ে দেয়া চলবে না। এ কাজের কৈফিয়ত তাকে দিতে হবে। মনে অসীম সাহস নিয়ে সে রহমত মিয়াকে ঘুম থেকে জাগাল।
রহমত মিয়া ঘুম ভাঙ্গা ফোলা চোখে তার দিকে তাকাল। তার সব কিছু গুলিয়ে গেল। এত জঘন্য কথা সে কিভাবে বলবে ? ফাহমিদা দিশেহারা বোধ করল। চোখে জল নিয়ে সে নীরবে রহমত মিয়ার দিকে চেয়ে রইল।
রহমত মিয়া অসহ্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী , কিছু কইবা ?’
‘হ্যা, বলব’, ফাহমিদার কান্না ভেজা কণ্ঠে আগুন।
রহমত মিয়া চট করে বুঝে ফেলল ফাহমিদা কী বলবে। সে তার ঠাণ্ডা মাথা চালু করে দিল। এই মাথা দিয়ে সে বড় বড় ব্যবসায়ীকে কাত করে।
‘কও, কী কইবা।’
‘এই ওড়নাটা কার ?’
রহমত মিয়া হাসতে চেষ্টা করল। তার ঠাণ্ডা মাথা ঠাণ্ডা থাকছে না, গরম হয়ে যাচ্ছে। সে ফাহমিদার গালে হাত ছুঁয়ে বলল, ‘এই কথা কইতে ঘুম ভাঙ্গাইলা ?’
ফাহমিদার মনে হল তার গায়ে কেউ কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এ লোক ভান করছে। সে চিৎকার করে বলল, ‘সত্যি করে জবাব দাও, এই ওড়না কার ?’
‘ তোমারই হইব।’
‘না, আমার না। তুমি ভালো করেই জান এই ওড়না কার।’
রহমত মিয়া হঠাৎ দিশেহারা বোধ করল। মাথা ঠাণ্ডা থাকছে না। এ রকম হওয়ার কথা নয়। এর চেয়ে বড় ঘটনা সে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সে বিস্মিত হওয়ার ভান করল, ‘আমি কী কইরা জানমু ? রাইত কইরা কী আবোল তাবোল শুরু করলা ?’
‘কী বলছ , আমি আবোল তাবোল করছি ? ভেবেছ , আমি কিচ্ছু বুঝি নি। সব বুঝেছি। ছিঃ, তুমি এত জঘন্য ! ’
‘রাইত কইরা এই সব ফালতু কথা থুইয়া ঘুমাও। স্বাস্থ্য ভালো হইব।’
‘আমার স্বাস্থ্য ভালো। তোমারটা কুৎসিত। তোমার দেহে মনে পোকা ধরেছে।’
‘ পোকা ক্যা, পায়খানা লাইগ্যা থাকুক। তোমার অসুবিধা কিসের ?’
‘ছিঃ, তুমি কি না শেষ পর্যন্ত পায়ের ধূলাকে আমার সংসারে ঢুকালে। তোমার একবারও ঘৃণা করল না ?’
‘তুমি যত কথা কও, কোন কথাই শুনতাছি না। তোমার মাথা খারাপ হইছে। কালকা ডাক্তারের কাছে নিয়া যামু।’
‘ডাক্তারের কাছে তুমি যাও। তোমার মনে পঁচন ধরেছে। তার চিকিৎসা করাও।’
‘ঠিক আছে, তা-ই করামু। অহন শান্তিতে ঘুমাইতে দেও।’
ফাহমিদার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল; বলল, ‘ তোমার পায়ে পড়ি। আমার সংসারকে অপবিত্র করো না। তোমার পায়ে পড়ি।’
রহমত মিয়া উঠে বসল। ফাহমিদাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা রাখমু।’
রহমত মিয়া সেই কথাই রেখেছে। সে আবার ওই কুৎসিত পথে পা বাড়িয়েছে। রহমত মিয়ার এই বদ অভ্যাস জানা বলেই সে কখনও যুবতী কাজের মেয়ে রাখে না। শাহিদার মা মধ্যবয়স্ক এবং দেখতে কুৎসিত বলেই সে তাকে রেখেছিল। কিন্তু তার পেছনে যে এত বড় সর্বনাশ লুকানো আছে তা সে বুঝতে পারে নি।
আজ দুপুরে যখন আজগর আলী সব বলল, তখন তার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। আজগর আলী ব্যাপারটা জানতে পেরেছে দু’মাস আগে। এত দিন সাহস করে বলতে পারে নি। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হল। এতটুকুন মেয়ে , তার সাথে এ সব কী ? ছিঃ !
