প্রথমবার যখন বুয়েট এর বাসে ফিরব তখন বাস টার্মিনালের কাছাকাছি যেতেই দেখি দুই সিনিয়র ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা আর মুখভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়ি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে তারা আমার সিনিয়র। Nervousness থেকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম “বাড্ডা রুটের বাস কোনটা?” তারা আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন তারপর বাসগুলোর দিকে এক নজর দেখেই বলে দিলেন “ঐ যে ঐ-টা”। আমি বেশ অবাক হলাম- এত দূর থেকে বুঝল কী করে? এই না হলে কি আর বুয়েট স্টুডেন্ট! আমি তখন ১-১ এ পড়ি। পরে অবশ্য বুঝতে বাকি থাকল না বাড্ডা রুটের বাস সনাক্তকরণ পদ্ধতি- বাস এর সামনে অস্বাভাবিক লম্বা লাইন।
আমরা যারা এই রুটে যাতায়াত করি তারা সবাই অতিরিক্ত ভিড়ের এই ব্যাপারটার সাথে খুবই পরিচিত। তাই বাসের দরজা খোলার অনেক আগে থেকেই বাস এর সামনে লম্বা লাইন শুরু হয়। প্রথমে যে লাইনটা শুরু হয় সরলরৈখিকভাবে তার পরিসমাপ্তি হয় খুবই challenging। প্রথমে আমরা ভদ্রতা করে আমাদের সম্মানিত মহিলা যাত্রীদের বাসে উঠবার ক্ষীণ সুব্যবস্থা করে দিই। এরই মধ্যে আমরা ছেলেরা মানসিক ও শারীরিকভাবে নিজেরদেরকে প্রস্তুত করে নিতে থাকি ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবী ধাক্কাধাক্কির জন্য। সম্মানিত যাত্রীরা বাসে উঠবার পর শুরু হয় পেশিশক্তির অসম লড়াই। একেবারে যেন 'survival of the fittest'। সেখানে আমরা সবাই রাজা। যে যেভাবে পারে বাসে উঠে যাচ্ছে, কখনও সিনিয়র ভাই এর কাধে হাঁটু রেখে কিংবা জুনিয়র কারও পায়ে পাড়া দিয়ে। অত শত দেখার সময় নেই ভাই; ....aim in life তখন বাসের কাঙ্খিত শুধুমাত্র এবং কেবলমাত্র একটি সীট। আমি নিজেও যে কতদিন কত জনকে পার করেছি নিজের ঘাড়ের উপর দিয়ে আর তার চেয়েও কত বেশিদিন নিজে পার হয়েছি অন্যের পায়ে পাড়া দিয়ে তা না হয় নাই বা বললাম। আমার তিন বছর বুয়েট জীবনে পেশিশক্তির ব্যাপক ব্যবহার করে হাতেগোনা ক’বার মাত্র সীটে বসতে পেরেছি। অবশ্য না পারবার-ই কথা; ৬০ জনের বাসে যদি ৯০১১০ যাতায়াত করে তাহলে’ত এরকম অবস্থা হবেই। এমন অনেক সময় হয় যে বাস চালক নিজেই বাস এ উঠবার জায়গা পাচ্ছে না, কারণ বাস এর দরজায় তিন খানা হাতের উপর ভর করে ঝুলে আছে চারজন (অন্য আরেকজন হয়ত তার বন্ধুর হাতের উপর ভর করে ঝুলছে)। আমার কথাগুলো যে মোটেও অত্যুক্তি নয় তা আমাদের বাড্ডা রুটের বাস এ চড়লেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। রমযান মাসে আমাদের বাস সংযম পালন করে যখন দুই বার এর পরিবর্তে মাত্র একবার আমাদের আনা-নেওয়া করে তখন আমাদের অবস্থা হয় দেখার মত। আমাদের প্রত্যাশিত সেই একটি সীট আরও দুর্লভ হয়ে পড়ে।
আমাদের বুয়েট এর বাসগুলো নাকি অনেক sensitive। একটু বৃষ্টি হলেই- “আজকে বাস যাবে না”। আমরা না- হয় বুয়েট এর গোটা ৯০০ এর মত ছাত্র-ছাত্রী, তাও আবার প্রত্যেক লেভেলে; আমরা বৃষ্টিতে ভিজলেই বা কী? কিন্তু বুয়েট-এর বাস বলে কথা- এদের কী আর হাটু পানিতে নামতে দেয়া যায়? বলাতো যায় না, যদি সর্দি-জ্বর হয়ে যায়? এরা তো মাত্র সংখ্যায় মাত্র ৬- ৭ !!!
