somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেভাবে আমি ’সত্য’ অর্জন করলাম

২০ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ১০:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যখন এ পৃথিবীতে আমার আগমন এবং আমি যখন বুঝতে শুরু করলাম যে আমাকে আবার চলে যেতে হবে তখন হতেই একটি প্রশ্ন আমাকে ”সত্য” অর্জন করার পূর্ব পর্যন্ত কুরে কুরে খেয়েছিল আর তা হল ”কে আমি”? আমি কি আসলেই ”আরমান আরজু”? নামটি তো আমার বাপ-দাদাদের দেয়া। আমার আসল নামটি কী অথবা আমি কে? পৃথিবীতে আমি না এলে কী-ই বা এমন হতো? কেন আমাকে পৃথিবীতে পাঠানো হলো? খেয়ে-পরে বেঁচে মরার জন্য? কেউ আসছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে, লাট বাবার সম্পদ বসে বসে খায় আর একসময় চক্ষু উল্টিয়ে পটল তুলে। আর কেউ আসছে এক বেলা খেলে আরেক বেলা আদৌ কিছু জুটবে কিনা চিন্তা মাথায় নিয়ে, সারা জীবন কলুর বলদের মতো খেটে একসময় সেও নয়ন মেলে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি বরণ করে। আমি পড়েছি মাইনকা চিপায়। চিড়েচ্যাপ্টা। কিন্তু নিজেকে আমি বারবার প্রশ্নটি করেছি, কেন আমাকে পৃথিবীর দরকার পড়ল যে আশির দশকেই আমার আগমন হতে হবে? তবে কি আমি কবি উইলিয়াম শেকসপিয়রের পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চের কোন অভিনেতা যার অংশ এখন চলছে?
”আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ” অর্থ- সাক্ষ্য দিচ্ছি নেই কোন ইলাহ আল্লাহ ব্যতীত।
প্রতিদিনকার আযানে বাক্যটি সবাই শুনে। আমিও শুনি আর চিন্তা করি যিনি সাক্ষ্য দেন তাকে কিন্তু সব দেখে-জেনে-বুঝে সাক্ষ্য দিতে হয়। পৃথিবীর কোন মুয়াজ্জিনকে যদি প্রশ্ন করি, তিনি যে সাক্ষ্য দিচ্ছেন ’আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই’ সেটা তিনি চাক্ষুস কোথায় দেখেছেন বা কোথায় জেনেছেন বা কোথায় বুঝেছেন? (আল্লাহর কথা) শুনেছি বা (গ্রন্থে) পড়েছি ধরনের উত্তর আমিও দিতে পারি। সাক্ষী যদি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন যে তিনি শুনেছেন অমুক অপরাধ করেছে তবে কি তার সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে?
"এবং তাদের অধিকাংশ অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত করে না। নিশ্চয় সত্যের কোন বিষয়ের বিপক্ষে অনুমান ফলপ্রসূ হয় না” (সূরা ইউনুস, আয়াত ৩৬)।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ এখানে অনুমানের ভিত্তিতে কোন কিছু করতে নিষেধ করছেন। অথচ পুরো পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ অনুমান আর মিথ্যা সাক্ষ্যে ভরপুর! আমাদের ভোর হতে শুরু করে সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত পার হয়ে যায় অনুমান আর মিথ্যা সাক্ষ্যের চর্চা করে!
