somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ মুখোশ

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নাজিম ভাই আবার ফোন দিয়েছেন। কিন্তু কোন রিকসাই পাচ্ছি না। প্রয়োজনের সময়ে কোনদিনই রিকসা পাওয়া যাবে না। আর যদি পাওয়া যায় দশ টাকার ভাড়া একশ টাকা চাইতেও তাদের মুখে আটকায় না। আগে বেশ হাঁটতাম। ইদানিং কি যে হলো শরীর ভারি হয়ে আসছে। হাঁটতে পারি না। কবে যে একটা গাড়ি হবে! নাজিম ভাই অবশ্য কথা দিয়েছেন তাদের কাগজে সাহিত্য পাতার ভার আমাকে দিয়ে দিবেন। সেক্ষেত্রে জোর জারি করলে গাড়িটা হয়ত জুটতেও পারে। নাজিম ভাই আবার ফোন দিচ্ছেন।
‘আসছি বস, আমি প্রেস ক্লাবের সামনে। রিকসা পাচ্ছি না’
‘আরে হেঁটে চলে আস। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।’

বেশ চমৎকার একটা গল্প লিখেছি। নিজের কোন কাজ নিজের এত পছন্দ হয়নি। চরিত্র হিসেবে রিকসাওয়ালা, মুচি, চামার, পোশাকশ্রমিক এরা আমার অতি পছন্দের। এর একটা কারন আছে। মানুষের এখনো এদের প্রতি সহানুভূতি অবশিষ্ট আছে। আর এই সব ক্যারেক্টারে বেশ আবেগ-টাবেগ মেশানো যায়। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগ না থাকলে তারা কোন শিল্পই খাবে না। আমার খুব দুঃখ হয়, এই সব রিকশাওয়ালারা কখনো এই গল্প পড়বে না। স্কুল কলেজ ভার্সিটির ছেলেমেয়ারা পড়বে। কোন কোন ছেলের চোখের কোনা ছলছল করবে। নরম হৃদয়ের মেয়েরা কাঁদবে হয়ত। সমকালের ঈদসংখ্যায় যাবে গল্পটা। কাল রাতে মেইল করেছি । ফাটাফাটি বলেছেন নাজিম ভাই। তাঁর ধারনা আমার এই গল্পটির জন্যই বাংলা সাহিত্যে আমার আসন পোক্ত হবে। শরৎ বাবুর মত দরদ ঝরে আমার লেখায়। এই একটি গল্পের জন্য আমি বেশ কাজ করেছি। কোন কাল্পনিক রোমান্টিক গল্প নয়। রিকসাওলাদের পিছু নিয়ে তাদের বস্তিতে বস্তিতে গিয়েছি। দেখেছি তাদের আনন্দ বেদনা, খিস্তি-খেউড়, বেআব্রু ঘর-দোর-বাথরুম, বেলাজ প্রেম-পিরীতি, সকাল বেলা তল পেটে অসহ্য চাপ নিয়ে লম্বা লাইন। শাহবাগের মোড়ে ফুটপাতের ভাতের দোকান থেকে ভাত কিনে খেয়েছি রিকসাওলাদের সাথে। এমনকি দুজন রিকসাওলার সাথে আমার বেশ খাতিরও হয়েছে। তাদের সাথে একবার সারারাত গ্যারেজে জুয়া খেলেছি। সাথে গাঞ্জা।

