বৃক্ষ-জীবন প্রণতি
বৃক্ষেরও জীবন আছে, বৃক্ষ জড় পদার্থ না। একথা আধুনিক মানুষ জেনেছে অনেক দিন আগে। জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করে দেখেয়িছেন, প্রাণের অস্তিত্ব আছে বৃক্ষেরও। প্রাণ থাকলেও বৃক্ষ চলাফেরা করতে পারে না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি; কাটিয়ে দেয় জীবন। কত ঘটনা, কত মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের নীরব দর্শক বৃক্ষ। বুদ্ধিবৃত্তি নেই বলেই গাছপালা সব ঘটনার নীরব সাক্ষী হতে পারে।

কোনো কোনো মানুষও বৃক্ষের মতো; বাহ্যিকভাবে দেখা যায় সে চলাফেরা করে, হাটে-বাজারে যায়, শপিং মলে স্কুল-কলেজে যায় বটে, কিন্তু প্রকৃতার্থে কাটায় বৃক্ষ-জীবন। বৃক্ষের মতো সে স্থবির না; কিন্তু শুধু বাহ্যিক চলাফেরা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না, অথবা তার বৃক্ষ-জীবনকে অস্বীকার করা যায় না। মানব-জীবন তো শুধু দৈহিক না, মানসিকও। যে মানুষ মানসিক শৃঙ্খলে বাধা, সে দৈহিকভাবে স্থান পরিবর্তন করতে পারলেও তার প্রকৃত জীবন তো বৃক্ষের মতো স্থাণু-স্থবির ও অচল। এক্সিসটেনশিয়ালিস্টরা তো এজন্য জাগতিক জীবনে একমাত্র মানুষকেই অস্তিত্বশীল বলে মনে করে। কারণ, বস্তুগত উপস্থিতিই অস্তিত্ব না, তাঁদের কাছে। তাঁরা মনে করে বস্তুকে অস্তিত্বশীল হতে হলে অবশ্যই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। আর এই ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া বস্তুজগতে আর কারো নেই, আর কোনো প্রাণের নেই। মানুষই পারে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে; মানুষের দ্বারাই সম্ভব নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া। বস্তুজগতে পশু-পাখি, বৃক্ষ-তরুলতা অন্য সবকিছু জন্মেই উত্তরাধিকার পায়, পশু-পাখি, তরুলতা জন্মেই পূর্ব-পুরুষের নামে চিহ্নিত হয়। শুধু মানুষই জন্মেই মানুষ না; অথবা মানুষকে খুব সহজে উত্তরাধিকার দেয়া হয় না। প্রাণী জগতে জন্মের পর একমাত্র মানুষকেই পূর্ব-পুরুষের পরিচয় অর্জন করতে হয়, তাকে মানুষ হতে হয়। মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। তার মানে, মনুষ্যত্ব একটা গুণ; যা জন্মের পর মানুষকে বস্তুজগতের অন্যসব কিছু থেকে আলাদা করে দেয়। যে মানুষ নিজস্বতা সম্পর্কে জানল না, মানসিক বিকাশ ঘটল না, খাওয়া-দাওয়া আর কোষ বৃদ্ধি ছাড়া আর অন্য কিছু হলো না তার; সে মানুষ তো বৃক্ষই।
সুমনা হকও বৃক্ষের মতোই জাগতিক জীবনে উপস্থিত, তবে অস্তিত্বশীল না। নিজের বলে তার কিছু নেই, নিজের বিকাশ নেই, উত্তরণ নেই। তার মানসিক স্বাস্থ্য রোগাক্রান্ত। হাত-পা মাথা সমেত একদলা বস্তুপিণ্ড মাত্র সুমনা। বিয়ের আগে বাবা তাকে শিখিয়েছিল মানুষ হওয়ার কৌশল। তখনো সবকিছু আয়ত্তাধীন হয় নি তার। তবে বুঝে নিয়েছিল-- মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদির মধ্যেই ব্যক্তির অস্তিত্ব নিহিত থাকে। স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে উঠবার জন্য সুমনা এসব তার বাবা এনামুল হকের কাছ থেকেই জেনেছিল। আদর্শবান পিতার আদর্শ মেয়ে সুমনা হক। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে অন্য পাঁচজনের চেয়ে একটু বেশি আদরেই মানুষ হয়েছিল সে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ বর্ষে পড়ার সময় বাবার বন্ধুর ডাক্তার ছেলে সজল আশফাকের সাথে এক সপ্তাহের নোটিশে বিয়ে হলে পড়ালেখায় ছেদ পড়েছিল তার।