এটি ঠিক যে একটি মানবের বেড়ে উঠার পেছনে তার পরিবার, তার স্বজন-বান্ধব, তার সমাজ, তার পরিবেশ, তার রাষ্ট্র বড় ভূমিকা রাখে। আমি আমার পরিবার, স্বজন-বান্ধব, সমাজ, পরিবেশ, রাষ্ট্র সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার বেড়ে উঠার পেছনে এঁদের প্রত্যেকের অবদানকে আমি সম্মান করি। আমি স্মরণ করছি সেই চিকিৎসককে যিনি আমার জননীর সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আমাকে ধরাধামে আগমনের সুযোগ করে দেন। স্মরণ করছি সেই ধাত্রীকে এবং আরো অনেককে। কিন্তু এঁরা কেউই আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি আর তা হল ’আমি কে’। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেনি একটি সত্তার সাথে যাঁর নাম ”আল্লাহ”। তারা আরো বড় গলায় বলে মা-বাবার চেয়ে নাকি বড় মাওলানা, বড় হুজুর, বড় পীর আর কেউ নেই। অর্থাৎ মা-বাবাই সব! কিন্তু তারা ভুলেও বলে না মা-বাবার চেয়ে বড় চিকিৎসক, বড় প্রকৌশলী, বড় অমুক বড় তমুক আর নেই। কারণ কঠিন রোগে ধরলে তখন কিন্তু চিকিৎসকের কাছেই যেতে হয় এবং মা-বাবাই নিয়ে যান। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার পরিচয় দিতে মা-বাবা সহ পারিপার্শ্বিক যারা আছেন সবাই ব্যর্থ। অথচ মহান আল্লাহ বলছেন,
”এবং আমরা তার প্রাণশিরা অপেক্ষা নিকটে আছি” (সূরা ক্বাফ, আয়াত ১৬)।
এত নিকটে! অথচ আমরা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি মহাকাশে-মহাপাতালে! আমি নেমে পড়ি তাঁর সন্ধানে। প্রশ্ন হল কে দেবে তাঁর ঠিকানা?
মসজিদের মোল্লা?
মন্দিরের পুরোহিত?
প্যাগোডার ভান্তে?
গির্জার যাজক?
বিশ্ববিদ্যালয়/মাদ্রাসা/দরবার/দল- গুলোর শিক্ষক, মাওলানা-শায়খ-মুফতী, পীর-হুজুর কিংবা নেতাগণ?
সাধারণ মানুষদের মতো এরাও তো সবাই অনুমান আর মিথ্যা সাক্ষ্যে ভরপুর! উপায়? তো যাওয়া যাক নিজের মতবাদ গ্রন্থের কাছে।
বলে রাখা ভাল আরবী ’দ্বীন’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে মতবাদ, ধর্ম নয়। ধর্ম বলতে কোন কিছুর বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবকে বোঝায়। ইসলাম একটি মতবাদ, সনাতন একটি মতবাদ, বৌদ্ধ একটি মতবাদ, খ্রিস্ট একটি মতবাদ। ইসলামের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য কী? অন্যান্য মতবাদ গুলোর ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য কী? আমি ওদিকে যাচ্ছি না।
নিজের মতবাদ গ্রন্থ পবিত্র কোরআন খুললাম। প্রথম সূরার পঞ্চম থেকে সপ্তম আয়াতে এসে আমি থেমে গেলাম-
”আমাদেরকে পরিচালিত করো মোসতাক্বিমের পথে। তাঁদের পথে যাঁদের উপর নেয়ামত দান করছো, যারা ক্রোধ নিপতিত নয় পথভ্রষ্টও নয়” (সূরা ফাতিহা, আয়াত ৫-৭)।
