somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাঙনের শব্দ শুনি

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





রুকাইয়া নামের একটি কিশোরী মেয়ের ধর্ষণের প্রতিবাদে সারা দেশের মানুষ যখন নীরব ভূমিকা পালন করছে তখন প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে গণসংযোগ গড়ে তুললেন শায়লা নামের একজন সাহসী নারী। দেশের নারীদের মনে স্থান করে নিলেন খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। এরপর আর থেমে থাকা নয়। নারী মুক্তি, নারী অধিকার নিয়ে একের পর এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে নিরলস ভাবে চলছে তার পথ চলা। বয়স চল্লিশের কিছু কাছাকাছি। এই বয়সেও তারুন্য ধরে রেখেছেন। চেহারায় বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। চাকরী করেন সেভ দ্যা ওমেন নামের একটি এনজিওতে সিনিয়র কনসাল্টেন্ট পদে। তিনি মনে করেন নারীরা হচ্ছে ফুলের মত। ফুলের সৌরভ নেয়ার মোহে যেমন মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতপক্ষে ফুলগুলোকে পচনের দিকে ঠেলে দেয় ঠিক তেমনি পুরুষরাও নারীদের ঠেলে দেয় অন্ধকার কুঠুরিতে জীবনের ব্যাঞ্জনা পোহাতে। তাই নারীদের নিজেদের প্রয়োজনেই নিজেদের জেগে উঠতে হবে। সোচ্চার হতে হবে পুরুষ শাসিত সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে। সমাজের প্রচলিত বাঁধ ভেঙে নতুন ভোরের আলোতে ধাবমান হতে হবে। আর তাইতো তিনি তার কবিতায় লিখেছেন;

আমার কানে আজো অনুরণন তোলে সেই আযানের ধ্বনি,
আমি কবরের মায়ায় জড়িয়ে আঁচল টেনে বিলাপ করে শুনি।
বেলা অবেলার যাত্রায় শেষ নক্ষত্র পথের ক্লান্তি মাখা ঘুমে;
যদিওবা হোঁচট খেতে হয়, তবু সকালের রোদ খুঁজে ফিরি।
আমাকে কেউ কি কিনে দেবে রেশমি চুড়ি আর লাল রঙের লেইস ফিতা ?
আমি আলতা পায়ের কিশোরী এক কন্যার চোখের মতো;
নাজুক পায়ে মাঠের ঘাস মাড়িয়ে শিশির কুড়বো।
আমার অতলে যতো দুষ্প্রাপ্য ঝিনুকেরা কেলাসিত হয়ে পাহাড় গড়েছে;
পরিনত বুড়ো হিমালয়ের মতো, আমি তাদের নিকুচি করি।
তার চেয়ে ঢের সুখ খুঁজে পাই তোমার মেহেদী লগ্নে,
আমি যে তখন মাটিতে ভাঙনের রেখা ধরে পথ হেটে চলায় তৃপ্ত হই।
আর একটু পরেই বন্যার স্রোতে বিলীন হবে আমার মনের যতো বসতী;
তুমি দেখে নিও, কতটা সুখেই আছি তোমার আঁকা ক্যানভাসের নীল আঁচড়ে।


