রহমত মিয়া বেরিয়ে গেলে আজগর আলী চিন্তিত হয়ে পড়ল। রহমত মিয়াকে চেনা মুশকিল। কখন কী করে বসবে বোঝা অসম্ভব। তবে রহমত মিয়া এবার কঠিন কিছু করতে যাচ্ছে। তার মুখের প্রতিটি বলিরেখা তা-ই বলে দিচ্ছিল।
কিছু দিন আগে দশ হাজার টাকা চুরির ব্যাপারটা নিয়ে রহমত মিয়া কম কিছু করে নি। বুড়োর চাকুরিই চলে গেল। হতভম্ভ বুড়ো রহমত মিয়ার পায়ে গিয়ে পড়ল।
‘সাহেব, বিশ্বাস করেন, এই কাজ আমি করি নাই। বুড়া মানুষ, কয় দিন পর চিতায় যামু। বিশ্বাস করেন, সাহেব, ভগবানের দোহাই। টাকাটা কই থিকা কই গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না।’
রহমত মিয়ার মন টলল না। এই রকম তালকানা বুড়ো দিয়ে তার চলবে না। বুড়ো তৎক্ষণাৎ গেট আউট হয়ে গেল। এখনও বুড়ো নানা জনকে ধরছে , চাকুরিটা ফেরত পাওয়ার আশায়। কিন্তু বুড়োর চাকুরি হবে না, চাকুরি হতে দেবে না আজগর আলী। বুড়োর চাকুরি হলে আজগর আলীর ডিমোশন হয়ে যাবে। দশ হাজার টাকা আরও আগেই কেন চুরি করে নি, তার জন্য আফসোস করে আজগর আলী। বুড়োর মতো করে দাড়োয়ানেরও চাকুরি যাওয়ার কথা। এখনও যে যায়নি সেটাই আশ্চর্য।
নুরু মিয়ার সঙ্গে দেখা করা দরকার। কেবল নিজের বুদ্ধি দিয়ে কুলাচ্ছে না। আজগর আলীর তীব্র ভয় করছে। মনে হচ্ছে, সে অচিরেই ধরা পড়ে যাবে এবং নিশ্চিত জেলের ঘানি। আল্লাহ, তুমি মালিক।
নুরু মিয়াও কম না। কথা ছিল, দেড় লাখ টাকার কাঠ সরাবে। সরিয়েছে আড়াই লাখ টাকার মাল। শালা, হেভি ট্যালেন্ট। শহরটাকে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে।
আজগর আলীকে বিস্মিত করে কিছুক্ষণ পর নুরু মিয়া এল। মুখভর্তি পান। হাতে জলন্ত সিগারেট।
‘কী খবর মিয়া বাই, এই দিকের কী অবস্থা ?’
আজগর আলী নুরু মিয়াকে টেনে অফিসে ঢুকাল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে লেকচার শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ কেউ বুঝে ফেললে কম্ম সাবাড়।
‘এত চিল্লাইতাছেন ক্যান ? এই দিকের অবস্থা খারাপ। আইজ মিল বন্ধ।’
‘ডরাইয়েন না, মিয়া বাই। কাম শেষ। এতক্ষণে তিরিশ মাইল দূরে গেছে গা।’
‘তা না হয় গেল। কিন্তু এদিকে তো মুশকিল।’
‘কী মুশকিল ?’
‘সাহেব কই জানি গেল। কী করতাছে কিছুই বুঝতে পারতাছি না।’
‘বুজনের দরকার নাই। আজকা রাইতেই তোমার সাহেবের স্ক্রু টাইট দিমু। হের বৌটা বাইত আছে নি ?’
আজগর আলী অবাক চোখে তাকাল। হঠাৎ নুরু মিয়া সাহেবের ঘরের খবর নিচ্ছে কেন ? আবার কোন বদ মতলব চাপল তার মাথায় ?
‘হঠাৎ ভাবীজানের খবর নিতাছেন ? ব্যাপারটা কী ?’
‘হেইডা আফনের বুজনের কাম নাই। হালার পুতরে ভালা গ্যাঞ্জামে না হালাইলে চলব নি ? নিজের গ্যাঞ্জামই হামলাইতে পারব না, আমাগো লয়া চিন্তা করব কুন সম ?’ নুরু মিয়া বিশ্রী ভঙ্গি করে হাসল।
আজগর আলী বোকার মতো স্বীকার করল, ‘আপনের কথা কিছুই বুঝতে পারতাছি না।’
‘আরে মিয়া হুনেন, খবর নিয়া জানছি হের বৌ বাইত নাই। কতাডা ঠিক নিহি ?’