আয়াতটি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে পথ একটাই কিন্তু পথ দেখানোর লোক দু’জন তন্মধ্যে একজন নেয়ামত প্রাপ্ত আর অন্যজন পথভ্রষ্ট। পথের আরেকটি অর্থ হল মতবাদ। মতবাদের কিছু নমুনা দেখুন- ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট, ইহুদি, সূফি, সুন্নী, শিয়া, ওয়াহাবী, তাবলীগ, জামায়াতে ইসলাম, তালেবান, দ্রুজ, মান্দাই, জৈন, শাক্ত, শিখ, ইয়াজিদি, বাহাই, মাজদাক, কনফুসীয়, শিন্তো, তাওবাদ, সামারিতান, আর্য, মিশরীয়, গ্রিক, পুরাণ, আদি ইত্যাদি আরো অনেক। যত পথ তত মত। কিন্তু পথ তো একটাই আর তা হল মোসতাক্বিমের পথ।
বুঝা গেল যেসব ব্যক্তিবর্গের উপর মহান আল্লাহর নেয়ামত বর্ষিত হচ্ছে শুধুমাত্র তাঁরাই মোসতাক্বিমের পথে আছেন। আমাকে জানতে হবে মোসতাক্বিমের পথ কোনটি, নেয়ামত কী এবং যাঁদের উপর নেয়ামত দান করা হচ্ছে তাঁরা কারা। তো আগে যাওয়া যাক বিজ্ঞানের কাছে যেহেতু আমি ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্র। ছিলাম বললে ভুল হচ্ছে কারণ আমি তো এখনো গবেষণা নিয়েই আছি আর বিজ্ঞানের মূল অংশই হল গবেষণা। আমার গবেষণার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর ইংরেজিতে যাকে বলে সেনসিটিভ (আমার প্রত্যেকটি লেখায় আমি চেষ্টা করি বিদেশি শব্দ পরিহার করতে) আর তা হল সৃষ্টিকর্তার ধারণা এবং মতবাদ সমূহের আবশ্যিকতা।
বিজ্ঞান আমার প্রিয় বিষয় কারণ অনুমান আর মিথ্যা সাক্ষ্যের এ পৃথিবীতে একমাত্র বিজ্ঞানই প্রমাণ ব্যতীত কোন কিছু মেনে নিতে নারাজ। মাওলানা বলেন, শায়খ বলেন, পীর বলেন, পুরোহিত বলেন, ভান্তে বলেন, যাজক বলেন সবাই পুস্তকের বাইরে একটা বাক্যও বলতে পারবে না। অথচ একেকটার কী পন্ডিতী ভাব-সাব! তাঁদের রচিত পবিত্র গ্রন্থগুলোর তাফসীর পড়লে মনে হবে যেন তাঁরা একেকজন সবজান্তা। উদ্ভট ওয়াজ, গলাবাজি আর ফতোয়াবাজিতে এদের মুখ আটকায় না। যেখানে আটকে যায় সেখানে বলে ’এর মর্ম একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন’। মহান আল্লাহ তো সবকিছুই ভাল জানেন ও বোঝেন। আপনি কতটুকু জানলেন সেটাই হচ্ছে বিষয়। বিজ্ঞান কোন মতবাদ মানে না (এবং সেটা বিজ্ঞানের বিষয় আমার নয়)। বিজ্ঞানের ধর্ম হল পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, গবেষণা এবং প্রকাশ। বিজ্ঞান অদৃশ্যে বিশ্বাস করে না। মহাকাশে আর ভূমিতে যা কিছু দৃশ্যমান তা নিয়েই শুধু বিজ্ঞান কাজ করে। মতবাদের সাথে এখানেই বিজ্ঞানের বিরোধ। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও’র জীবনী পড়লে সব জানা যাবে। মতবাদ সমূহ আমাদের শুধু অদৃশ্যে বিশ্বাস করতে বলে অথচ নিজের মতবাদ গ্রন্থ কোরআন বলছেন অনুমান কিংবা আন্দাজ হতে বিরত থাকতে। যেহেতু প্রমাণ ব্যতীত আমি কোন কিছু মানতে নারাজ তাই বিজ্ঞানের শরণ নিলাম। কিন্তু সমস্যা হল বিজ্ঞান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব মানতে একদম রাজি নয় যেহেতু সৃষ্টিকর্তার কোন দৃশ্যমান অস্তিত্ব এ জগতে নেই (বৌদ্ধ মতবাদেও কিন্তু কোন সৃষ্টিকর্তা নেই!)