আজগর আলীর খুব ফুর্তি লাগছে। তার এই ছোট বারান্দা কাম বেডরুমকে স্বর্গ মনে হচ্ছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। তার ভবিষ্যৎ পরিষ্কার - ঝকঝকে।
আজ সকালে আশি হাজার টাকা দিয়ে গেছে নুরু মিয়া। বিনিময়ে নিয়ে গেছে স মিলের প্রত্যেকটি চাবির ডুপ্লিকেট। আজ রাতে কাজ হবে। কমপক্ষে দশ বারোটা কাঠের ফালি সরিয়ে দেবে নুরু মিয়া। মিলের পেছনে পুকুর দিয়ে ভেসে চলে যাবে গোপন চালান। দাড়োয়ানকে ম্যানেজ করা হয়েছে। ঠিক এগারোটায় দাড়োয়ান ভিডিও ক্যাসেট আনতে যাবে। সেই মুহূর্তে নুরু মিয়া কাজ সেরে ফেলবে। কমপক্ষে লাখ দেড়েক টাকার কাঠ সরিয়ে দেবে।
হঠাৎ ফাহমিদার চিৎকারে তার চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল। বাহ, লেগে গেছে ধুমধাম। আজ দুপুরের কথায় কাজ হয়েছে। রহমত মিয়ার ঠাণ্ডা মাথায় গরম হাওয়া ঢোকানো হচ্ছে।
শালা হারামজাদা। লম্পটের এক শেষ। নইলে ওই রকম অল্প বয়স্ক মেয়েটার সাথে কিভাবে এ সব করে ? শালার রুচি জ্ঞান নেই। শালা ব কলম, টাকা কামিয়ে নিজেকে সম্রাট মনে করে। এ সম্রাটকে পথে বসাতে হবে। কথায় কথায় ধমক ছুটে যাবে।
দরজায় খুট করে শব্দ হল। আজগর আলী বুঝতে পারল দাড়োয়ান এসেছে। তার খেমটা নাচতে ইচ্ছে হল। কেল্লাফতে ! সে এতক্ষণে আশি হাজার টাকার মালিক হয়ে গেছে।
দরজা খুলে আজগর আলী আস্তে করে সিঁড়ি কোঠায় বেরিয়ে এল। দাড়োয়ান তার লুঙ্গির কোচড় থেকে ভিডিও ক্যাসেট বের করল। আজগর আলী ক্যাসেটটা নিল। তারপর বলল, ‘একটু দাঁড়াও। তোমাকে রিক্সা ভাড়া দিয়ে দেই। ’
আজগর আলী ক্যাসেট নিয়ে ভেতরে চলে গেল। দাড়োয়ান দাঁড়িয়ে রইল। ভেতর থেকে সাহেব আর তার বৌয়ের গলা ভেসে আসছে। তারা কি ঝগড়া করছে ?
আজগর আলী ফিরে এল। হাতে একটা পেপসির বোতল। সে বোতলটা দাড়োয়ানের হাতে দিল। দাড়োয়ান তার দিকে তাকাল।
আজগর আলী বলল, ‘নেও, এইটা খাইতে খাইতে যাইও। আর এই যে তোমার রিক্সা ভাড়া।’
আজগর আলী দাড়োয়ানকে পঞ্চাশটা টাকা দিল। দাড়োয়ান খুশি মনে টাকাটা পকেটে ঢোকাল। সেই মুহূর্তে ভেতর থেকে ফাহমিদা চিৎকার ভেসে এল।
দাড়োয়ান জিজ্ঞেস করল, ‘উনারা এত জোরে কতা কয় ক্যান ?’
‘এইটা কথা না। বক্সিং। রেসলিং। ’
‘কন কী ! স্যারের লগে স্যারের বৌ কাইজ্জা করতাছে ?’
‘এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সব বৌই এ রকম করে। তোমার বৌ ঝগড়া করে না ?’
দাড়োয়ান না বুঝেই মাথা ঝাকাল। তার বৌ ভয়ানক বজ্জাত। যে লাঠির ভয়ে এই অঞ্চলের সব চোর তটস্থ, সে লাঠি তার বৌ তার উপর ব্যবহার করে। থাক্, এ শরমের কথা কাউকে বলার দরকার নাই।
দাড়োয়ানকে বিদায় করে আজগর আলী খুশিতে লাফাতে লাগল। সে এখন ধনী। অনেক টাকার মালিক। আশি হাজার টাকা। উত্তেজনায় তার দেহ বেয়ে ঘাম ছুটছে।
ফাহমিদার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বরং ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। রহমত মিয়া বৌকে মারছে নাকি ? মারুক। বেশি করে মারুক। কাল সে নিজের কপালেই মারবে।
আঃ, আনন্দের জন্য কী করা যায় ? রহমত মিয়ার মতো মাল টানবে নাকি ? কমপক্ষে এক দিনের জন্য যদি রহমত মিয়া হওয়া যেত।
চার
রহমত মিয়ার কিছুতেই হিসাব মিলছে না। তার ব্যবসার চৌদ্দ বছরের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা নেই। এ কেমন কথা ! এক রাতে আড়াই লাখ টাকা কাঠ গায়েব। কেউ বিশ্বাস করবে না। বরং লোকে ভাববে, পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এটা একটা কৌশল মাত্র।
আজগর আলী থমথমে মুখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দাড়োয়ান পায়ের কাছে কুকুরের মতো বসে আছে। সে ঘাবড়ে গেছে। রহমত মিয়া হুংকার ছাড়ল, ‘হারামীর বাচ্চা, সত্যি কইরা ক, এই কাম কেডা করছে।’
‘সাব, সত্যি কইরা কইতাছি, আমি কিছুই জানি না।’
‘তুই না জানলে কেডা জানব ?’