শহরের হিসেবে খুব বেশি রাত এখন নয়। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। শায়লা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বৃষ্টির ঝাপটা এসে তাকে বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছে। রাতের আঁধারে কে যেন এই বৃষ্টিতে ভিজেই পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। তিনি সেই যুবকের হেটে চলা পথের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ করেই যেন বুকের ভেতরটাতে একাকীত্বের হাহাকার তাকে আঘাত করে উঠল। পরনের ভেজা গাউন নিয়েই ঘরে ফিরে এসে সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ঠিক যেন আকাশের মত ফাঁপা লাগছে মনের এই মুহূর্তগুলো। একটি সিগারেট ধরালেন। সাধারনত তিনি সিগারেট খান না কিন্তু যখনই কোন বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পরেন তখনই শুধুমাত্র তিনি সিগারেট খান। এই মুহূর্তে বেশ উদ্বিগ্ন রয়েছেন। যিনি সারাদিন মানুষের সমস্যা নিয়ে কাজ করে বেড়ান আজ তার নিজের ঘরের সমস্যা নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হতে হল সেই তাকেই। তিনি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছেন না। তার ঘরের কাজের মেয়েটিকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পরেছেন। কাকে সন্দেহ করবেন নিজের স্বামীকে নাকি তার একমাত্র ছেলেকে ? মিসেস শায়লার স্বামী আরাফাত সাহেব দেশের একজন বরেন্য ব্যাক্তিত্ব। সারাদিন ব্যাস্ত থাকেন তার কাজ নিয়ে। কদাচিৎ তিনি বাসায় থাকেন। অথচ মাঝে মাঝে যে সময়টুকুতে তিনি বাসায় থাকতে পারেন শায়লাকে থাকতে হয় অফিসের কাজ নিয়ে বাইরে ব্যাস্ত। বাকিটা সময় তার বাইরে বাইরেই কাটাতে হয়। আরাফাত সাহেবের সাথে এই কারণে সম্পর্কের দূরত্বটা বেড়ে যাওয়াতে একাকীত্বে ভোগেন শায়লা। এমন একজন মানুষকেইবা কিভাবে তিনি সন্দেহ করবেন ? নাহ তার ছেলেও এমন কাজ করতে পারেনা ! আর যাই হোক তার সদ্য কলেজ পড়ুয়া ছেলেটির দ্বারা নিশ্চয় এমন কাজ সম্ভব নয়। রাবেয়াকে বহুবার জিজ্ঞাস করেও তিনি কোন কথা বের করতে পারেননি। যতবার রাবেয়ার কাছে জানতে চেয়েছেন; মেয়েটি শুধু চুপ থেকে নীরবে চোখের পানি ফেলেছে। কিছুতেই তিনি ভেবে পাচ্ছেন না আসল দোষী কে ? আরেকটি সিগারেট ধরালেন শায়লা। কাল তিনি রাবেয়াকে নিয়ে তার বান্ধবী ডাক্তার লীনার ক্লিনিকে নিয়ে এ্যাবরশন করিয়ে আনবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ব্যাপারে ড. লীনার সাথে তিনি সব পরামর্শ ইতিমধ্যে শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু এতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেনা। তার মনের মাঝে সন্দেহ থেকেই যাবে। স্বামী অথবা ছেলে কাউকে জিজ্ঞাস করে সত্য উদ্ধার করাও সম্ভব হবেনা। কারণ কেউ সত্যটা স্বীকার করবেনা। তাহলে কি বাকিটা জীবন মনের মাঝে সন্দেহের এই জ্বালাটুকু পুষে রেখেই কাটিয়ে দিতে হবে ?

মিসেস শায়লার মোবাইলে ফোন এসেছে। মোবাইলের স্ক্রিনে রাকিব নামটি দেখেই চোখে মুখে যেন একটু স্বস্তি ফিরে পেলেন তিনি। রাকিব তার অফিসে মাস কয়েক হল মাত্র জুনিয়র অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে। বয়সে ছোট হলেও অল্প কদিনেই তাদের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। এমনও হয় যে রাতের পর রাত তারা দুজনে মোবাইলে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেন। ভোর হয় তবু যেন কথার রেশ থেকে যায়। এইতো কিছুক্ষন আগেও যাকে বৃষ্টিতে পথে হেটে যেতে দেখেছেন মনে মনে রাকিবকে ভেবেই কল্পনায় রংধনু এঁকেছেন। শায়লার কাছ থেকে সব শুনে রাকিব তার সাথে কিছুদিন শহরের বাইরে কোথাও হতে ঘুরে আসার প্রস্তাব জানাল। প্রস্তাব শুনে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন শায়লা। সিদ্ধান্ত হল কাল রাবেয়ার এ্যাবরশন করিয়ে তাকে তার মায়ের কাছে রেখে এসে তারা বের হবেন। ভালই হল এই সময়টাতে আরাফাত সাহেব রয়েছেন এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে তার একটি থিসিসের কাজে। ছেলেটিও থাকছেনা। সেও তার বন্ধুদের সাথে কোথায় যেন বেড়াতে যাবে বলছিলো। মনে মনে সবকিছু ঠিক করে নিলেন শায়লা । তারপর সিগারেটে খুব আয়েশ করে টান দিলেন।