। আবার অনেক অদৃশ্য বিষয়েও তো বিজ্ঞান প্রমাণসহ ব্যাখ্যা দিয়েছে যেমন- ভাইরাস (এক অদৃশ্য ’করোনা ভাইরাস’র দাপটে বিজ্ঞান সহ তাবৎ পৃথিবী নাকানি-চুবানি খাচ্ছে!)। ভাইরাস তো খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু বিজ্ঞান দেখে, খালি চোখে নয় বিদ্যুতিন অণুবীক্ষণ (ইলেকট্রোন মাইক্রোস্কোপ) যন্ত্রের সাহায্যে। সুতরাং ভাইরাস আমি খালি চোখে দেখি না তাই ভাইরাস বলতে কিছু নেই এরকম কথা বললে বিজ্ঞান হাসবে। আর আমি হাসছি বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখে যে বিজ্ঞান বলছে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই সবকিছু নাকি এমনি এমনি হচ্ছে! অথচ মহান আল্লাহ বলছেন,
”তিনিই আদি এবং অন্ত এবং দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য। এবং তিনিই সব কিছুর সাথে জ্ঞানবান” (সূরা হাদিদ, আয়াত ৩)।
সৃষ্টিকর্তার উন্মুক্ত আহবান, তিনি দৃশ্যমান এবং সব কিছুর সাথে জ্ঞানবান। ব্যর্থতা কি বিজ্ঞানের নয়? বিজ্ঞান নিয়ত পরিবর্তনশীল। আজ এটা বলছে তো একশ বছর পর বলবে ওটা ভুল ছিল। আজ বলছে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই কিন্তু হয়ত একদিন এই বিজ্ঞানই স্বীকার করবে যে ’তিনি দৃশ্যমান’। ততদিনে কত জল গড়িয়ে যাবে কতশত বছর পার হয়ে যাবে আমরা জানি না। কিন্তু আমার জীবন চাকা তো ততবছর পর্যন্ত ঘুরবে না। শুনেছি অনেক আগের মানুষেরা নাকি হাজার বছর আয়ু পেতেন। অথচ সীমিত আয়ুর অধিকারী আমরা। এর মধ্যেই আমাকে যা জানার জেনে যেতে হবে। নইলে আমি ব্যর্থ, আমার জন্ম ব্যর্থ, আমার সবকিছু ব্যর্থ। কিন্তু নিজেকে আমি ব্যর্থ হতে দেব না। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ খেয়ে-দেয়ে ঘুমায় আর আমি জেগে জেগে চিন্তা করি। চিন্তা করি কোরআন কেন বারবার চিন্তা করতে গবেষণা করতে আমন্ত্রণ জানায়। কোরআনের বেশকিছু আয়াতে জ্ঞানী কিংবা চিন্তুাশীল কিংবা গবেষকদের কিংবা দার্শনিকদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে ’উলিল আলবাব’ কিংবা ’উলিল আবসার’দের জন্য এতে শিক্ষণীয় বিষয় বা উপদেশ রয়েছে। কিন্তু কোরআনের কোথাও তাঁদের অনুসরণের বিন্দুমাত্র কোন আদেশ কিংবা উপদেশ নেই। এবং এই চিন্তা বা গবেষণা করে তাঁদের কোন উপকার হবে কিনা এ ব্যাপারেও কোরআন একদম নীরব। আবার কোরআনের আরেক স্থানে ’উলিল আমর’গণকে আল্লাহ এবং রসূলের পরেই অনুসরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আবার সূরা কাহাফে আমরা এমন একজন মহামানবের সাক্ষাৎ পাই যাঁকে কোরআন ’আবদুহু’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং আরো ঘোষণা দিয়েছেন যে তাঁকে ’ইলমে লাদুন্নী’ অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম’র মত নবীকে বলছেন সেই আবদুহুকে অনুসরণ করতে। এসব বিষয়গুলো হতে আমরা কী বুঝলাম? কোরআন কোনটিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন? কিছু কি বুঝতে পারছেন?
