প্রথমে জানার চেষ্টা করি বাংলা পঞ্জিকা, পহেলা বৈশাখ এবং তার উৎপত্তি সম্পর্কে, পহেলা বৈশাখ বা বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিন।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর,নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত।
ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।
প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত।
তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের পাওনা টাকা আদায় করে এবং ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত হিন্দু মালিকানার স্বর্ণের দোকানে।
এবার বলতে চাই আমার দেখা পহেলা বৈশাখ উদযাপন কেমন দেখেছি এবং কেমন দেখছি, আমি গ্রামের ছেলে ছোট বয়সে আমরা পহেলা বৈশাখ মানে বুঝতাম আম বড় হবে, আমের বিয়ে হবে, আমরা আম খাব। এদিকে হিন্দু বাড়ির দরজায় গড়াইয়া (মেলা) বসবে যেখানে ছোট ছোট হরেক রকম অস্থায়ী দোকান থাকবে, ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় জিনিসপত্র বিক্রি হবে। গড়াইয়াতে আমাদের প্রধান আকর্ষণ থাকত বাঁশি বেলুন সহ বিভিন্ন খেলনা এবং আম কাটার ছুরি।
হিন্দু বা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা বড় বট গাছের গোরায় কিংবা তুলসী গাছের গোরায় এই দিনে পুঁজা দিতে দেখেছি।
গড়াইয়াতে ছয় গুটি দিয়ে এবং চরকা দিয়ে জুয়া খেলা হত, জুয়া মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয় হলেও, নামে মাত্র মুসলিমরা জুয়া খেলতে গড়াইয়াতে যেত এবং মাঝে মধ্যে এই নিয়ে হাঙ্গামাও হত।
আমার ছোট বয়সে একবার ঢাকায় এসেছিলাম বড় ভাই বিদেশ যাওয়ার সুবাদে, যে দিন বড় ভাই ঢাকা ত্যাগ করলেন তার পরদিন পহেলা বৈশাখ, আমার সাথে এসেছিল আমার চাইতে বয়সে বড় আমার এক বেয়াই, তিনি খুব খুশি আগামী দিন পহেলা বৈশাখে ঢাকায় রমনা পার্কে বেড়াবে এই জন্যে। ঢাকায় উঠেছি খালার বাসায়, বেয়াইয়ের সমবয়সী এক খালাত ভাই আছেন।
খালাত ভাই, বেয়াই আমিসহ সকালে বের হলাম, রমনা পার্কে লাল সাদা কাপড় আর মাথায় ফুল লাগিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সুন্দরি মেয়েরা হইচই করে গান গেয়ে গুরে বেড়াচ্ছে, গান বাজনা হচ্ছে হাজার হাজার নারী পুরুষ রাস্তায় এবং এইদিনই আমি দেখলাম অন্যরকম এক পহেলা বৈশাখ।
খালাত ভাই আর বেয়াইসহ চটপটি, সিঙ্গারা, বুট বাজা, জিলাপি ইত্যাদি হাবিজাবি খোলা দোকান গুলো থেকে গুরে গুরে খেয়েছি যা আমার কাছে খুব মজার ছিল। বেয়াই আর খালাত ভাই মেয়েদের ভীরে অন্যরকম আনন্দ উপভোগ করেছে, তা আমি তখন না বুঝতে পারলেও এখন বুঝি।
ঐ দিনের একটি ঘটনা না বললেই নয়, তখন মোবাইল ব্যবহার ছিলনা, আমরা তিন জন রমনা পার্কের ঘাসের উপর বসে আছি, আমাদের থেকে কিছুটা দূরে ফুল গাছের নিছে দুইটা মেয়ে বসে আছে। তারাও অন্যদের মত বৈশাখী সাজে সেজেছে, বেয়াই ওই মেয়ে দুইটির একটিকে দেখিয়ে খালাত ভাইকে বলল, এই মেয়েটার সাথে কথা বলে যদি ঠিকানা আনতে পার, তাহলে আমারা তিন জনে বিরানি খাব এবং টাকা দিবে বেয়াই। খালাত ভাই রাজি হয়ে মেয়ের পাশে বসে দীর্ঘ আলাপ সেরে ঠিকানা নিয়ে নিলো এবং আগামীতে কোথায় দেখা করবে সে ডেইট ও করে নিল, আমরাও তার সাথে ছিলাম।
আমি দেখে আশ্চর্য যেমন হয়েছি ভয়ও পেয়েছি, অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে যে ভাবে কথা বলে ঠিকানা নিলো, তা গ্রামে হলে মার খেয়ে ভুত হয়ে যেতে হত।
সবার কাছে আবেদন, পহেলা বৈশাখ পালন করতে যেয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করি, নিজের ধর্মের খেলাপ করে পাপী না হই। অন্যের ধর্ম পালনে যেন বাধা হয়ে না দাড়াই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