নাজিম ভাই তাড়া দিচ্ছেন মোবাইলে। ঈদ সংখ্যার সব লেখকদের নিয়ে আজ প্রোগ্রাম। একজন সিনেমা পরিচালকও আছেন। নাজিম ভাইয়ের বিশেষ বন্ধু। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া। টিভি সিনেমা দু’ জায়গাতেই এখন তাঁর রাজত্ব। জাতীয় পুরষ্কার পাওয়া পরিচালকরা আবার বাণিজ্যিক ছবি তৈয়ার করেন না। ইনি ভিন্ন কিসিমের। ঢাকার মধ্যবিত্ত আর উঠতি ছেলেমেয়েরা বেশ লাইন দিয়ে তাঁর ছবি দেখে। স্টার সিনেপ্লেক্সে আমি নিজেও তাঁর মুভি দেখেছি। ঢাউস সাইজের বাজেট নিয়ে একটা মুভি নিয়ে নাকি নামবেন। সেই ছবির জন্য আমার রিক্সাওলাকে গছিয়ে দিতে চাচ্ছেন নাজিম ভাই। গল্পটি নাকি তাঁরও খুব পছন্দ হয়েছে। আজ আমাকে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। এমনিতেই তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করেন। তিনি আমাকে ব্রেক না দিলে আমার পক্ষে এতদূর আসা সম্ভব ছিল না। আমি সম্পাদকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি কিন্তু কেউ আমাকে চান্স দেয়নি। নতুন মুখের লেখা কেউ নিতে চায় না। নিজের পয়সাও ছিলনা একটা বই বের করব। সেই সময়েই নাজিম ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। জগন্নাথ হলের বড় ভাই প্রদীপ দা’র পরিচিত। তিনিই একদিন নিয়ে যান নাজিম ভাইয়ের বাসায়। আমার সব গল্প রেখে আসি সেদিন। পরদিন সকালেই নাজিম ভাইয়ের ফোন, ‘আরে ভাই আপনি তো ফাটাফাটি লিখেন।’
আমার বেলা করে ওঠা অভ্যাস। ঘুম চোখে বুঝিনি নাজিম ভাইয়ের ফোন। সমকালের মত একটা জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক আমার গল্প ফাটাফাটি বলছেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এর পরের শনিবারেই সমকালে আমার প্রথম গল্প ছাপা হল। সেই ছাপার অক্ষরে লিখা নিজের কোন লিখা। তখন নন্দিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল নন্দিনীকে দেখাই আমার গল্পটি। নন্দিনী ছাড়া কেউ কোনদিন বিশ্বাস করেনি আমি একদিন গল্পকার হব। যেদিন নন্দিনী আর আমি একজন আরেক জনের হৃদয় ভেঙেছি সেদিনও বলেছিল, আমার মাথার দিব্যি (নন্দিনী আবার দিব্যি, দূর্গা ছাড়া কথা বলতে পারত না। বেশ একটু গেঁয়ো ধরনের ছিল।) কোন দিন লেখালেখি ছেড়ো না। একদিন অনেক বড় হবে, আমি জানি। আমি দূর থেকে দেখে সুখ পাব। সারাদিন নন্দিনী আমাকে রিকসা করে ঘুরাল, যাবার বেলায় কোন কান্নাকাটি করেনি। আমি জানতাম কান্নাকাটি যা করার বাসায় গিয়ে করবে। আর দশটা মেয়ের মত কোনদিন, আমাকে বিয়ে কর, বিয়ে কর বলে ঘ্যান ঘ্যান করেনি, আমার অতি উদ্ভট চলাফেরা আর ছন্নছাড়া জীবন সাজিয়ে দেবার নাম করে ছিনিয়ে নিতে চায় নি। সে বলেছিল, কোন দিন আমার সামনে আসবে না। আমার সাথে সেই দিনই ছিল তার শেষ দেখা। কোনদিন আসবেও না। পাছে আমি কষ্ট পাই। নন্দিনী কি আমার গল্প পড়ে এখন? কোন খোঁজ রাখে আমার গল্পের? আমার লাল নীল মলাটের প্রথম বই, যা নিয়ে সমকালের সাহিত্য পাতায় ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল, তা কি দেখেছিল নন্দিনী? নব্য লেখকদের মাঝে অতি আলোচিত, বিক্রিত আমার সে বই, ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে!
আমার কোন উপায় ছিল না নন্দীনিকে বিয়ে করার। আমাদের দেশে এখনো প্রতিষ্ঠিত লেখকরাও শুধু লেখালেখি দিয়ে পেট চালাতে পারে না। আমি তো তখন বেকার। শ্যামলীর আদাবরে একটা টিন শেড ঘরে থাকি, বৃষ্টি হলে উপর নিচ দুদিক থেকেই পানি আসে। কোন কোন দিন এক প্যাকেট নেভী সিগারেট আর একটা সিঙাড়া খেয়েই আমার দিনাতিপাত হয়। আবার ফোন,
‘হ্যালো , নাজিম ভাই আমি আসছি। রিকসা পাচ্ছি না। রিকসার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।’
‘তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ! হেঁটে চলে আস না, কাছেই তো।’
‘ওকে, নাজিম ভাই।’

