তখনও পাখিদের ঘুম ভাঙ্গেনি। পাড়ার মসজিদ থেকে ভেসে আসেনি আযানধ্বনি। রাতের স্নিগ্ধতা হারিয়ে চাঁদটা ক্লান্ত শরীরে নুঁয়ে পড়েছে পশ্চিমের আকাশে। নিদ্রাহীন চোখে জানালা খুলে বাইরে তাকায় সুষমা। গতকাল বিপ্লবের কথাটা মনে করে সারারাত তার ঘুম হয়নি। আলো-আধারের মাঝে দেখার মত তেমন কিছুই খুজে পেলনা। বিছানায় আর থাকতেও মন চায় না তার। ঘুম ছাড়া বিছানায় শুয়ে থাকা যায় কতক্ষণ? কিন্তু যাবে কোথায় সে, খুজে পায় না। একাকিত্বের অবসান ঘটানো যায় কিভাবে সেই ভাবনা থেকেই জানালা খুলে বাইরে তাকিয়েছিল সুষমা। হাসনাহেনা গাছে ফুল ফুটলে তার সুগন্ধ নেওয়া যেত মন ভরে, সেটাও নেই। পাশের কক্ষে বাবা মা ঘুমাচ্ছেন, তাই ইচ্ছা করলেও আলো জ্বালিয়ে বই পড়া সম্ভব নয়।
অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে একসময় ঠিকই মসজিদ থেকে ভেসে আসে আযানধ্বনি। একটু পরেই ওপাড়া থেকে শোনা যায় উলুধ্বনি। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে রাতের নির্জনতা ভাঙ্গার সার্থক প্রয়াস চালাচ্ছে। দরজা খুলতেই আধো আলোয় চোখে পড়ে এক যুবক দাড়িয়ে আছে ঠিক দরাজার সামনে। ভয়ে চিৎকার দিতে গিয়েও আগে নিজেকে সামলে নেয় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে। দ্রুত হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ায় সুষমা বসে পড়ে সোফার উপর। অসুস্থ মাকে ডাক দিবে কিনা সে প্রশ্নই করতে থাকে নিজের নিকট। উত্তর খুজে পায় না। একবার ভাবে লাভটা কি লোক জানাজানি করে। বরং নানান মুখে নানা কথা শোভা পাবে তাকে ঘিরে। কেউই হয়তো বিষয়টি ভাল চোখে দেখবে না। এমনকি স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে তার। কিন্তু স্কুলে না গেলে বিপ্লবকে দেখবে কিভাবে সে। এতসব কিছু ভেবে সে সিদ্ধান্ত নেয় কাউকে কিছু না জানানোর। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর খুজে পায় না, কে এই যুবক?
প্রভাতী ট্রেনের ছন্দময় ঝিক-ঝিক শব্দে তন্দ্রাভাব কেঁটে যায় সুষমার। বাড়ির পাশ দিয়েই চলে গেছে ট্রেন লাইনটা। সোফায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছে ঠাহর করতে পারেনি সে। বাইরের ভোরের আলোক রেখা জানালার সামান্য ফাঁকা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে এক নতুন আবহ্ সৃষ্টি করেছে। তড়িৎ সোফা থেকে উঠে মা বলে ডাক দেয় সুষমা। পাশের কক্ষ থেকে মা ছুটে আসেন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে।
আমি ভেবেছি তুই এখনো উঠিসনি!
না মা আমি উঠেছি আগেই, কিন্তু.....
কি হয়েছে তোর, শরীর খারাপ করেনিতো? বলে কপালে হাত দেয় সুষমার মা।
না মা জ্বর-টর ওরকম কিছু না, রাতে ভাল ঘুম হয়নি তাই।
তা আমাকে ডাক দিসনি কেন?
