ছোটকাল হইতেই আমি বোকা ধরণের মানুষ। দুনিয়ার এত প্যাঁচসকল বুঝিতে পারিনা। ক্লাশ ইলিভেনে থাকিতে আমার ক্লাসের কোন এক মহাজ্ঞানী, মহাপণ্ডিত আমাকে একখান কথা বলিয়াছিলেন। কথাখানা ছিল এইরকম-
"পরীক্ষা চলাকালীন সময় বাথরুমে যাওয়া মানে গোটা কয়েক নম্বর পাওয়া। তাই দলে-দলে বাথরুমে যাও আর বুক ফুলিয়ে পাশ করিয়া বেড়াও।"
ছেলেটা বড়ই পন্ডিত মানুষ। নিজের জ্ঞানের উপর ভর করিয়া অনেক কিছু করিয়াছে।
তবে ঐ কথাটার মর্মার্থ আমার মাথায় প্রবেশ করিতে পারে নাই। বাথরুমে গমন করিলে আবার পরীক্ষায় নম্বর লব্ধ হয় কি করিয়া! এই চিন্তায় কয়েক রজনী আমার ঘুম হইয়াছিল না । কথাখানা বড়ই পান্ডিন্ত্যের! আমার বুঝিবার সাধ্যের বাইরে।
পরেরদিন পরীক্ষার পূর্বে পন্ডিত বন্ধুর সাথে কথা বলিতে উপস্থিত হইলাম। সবাই যখন পাশ করিবার চিন্তায় অধীর পেরেশানে এদিক-সেদিক পায়চারী করিতেছে, সে তখন দিব্যি হাসিতেছে। আমি ক্লাশের ফার্স্ট বয়। তবেও কিনা ঐ কথাখানা আমার বুঝিবার বাইরে। তাই তো তাহার কাছে আসিয়া জিজ্ঞেস করিলাম-
"তোমার গতদিনের কথাখানা আমার বোধগম্য হইতেছে না। দয়া করিয়া একটু বুঝাইয়া বলিবে?"
ছেলেটা একটু বিব্রত বোধ করিল। হয়ত চারপাশে এত লোকজন দেখিয়া নিজের মহামন্ত্রের রহস্য সকলের সম্মুখে ফাঁস করিতে চায় না। তারপর আমাকে একটু দূরে আড়ালে নিয়া কহিল-
"আজকে পরীক্ষার মাঝে সময় করিয়া একবার বাথরুমে যাইবে। তাহলেই সবকিছু বুঝিতে পারিবে।"
পরীক্ষা শুরু হইলো। ঘন্টাখানেক যাওয়ার পর একের পর এক বাথরুমে যাইবার সিরিয়াল। আমি ওসব কাজ-কাম পরীক্ষার আগেই সেরে আসি। আমার পিতামহ সর্বদা উপদেশ দিয়াছেন পরীক্ষার সময় অযথা নষ্ট না করিয়া যথা কর্ম করি। তবে আজকে ঐ গোপন রহস্য উদঘাটন করিবার জন্যে হইলেও আমাকে একবার ওখানে যাইতে হইবে। আমার পরীক্ষা দেওয়া প্রায় শেষ। রহস্য উদঘাটন করিবার ইহাই উপযুক্ত সময়। তাই তো সময় নষ্ট না করিয়া একটা সিরিয়াল টুকে দিলাম।
তিনজনের পরে আমার সিরিয়াল পড়িল। তারপর সুযোগ পাইয়া খুশি মনে বাথরুমের দিক গমন করিলাম।
সেখানে গিয়া সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হইলো। তবে দক্ষিণ পাশের দেওয়ালে একখানা বই রাখা।
ইতিহাসের বই।
আমি আশ্চর্যমন্ডিত হইয়া ভাবিলাম আজকে তো ইতিহাস পরীক্ষা! তবে কিনা এইটাই গোপন রহস্য!
বইখানা একটু উল্টায়-পাল্টায় দেখিলাম। ভিতরে কিছু থাকিলেও থাকিতে পারে। পাতা উল্টানোর খস-খস শব্দে চারপাশ মোহিত হইয়া গেল। আমি তো মনে মনে অনেক খুশি। জীবনে এই প্রথমবার নিজে কোন রহস্য উদঘাটন করিয়াছি। এই কথা ভেবেই মনে কেমন আনন্দ বোধ হইতেছে।
তাহারপর মনের আনন্দে আনন্দিত হইয়া দরজা খুলিলাম। তবে দরজা খুলিয়া আমি বেশ অবাক হইয়াছি। আমাদের প্রিন্সিপাল আর অফিস সহকারী মজিদ স্বশরীরে হাজির। স্যার কিংবা কর্মচারীদের জন্যে তো এই বাথরুম না, তবে তাহারা এইখানে উপস্থিত হইয়াছে কেন!
আমি যখন এইগুলা চিন্তা করতেছি, ততক্ষণে মজিদ মিয়া বাথরুমের ভিতর থেকে বইখানা উদ্ধার করিয়া প্রিন্সিপাল স্যারের সম্মুখে হাজির।
অতঃপর স্যারের চোখ গভীর সমুদ্রের মতো ফুঁসিতে লাগিল। ফুঁসিতে ফুঁসিতে আমার জীবনে গভীর ঝড় বহিয়া দিয়া গেল। জীবনে প্রথম কোন রহস্য আবিষ্কার করিবার সকল স্বাদ মাটিতে মিশিয়া ধূলিসাৎ হইল। যদিও ইহার পরে কস্মিনকালে আর কোন রহস্য উদঘাটন করিবার দুঃসাহস করিনাই।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০১