সাভার থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। পথেই খবর পেলাম নানু খুব অসুস্থ। গ্রামের বাড়িতে তিনি একা থাকেন। তাকে নিয়ে আসতে যেতে হবে। পরদিন ভোরবেলা নিজেই ড্রাইভ করে রওনা হলাম। সাথে আমার মা, আমার বড়বোন আর ভগ্নীপতি। পৌছে দেখলাম নানুর অবস্থা সত্যিই বেশ খারাপ। তাই তাকে নিয়ে ঐ দিনই ঢাকা ফিরে এলাম। দিনটি ২১শে ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার। সন্ধ্যার একটু আগেই বাসায় ফিরলাম। পরদিন নানুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। কিছুক্ষন বিশ্রামের পর নানুকে রাতের খাবার খাওয়ানো হল। তারপরই তাঁর অবস্থা খারাপ হতে লাগল। হাসপাতালে নেয়ার পথেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন রাত সাড়ে ১১টায় । নানুর তিন সন্তানের মধ্যে শুধু আমার মা’ ই তার পাশে ছিলেন মৃত্যুর সময়। আমার মা নানুর পা দুটো কোলে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসে ছিলেন আর কাঁদছিলেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর সময় তার দুই ছেলের কেউই ছিল না তাঁর পাশে
নানু আমাকে ভীষণ আদর করতেন। প্রিয় নানুকে হারানো আর আমার মায়ের কান্না মিলয়ে মনটা ভীষণ খারাপ। নানু একজন মহীয়সী নারী ছিলেন আর অনেক অভিমানীও। তিনি ১৯৫৯ সালে বিধবা হন। তখন তাঁর তিন সন্তানদের বয়স ১, ৩ আর ৪। সব মায়ের মতই তিনি নিজের সন্তানদের মানুষ করেছেন, কিন্তু এর জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার আর স্ট্রাগ্ল করেছেন তা অসামান্য। কিন্তু সে তুলনায় তাঁর ছেলেরা তাঁর প্রতি দ্বায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন। সে অভিমানেই তিনি এই বৃদ্ধ বয়সেও একা থাকতেন। নানুর অসুস্থতার বিষয়টি দু’ছেলেই সিরিয়াসলি নেননি। পরদিন সকালে তাঁর মরদেহের পাশে দু’ছেলেই অনেক কান্নাকাটি করলেন, অপরাধী অপরাধী চেহারা নিয়ে অনুতপ্ত হলেন। সময় থাকতে কেউই অনুতপ্ত হননি; ‘সরি’ হননি, হয়ত ভেবেছেন আরও সময় আছে ‘সরি’ হবার, ‘সরি’ বলার। নানুকে কবর দিয়ে ফিরে আসার পথে এসব কথাই মনের ভেতর বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর ভীষণ রাগ হচ্ছিল মামাদের উপর। তখনই মনে হল আমি আমার মা আর বাবার জন্য যথেষ্ট করছি কিনা। এর উত্তরটাও আমার কাছেই ছিল –- না, মোটেও করছি না। আমিও আমার মামাদেরই মত দ্বায়িত্ব এড়িয়ে যাই, গা বাঁচিয়ে চলি।