ভাবলাম তোমার শরীরটা বেশী ভাল নেই, তাই তোমাকে ডাক দেওয়ার সাহস করিনি।
নে চা খেয়ে নে। হাত মুখ ধুয়ে একবারে গোসল করে বের হ্।
মা চলে যায় রান্না ঘরে। বাবার অফিসে যাওয়ার আগে নাস্তা প্রস্তুত করতেই মায়ের যত ব্যস্ততা। সাথে আবার দুপুরের খাবারটাও টিফিন বক্সে দিয়ে দিতে হবে। চায়ের কাপে মুখ দিয়ে ভাবে সুষমা, হায়রে জনম! মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মানো মানেই কুলহীণ কষ্টের নদীতে সাতার দেওয়া। জীবনে এরকম কত ঘটনাই মুখ বুজে হজম করতে হয়, তা শুধু মেয়েরাই জানে। কিন্তু সুষমার মন থেকে আলো আধারের মাঝে দেখা যুবকটি কে, সেই প্রশ্নটা বারবার উঁকি দিচ্ছে। বিষন্ন মন নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে গোসল সেরে বের হয় সুষমা। ততক্ষনে বাবা নাস্তার টেবিল থেকে ডাক দেয় সুষমাকে। বাবার সঙ্গে নাস্তা খেয়ে প্রস্তুত হয় স্কুলে যাওয়ার জন্য।
যথারিতী স্কুলে পৌছে বিপ্লবকে খুজতে থাকে সুষমা। গতকাল বিপ্লব যে কথাটি বলেছিল তার অর্থ জানতে হবে সুষমাকে। কিন্তু কোথাও খুজে পায় না বিপ্লবকে। তাহলে গেল কোথায়? বিপ্লবের সঙ্গে তার পরিচয় সেই ছোট বেলা থেকেই। একই সাথে স্কুলে লেখাপড়ার সুবাদে তাদের মধ্যে কখন যে বিনিসুতোর বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে তা কেউ জানেনা। তবে দু'জনার মধ্যে খুব বেশী কথা হয়নি কখনো। নিজেদের ভাললাগার কথাটিও কখনো প্রকাশ করেনি একে-অপরকে। কিন্তু একজনকে না দেখলে অপরজনের বুকে যে শুণ্যতার সৃষ্টি হয় তা অন্য কেউ কখনো জানতেও পারেনি। বিপ্লব স্কুলে না আসায় ক্লাসে মন বসেনা সুষমার। সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে হৃদকম্পন।
বিষন্ন মনে স্কুল থেকে বের হয় সুষমা। সারাটা রাস্তায় বিপ্লবকে খুজেছে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। না কোথাও পায় না খুজে তাকে। কারো নিকট বিপ্লবের কথা জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়না তার। কে কি ভাববে সে ভয় আছে। বাড়ি ফিরে বিষন্ন মুখ দেখে কিছুটা আঁচ করতে পেরে প্রশ্ন করে সুষমার মা,
কি হয়েছে তোর?
রাতে ঘুম না হওয়ায় শরীরটা ভাল লাগছে না, মা,
খাবার খেয়ে শুয়ে পড়, আমি তোকে ঘুম পড়িয়ে দিচ্ছি,
না মা, দিনে ঘুমোলে শরীর আরো বেশী খারাপ করবে,
ঠিক আছে তুই না ঘুমোস আমি তোর সাথে গল্প করবো, নে আগে খেয়ে নে।
খাবার খেয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে সুষমা। ছোট বেলায় একবার বিল থেকে শাপলা তুলেছিল বলে গাঁয়ের ছেলেরা তাকে শাপলা বালিকা বলে ডাকতো, এই কথা দিয়েই শুরু হয় মায়ের গল্প বলা। তারপর আরো অনেক গল্প। কিন্তু কোন গল্পেই সুষমার মনকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হচ্ছিল না। একসময় মা বললেন জানিস, আজ ওপাড়ার বিধান দাদারা রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে চলে গেছে? জমি জমা যা ছিল গোপনে বিক্রি করে গেছে। যাওয়ার সময় একটু বলেও গেলনা তারা। বলবেইবা কি করে! এক জমি ২/৩ জনের নিকট বিক্রি করে গেছে। প্রত্যেককে বলে গেছে, 'দাদা এই জমি বিক্রির কথা আর যেন কেউ না জানে'। এখন এক জমির ২/৩ জন মালিক দাড়িয়েছে। বিধান দাদার ছেলে বিপ্লব না তোদের সাথে পড়তো? তোদেরকেও মনে হয় বলে যায়নি, না?
প্রশ্নগুলির কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না সুষমা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আধো আলো-আধারে দাড়িয়ে থাকা একটি যুবক, যাকে সে রাতে দেখেছিল। মায়ের কথাগুলো শুনে সুষমার মনে হল বুকের উপর কেউ কুঠার দিয়ে আঘাত করছে। এই দেশ আমার দেশ। এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কখনো ভাবতেই পারেনা সুষমা। স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে এ্যাসেম্বিলিতে দাড়িয়ে যখন সকলে একসাথে জাতীয় সংগীত গাইতো, তখনতো সকলের সাথে বিপ্লবও গাইতো 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি'। তাহলে কি এতদিন বিপ্লব মিথ্যা বলেছে? এ দেশকে, এ দেশের মানুষকে কখনোই ভালবাসেনি? তাহলে স্কুলে গতকাল ক্ষমা চেয়েছিল কেন? এই মিথ্যা ভালবাসাই কি তার অপরাধ? প্রশ্নবানে নিজেকে জর্জরিত করে তুলে সুষমা। খুব ভোরে যে বালকটি এসেছিল দ্বারে সে বিপ্লব ছাড়া আর যে কেউ নয়, ততক্ষণে বুঝতে পেরে নিজেকেই অপরাধী মনে করে সুষমা!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৫:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