রাবেয়া তার মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করল। মায়ের মন সেই কান্নার অর্থ বুঝে নিলো। কিন্তু তার মত এক অসহায় গরীবের পক্ষে সান্তনা দেবার মত কোন ভাষা নেই। তিনিও মেয়ের সাথে কাঁদছেন। রাবেয়ার বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। একবার ছয়তালা একটি বিল্ডিঙের প্লাস্টারের কাজ করছিলেন বাইরে দিয়ে ঝুলান বাঁশের মাচার উপর দাড়িয়ে। হঠাৎ করে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে উপর থেকে পরে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর জন্য তিনি আইনের সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু টাকার কাছে হার মানতে হয় তাকে। স্বামীর করুন মৃত্যুতে তিনি বিল্ডিঙের মালিকের কাছ থেকে কোন সাহায্যতো পানইনি বরং তাকে আইনের আশ্রয় নেয়াতে সহ্য করতে হয়েছে নানা রকম ব্যাঞ্জনা। তারপর শুরু হয় মা আর মেয়ের অসহায় জীবন যাপন। একপর্যায়ে কোন কাজ না পেয়ে রাবেয়ার মা বেছে নেন শরীরবৃত্তি। অন্তত তাতে করে তার নিজের ও মেয়েটির মুখে দুবেলা ভাত তুলে দেবার ব্যবস্থা হলো। তবু তিনি তার মেয়েকে কোনরূপ আঁচড় লাগতে দেননি। সবসময় আগলে রেখেছেন। কিন্তু শেষটায় আর না পেরে দিয়েছিলেন মানুষের বাসায় কাজ করতে। মিসেস শায়লার বাসায় কাজ করলে অন্তত নিরাপদেই থাকবে তার মেয়ে। এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। অথচ নিজে হারিয়ে গেছেন অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হয়ে। ধীরে ধীরে নিজেকে ভোগের পন্য হিসেবে বেচতে বেচতে তিনি আজ বড় বেশি ক্লান্ত। মৃত্যু যখন তার দরজায় দাড়িয়ে হাসছে ঠিক তখন তার এতদিন ধরে আগলে রাখা একমাত্র মেয়েটির এই পরিনতি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের কোলেই মাথা রেখে তিনিও চলে গেলেন মৃত্যু নিয়ে সুখের সন্ধানে। এই নষ্ট শহরে হয়ত রাবেয়াকেও আজ হতে মায়ের পথেই জীবিকার উৎস বেছে নিতে হবে। বেঁচে থাকার এইত নিয়তি। এইত রাবেয়াদের মত নারীদের যাপিত জীবন।

রাতের বেলা সমুদ্রের পার ধরে হেটে চলার মাঝে যে কতটা সুখ থাকতে পারে জীবনের এতটা কাল পেরিয়ে এসে; শায়লা সেটা আজ অনুভব করছেন। রাকিবের কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছেন আর ভাবছেন ঈশ! যদি আরও আগে রাকিবের সাথে তার দেখা হত হয়ত জীবনটা আজ তার অন্যরকম হত। রাকিব শায়লার কোমরে হাত রেখে হাঁটছে আর কবিতা আবৃত্তি করছে।

অপ্রকাশিত সাগরের রহস্য
তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখার অবকাশ পেলাম
আজ বহুকালের পর
একটু আমাকে ডুবুরির বেশে কাছে আসতে দাও


সমুদ্রের স্রোত বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দুজনার নগ্ন পাগুলোকে। আকাশে অনেকক্ষণ ধরে তারা খোঁজার চেষ্টা করলেন শায়লা। বুড়ো চাঁদটাও বুঝি আজ ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে অবকাশ যাপন করতে।
-কি দেখছো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে ?
-নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করছি।
-কিন্তু আজ যে অমাবস্যা রাত। তোমাকে খুঁজে পেতে হলে ভরা পূর্ণিমার রাতে আকাশে খুঁজে দেখবে; তাহলেই তোমার নিজেকে ফিরে পাবে। শায়লা ?
-হুম !
-এভাবে যদি দুজনে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম সমুদ্রের পারে এভাবেই হেটে হেটে তবে কেমন হত ?
-হুম !
-কিছু বল ? শুধু হুম করছ যে ?
-ভাবছি ?
-কি ?
-ভাবছি তোমাকে কিভাবে চিরদনের জন্য কাছে পাওয়া যায় !
-আমাকে তোমার বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলেই হয়ে যায় !
-সেটাতো নিয়েছিই। কিন্তু ভাবছি ফিরে গিয়ে কি করব ?
-ওহ ! এসব ভেবে কেন এই সুন্দর রাতটাকে নষ্ট করছ ? ফিরে গিয়ে নাহয় এসব নিয়ে ভাবা যাবে।
-হুম ! শায়লার বুকের ভেতর হঠাৎ অজানা এক শঙ্কা হাহাকার করে উঠল। কোন ভুল হচ্ছেনাতো আবার কোথাও ? রাকিব কি তবে শুধুই তাকে ভোগ করছে। সত্যিকারের ভালোবাসা হয়ত সে তার কাছে মিছেই আশা করছে। আবার তেমন কিছু নাও হতে পারে। রাকিব হয়ত তাকে সত্যি ভালোবাসে। শায়লা আরও শক্ত করে রাকিবকে জড়িয়ে ধরল। রাকিব একটা সিগারেট ধরাল।
-আচ্ছা তুমি কি আমার শরীরে কোন গন্ধ পাও ?
-হুম ! ঠিক যেন কোন এক ফুলের সৌরভ। চল হোটেলের রুমে ফিরে যাই। সময়গুলো খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে আসে। চল আজ দুজনে মিলে ভীষণ আবেগ নিয়ে আমরা রাতটাকে উপভোগ করব। এভাবে রাত উপভোগ করার মাঝে যে সুখ খুঁজে পাওয়া যায় তা রাতের আকাশে হাজার তারা গুনেও পাওয়া যায়না। আমরা দুজনে আজ হারিয়ে যাবো পৃথিবীর আদিমতার উল্লাসে।
-হুম ! শায়লার যেন ঠিক বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তারই দর্শন হয়ত আজকে তার সাথেই প্রতারনার উপহাস করবে।