‘আল্লা মালুম, সাব, আল্লা মালুম।
রহমত মিয়া রাগে দাড়োয়ানের পাছায় কষে লাথি মারল। দাড়োয়ান ছিটকে গিয়ে পড়ল তিন হাত দূরে। কঁকিয়ে উঠল, ‘সাব, সত্যি কইরা কইতাছি, আমি কিছুই জানি না।’
‘হারামীর বাচ্চা, রাইত কইরা ঘুমাস ; আবার বড়ো বড়ো কথা।’
‘রাইতে কুনো দিনও ঘুমাই নাই।’
‘না ঘুমাইলে কয় দিন আগে তর জুতা চুরি হইল কেমনে ?’
দাড়োয়ান মাথা নিচু করে ফেলল। সত্যি কিছু দিন আগে তার জুতা চুরি হয়েছে। এ ঘটনা কী করে ঘটেছে সে বুঝতে পারে নি।
‘রাইত কইরা কুনোহানে গেছিলি নিহি ?’
দাড়োয়ান একটু ভেবে নিল। চট করে আজগর আলীর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত জবাব দিল, ‘কুনহানে যামু, আপনেই কন ?’
‘চোপ, হারামীর বাচ্চা।’
রহমত মিয়া হঠাৎ চুপ মেরে গেল। বাইরে লোকজন জমে যাচ্ছে নাকি ? তাহলে তো অসুবিধা হবে। এতগুলো কাঠ যেই সরাক, সবগুলো সরিয়ে ফেলা সম্ভব না। কোথাও কমপক্ষে একটি হলেও অসাবধানে প্রকাশ্যে থাকবে। তাই হৈ চৈ করা যাবে না। তাহলে হারামীর বাচ্চা তার শেষ চিহ্ণটুকু মুছে ফেলবে।
চোরের বাচ্চা নিশ্চয়ই আনন্দে ধেই ধেই করে নাচছে। কারণ সে ধরেই নিয়েছে তার অপকর্ম এত দ্রুত ধরা পড়বে না। ধরা পড়ার কথাও না। সত্তর আশি লাখ টাকার কাঠ থেকে আড়াই লাখ টাকার মাল সরালে চোখে না পড়ারই কথা। রহমত মিয়া খোদার কাছে শুকরিয়া জানাল। তার আজগর আলীর মতো একজন কর্মচারী আছে। আজগর আলীই তো প্রথম তাকে সংবাদ দিল।
‘পুকুরের দিকে কিছু কাঠ কম মনে হইতাছে।’
‘কও কী ! চলো তো দেখি।’
রহমত মিয়া পুকুরের ধারে এসে প্রথমটায় তেমন চিন্তিত হল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন আসল ব্যাপারটা ধরতে পারল, তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এ কী কাণ্ড ! এ কি করে সম্ভব ? তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল।
‘এত বড় আকাম হইল ক্যামনে ?’
‘আমারও তো সেই কথাই। কিছু বুঝতে পারতাছি না।’
রহমত মিয়া মাথায় হাত দিয়ে কাঠের ফালির উপর বসে রইল।
দাড়োয়ান ফিরে যাচ্ছে। জীবনে প্রথমবারের মতো সে বুদ্ধির খেলা দেখিয়েছে। অবশ্য সেই সাথে মিথ্যে কথাও বলা হয়ে গেল। এই জন্য তার দুঃখ নেই। বরং আজগর আলী লোকটার প্রতি সে কৃতজ্ঞ। আজগর আলীর বুদ্ধি না শুনলে এতক্ষণে জেলের ভাত খাওয়া শুরু হয়ে যেত। আজগর আলীই তাকে বুদ্ধি দিল, ‘শোন, কাইল রাইতে যে তুমি ভিডিও ক্যাসেট আনতে গেছিলা, এইটা বলবা না। এইটা বললে চাকুরি থাকব না। তারচেয়ে বড় কথা, পুলিশ ডেকে ধরিয়েও দিতে পারে। তুমি ডিউটিতে ফাকি দিছ এইটা শুনলে ... ’
ঠিক কথা, সে ডিউটিতে ফাকি দিয়েছে এ কথা শুনলে সঙ্গে সঙ্গে চাকুরি নট। তারপর জেল জরিমানা । ওরে বাবা ! তারচেয়ে অস্বীকার করাই ভালো। মালিকের দয়া হলে চাকুরিটা টিকে যেতে পারে। জেল জরিমানার ভয়ও নাই।
রহমত মিয়া অফিসে এসে দীর্ঘক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। সে কি থানায় যাবে ? কিন্তু থানায় গেলে তো অসুবিধা। মালগুলো চোরাই। কেঁচো খুড়তে আজদাহা সাপ বেরিয়ে যাবে। তার চেয়ে অন্য ব্যবস্থা নেয়াই ভালো। হারামজাদা, বুঝে শুনে চোরাই মাল সরিয়েছে।
এই মুহূর্তে একজন প্রচণ্ড বুদ্ধিমান লোক দরকার। কার কাছে যাওয়া যায় ? কে তাকে সাহায্য করতে পারে ? ফাহমিদার বাবা খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক - নিখুঁত হিসেবী। কিন্তু ফাহমিদা গিয়ে তার বাবার কাছে কী কী লাগিয়েছে কে জানে। এই লোক কি বিগড়ে আছে কি না সেটাও ভাবনার বিষয়। তবু যেতে হবে, এই লোক ছাড়া এই বিপদ থেকে কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারবে না।
চলবে .....
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । সপ্তম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