বিয়ের পর নতুন সংসার, নতুন জীবন। সবকিছুই নতুন করে শুরু হলো সুমনার। প্রজাপতি পাখায় স্বপ্নময় দিন কোথা দিয়ে কিভাবে কেটে যেতে লাগল; এসব বুঝে ওঠার আগেই দুবছর কেটে গেল। শরীরের আকর্ষণেও এবার খানিকটা ভাটা পড়ল। কারণ, ততোদিনে তার দেহের অভ্যন্তরে আরো একজনের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করেছে সুমনা। মাতৃত্বের অনাস্বাদিত ভালো লাগা তার দেহমন জুড়ে বাসা বাধলে সজল তার কাছে অনেকটাই গৌণ হয়ে উঠল। অবশ্য পিতৃত্বের আকাক্সক্ষায় সজলও বাড়তি সেবাযত্ন করতে মুরু করল সুমনার। দেখতে দেখতে নয় মাস উবে গেল কর্পুরের মতো; একদিন তাকে প্রাইভেট একটা ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো। ওখানে অফিস সময়ের পর বাড়তি ডিউটি করে সজল। ডাক্তারের স্ত্রী হিসেবে বাড়তি কিছু খাতির করল ক্লিনিকের স্টাফরা। সুমনা ভর্তি হওয়ার পরদিন ওকে সিজার করার জন্য ওটিতে নেয়া হলে প্রথমবারের মতো সুমনার মৃত্যুভয় হলো। এ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তার কথায় কথায় কখন ওকে সেন্সলেস করার ঔষধ দিয়েছির সুমনা তা বুঝতে পারল না। যখন ওর জ্ঞান ফিরল তখন দেখল কোমরের নিচের অংশ ও কিছুতেই নাড়াতে পারছে না। ধবধবে সাদা বিছানার এক পাশে বাবাকে দেখে সুমনার চোখে জল এলো। এর মধ্যে অবশ্য একজন নার্স সোহানকে ওর চোখের সামনে তুলে ধরলে সুমনা বুঝল ও মা হয়েছে।
দিন-সাতেক ক্লিনিকে থাকার পর একদিন বিকেলে সোহানকে নিয়ে ওরা বাসায় এলো। বাসায় এবার নতুন ব্যবস্থা। শিশুর আগমন উপলক্ষে মা-ছেলের জন্য আলাদা বিছানার ব্যবস্থা সজল আগে থেকেই করে রেখেছিল। এটা দেখে অবাক লাগে সুমনার প্রথম প্রথম। বিয়ের পর ওরা কখনোই আলাদা বিছানায় রাত কাটায় নি। সজল অবশ্য আলাদা বিছানার ব্যাখ্যা দিলে ওর ভাবনায় ছেদ পড়ল। সত্যি তো ছোট সোহানকে নিয়ে এক বিছানায় থাকতে গিয়ে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়। এভাবে সজলের সাথে সুমনার বিছানা আলাদা হওয়ার মধ্য দিয়ে যে ওদের পারস্পরিক বন্ধনটাও শিথিল হয়ে আলাদা হয়ে যাবে সেকথা তখন দুজনের কেউ-ই ভাবে নি। সোহান এখন হাত-পা নেড়ে সুমনার কথার অনুসরণ করে; আকার-ইঙ্গিতগুলো বোঝার চেষ্টা করে। ছোট্ট সোহানের বিষয়ে গোপনে মনের অজান্তে সুমনা কতটা এনগেজ্ড হয়েছে সেটাও অবশ্য হিসেব করে দেখা হয় নি তার। সজল কখন বাসায় আসে, কখন যায়; খায়, ঘুমায়-- এসব সে কতদিন খেয়াল করে নি তা ঠিকঠাক গুনে বের করাও এখন সুমনার জন্য অসম্ভব। কোন্ ফাঁকে সজলের সাথে বিছানার দূরত্বটা শরীরের এবং মানসিক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে সে খবরও সুমনা রাখতে পারে নি। প্রায় বছরখানেক এভাবে কেটে গেলে একরাতে সুমনার হৃদয় জেগে ওঠে; জেগে ওঠে শরীরও। সজলকে ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে করে ওর। কিন্তু রাত দশটা-বারোটা পার হলেও ঘরে ফেরে না সজল। সারা রাত সজলের অপেক্ষায় বিনিদ্র কেটে গেলেও সজল ঘরে না ফিরলে-- সুমনা ভাবে সে বিরক্ত হবে কিনা!