অনেকে আধুনিক সভ্যতার অবদানের পেছনে একমাত্র বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের বাহবা দেন কিন্তু নির্মম সত্য হল বাহবা দেয়া উচিৎ শয়তানকে। আধুনিক সভ্যতার এ উল্লম্ফনের পেছনে আছে শুধু একজনই আর সে হল শয়তান। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি যতই যন্ত্রপাতি নির্ভর হচ্ছি ততই আমরা সততা, মানবিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ”সত্য” অর্জন করার বিষয় হতে দূরে সরে যাচ্ছি আর শয়তানও এটাই চায়। আমার কথা নয় পবিত্র কোরআনেই আছে। এখন অনেকে আয়াতের সূত্র চাইবেন। না, এ আয়াতটির উল্লেখ আমি করব না কারণ আমি ’শরীয়ত’কে শ্রদ্ধা করি। কোরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই রহস্য আর তত্ত্বে ভরপুর কিন্তু শরীয়তের চাদরে ঢাকা। গবেষণা করুন, সাধনা করুন দেখবেন কোরআন আপনার কাছে সব একে একে মেলে ধরবেন। কাসাসুল আম্বিয়া-সাহাবা-আওলিয়া, লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি, সহী-শুদ্ধরূপে কোরআন পাঠ, হাদীস সংগ্রহের ইতিহাস, লাইলী-মজনুর প্রেম কাহানী ধরনের বই আর কত বছর পড়বেন? ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে মজে থেকে সময় নষ্ট করে একসময় তো মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যাবেন। ”সত্য” অর্জনের সাধনা আর কখন করবেন?
এরমধ্যে ঘটে গেল এক অমীমাংসিত ঘটনা। তখন আমি অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণীতে পড়ি। বিজ্ঞানের কাছে ’আমি কে’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলছি। পড়ালেখা করছি। আবার নিজস্ব মতবাদ মেনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাতে পড়ছি। আমরা তখন থাকতাম পাহাড়ি এলাকায়। যে মসজিদটিতে নামায পড়তাম তার পেছন হতেই পাহাড়ের শুরু। কয়েকদিন ধরে মসজিদে যাওয়া-আসার পথে লক্ষ্য করলাম এক অপ্রকৃতিস্থ (পাগল নয়) লোক পথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন চিন্তা করেন। পরনে পুরোনো মলিন বসন। শরীর দেখলে মনে হবে বহুদিন গোসল করেননি। চুল-দাড়ি সব এলোমেলো। কারো সাথে কোন কথা বলেন না। কারো দিকে তাকান না পর্যন্ত। একদিন ইশার নামায অন্তে মসজিদ হতে বের হওয়ার সময় দেখলাম লোকটি মসজিদের খোলা উঠোনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। অপ্রকৃতিস্থ লোক। সুতরাং তাঁকে নিয়ে এত ভাবার সময় নেই। ফযরের নামায পড়ার জন্য মসজিদে আমি একটু আগেই যেতাম কারণ মসজিদটিতে মুুয়াজ্জিন ছিলেন না। আযান দেয়া আমি খুব উপভোগ করতাম যে মহান আল্লাহর আহবান আমি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। এবং সুযোগটি পেতাম শুধু ফযরের নামাযে আগে-ভাগে গেলে। কারণ প্রতিদ্বন্ধী আরো অনেকে ছিলেন। মসজিদের উঠোনে যেয়ে আমি তো হতবাক। দেখি সেই অপ্রকৃতিস্থ লোকটি দাঁড়িয়েই আছেন যেভাবে তাঁকে ইশার নামায শেষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তার মানে লোকটি কি সারারাত এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন! সময় তখন সুবহে সাদিক। মসজিদের উঠোনে আমি আর লোকটি। সবাই ঘুমে এমনকি মসজিদের ইমাম সাহেবও। