somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'পরাণ ডোমের পোস্টমর্টেম' এর এক ঝলক।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




বাপ নাম রেখেছিলেন পরাণ অথচ ওর কাজ কিনা মরণ নিয়ে। বাপ অবশ্য ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়ে 'ভদ্দরনোক' বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরাণের কপালে আর ভদ্রলোক হওয়া জুটল না। বিদেশি হুইস্কির বদলে ওর গলায় চড়ল সস্তা বাংলা মদ আর হাতে, কলমের বদলে উঠল স্কালপেল, হাড়-মাংস কাটার ছুরি। তারপর বড় চাকরির স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে পরাণ একদিন লাশকাটা ঘরে চলে গেল। লাশ হয়ে নয়, লাশ কাটতে। মোহন ডোমের ছেলে পরাণ ডোম আর কী-ই বা করতে পারত?
আস্তে আস্তে পরাণ ডোমের পদোন্নতি হল। সদর হাসপাতালের ডোম থেকে বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে চলে এল সে। কিন্তু তার বাপ মোহন ডোম ছেলের এই উন্নতি দেখে যেতে পারলেন না। বাংলা মদ ততদিনে তার লিভারকে খেয়ে নিয়েছিল। একদিন ফট করে তাই মোহন ডোম পরপারে চলে গেলেন।
পরাণ ডোমের কাছে মৃত্যু ততদিনে অতি স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। মানুষ যেমন খায়, বিয়ে করে, বাচ্চা বিয়োয়- ঠিক তেমনি মারাও যায়। তাই বাপের মৃত্যুতে সে কিছুটা দুঃখ পেল বটে, তবে ভেঙ্গে পড়ল না। তারপর শ্রাদ্ধ-শান্তি করে একদিন নিজের কোয়ার্টারে রওনা হল।
এসেই সে ছোট্ট একটা ধাক্কা খেল। প্রফেসর মনোয়ার খান স্ট্রোক করে মরে গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল পরাণের। স্যার খুব আমুদে লোক ছিলেন। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে একটু পান করার অভ্যাস ছিল স্যারের। মাঝে মাঝে শেষ হয়ে আসা বিদেশী বোতল স্যার ওকে দিয়ে দিতেন। আহা, সেই রাতগুলো ওর জীবনে আর আসবে না।
স্যার চিরকুমার ছিলেন। কোন এক যৌবনে তার এক সুন্দরী সহপাঠী তাকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, কিন্তু তারপর সে তারই এক টেকো প্রফেসরের ঘরে গিয়ে উঠেছিল। সেই দুঃখে মনোয়ার স্যার আর বিয়েই করলেন না।
এসব অবশ্য পরাণ ডোমের জানার কথা না। কিন্তু সে জেনেছিল। স্যার থাকতেন ডক্টরস কোয়ার্টারে কলেজ থেকে বরাদ্দ করা একটা এপার্টমেন্টে। পরাণ নিজের জন্য চতূর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের একটা এপার্টমেন্ট পেয়েছিল বটে, কিন্তু সে একা মানুষ। অতো বড়ো কোয়ার্টার দিয়ে সে করবে কী?
মনোয়ার স্যার তাই ওকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, সে যেন স্যারের সাথেই থাকে। সেই সাথে ওর কোয়ার্টারটা সে ভাড়া দিয়ে দেয়। এতে দু পয়সা আসবে। আর স্যারের সাথে থেকে বাজারঘাট করে দিলে খাওয়া খরচটাও বাঁচবে।
সেদিন থেকে পরাণ মনোয়ার স্যারের বাসায় একটা রুম দখল করে নিয়েছিল। স্যারের সাথে আরামেই ছিল সে। দুনিয়ায় যে কয়জন ভালো মানুষ দেখেছে সে, স্যার তাদের মধ্যে একজন। কোথায় ডোমের ছেলে পরাণ আর কোথায় প্রফেসর মনোয়ার খান। আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কিন্তু এক আশ্চর্য লহমায় দু’জনের পার্থক্য ঘুচে গিয়েছিল। নিপাট ভদ্রলোক মানুষটির নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রায় পরাণ ডোম ছিল একমাত্র সঙ্গী।

