ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র শাশ্বত চিরন্তন ও পরিপূর্ণ জীবন দর্শন। যা কিছু সত্য, সুন্দর ও মার্জিত তাই ইসলামে অনুমোদিত। অন্যদিকে অন্যায়, অসত্য, অসুন্দর বা কদর্যতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা ইসলামে অননুমোদিত। দুর্নীতি এমন একটি অন্যায় ও অপকর্ম যা ইসলামে অননুমোদিত এবং এর সাথে ইসলাম ও আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা

-এর দূরতম সম্পর্কও নেই। বরং যাবতীয় অন্যায়, অপকর্ম, অসত্য, অসুন্দর বা কদর্যতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার মূলোৎপাটন করে সুশৃঙ্খল ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা

কাজ করে গেছেন। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিষয়ে মহানবী (সা

ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা

অন্যতম অন্যায় কাজ, ঘুষ এবং এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়ই জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে (তাবারানী)। কেবল ঘুষদাতা এবং ঘুষ গ্রহীতাই নয়; বরং ঘুষ এবং দুর্নীতির ব্যাপারে মধ্যস্থতাকারীর প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ বিষয়েও হাদীস শরীফে আলোচনা এসেছে (আবু দাউদ, তিরমিযি, আহমদ, তাবারানী)। শাসনকর্তা ও বিচারকের দুর্নীতির পরিণাম সম্পর্কে হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা

ইরশাদ করেন, "যে ব্যক্তি কোন জাতির শাসনকর্তা বা বিচারক নিযুক্ত হবেন রোজ কিয়ামতে তাকে হাত-পা কাঁধের সঙ্গে বেঁধে আল্লাহ পাকের সামনে উপস্থিত করা হবে। দুনিয়ায় তিনি যদি শাসনকার্য ও বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে থাকেন এবং ঘুষ ও দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে না থাকেন তবে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। অন্যথায় তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।" রাজকর্মচারী বা কর্মকর্তা হিসেবে কোন ধরনের উপঢৌকন গ্রহণও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা

অভিমত ব্যক্ত করেন, "রাজকর্মচারী নিযুক্ত হয়ে যে উপঢৌকন বা বেতনের অতিরিক্ত পাওনা গ্রহণ করলো সে নিঃসন্দেহে আমানতের খিয়ানত করলো এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হলো" ( আহমাদ ও আবু দাউদ)। এমনকি কোন সুপারিশের বিনিময়ে উপঢৌকন গ্রহণ করাকেও আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা

কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং একে সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতি আমানতের খিয়ানত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ও আমানতের খিয়ানত হিসেবে বিবেচিত বিষয় কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হারাম এবং এর পরিণাম নি:সন্দেহে জাহান্নাম।
এখানে লক্ষ্যনীয় যে, ইসলামে দুর্নীতির কি ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে? আমাদের কি উচিত নয় উক্ত দুর্নীতি থেকে দূরে থাকা এবং এর মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা? তা না হলে আমরা কি শেষ বিচারের দিন রেহাই পাব? জাহান্নাম কি দুর্নীতিবাজদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে না? মহানবী (সা

কি হাশরের ময়দানে দুর্নীতিবাজদের জন্য সুপারিশ করবেন? মোটেও করবেন না। তা হলে আমাদের পরিণতি কি হবে? আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পরপর কয়েকবার প্রথম হয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। এটা কি আমাদের জন্য কোন গৌরবের ব্যাপার? এটা কি আমাদের জন্য চরম অপমান ও লজ্জার বিষয় নয়? আমরা সচেতন ব্যক্তিবর্গ কি তা মেনে নিতে পারি? এর কি কোন বিহিত ব্যবস্থা নেয়া উচিত নয়? কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির জন্য আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ কলংকিত হোক তা কি আমাদের জন্য কোন সুখকর ব্যাপার? আমরা জানি স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ। সুতরাং যার স্বদেশ প্রেম নেই তার ঈমান অপূর্ণাঙ্গ।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা

-এর সাথে এবং প্রকৃত মুসলিমদের সাথে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আদৌ কোন সম্পৃক্ততা নেই। কখনও থাকতে পারে না এবং একজন প্রকৃত মুসলিম কখনও সন্ত্রাসবাদী বা সন্ত্রাসী হতে পারে না। বরং সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করে প্রকৃত মানব কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যেই মহানবী (স