‘হ্যা, ভাবী আজ সকালে বাপের বাড়ি গেছে।’
‘তাইলে কাম হইছে। কুনো চিন্তা কইরেন না। আফনের কুনো অসুবিদা নাই। শুধু একটা কাম করবেন, আউজকা রাইতে বাইতে যাইয়েন না। এই আপিসেই ঘুমাইয়া থাইকেন। ’
আজগর আলীর মাথা ঘুরছে। এ কী রকম জটিল লোকের পাল্লায় সে পড়ল ! শেষ পর্যন্ত সব ডোবাবে না তো ? খোদা সহায়, জীবনটা বরবাদ না হলেই হয়।
‘আপনার কথা তো শুনলাম। কিন্তু তাতে হইবটা কী ?’
নুরু মিয়া হে হে করে বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসল, ‘বহুত লাভ হইব। এত লাভ হইব যে, রাইত কইরা আরামসে ঘুমাইতে পারবেন।’
একটু দ্বিধা নিয়ে আজগর আলী জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু সাহেব যদি অফিসে না ঘুমাইতে দেয় ?’
নুরু মিয়া পানের পিক ফেলে বলল, ‘দিব না মানে ! আউজকা বেশি দিব। হেয় কি চাইব নাকি আরও মাল গায়েব হউক ?’
নুরু মিয়া হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল। আজগর আলীর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘কুনো চিন্তা কইরেন না। আপনের কাম শেষ। বাকি ঝামেলা আমার।’
নুরু মিয়া চলে গেল। আজগর আলী নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। পুরো ব্যাপারটা ভজঘট পাকিয়ে গেছে। নুরু মিয়াকে কিছু বলাও বিপদ। মাথা গরম মানুষ। ধাম করে শেষ করে দেবে। শেষ পর্যন্ত জানটা হারানোর কী দরকার ? উহ, কী ভীষণ বিপদেই না পড়া গেল ?
রহমত মিয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্বশুর বাড়িতে বসে রইল। তার শ্বশুর ইউসুফ আলী খানের কোন খবর নেই। সেই সকালে কোন লোকের সাথে বেরিয়ে গেছে। দুপুরে খেতেও আসে নি।
ফাহমিদারও দেখা নেই। তারা মা-মেয়ে ঘর বন্ধ করে বসে আছে। মেয়ে যেমন গবেট, মা তার চেয়েও বেশি। তারা ভেবে বসে আছে, সে ফাহমিদাকে নিতে এসেছে। ফাহমিদাকে এই মুহূর্তে দরকার নেই। বরং কাছে না থাকলেই সুবিধা। মাথাটা ঠাণ্ডা থাকবে।
তার এক মাত্র শালা রবিন দু তিন বার উঁকি দিয়ে গেছে। কিন্তু কাছে ডাকলেই এক দৌড়ে হাওয়া। তাকেও কি কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে ? সম্ভবত তার বুদ্ধিতে যা কুলাচ্ছে তা-ই সে করছে। কাশ ফোর পড়ুয়া ছেলের আর কি বা বুদ্ধি থাকবে। উহ, একা বসে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। কী মুশকিল।
রহমত মিয়া মাসুকে ডাকল। মাসু এ বাড়ির চাকর। খুব পুরোনো, বিশ্বস্ত ও অতি বিনয়ী চাকর।
‘মাসু, একবার গিয়া দেইখ্যা আস তো আব্বাজান গদিত আছে কি না । ’
মাসু কোন কথা না বলে তৎক্ষণাৎ রওয়ানা হল। এই নিয়ে পাঁচবার। দশবার পাঠালেও সে যেতে রাজি। এ বাড়ির জামাই খুবই বদরাগী। কথায় কথায় ধমকায়।
মাসু বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে ইউসুফ আলী খানের কাঠের আড়তে উঁকি দিল। না, সাহেব নেই। আড়তের এক কর্মচারী তাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘কী খবর, মাসু ?’
‘সাবে আইছে নি ?
‘তোমার এত সাবের খবর দিয়া দরকার কী ?’