মনোয়ার স্যার বলতেন, ‘জানিস পরাণ, আমি হলাম গিয়ে শিল্পী- মৃত্যুর শিল্পী। মৃত্যুর ভেতরে ডুব দিয়ে বের করে আনি তার কারণ।’
ফাঁস দিয়ে মরা যুবতীর লাশের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে বলতেন, ‘এই দেখ দাগটা। দড়ি গলার উপর কিভাবে বসে আছে? এর মানে হল এই মেয়েটা নিজের গলায় নিজে দড়ি লাগায়নি। এটা... ’
সেই মনোয়ার স্যার চলে গেলেন। দুঃখ পাওয়াই স্বাভাবিক পরাণের। কিন্তু মৃত্যু তার কাছে ডাল-ভাত। নিজেকে সামলে নিল সে।
দারোয়ানকে পরাণ জিজ্ঞেস করল, ‘নতুন সার কেমন রে?’
‘আরে ছার না। নতুন এক ম্যাডাম আইছে। পরীর মতোন সুন্দর। যা যা। ম্যাডামের সাথে দেহা কইরে আয়। তোরই তো এহন সময়।’
ইশারায় চোখ টিপল দারোয়ান। অশ্লীল ইংগিত স্পষ্ট সে চোখে। দেখেও না দেখার ভান করল পরাণ ডোম।
মনোয়ার স্যারের মৃত্যু ক্রমশ অসাড় করে দিচ্ছে তার মনকে। ধীরে ধীরে পা বাড়াল সে। তবে শহরের বাইরের দিকে- মালতীর আস্তানায়।
*******
পরাণ ডোম মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃতদের তো নয়ই। সে ডোম। লাশ কাটে। ধারালো বাটালি মৃতের কপালের উপর শক্ত করে ধরে। তারপর আঘাত হানে হাতুড়ি দিয়ে। ফট্টাস করে ফেটে যায় খুলিটা। বেরিয়ে আসে থকথকে মস্তিষ্ক। ধুসর রঙয়ের মস্তিষ্কের দুটি ভাগ পরস্পরের সাথে মিশে শুয়ে আছে চুপচাপ।
সেই মস্তিষ্কের গায়ে অগুনতি শিরা উপশিরা তখন কালচে রঙ ধারণ করেছে। যেন অযুত-নিযুত কেঁচো বৃষ্টি হওয়ার পর সদ্য ভেজা মাটিতে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তাদের সেই গমনপথে উত্থিত মাটির স্তূপের মতো শিরাগুলি জেগে থাকে মস্তিষ্কের সমস্ত পিঠ জুড়ে।
পরাণ ডোমের হাতে ধরা সুতীক্ষ্ণ স্কালপেলের আঘাতে সেই শিরাগুলি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে আরো গভীরে ঢুকিয়ে দেয় স্কালপেল। উন্মোচিত করে রহস্য- মৃত্যুর রহস্য।
লাশের পাশে ময়নাতদন্তের শিট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে স্নেহা ম্যাডাম। মোমের মতন মসৃণ চিবুকে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। আহা! পরাণ ডোমের বড্ড কষ্ট হয় ম্যাডামের জন্য। বড্ড ছেলেমানুষ তিনি। এখনও মৃত্যু আর লাশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। পারার কথাও নয়।
কত-ই বা বয়স হবে তাঁর? বড়জোর ত্রিশ। থাকেন মেডিকেল কলেজের কোয়ার্টারে। যেখানে প্রফেসর মনোয়ার খান থাকতেন সেখানেই- একা। বাড়ি ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে।
ম্যাডাম যেদিন দেরি করে কলেজে আসে, সেদিন পরাণ অস্থির হয়ে যায়। বুক ধুকপুক করতে থাকে। তারপর হয়ত বারান্দার অন্য প্রান্তে ছোট্ট প্রলম্বিত পদক্ষেপে তাঁর পদধ্বনি শোনা যায়। ওর কান উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকে। তিনি গিয়ে তাঁর রুমে বসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পরাণ হাজির হয় তার সামনে। স্নেহা ম্যাডাম তাকে প্রতিদিনের মতো জিজ্ঞেস করেন, ‘পরাণ, আজকে কয়টা?’

