somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিছুতেই চোখের পানি থামাতে পারছি না....

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৬:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
আমার বাবার দুটো কিডনি অকেজো হওয়ায় ২০০৬ থেকেই একদিন অন্তর অন্তর ব্যয়বহুল হেমোডায়ালাইসিস দিতে হতো। ২০০৭ সালে হার্টের জটিল সমস্যাসহ ভয়ানক ‘হেপাটাইটিস সি’ ধরা পড়ে। সবমিলিয়ে চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে তখন বেশ কয়েক লাখ টাকার দরকার হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ওই সময় গ্রামের জমি-জমা বিক্রির ওপর চাপ পড়ল। কি করব ভেবে পাচ্ছি না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়। এদিকে ‘আমার দেশ’ এর মালিক মোসাদ্দেক আলী জেলে বন্দি। ১০ মাস ধরে আমাদের বেতনও বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতেও হাসপাতাল সন্নিকটে থাকায় ঢাকার কাঠাঁলবাগান এলাকায় বাসাভাড়া করে বসবাস করছি বাবা-মাসহ। এসব বিষয়ে অফিস এমনকি পরিবারের বাইরে তেমন কেউ না জানলেও, পারিবারিক আর্র্থিক দুরবস্থার সংবাদটি ঠিকই আতাউস সামাদ স্যারের কানে কীভাবে যেন পৌঁছে যায়। তিনি আমার দেশ-এর উপদেষ্ঠা সম্পাদক। তাঁর রুমের সামনেই আমার বসার স্থান।
১০ ডিসেম্বর, ২০০৭ সকালে সামাদ স্যার নিজেই আমাকে ফোন করলেন। কথা মত, ঢাকা ক্লাবে কিডনি ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠান শেষে তাঁর গাড়িতে করেই আমাকে নিয়ে চললেন সেগুনবাগিচাস্থ তাঁর সাপ্তাহিক ‘এখন’ অফিসে। অফিসে পৌঁছেই প্যাডে নিজ হাতে একটি চিঠি লিখলেন তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদের প্রেস সচিব ফাহিম মুনেম বরাবর। ফাহিম মুনেমকে সম্ভবত ‘মামা’ সম্বোধন করতেন।
আমার সামনেই তাকে ফোন দিলেন। আগেও নাকি এ বিষয়ে কথা বলেছেন। চিঠির ভাষা এখনও আমার মনে আছে- ‘‘কয়েকদিন আগে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দফতরে আপনার সাথে সাক্ষাত হলে আমাদের একজন সাংবাদিকের পিতার চিকিৎসার সহযোগীতার জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার তহবিল থেকে কিছু আর্থিক সহযোগীতা দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সেই সাংবাদিকের পিতা মো: আবদুল মালেক (৫৮) দুরারোগ্য কিডনি ফেলিওর রোগে আক্রান্ত। তার দুটো কিডনিই সম্পুর্ণরূপে বিকল। বর্তমানে ১ দিন পর পর তাকে হেমোডায়ালাইসিস করাতে হচ্ছে যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা। ইতোমধ্যে তার ‘হেপাটাইটিস সি’ ধরা পড়েছে। এ অবস্থায় পিতার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহে যথোপযুক্ত সহযোগীতা করতে পারলে বাধিত হবো।’’
স্যারের কথামত চিঠিটি আমি নিজে পৌঁছে দিলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কানে এ চিঠির আবেদন এবং বাবার করুণ অবস্থা সাড়া ফেলেনি সে সময়। অবশ্য এ নিয়ে আমার কোন ক্ষোভ কোনদিন ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু মুমুর্ষু পিতার চিকিৎসায় আর্থিক সংকটে পড়া একজন তরুণ সাংবাদিকের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একজন আতাউস সামাদের মনে যে প্রচেষ্টা ও সহমর্মিতা সে সময়ে লক্ষ্য করেছি তা কোনদিন ভোলার নয়।
আমার বাবা ২০০৮ সালে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। এখনও মনে আছে, ঢাকায় ফিরলে তিনিই খোঁজ নিলেন সব ঠিকঠাকমত সম্পন্ন হয়েছে কিনা।

২.
২০০৮ সালের শুরুর ঘটনা। এক রাতে গ্রামের বাড়ী থেকে সংবাদ আসল, আমাদের জমির একটা বড় অংশ কিছু দুষ্কৃতিকারী নাকি ওই রাতে দখলে নেবে। পিতার মুমুর্ষু অবস্থায় এই ধরনের সংবাদে ভীষণ মর্মামত হলাম। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে হলো, সামাদ স্যারকে বিষয়টা জানাই। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি শোনামাত্র আমার কাছে নম্বর নিয়ে পঞ্চগড়ের তৎকালীন পুলিশ সুপার হারুনুর রশিদকে ফোন করলেন। আমার বাবার অসুস্থতা, পারিবারিক পরিস্থিতি বর্ণনাসহ তাকে অনুরোধ করলেন, যেন আমাদের জমিটা হাতছাড়া না হয় এবং তিনি যেন একটা ভুমিকা রাখেন।
ওষুধের মতই কাজ হলো। বড় ভাই গ্রাম থেকে জানালেন, পানি-কাদা ভেঙ্গে গভীর রাতে স্পটে থানা পুলিশ গিয়ে বাধা দেওয়ায় জমি দখল করতে পারেনি। আমি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাদের বিরাট সম্পত্তি বলা যায় সামাদ স্যারের চেষ্টায় সেই রাতে রক্ষা হলো।

