গত সপ্তাহে বাংলাদেশের সকল স্কুলগুলিতে আগামী ২০১০ সালে অনুষ্ঠিতব্য মাধ্যমিক পরীক্ষা ২০১০ পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের ফরম পূরণ শেষ হয়েছে। সাধারণতঃ সকল স্কুলগুলিতে অনুষ্ঠিত “এস এস সি টেষ্ট পরীক্ষায় উর্ত্তীণ ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। তবে মোটামুটি সব স্কুলে টেষ্ট পরীক্ষায় ১ বা ২ বিষয়ে অকৃতকার্য ছাত্র/ছাত্রীদের বিশেষ বিবেচনায় মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহনের নিমিত্তে অনুমতি প্রদান করা হয়ে থাকে।
এই ফরম পূরনের সময় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত হারে পরীক্ষা ও আনুষঙ্গিক ফি স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শিক্ষা বোড সমুহ জমা দিতে হয়। সচরাচর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব কিছু আনুষঙ্গিক চার্জ বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ফি এর সাথে যুক্ত করে তা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে থাকে।
মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ফির সঠিক হারটি কত আমি জানি না। তবে সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী এ বছর অধিকাংশ স্কুলগুলিতে বোর্ডের নির্ধারিত ফি ও স্কুলের সংযোজিত ফি মিলে এর পরিমান ছিল পাঁচ হাজার টাকার মত।
সদস্য সমাপ্ত এই ফরম পূরনকে ঘিরে কিছু ঘটনা শুনে আমি রীতিমত স্তম্ভিত। এই ফরম পূরনকে ঘিরে বিভিন্ন স্কুলে চলেছে অবাধ বাণিজ্য। দুই ক্যাটাগরীর ছাত্র ছাত্রীদের ঘিরে চলছে এই ব্যবসা। প্রথম ক্যাটাগরী টেষ্ট পরীক্ষায় ১ বা ২ বিষয়ে অকৃতকার্য ছাত্র ছাত্রী আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরী শারিরীক অসুস্থতার কারনে যারা টেষ্টের সকল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি সেই সব ছাত্র ছাত্রী– ।
১ম ক্যাটাগরী
আমার এক কলিগের ছেলে স্কুলের (সরকারী স্কুল) টেষ্ট পরীক্ষায় ১টি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। সে ও তাঁর স্বামী স্কুলের হেড মাষ্টারের সাথে দেখা করে অনুরোধ করে তার ছেলেকে মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে। প্রথমে প্রধান শিক্ষাক খুব কড়া গলায় বলে যেহেতু ছাত্রটি টেষ্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে তাই বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী কোন অবস্থাতেই তাকে মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়ার কোন অবকাশ নেই এবং উপরন্তু ছেলের ১ বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় আমার কলিগ ও তার স্বামীকে তিনি ভৎসনা করেন। উপায়ন্ত না দেখে আমার কলিগ শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রধান শিক্ষকে পথ বাতলে দিতে বললে প্রধান শিক্ষক অন্য আরেকজন শিক্ষকের সাথে তাদের দেখা করতে বলেন। প্রধান শিক্ষকের কথা মোতাবেক অন্য শিক্ষকের কাছে গেলে ঐ শিক্ষক কোনো রাখ না রেখে বলেন, “২০ হাজার টাকা দিলে তার ছেলেকে মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে”। শেষ পর্যন্ত দরকষাকষির এক পর্যায়ে ১৫,০০০ টাকায় ফয়সালা হয় এবং তাদের বলা হয় যে এই টাকার বিপরীতে তারা কোন ধরনের রশিদ দিতে পারবে না। আমার সহকর্মীর স্বামী পরের দিন ঐ শিক্ষকের হাতে ১৫,০০০ টাকা তুলে দিলে তার ছেলে এস এস সি-এর ফরম পূরনের সুযোগ পায়।
ক্যাটাগরী-২
আমার ভাগ্নী মগবাজারে অবস্থিত মানের দিক থেকে প্রথম সারির একটি স্কুল থেকে সে আগামী ২০১০ সালের এস এস সি পরীক্ষার্থী। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। ক্লাস ওয়ান থেকে সে ঐ স্কুলে পড়ছে। এস এস সি নির্বাচনী পরীক্ষার ৭টি বিষয়ে সে অংশগ্রহণ করে। অষ্টম পরীক্ষাতে অংশগ্রহণরত অবস্থায় পরীক্ষা হলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার অসুস্থতার মাত্রা এতো বেশী ছিল যে পরীক্ষার হল থেকে তাকে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ৫ দিনের চিকিৎসা শেষে তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ী নিয়ে আসা হয়। যার কারনে অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলিতে সে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নির্বাচনী পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর আমার বোন ও ভগ্নীপতি স্কুলে যান প্রধান শিক্ষককে অনুরোধ করতে যেন তাকে মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কেননা সে খুব ভাল ছাত্রী এবং মূল পরীক্ষায় ভাল ফল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে উপস্থিত ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমার ভগ্নিকে মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ দিতে জোর সুপারিশ করে এবং তারা জোরালো আশাবাদ ব্যক্ত করে ভবিষ্যত ভাল ফলাফলের ব্যাপারে। আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধান শিক্ষক আমার বোন ও ভগ্নিপতি ছাড়া অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের কক্ষ থেকে চলে যেতে বলেন। শিক্ষক শিক্ষিকারা কক্ষ ত্যাগের পর পরই প্রধান শিক্ষক ভিন্ন সুরে কথা বলা শুরু করে। উনি তখন শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন নিয়মনীতির ব্যাখ্যা করা শুরু করেন। আমার ভগ্নিপতি প্রধান শিক্ষককে বলেন আপনার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার আলোকে অন্ততঃ এটা বোঝা উচিত যে, আপনার স্কুলে ফার্ষ্ট গার্ল সে আর যাই হোক অন্তত মূল পরীক্ষায় ফেল করবে না আর যেহেতু শারিরীক অসুস্থতার কারনে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে (যার প্রমান পত্র আছে) তাই অন্তত মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু তাতেও একমত পোষন না করে সাফ বলে দেন আমার ভাগ্নিকে মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে না। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হলে আমার বোন প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চায় তাহলে কিভাবে নির্বাচনী পরীক্ষায় ১ বা ২ বিষয়ে অকৃতকার্য ছাত্রীদের ফরম পূরনের অনুমতি দেয়া হলো? জবাবে প্রধান শিক্ষক জানান তাহলে ভিšন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। কি পদ্ধতি জানতে চাওয়ায় প্রত্যুত্তরে প্রধান শিক্ষক বলেন-“আগামী ১৭ তারিখে আপনার মেয়েকে ২০,০০০ টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিবেন-ফরম পূরণ করতে দেয়া হবে। এতো বড় অংকের টাকা বিবরণী জানতে চাইলে বলেন ৫০০০ টাকা বোর্ডের ফি ও বাকী টাকা স্পেশাল কোচিং এর ব্যবস্থা করা বাবদ দিতে হবে। ২০ হাজার টাকার বিপরীতে কোন রসিদ দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে বলেন শুধু ৫০০০ টাকার রসিদ স্কুল কর্তৃপক্ষ দিবে কিন্তু বাকী ১৫০০০ টাকার কোন রসিদ তারা দিতে পারবে না। এতে আমার ভগ্নিপতি অত্যন্ত ক্রব্ধ হয়ে উঠেন এবং উচ্চস¦রে কথা কাটাকাটি শুরু হলে পাশের রুম থেকে স্কুল পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এসে দুই পক্ষকে শান্ত করেন এবং ঘটনার বিস্তারিত শুনে প্রধান শিক্ষককে আর কোনরূপ বাদানুবাদ না করে ভাল ছাত্রী ও মানবিক বিবেচনায় মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিমিত্তে ফরম পূরনের অনুমতি দিতে বলেন। এই ঘটনার পরের দিন আমার ভাগ্নি আনুমানিক ৫ হাজার টাকা ফি প্রদান পূর্বক ফরম গ্রহণ করে।
আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষার নিমিত্তে ফরম পূরনের সময় সংঘটিত দুইটি বাস্তব ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এই দুটি ঘটনা জানার পর কৌতুহল বশতঃ পরিচিত মহলে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে আরো কয়েকটি এরুপ ঘটনার কথা জানতে পারি যেখানে নির্ধারিত ফি এর চেয়ে বেশী টাকা নিয়ে সোজা কথা ঘুষ নিয়ে মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন নামী দামী স্কুলে ভর্তি বানিজ্যের কথা সকলেই জানেন। কিন্তু ফরম পূরনের নামে বানিজ্যের সাথে আমি অন্তত পরিচিত ছিলাম না। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ বেশ কিছু কাল ধরে। আগের দিনের পন্ডিত মশাই বা মাস্টার মশাই টাইপের স্কুলের শিক্ষক বা “আবার তোরা মানুষ হ-” নামক বাংলা চলচিত্রের কলেজের প্রিন্সিপালের (খান আতা অভিনীত) মত বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী শিক্ষকের দেখা পাওয়া এখন আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। শিক্ষকদের সব সময় বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। অথচ চিন্তা করুন এক বার এই দূর্ণীতিবাজ অনৈতিক চরিত্রের অধিকারী শিক্ষকরা আমারদের সন্তানদের মধ্যে কোন গুনের (!!) প্রস্ফুটন ঘটাবে। ভর্তি বানিজ্য, প্রাইভেট কোচিং বানিজ্য, অধিপত্য বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসীদের সাথে আঁতাত, রাজনৈতিক আঁতাত থেকে শুরু করে আরো অনেক অনৈতিক কাজে শিক্ষকদের জড়িত থাকার কথা প্রায়শই শোনা যায়। ফরম পূরনের নামে শিক্ষকদের বানিজ্যে এই ঘটনা এর সাথে আরেক নতুন আঙ্গিক যোগ করলো। এই সকল নৈতিকতাহীন শিক্ষকদের ভীড়ে বিভিন্ন নাটক, সিনেমা বা গনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনে গ্রামের “রফিক মাস্টার ” এর মতো চরিত্র বা গনাবলীর শিক্ষকরা হারিয়ে যাচ্ছেন, যা আমাদের জন্য কিন্তু অশনি সংকেত বয়ে আনছে।
আজ আমাদের সমাজে পন্ডিত মশাই বা মাষ্টার মশাই বা আবার তোরা মানুষ হ এর সেই প্রিন্সিপালের মতো শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা খুবই অনুভব করছি।