‘আমার দরকার নাই। সাবের জামাই আইস্যা বইয়া রইছে হেই দুইফর থন।’
‘জামাই মিয়ারে বইতে কও। সাবে আইলে পাঠাইয়া দিমুনে। ’
মাসু ভয়ে ভয়ে ফিরে এসে দেখে রহমত মিয়া ঘুমাচ্ছে। যাক, বাঁচা গেল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ধমক খেতে হবে না । সে নিশ্চিন্ত মনে রাতের খাবার তৈরি করতে চলে গেল।
রহমত মিয়ার ঘুম ভাঙ্গল শ্বশুরের ডাকে। সে ধড়মড় করে উঠে বসল। কী অবস্থা ! এত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক হয় নি। কথাটা হালকা হয়ে গেল।
‘কী মিয়া, কতক্ষণ ধইরা আইছ ?’
‘আইছি দুপুরে।’
‘আমার বোকা মেয়েটারে লইতে আইছ নি ?’
‘হেইডা তো আছেই। আরো কথা আছে।’
ইউসুফ আলী খান সোফায় জাকিয়ে বসে বললেন, ‘কও, কী কথা।’
‘আপনে আগে হাত মুখ ধুইয়া রেস্ট নেন। তারপর কই।’
ইউসুফ আলী খান ফুর্তিতে গা দুলাতে দুলাতে চলে গেল। বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। আজ বেশ বড় একটা বড় কাস্টমার পাওয়া গেছে। লাখ পাঁচেক টাকার অর্ডার প্রথম সুযোগেই। বিরাট কন্ট্রাক্ট। তিনি হাত মুখ ধুয়ে মাসুকে খাবার দিতে বলে রহমত মিয়ার সামনে গিয়ে বসলেন।
‘কও তোমার কী কথা ?’
‘কথাটা যে কেমনে কই।’
‘ফাহমিদার লগে তোমার কী হইছে ?’
‘হেই কথা কই না। অন্য কথা। ’
ইউসুফ আলী খান থ হয়ে রইলেন। রহমতকে যতটুকু বুদ্ধিমান ভেবে মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন, এখন দেখেন তার চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত। এর মতিগতি বোঝা মুশকিল।
তিনি হাসি মুখে বললেন, ‘কও, তোমার অন্য কথাই কও।’
‘কাইল রাইতে মিলের থিকা প্রায় সতের আঠারটা কাঠের ফালি চুরি হইছে।’
রহমত রসিকতা করছে না তো ? এ কিভাবে সম্ভব ? ইউসুফ আলী খান আঁতকে উঠলেন, ‘কও কী ! এত ডি মাল এক রাইতে চুরি ! সত্যি কইরা কইতাছ তো ?’
রহমত বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দুপুর থিকা বয়া রইছি মিছা কথা কওনের লিগা?’
ইউসুফ আলী খান বিষম খেলেন। রহমতের মাথার ঠিক নেই। সে এভাবে কথা বলে না। অভদ্রতা তার স্বভাবে নেই। মুরুব্বীর সাথে সে অতি বিনয়ী।
একটু ভেবে নিয়ে ইউসুফ আলী খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘অহন কী করবা ?’
‘মালডি কেমনে পাওন যায় হেই ব্যবস্তা করন লাগব।’
‘থানা পুলিশ করছ নি ?’
রহমত মিয়া বিরক্ত হল। বলল, ‘থানা পুলিশ কইরা মরমু নাকি ? আপনে জানেন না মালডি কুনহানকার ?’
ইউসুফ আলী খান চুপ মেরে গেলেন। সত্যি কথা, থানা পুলিশ করে নিজের কপাল মারার কোন মানে হয় না। জেলের ভাত খাওয়া লাগবে। সেধে বোকামি করার কী দরকার ?
রহমত মিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘অহন কী করন যায় ?’
ইউসুফ আলী খান খানিকটা ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তুমি কেমনে বুঝলা কালকা রাইতেই সবডি মাল চুরি হইছে ?’
‘আজগর আলী দেহাইল।’
‘আজগর আলী দেহাইল আর তুমি বিশ্বাস করলা ? আমার মনে হয়, বহুত দিন ধইরা মাল চুরি হইতাছে।’
রহমত মিয়া মাথা ঝাঁকাল, ‘আরে না, আপনে দেখলেই বুজবেন, এক রাইতেই কাম হইছে।’
ইউসুফ আলী খান সোফায় আরাম করে হেলান দিয়ে বললেন, ‘তাইলে তোমার নিজের লোক এই কামের লগে আছে।’
চলবে .....
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব । অষ্টম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



