ভালই কাটছিল ছেলেবেলা – সকালে স্কুল, বিকেলে ‘বাধ্যতামূলক’ ঘুম ফাকি দিয়ে খেলা, আরা রাতের বেলা সবচে অপ্রিয় এপিসোড – পড়তে বসা। ক্লাস সিক্স থেকে সবে মাত্র সেভেন-এ উঠেছি। সে বছরেরই মে মাসের কোন এক দিনে বাবা-মা আমাকে রেখে আসলেন ক্যাডেট কলেজে। ভর্তির দৌড় ঝাপ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ‘ক্যাডেট কলেজে পড়ব না’ - এমন মত দেয়ার মত সাইকোলজিক্যাল ম্যাচুরিটি আর স্বাধীনতা কোনটাই বোধকরি ছিলা না তখন। বরঞ্চ, ক্লাশে ফার্স্ট বা সেকেন্ড হওয়ার মত বাবা-মা’র রেগুলার তাগিদ হিসেবেই নিয়েছি আর যথারীতি উতরেও গিয়েছি, তাদের গর্বিত করেছি।
দিনটির কথা আমার আজও মনে আছে, আমাকে ক্যাডেট কলেজের হাউজে (ডরমিটরি) রেখে দিয়ে আব্বু-আম্মু আর আমার বড় বোন চলে গেল, আর আমি হাউসের গেটে দাড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। কেন কাঁদছিলাম জানিনা, কিন্তু কান্না পাচ্ছিল অনেক। বাবা-মা’কে ছেড়ে সেদিনের আগে পর্যন্ত একদিনও থাকিনি। হয়ত সেটাও একটা কারণ হয়ে থাকবে। তবে সেদিন বুঝিনি যে, ঐদিন থেকে আমাকে বাকি জীবনটা বাবা-মা থেকে দূরে আর বাসার বাইরে বাইরেই কাটাতে হবে, আর কোনদিন মায়ের কাছে সেই অর্থে ফিরে যাওয়া হবে না। আজও জানিনা তাঁরাও বুঝতে পেরেছিলেন কিনা।
ক্যাডেট কলেজের ৬ বছরে প্রায় আবেগ শূন্য হয়ে গেলাম। বছরে তিন থেকে চার বার ছুটিতে বাসায় যেতাম। ছুটিতে বাসায় গেলে প্রায় ‘মেহমানের’ মত ট্রীট করা হত আমাকে। হয়ত আব্বু-আম্মু স্নেহের ঘটতি টুকু ছুটির সেই ক’দিনের ভেতর পুষিয়ে দিতে চাইতেন। আর তাই প্রথম প্রথম ছুটি শেষে আমিও কাঁদতাম, তেমনি কাঁদতেন আব্বু-আম্মুও। এই আবেগ টুকুও ফিকে হতে শুরু করল শেষের বছর গুলোতে। অর্ধ-যুগ পর যখন বেরিয়ে এলাম, তখন টের পেলাম কোন এক জায়গায় ছন্দ কেটে গেছে আমার আর আমার বাসার অন্য সবার মাঝে।
মাস তিনেক বাসায় ছিলাম এর পর। এইচএসসির রেজাল্ট বেরুতে না বেরুতেই আবার আমি বাসার বাইরে। আর এবার আমার নিজের ইচ্ছায় – আর কিছুটা আত্মপোষনের তাগিদ থেকে। এবার আমি স্বাধীন – জীবিকা আর জীবন দুই দিক থেকেই। ছুটিতে বাসায় আব্বু-আম্মুর কাছে যাবার ফ্রিকোয়েন্সি আর ডিউরেশন দুটোই কমে গেল – ক্যাডেট কলেজের তুলনায় বহুগুণে। ক্যাডেট কলেজ শেষে যারা আবার বাসায় ফিরে গেল তাঁরা হয়ত বাবা-মা’র সাথে সেই ছন্দটা আবার ফিরে পেয়েছে কেউ কেউ, কিন্তু আমি আর পাইনি।
খুব ক্ষোভ হয়, অভিমান হয় আব্বু-আম্মুর উপর আমার ছোট বেলার ক্যাডেট কলেজের সেই দিনগুলোর জন্য। মাঝে মাঝে আব্বু-আম্মুকে প্রশ্ন করেছি - ‘যখন বাবুদের সবচে বেশি মায়ের আদর আর গাইডেন্স দরকার ঠিক তখনই তোমরা আমাকে একলা ফেলে এসেছিলে ওখানে, কেন??’ - উত্তরে আব্বু মন খারাপ করেন, আর আম্মু কেঁদে ফেলেন। ওদের বয়স হয়েছে, এখন আর এসব প্রশ্ন করে ওদের অপরাধী করি না, নিজেই অপরাধ বোধে ভুগি অমন প্রশ্ন করে আব্বু-আম্মুকে কষ্ট দেয়ার জন্য। ক্লাস সেভেন’এ মে মাসের সেই দিনটি তে শুধু আমিই আব্বু-আম্মু’র স্নেহ হারাইনি, আব্বু-আম্মু’ও হারিয়েছে ওদের ছেলে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৩০