৩.
শিশুর মত ছিল জনাব আতাউস সামাদের মন। তিনি পিয়নের সাথে যে ব্যবহার করতেন, একই ব্যবহার করতেন অফিসের সবচেয়ে বড় কর্তাটির সাথেও। একটা ব্যাপার অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি তা হলো- সঠিক কথা বলতে তিনি কখনোই দ্বিধা এমনকি বিলম্বও করতেন না। কাউকে খুশি করার জন্য কোনদিন কিছু বলতেন না।
শুধু কি রাজনীতির খবরই তিনি রাখতেন? লেটেস্ট প্রযুক্তির সংবাদটিও আমি তার কাছ থেকেই পেতাম। এরপর লিখে ফেলতাম হয়ত কোন আর্টিকেল।
একটা মানুষ এতকিছুর অধিকারী হয় কিভাবে! আমরা যারা তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, তারা সত্যিই ভাগ্যবান। এইতো কয়দিন আগে তার বারিধারার বাসায় পুরো বিকেল গল্প করেছি তাঁর ভাগিনা প্রখ্যাত আইনজীবী আনিসুল হকের আমেরিকা প্রবাসী ভাই হারিসুল হকসহ।
আতাউস সামাদ আমাকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছেন, হারিসুল হক সাহেব বিআরটিসি-র অটোমেশন করেছেন। বিষয়টা কীভাবে বিভিন্ন মিডিয়ায় আনা যায় তা নিয়েই কথা হচ্ছিল। আসার পথে লিফট পর্যন্ত চলে এলেও কথা যেন শেষই হয় না! অনেক স্বপ্ন, অনেক উচ্ছাস সব সময় দেখতাম তার মনে।

৪.
আতাউস সামাদ হচ্ছেন বাংলাদেশের সেই কম সংখ্যক প্রথিতযশা সাংবাদিকদের একজন, যাঁরা একইসঙ্গে সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনে কাজ করেছেন। চরম প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও গণতান্ত্রিক প্রচেষ্ঠা ও মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সংবাদ পরিবেশন করতেন তিনি। কলামেও গণতন্ত্র ও জনকল্যাণের রাজনীতির পথ ধরে জাতীয় ঐক্যের কথাই লিখে আসছিলেন বরাবর। তাঁর কোন লেখা পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠে যাওয়া যেত না। সহজবোধ্য ও সাবলীল ছিল ভাষার গাঁথুনি। তবে আক্ষেপের কথাটা হলো, তাঁর রিপোর্টার জীবনের প্রায় সবটা সময় কেটেছে যুদ্ধ, সেন্সরশিপ, সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিক জরুরি আইনের শাসনের মধ্য দিয়ে। সাংবাদিকদের মধ্যে যেটা দুর্লভ, সেই ইংরেজির ওপর চুড়ান্ত দখল ছিল তার। ইংরেজিতে দুর্বলতার জন্য আমাদেরকে অনেক বকাঝকা করতেন।
হয়তো এসব কারণেই তিনি আলাদা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শিশুর মত মন ছিল তার, এতটা প্রাণবন্ত, এতটা আন্তরিক, নিখাদ ভালবাসাপূর্ণ একজন মানুষ আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন!!!

মৃত্যুকালে কত আর বয়স হয়েছিল আপনার? ৭৫ বছর। অনেক সময়। যদিও তা আমাদের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের কাছে আপনার চলে যাওয়াটা বেশ ‘তাড়াতাড়ি’ই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অনেক জলদিই চলে গেলেন আপনি!
এখন মনে হচ্ছে-কেন আপনাকে অ্যাপোলোতে নেওয়া হলো? কি এমন হলো যে, অল্পতেই পা কেটে ফেলতে হলো? আরও হাসপাতাল ছিল সেখানে নিলে হয়তো বেঁচে যেতেন! সারাজীবন ডাক্তারদের সহচর্যে থেকেও আপনার বেলায় কিছুই করতে পারলাম না!
স্যার! গত বুধবার থেকেই চোখের পানি ঝরছে। এখন ভোর ৬:০১, তবুও ঘুম আসছে না। আপনার কথা মনে হলে কিছুতেই চোখের পানি থামাতে পারছি না.... আমার বাবার মৃত্যুর পর বোধ হয় এত চোখের পানি আর ফেলিনি কারোর জন্য।
আয়নার মত আপনার ছবি ভাসছে। সেদিন প্রেসক্লাবে জানাযার পর বড় শখ করে কফিনটি কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম।
ইস! ভাবতেই পারছি না আর কোনদিন আপনার সাথে দেখা হবে না। অফিসে পেছন ফিরে তাকালেই আপনার রুমের দিকে চোখ পড়বে। যখন দেখব আপনি নেই, সে চোখে তখন পানি ঝরবে। ঝরুক। এই চোখের পানিই আমাদের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।
আপনি আপাদমস্তক একজন সচ্চরিত্রের ধার্মিক মানুষ ছিলেন। আপনি নিশ্চয় ভাল থাকবেন স্যার। আল্লাহ্ পাক আপনাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।

লেখক : সহ-সম্পাদক, আমার দেশ
[email protected]
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৩২
২৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×