আমি বাড্ডা রুটের যেই বাসটিতে বুয়েটে আসি, সেটাতে উঠতে হয় মৌচাক মোড় থেকে।
প্রথমদিন বাস কাউন্টারে গিয়ে বাস ছাড়ার টাইম জিজ্ঞেস করতে বলল- “ঠিক ৭:২০ কিন্তু, আপনি ৫ মিনিট আগেই থাকবেন’। আমি ভাল ছেলের মত তা-ই করলাম। সপ্তাহখানেক ৭.১০ থেকে দাঁড়িয়ে থেকে যখন বুঝতে পারলাম বাস এর পক্ষে ৭.৩৫ এর আগে আসা সম্ভব নয় এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম কাল থেকে একটু দেরি করেই আসব। কিন্তু, ঠিক তখনি মূরালিধরণের দুসরা’র মত আমাকে ক্লীন বোল্ড করে দিল আমাদের বাড্ডা রুটের বাস। আমি ঠিক ৭.১৫ তে পৌঁছে শুনতে পারলাম আরও ১০ মিনিট আগেই বাস ছেড়ে দিয়েছে। বাস-এর আগে আসার কারণ অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না- সেদিনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মনে মনে ভাবলাম, ঠিক-ই তো, “বাস এর যদি সর্দি-জ্বর হয়”।
এরকম Practical jokes আমাদের সাথে আমাদের বাস প্রায়-ই করে থাকে। মাঝে লক্ষ্য করি কিছু জুনিয়র ছেলে বাসের জানালা খুলে নিজের ব্যাগ-খানি সীটে রেখে নিশ্চিত সীট প্রাপ্তি’র কথা চিন্তা করে মনে মনে বেশ পরিতৃপ্তি পাচ্ছে। ঠিক তখনি তাদের সুন্দর স্বপ্নে গুড়ে-বালি দিয়ে বাসের হেলপার বাস এর সামনে ঝুলে থাকা “বাড্ডা” ট্যাগটি পরিবর্তন করে “উত্তরা” করে দিলেন। জনগণ তখন দিশেহারা হয়ে বাস খুঁজছে, কারণ একটি মাত্র বাড্ডা রুটের বাস তাও আবার “নাহি ঠাঁই নাহি ঠাঁই” অবস্থা- যদি ফেলে চলে যায়? আর আগে ভাগে ব্যাগ রাখা সেই ছেলেগুলোর মুখের অবস্থা হয় তখন দেখার মত। বাসের হেলপার হয়ত তখন মনে মনে তৃপ্তি’র সাথে ভাবেন- “অতি চালাকের গলায় দড়ি”।
তবে আমাদের বাড্ডা রুটের বাস কিন্তু বেশ নিয়মতান্ত্রিক। “দেরি একদম সহ্য করা হবে না” এটাই তাদের মূলমন্ত্র। একদিনের একটি ঘটনা আগেই বলছি আমি মৌচাক মোড় থেকে উঠি। বাস থামে মৌচাক মোড় থেকে কিছু সামনে কোন এক random জায়গায়। স্বভাবতই, এক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো এক প্রান্তের কিছু সংখ্যক মানুষ বাসে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় আর অন্যদের তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তেমনি এক বুয়েট ছাত্রী সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা সে তার অন্য সহপাঠীদের পিছনে ফেলে সামনে আসতে একটু দেরী করে ফেলে। এরই মধ্যে ছেড়ে দেয় বাস। মেয়েটির সকরূণ আর্তি অবশেষে বাসের হেলপার-এর কানে পৌঁছে। বাসের গতি ধীর করে তাকে উঠবার সুযোগ করে দেওয়া হয় punctual আমাদের এই বাসে। কোন রকমে বাসে উঠে বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “এমন করলেন কেন?” ড্রাইভার এবং হেলপারের তীব্র তিরষ্কার এর মুখে থেমে গেল তার দূর্বল প্রতিবাদ। চোখের কোণায় মৃদৃ জল চিকচিক করে উঠল। তাকে পরে আর কখনো বাড্ডা রুটের বাসে চড়তে দেখিনি। পরে মনে মনে আমারো একটু খারাপ লাগলো- আমিও হয়ত একটু প্রতিবাদ করতে পারতাম সেই দিন।
বুয়েট এর ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে বাসের সংখ্যা বাড়ছে কী? তাছাড়াও বাসের ড্রাইভার আর হেলপারদের ব্যবহারও লোকাল বাসের ড্রাইভার আর হেলপারদের চেয়ে খুব বেশি সুশোভন নয়। আমার মত অনেকেই ভাবে
কত দূর আর যাবার আছে?
কত পথ রয়েছে বাকি?
কত মেঘ এই আকাশে ওড়ে,
আজ রোদের হাসি কাল বৃষ্টি
তবুও এ পথ চলা.......
তাই হয়তো সবাই নির্বাক।
হাজার হোক “বুয়েটের বাস” বলে কথা “ভাব-ই আলাদা”। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি বুয়েটে যাতায়াত কর কি ভাবে? আমি অনেক ভাব নিয়ে বলি “আমি বুয়েটের বাসে যাতায়াত করি”।
শিরোনাম: আমাদের বাড্ডা রুটের বাস
লেখক: ইশতিয়াক মাহমুদ শাহ (০৫০৫১১৩)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৫:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