বিয়ের পরের দিনগুলো কিভাবে প্রজাপতি ডানায় ভর করে কেটে গেছে, এসব কথা ভাবতে ভাবতে সোহানকে বুকের পাশে রেখে সুমনা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সজলের কথা অনেক দূর থেকে ভাসতে ভাসতে সুমনার কানের খুব কাছে এসে পষ্ট হলে ঘুম জড়ানো চোখের পাতা টেনে তুলে সে আবছা দেখতে পায়-- সোহানকে কোলে নিয়ে আদর করছে সজল।
শিশু মুখ আদর পেয়ে আনন্দে ভরে উঠেছে। মৃদু শব্দ করে হাসার চেষ্টা করছে সোহান। ধীরে ধীরে সুমনা হক ঘুম জড়ানো চোখ টেনে তুলে বিছানায় উঠে বসে। রাত অনেক। ঘড়ির কাটা দুটো পার হয়ে গেছে। ডিম লাইটের আবছা আলোয় সজলের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে দেখে সুমনা; সে খোঁজে নিজেকে। খোঁজে পুরনো সজলকে। না, কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই; উদ্বেগ-উৎকণ্ঠারও কোনো ছাপ নেই সজলের মুখে। হাসি-খুশি প্রাণবন্ত সজল তার রক্তের উত্তরাধিকার সোহানকে আদর করছে। সুমনাকে যেন লক্ষ্যই করে না সে। ও যে ঘুম থেকে জেগে বিছানায় বসে আসে, তবুও একটিও কথা বলে না সজল।
সুমনার ভীষণ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এতো রাত পর্যন্ত ঘরে ফেরে নি কেন সে! কিন্তু করে না সুমনা; প্রশ্ন করে লাভ নেই সেটা ভালো করেই জানে সে। সজল অজুহাত দেখাবে ক্লিনিকে সিরিয়াস রুগী এসেছিল। অথবা সত্যিই সেদিন রুগী ছিল। ডাক্তারদের পেশায় রুগীর কথা বলে তারা সব ধরনের পারিবারিক অমানবিক আচরণগুলো করতে পারে সহজেই। স্বামীকে সন্দেহ করলে স্ত্রী হিসেবে এক্ষেত্রে দোষ হবে সুমনার-ই। লোকে বলবে, তার মধ্যে মানবিকতা নেই! কোনো কথা না বলে সুমনা অবশেষে আবারো শুয়ে পড়ে বিছানায়। চোখ বোজে সে, ঘুমাতে চায়; কিন্তু পারে না। ওর চোখের সামনে বিগত দু-বছরের রাজ্যের স্মৃতিময় ঘটনাগুলো বায়োস্কপের মতো ভেসে বেড়াতে থাকে।
সোহান বাবার সাথে খেলা করে ঘুমিয়ে পড়লে সজল ওকে নিঃশব্দে সুমনার বুকের কাছে শুইয়ে দিয়ে চলে যায় ওর নিজের ঘরে। তখন সুমনার মনে হতে থাকে, ওকে ভীষণ উপেক্ষঅ করছে সজল। ডাক্তার সজল আশফাক পেশার দোহাই দিয়ে ওর কাছে আত্মগোপন করেছে। অথবা সুমনাকে এখন শুধুই সজল তার সন্তানের, তার ছেলের মা মনে করে। মায়ের অধিক কোনো আবেদনই এখন আর সুমনার নেই। অথবা ওর মাতৃমূর্তি ভেদ করে সজলের কাছে অন্য কোনো আবেদন তৈরি করে। তাহলে কি সুমনা হকের একেবারে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে সজলের কাছে। মাতৃত্বের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় সুমনা অনেক কিছুই খেয়াল করে নি। কখন কিভাবে সজল আর ওর সম্পর্কের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল উঠেছে তা বুঝতে পারে নি সে। ইচ্ছে করলেও সেই দেয়ালটা এখন সরাতে পারছে না সে কিংবা সজল- দুজনের কেউ-ই।
সুমনা এরপর ভাবতে থাকে, পড়ালেখাটা এবার শেষ করবে। বৃক্ষ-জীবন অতিক্রম করতে হলে ওকে অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কোনো কাজ জোটাতে পারলেই কী স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের দেয়াল অতিক্রম করে আবারো তারা বিয়ের ঠিক পরের দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারবে? না পারলেও, সুমনা এমএসসি শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে মনে মনে।
ব্যক্তিগত ইচ্ছা ত্যাগ করে সুমনা মা হওয়ার মধ্য দিয়ে যে স্থবির জগতে ঢুকে পড়েছে সেখান বেরিয়ে আসার প্রবল আকাক্সক্ষায় একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলো। সজল তার ভর্তি হওয়ার ব্যাপার নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তাকে বাধা দিল না, আবার উৎসাহিতও করল না তাকে। সজল হয়তো দেখতে চেয়েছিল, সুমনা তার ইচ্ছাকে সফল করতে পারে কিনা! অথবা সজল আগেই জানতো পরিণাম কী হবে!
ক্লাস শুরু হওয়ার পর সুমনা বুঝতে পারে-- সোহানকে রেখে যাবে সে কার কাছে। এ সময় সুমনার মনে পরে যৌথ পরিবারের কথা। ওরা দু-জন ছাড়া যদি সংসারে বাড়তি কেউ থাকত, তাহলে ওকে সমস্যায় পড়ে হতো না। সোহানকে নিয়ে ক্লাসও করতে পারবে না সে। সুমনার বৃক্ষ স্বরূপ মাতৃত্ব জড়িয়ে ধরে; অন্যদিকে তার মনের ভিতর ব্যক্তিজীবন সক্রিয় করে তোলার জন্য উদ্গ্রীবতা বাড়ে। উভয় ভাবনার সংঘাত-দ্বন্দ্ব হয়। এখন সুমনা কোন দিকে যাবে? নিজের শরীরের অংশ সোহানকে কিভাবে এবং কতটা মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব হবে সুমনা হকের পক্ষে!
সূত্র : দৈনিক উত্তরাপ্রতিদিন [ উত্তরলিপি], রাজশাহী : ৪ ডিসেম্বর ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৭:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