পরাণের চোখের পাতা পড়ে না। সে অপলক তাকিয়ে থাকে। সম্মোহিত হয়ে যায় স্নেহা ম্যাডামের দিকে তাকালে। তাঁর লালচে পাতলা ঠোঁট কথা বলার সাথে সাথে তিরতির করে কাঁপতে থাকে।
ম্যাডাম তার চোখের ঘন পত্রপল্লব কোনো একটা ভারী ইংরেজি বইতে সেঁটে রাখেন। হয়তো পরাণের উত্তর না পেয়ে এবার তিনি মুখটা উপর দিকে তুলে ধরেন। পরাণের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান। ওকে ডাক দেন, ‘পরাণ...’
পরাণ ডোমের বুক ধ্বক করে ওঠে। এত জোরে তার হৃদপিণ্ড শব্দ করে ওঠে যে, সে স্পষ্ট শুনতে পায়। পরাণ অস্ফুট স্বরে উত্তর দেয়,
‘জি ম্যাডাম…’
পরাণের ধ্যানময়তার ম্যাডাম মৃদু হাসেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দেন। পরাণ বুঝে পায় না, সেটি কি ব্যঙ্গ নাকি অন্য কিছু।
সে কেমন দিশেহারা বোধ করে। আবার বলে, ‘জি ম্যাডাম…’
স্নেহা ম্যাডাম জিজ্ঞেস করেন, ‘আজকে কয়টা কেস এসেছে?’
পরাণ ডোম সম্বিৎ ফিরে পায়। মৃত্যুই তার কাছে স্বাভাবিক। মৃত্যুই একমাত্র জিনিস যার উপরে সে নিজের মাতব্বরি ফলায়। পরাণ নিজের জগতে ফিরে আসে।
সে উত্তর দেয়, ‘তিনটা গলায় ফাঁস, দুইটা পয়জনিং, একটা আগুনে পোড়া কেস ম্যাডাম।’

********************************************************

পরাণ ডোমের পোস্টমর্টেম এর প্রিভিউ থেকে আশাতীত সাড়া পেয়েছি। তাই গ্রন্থটির নামগল্পের চুম্বকাংশ আপনাদের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
উল্লেখ্য, ‘পরাণ ডোমের পোস্টমর্টেম’ একটি রহস্য-মনোস্তাত্ত্বিক ঘরানার গল্পগ্রন্থ। এতে রহস্য, মনস্তত্ত্ব, পরাবাস্তব-অধিবাস্তব, সমসাময়িক ঘরানার মোট দশটি গল্প রয়েছে।

বইয়ের নামঃ পরাণ ডোমের পোস্টমর্টেম
জেনরঃ মিক্সড (রহস্য-মনোস্তাত্ত্বিক-রোমাঞ্চ)
লেখকঃ অমিতাভ অরণ্য
প্রচ্ছদঃ বাপ্পাদিত্য চৌধুরী
প্রকাশকঃ বদরুল মিল্লাত
প্রকাশনীঃ নহলী প্রকাশনী
প্রকাশকালঃ প্রকাশের তারিখ ২০ ডিসেম্বর
পৃষ্ঠাঃ ১২৮, মদ্রণ মূল্যঃ ২৫০/-, ৪০% ডিসকাউন্টে প্রি-অর্ডার মূল্য ১৫০/-,
প্রি অর্ডার শুরু হবে- ১০ ডিসেম্বর থেকে।
প্রি-অর্ডারে আপনার কপিটি পেতে চাইলে যোগাযোগ করুনঃ https://www.facebook.com/noholibooks/
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৩
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×