আজ লোকটা বাড়ি ফিরুক। বোঝাপড়া করতে হবে। কঠিন বোঝাপড়া। হয় ঠিক মতো সংসার করবে নচেৎ সে এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে।
দরজায় খুট খুট শব্দ হচ্ছে। এই শেষ বিকেলে কে এল ? ফাহমিদা দরজা খুলে দেখে শাহিদার মা। তার ইচ্ছে হল, লাথি মেরে এই বুড়িকে বের করে দিতে। কিন্তু বুড়ির কী দোষ ? বুড়ি তো কিছু জানে না।
‘আম্মার শইলডা কী খারাপ ?’
‘না, শরীর ভালোই।’
‘ চোখ মুখ কেমুন কেমুন জানি দেহায়।’
‘তাতে তোমার কী ? তোমার কাজ তুমি কর।’
শাহিদার মা বোকা হয়ে চেয়ে রইল। সে কী বেয়াদবি করল বুঝতে পারল না। কী জানি, বড়লোকের কোন খেয়াল।
ফাহমিদা হিসাব কষে দেখল, শাহিদার মা কত টাকা পায়। চার শ’ টাকা পায়। ড্রয়ার থেকে একটা পাঁচ শ’ টাকার নোট এনে শাহিদার মার হাতে গুঁজে দিল।
‘কাল থেকে তোমার আর আসার দরকার নেই’, ফাহমিদা ঘোষণা করে দিল।
শাহিদার মা নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। এ ঘটনার কিছুই তার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছে না। গণ্ডগোলটা হল কোথায় ? হঠাৎ আম্মাজান বিগড়ে গেল।
‘আম্মাজান, আমারে বিদায় কইরা দিলেন ?’
‘হ্যা।’
‘ক্যান, কী অইল ?’
‘সে কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে ? তোমাকে আসতে না করেছি, আসবে না।’
‘তাইলে আফনের এত কাম করব ক্যাডা ?’
‘সব আমি করব।’
শাহিদার মার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। বড়লোকের মেয়ে এত কাজ সামলাবে কিভাবে ? অসম্ভব। আম্মাজানের কাজের লোক লাগবেই। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
‘দাঁড়িয়ে রইলে যে ? তোমাকে না যেতে বললাম।’
‘আজকার কামগুলি সাইরা দিয়া যাই।’
‘কোন দরকার নাই। তুমি এই মুহূর্তে বিদায় হও।’
শাহিদার মা কোন কথা না বলে কেটে পড়ল। কারণ সে ইতিমধ্যে হিসেব করে ফেলেছে তাকে পাঁচ শ’ টাকা দেয়া হয়েছে। এক শ’ টাকা বেশি। আর কিছুণ এখানে থাকলে এ টাকাটা হারাতে হবে। তার চেয়ে কেটে পড়াই ভালো। পরে এসে হাত পা ধরলেই হবে।
ফাহমিদার অসম্ভব খারাপ লাগছে। শরীরটাকে অসহ্য ভারী লাগছে। বিছানায় গিয়ে শুতেই দেহটা ফোমের গভীরে চলে গেল। তার দেহ জুড়ে রাজ্যের কান্তি। যেন সারা পৃথিবীর ওজন কলুর বলদের মতো সে টেনে চলেছে।
মিষ্টি স্বরে কলিংবেল বাজছে। ফাহমিদা চমকে জেগে উঠল। আশ্চর্য ! সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গভীর ঘুম।
ঘর অন্ধকার। সে উঠে আলো জ্বালল। ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠল। রাত দশটা। মরার ঘুম ধরার আর সময় পেল না।
রহমত মিয়া এসেছে। সাথে আজগর আলী।
রহমত মিয়া উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার ? ঘুমাইয়া আছিলা নিহি ?’
ফাহমিদার কথা বলতে ইচ্ছে হল না। সে হাই তুলে বেড রুমে চলে এল। তার শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। আবারও শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। জীবনের ভার সে আর বহন করতে পারছে না।
রহমত মিয়া পাঞ্জাবি গেঞ্জি খুলে বাথরুমে ঢুকল। রহমত মিয়াকে কী কী বলবে ফাহমিদা শুয়ে শুয়ে সেটাই গোছাতে লাগল। খুব কঠিন কিছু বলা দরকার। লাস্ট ওয়ার্নিং।
রহমত মিয়া হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ফিরে এল। কিন শেভড চেহারা। হাসি খুশি মুখ।
‘ তোমার শরীল খারাপ নিহি ?’ রহমত মিয়া জানতে চাইল।
‘তোমার মুখের মেকি হাসিটা থামাও। ওই হাসি দেখে আমার শরীর ভালো হবে না।’
রহমত মিয়া বিষম খেল। কোন কারণে ফাহমিদা তার উপরে ক্ষেপে আছে। এ মুহূর্তে কথা বলা বিপজ্জনক। সে তার ঠাণ্ডা মাথাটা চালু করে দিল।
চলবে .....
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