রাবেয়া খুব সুন্দর করে সেজেছে। মায়ের বিয়ের সময়ের লাল বেনারশি শাড়িটি পরে নিয়েছে। কপালে বড় করে একটি লাল টিপ পরেছে। এমন ভাবে চোখে কাজল এঁকেছে যেন সেই চোখের মায়াতেই যে কেউ খুন হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ নিজের শরীরের গন্ধে রাবেয়া চমকে উঠল। নতুন বউদের শরীর থেকে যেমন একটা গন্ধ পাওয়া যায় আজ যেন তার নিজের শরীর থেকে তেমনই গন্ধ পাচ্ছে সে। আজকে প্রথম দিন তাই বুকের ভেতর একধরনের ভীতিকর উত্তেজনা কাজ করছে। তবু এমন ভাবে ফুটপাতে ল্যাম্পপোস্টের সাথে দাড়িয়ে রয়েছে যেন এই লাইনে সে বহু আগে থেকেই অভিজ্ঞ। কত মানুষ সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে কিন্তু সাহস করে অন্যান্যদের মত ছলনাময়ী হাসি দিয়ে সে কোন পুরুষের শরীর স্পর্শ করতে পারছেনা। মনে মনে নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। আর যাই হোক কাঁদায় নেমে পা ময়লা হবার ঘৃণা করে মিছে লাভ নেই। তাই যথাসম্ভব সে চেষ্টা করছে লজ্জাকে সংবরণ করতে। যেভাবে সেই দুপুরে লজ্জা সংবরণ করতে হয়েছিলো মিসেস শায়লার বিছানায়। একে একে সবাই তাদের রাতের আয়োজন করে ফেলেছে। দেখতে দেখতে শুধু রাবেয়া একাই দাড়িয়ে রইল। তবু প্রথম রাতেই রাবেয়া আশাহত হতে চায়না। তাই সে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে নিভু নিভু আলোতে একটি গাড়ি এসে তার পাশে দাঁড়াল। গাড়ির জানালার গ্লাস খুলে একটি হাত ইশারা করল রাবেয়াকে।
-যাবে ?
-যাব !
-সারারাত কত নিবে ?
-দুই হাজার টাকা দিবে, খুশি করে দিব।
গাড়ির দরজা খুলে দিলো ভেতরে বসে থাকা লোকটি। রাবেয়া গাড়ির ভেতর যেয়ে বসতেই গাড়ির গতি বেড়ে গেলো। গাড়ির চলছে, পেছনে দ্রুত রাতের অন্ধকারের সাথে মিশে যাচ্ছে রাস্তার ধুলোবালি। লোকটিকে রাবেয়ার খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন এর আগেও তাকে সে দেখেছে। কিছুতেই মনে করতে পারছেনা। গাড়িটি যে বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়াল সেই জায়গাটাও তার খুব পরিচিত কিন্তু অজানা কোন এক কারণে কিছুতেই মনে করতে পারছেনা সে। রাবেয়া চোখ বন্ধ করে লোকটির বিছানায় শুয়ে আছে। ধীরে ধীরে লোকটি তার শরীর থেকে খুলে নিচ্ছে মায়ের বিয়ের লাল বেনারশি শাড়িটি। চোখের কোণ হতে কাজল ধুয়ে কিছুটা অশ্রু গড়িয়ে তার কানের ভেতর এসে পরল। বাঁশের মাচায় দাড়িয়ে বিল্ডিঙের প্লাস্টারের কাজ করছেন তার বাবা। কি নিখুত সেই শৈল্পিক আস্তরণ ! মুহূর্তেই তার কানে বাবার চিৎকার শুনতে পেলো রাবেয়া। উপর থেকে পরে যাচ্ছেন তার বাবা। মাটিতে পরতেই মাথা ফেটে মগজ বের হয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো রাস্তা। রাবেয়া লাফ দিয়ে উঠে বসল। কপালে ঘাম জমেছে। পুরো নগ্ন শরীর জুড়ে ঘাম ঝরছে। রাবেয়া উঠে গিয়ে পাশেই টেবিলে রাখা ছুরিটি হাতে তুলে নিল। তারপর নিজের পেটে নিজেই ছুরিটি ঢুকিয়ে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতা লোকটিকে মুহূর্তেই কিংকর্তব্যবিমুড় করে ফেলল। লোকটি শুধু নীরবে তাকিয়ে রইল মেঝেতে পরে থাকা রাবেয়ার রক্ত মাখা নিথর শরীরের দিকে।