-এর আগমন এবং তাঁর উম্মতগণেরও জীবনের অন্যতম লক্ষ্য এটি। যারা সন্ত্রাস করছে তারা বিপথগামী, পথভ্রষ্ট তারা ইসলামের কেউ নয়। সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম নেই। কারণ কোন ধর্মই এটাকে সমর্থন করে না।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলা হয়েছে- ফিৎনা-সন্ত্রাস কতল তথা হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ [১:১৯১]। তাই আল্লাহতাআলা বলেন, দুনিয়াতে শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে ফাসাদ তথা বিপর্যয়-নৈরাজ্য বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করবে না [৭:৫৬]। কারণ, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বা সন্ত্রাসীদের মোটেও ভালবাসেন না। [আল কুরআন, আয়াত ২৮-৭৭]। ইসলামের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, মহানবী (সা

-এর জীবদ্দশায় সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। এগুলো কখনও আক্রমণাত্মক ছিল না। মহানবী (স

তার যুদ্ধনীতিতে ঘোষণা করলেন "কখনও আক্রমণের আকাঙ্খা পোষণ করো না, নিরাপত্তার জন্যে আল্লাহতাআলার শরণাপন্ন হও" [আবু দাউদ]। তিনি তার সাহবীদের আরও বুঝিয়ে বলেন, "যুদ্ধে বন্দি হলেও তোমরা মহিলা, শিশু ও অক্ষম বৃদ্ধদের হত্যা করো না, কোন যুদ্ধবন্দিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করো না; ফলবান বৃক্ষ নষ্ট করো না এবং জমির ফসল ও সম্পত্তি কেড়ে নিও না"। মূলত মহানবী (সা

-এর যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল একান্তভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান লক্ষ্যে। অনর্থক রক্ত ক্ষয়ের উন্মাদনা ছিল না তাঁর সমরনীতিতে। তা ছাড়া ৮ম হিজরীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের ঘটনার মতো কোন বিজয় পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসী ভেবেছিলো যে, তাদের কারোরই আর রক্ষা নেই। কারণ এতদিন যার প্রতি তারা সীমাহীন অত্যাচার ও অনাচার অব্যাহত রেখেছিল, আজ তিনি অবশ্যই এর প্রতিশাধ নিবেন। কিন্তু না! রাহমাতুল্লিল আলামীন সেদিন মক্কায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। সম্পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করলেন দীর্ঘদিন যাবৎ জ্বালাতনকারী লোকগুলোকে। বিশ্ব বিবেক এখানে স্তম্ভিত ও বিমূঢ়। এটা কি কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব!! মনুষ্য বিবেক যা কখনও কল্পনাই করতে পারে না, প্রিয় নবী (সা

তাই করতে সক্ষম হলেন। এরপরও কি বলা যায় ইসলামে সন্ত্রাসের কোন সুযোগ আছে? আর মহানবী (সা

এবং মুসলিমগণ যুদ্ধবাজ? আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বব্যাপী আজ এই যে প্রচন্ড সামাজিক অস্থিরতা, এই যে পৃথিবী বিস্তৃত বিশৃঙ্খলা, এই যে বিশ্বব্যাপী প্রচন্ড রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস, সমাজ দেহে পাপ ও অপরাধের এই যে অবাধ বিস্তৃতি, এ যেন নব্য জাহেলিয়াত, এ থেকে পরিত্রাণের একটি মাত্র পথ খোলা আছে এবং সেটা হলো- ব্যক্তি মানুষের হৃদয়ে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের জ্ঞানকে অনুপ্রবেশ করিয়ে আল্লাহর ভয়কে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করা এবং জীবনের সর্বেক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা

-এর প্রদর্শিত পথের ও আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো। এ এক পরীক্ষিত মহৌষধ। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের বড় দুভার্গ্য আল কুরআন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রদর্শিত অব্যর্থ কর্মপন্থাকে সতর্কভাবে বর্জন করা হচ্ছে।
পরিশেষে একথা নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আজকের এই অশান্ত দুনিয়ার অনাচার-অত্যাচার, নিপীড়ন, নৈতিকতা বিবর্জিত জীবন সন্ধিক্ষণে, সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহর আদর্শের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই। তাই আসুন আমরা সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মহানবী (সাঃ) এর আদর্শের অনুসরণ করি। আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। আমিন।