এক সময় এইটুকু পথ কেন, সারা ঢাকা শহর হাঁটতে আমার আপত্তি ছিল না। সারাদিন হাঁটতাম এ পত্রিকা থেকে ও পত্রিকা। টিউশনি করতাম, তাও হেঁটে হেঁটে যেতাম। এতে অবশ্য আমার বেশে ভালই হয়েছে। হেঁটে হেঁটে ঢাকা শহরের বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখে দেখে আমার অফুরন্ত ভান্ডার তৈরি হয়েছে। লেখক হিসেবে এটা দরকার ছিল। কিন্তু এখন আর হাঁটতে ভাল লাগে না। শুধু রিকসা কেন রাতের বেলা পার্টিতে যেতে মাঝে মাঝে হলুদ ক্যাবও আমি নিই। অভাব অনটনে মানুষ। হাতে টাকা আসলে তাই নিজেকে মুসা বিন শমসেরের মত মনে হয়। ইচ্ছেমত খরচ করি। আলসেমিও ধরেছে আস্তে আস্তে।
‘মামা যাবেন?’
আমি লাফ দিয়ে রিকসায় উঠি। ‘সামনে চল। বিজয় নগরের মুখে নামিয়ে দিবে।’
মাঝ বয়সী রিকসাওয়ালা। কাঁচাপাকা দাড়ি। স্যাঁতস্যাঁতে ন্যাকড়ার মত তেলছিটছিটে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে।

রিকসা থেকে নেমে দেখি পকেটে ভাংতি আছে শুধু দশটাকা। কমসে কম বিশ পঁচিশ টাকার ভাড়া। পাঁচশ টাকার নোট আছে দুইটা। একটা একশ টাকার নোট। নাজিম ভাই আবার ফোন দিয়েছেন। এই নোটটা আবার ভাঙাবে কে! ওদের একশ টাকার নোট দিলে বহুত ঝামেলা। ভাংতি নাই বলে ইচ্ছে মত দাম রেখে দেবে। আমি রিকসাওলাকে দশটাকার নোট টা বাড়িয়ে দিই। ওরা সব সময় বাড়িয়ে রাখে, আমি একদিন কমিয়ে দিলে কি এমন ক্ষতি?
‘মামা কয় ট্যাকা দিলেন?’
‘যা ভাড়া তাই দিলাম।’
‘তিরিশ ট্যাকার ভাড়া!’
‘ফাইজলামি কর! দামাদামি করে উঠি নাই বলে যা ইচ্ছা তা ভাড়া চাইবা?’
‘আপ্নে আর কাউরে জিগান ভাড়া কত?’
‘জিজ্ঞেস করার কাজ কি? ভাড়া কত আমি জানি না? ডেইলি আসি এখানে।
আবার ফোন নাজিম ভাইয়ের। ফোনের দিকে তাকিয়ে আমি হাঁটা দিই। লেখক, সম্পাদক, পরিচালক সবার জন্য তাড়া অনুভব করি।

পিছন থেকে অতি কুৎসিত একটা গালি দেয় রিকসাওয়ালা।

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:০৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×