সকালে হোটেলের রুমে বেয়াড়া এসে চা আর পত্রিকা দিয়ে গেছে। শায়লা বিছানায় শুয়ে থেকেই রাকিবের কাছে পত্রিকাটি চাইলেন। রাকিবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরেছে। শায়লার কোন কথাই এখন তার কানে এলোনা। রাকিব একটি সিগারেট ধরিয়ে পত্রিকাটি নিয়ে মেঝেতেই বসে পরল। শায়লা বিছানা ছেড়ে তার পাশে এসে বসলেন। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে পড়ছেন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রুহুল উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। রাতে তার বাড়িতে এনে একটি পতিতাকে খুনের দ্বায়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। পত্রিকাটিতে রাবেয়ার ছবি ছাপা হয়েছে; ইনসেটে রুহুল উদ্দিনের ছবি।
-রাকিব এই মেয়েকেত আমি চিনি। এইত সেই রাবেয়া যে আমার বাসায় কাজ করত। হায়রে অভাগী ! জীবন তোকে শেষ পর্যন্ত এভাবেই ক্ষমা করল।
-হুম আর ইনসেটে যার ছবি তুমি দেখছ শায়লা, তিনি আমার বাবা !
শায়লার মুখের ভাষা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো হোটেলের বদ্ধ রুমের নীরবতায়। মুহূর্তেই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছেন শায়লা; রাকিবের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট নিয়ে ধরালেন।

দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে
কোথাও কোথাও ফার্ন জাতীয় পাতাও বেড়ে উঠেছে
বাবা বলেছেন যেন নতুন করে দেয়ালে প্লাস্টার করিয়ে নেই
সাথে চুনের আস্তর দিতেও বলেছেন
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা
কোন একদিন সকালে বৃষ্টি এলে আমার ক্যানভাসে একটি ছবি আঁকব
ছবিটি উপহার দেব আমার প্রিয়াকে
বৃষ্টিস্নাত শ্যাওলা জমা দেয়ালের ছবি দেখবে আমার প্রিয়া নয়ন ভরে
আর আমি .........

থাকনা কিছু পুরনোরা এভাবেই অযত্নে অবহেলায় পরে
নতুন রঙে রাঙিয়ে কি লাভ ?


পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক হচ্ছে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। অবশ্য এই সম্পর্কের মাঝে গভীর ভালোবাসা, সত্য, বিশ্বাস ও নির্ভরতা থাকা চাই। ভালোবাসা ব্যতীত কোনো সাংসারিক জীবন, দাম্পত্য জীবন কখনই সুখের হয় না, হতে পারেনা। স্বামী স্ত্রী একে অন্যের পরিপূরক। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজন শূন্য। দাম্পত্য জীবন সুন্দর ও সুখের সংসার চাইলে নীচের বিষয়গুলোতে মনোযোগী হওয়া উচিতঃ

১। যে কোনো সংসারেই সাবলীল ও মধুর আনন্দ বজায় রাখতে দরকার দু’জনার ঐকমত্য। অবশ্য এ ঐকমত্যা সবসময় বা সবক্ষেত্রেই সমান হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আসল কথা হল দু’জন দু’জনার সংসার জীবন কিভাবে সুখ সমৃদ্ধতায় ভরিয়ে তোলা যায়, কি করলে দু’জনার মাঝে মনের আদান-প্রদান চমৎকারভাবে অক্ষুণ্ণ থাকবে, এমন বিষয়গুলোতে অপরের ইচ্ছার গুরুত্ব দেয়া।

২। একজন সুন্দর মনের, সুন্দর গুণের অধিকারী স্ত্রী সংসারকে তার নিজের আলোয় আলোকিত করে তুলতে পারে, সাজিয়ে তুলতে পারে সংসার জীবনকে সুখের স্বর্গীয় বাগানের মতো। তবে এই কাজের জন্য দরকার স্বামীর স্ত্রীর প্রতি ঐকান্তিক মায়া-মমতা ও সুগভীর ভালোবাসা।

৩। স্ত্রীকে স্বামীর বোঝার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে স্ত্রীকে যত বেশি বোঝার চেষ্টা থাকবে, তত বেশি তার ভালোবাসা উপলুব্ধ হবে, তত বেশি সংসার জীবনে সুখী হওয়া যাবে।

৪। সুখ সবসময় নিজে থেকে এসে ধরা দেয়না, ধরতে হয়, তৈরি করে নিতে হয় চমৎকার রূপে। এজন্যই স্বামী স্ত্রী দু’জনার মাঝে থাকতে হয় প্রচুর আত্মবিশ্বাস ও সমঝোতা এবং সুনিপুণ স্বচ্ছ অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা।

৫। স্বামীকে মনে রাখতে হবে, স্ত্রীকে হেয় করে বা তার কথা বা কাজকে অবহেলা করলে কিংবা গুরুত্ব না দিলে হৃদয়ের টান কমতে থাকে, জন্ম নেয় অজানা চাপা ক্ষোভ।যাকিনা ভালোবাসার দূর্গে আঘাত হানতে পারে।

৬। দৈনন্দিন জীবনে একে অপরকে সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারলেই এবাধন যাবেনা ছিড়ে। বরং এক অন্যের প্রতি আরো আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে।

৭। ছোট বড় যে কোনো ধরনের কাজ করার আগে নিজের স্ত্রীর সাথে তা খোলা মনে আলাপ আলোচনা বা পরামর্শ করে নিলে সে কাজে সুফল আসবে; কর্ম উদ্দীপনা প্রস্ফুটিত হবে। হতে পারে কোনো কাজে বা কোনো পদক্ষেপে ভুল লুকিয়ে আছে, শেয়ারিংয়ের ফলে সে ভুলটি ধরা পরবে,সহজ হবে কাজ, মজবুত হবে সম্পর্ক। এতে করে মন চাপমুক্ত হবে, টেনশন লাঘব হবে, ভালোবাসায় তিক্ততা আসবেনা।

৮। স্বামী-স্ত্রীর মিলিত ভালোবাসা, মিলিত বুদ্ধি ও চিন্তা ভাবনার সমন্বয়েই একটি ছোট সংসার সুখময় হয়ে উঠবে। স্ত্রীর ওপর কখনই অযথা রাগ করা উচিত নয়, কারণ অসুন্দর রাগ প্রিয়তমা স্ত্রীর সুন্দর আবেগ অনুভূতিকে দারুণভাবে নষ্ট করে দিতে পারে। ফলে ঝরঝরে, সতেজ, প্রাণবন্ত মায়া-মমতা,আবেগ একসময় তিক্ততায় রূপ নিতে পারে। যা কখনোই দাম্প্যত্ব জীবনের জন্য মঙ্গলময় নয়।

৯। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি মনের আবেগ-অনুভূতি, কামনা বাসনা, আকাক্ষা প্রকাশ করতে হবে। নিজের মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখলে বোঝাপরা কম হয়।

১০। প্রতিদিনই স্ত্রীর সঙ্গে কথা বার্তা, গল্প গুজব, দুষ্টামি, আকার, ইঙ্গিত, স্পর্শ, ইত্যাদি নানাভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করা শ্রেয়। ফলে ভালোবাসার অনুভূতি বিকোশিত হয়।



সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৭
৪৪টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×