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মনে হল লোকটি বিরক্ত এবং বিরক্তিভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চোখ দুটো তাঁর একদম লাল হয়ে আছে। আমি তাঁকে সালাম দিলাম যদিও জানি না তিনি কোন মতবাদের। কখনো তাঁকে নামায পড়তে দেখিনি। আমার সালামের উত্তর না দিয়ে তিনি শুধু মাথা নিচু করে আবার ধ্যানে মগ্ন হলেন। দাঁড়িয়ে। আমি ধীর পায়ে মসজিদে প্রবেশ করে আযান দেওয়ার জন্য দাঁড়ালাম। ফযরের নামায শেষে দেখলাম লোকটি নেই। আমি ইমাম সাহেবকে লোকটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বললেন কয়েকদিন ধরে তাঁকে দেখা যাচ্ছে। সারারাত মসজিদের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর হলে পাহাড়ের দিকে চলে যায়। আমার মনোজগতে লোকটি বিশাল ঝড় বইয়ে দিলেন। মশার জ্বালায় মসজিদে দাঁড়িয়ে নামায পড়া খুব কষ্টের আর লোকটি সারারাত মসজিদের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁকে কি মশা কামড়ায় না? লোকটি আসলে কে? যা হওয়ার হবে, সিদ্ধান্ত নিলাম লোকটির সাথে কথা বলতে হবে। আমাকে জানতে হবে তিনি আসলে কে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল পরদিন থেকে লোকটি উধাও। উধাও মানে উধাও। পুরো এলাকায় আমি নীরবে তাঁকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি কারণ কাউকে তো আর বলতে পারছি না আমি কেন তাঁকে খুঁজছি। না, লোকটিকে আর দেখা যায়নি। আমার আর জানা হল না কে সেই আগন্তুক। কিন্তু তিনি কেন এলেন আবার কেনই বা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন? তাও আবার আমি ধরতে যাবার আগেই। আমার মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন উদয় হওয়া শুরু করল। একবার চিন্তুা করলাম মসজিদের পেছনে পাহাড়ে যেয়ে তাঁকে খুঁজবো কিন্তু ওই বয়সে কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমি সে চিন্তা বাদ দিলাম।
বিজ্ঞান বাদ দিয়ে আমি নিজের মতবাদের উপর লিখিত গ্রন্থগুলোর কাছে গেলাম। আর গ্রন্থগুলোর জন্য আমি কৃতজ্ঞ ঢাকাস্থ আমার সেজ চাচার নিকট। আমার কোন আবদারে তিনি কখনো না বলেননি। ইসলামের সূফি মতবাদের সাথে আমি লোকটির মিল খুঁজে পেলাম। অনেক গ্রন্থ পড়া থাকলেও সূফিবাদের উপর লিখা খুব কম পড়া হয়েছে। কিন্তু সূফিদের সাধনা তো অনেক কঠিন। একাকীত্ব আর নীরবতা তাঁদের অলংকার। কোলাহল থেকে তাঁরা অনেক দূরে। তবে এখানেও বিভিন্ন ধারার দেখা মেলে। আর এ যুগে কি সূফি আছেন? সূফি আর পীরের আবরণে যাদের দেখছি তারা তো একেকজন অন্ধ আর ভন্ড। অন্ধ কি কাউকে পথ দেখাতে পারে? কিন্তু গবেষণা করে দেখলাম একমাত্র সূফিবাদই ”সত্য” অর্জনের আহবান জানায়। সূফিবাদই বলে প্রমাণ ব্যতীত কোন কিছু মেনে না নিতে। বিজ্ঞানের সাথে আর আমার ইচ্ছার সাথে মিলে গেল। সূফির খোঁজে বের হওয়া যাক।
বলে রাখা ভাল বাহ্যিক আবরণ দেখে কাউকে বিচার করা যায় না। পোশাক তথা জোব্বা, টুপি, দাড়ি, শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবী, বোরকা, কোট-টাই, ধুতি-সিঁদুর, চীবর, ক্রুশ, ডেভিড তারা ইত্যাদির ভেতরেও যে শয়তান থাকতে পারে তা তো আমরা প্রতিদিনকার পত্রিকা খুললেই দেখতে পাচ্ছি। নইলে মাদ্রাসার হুজুররা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কেন ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়েন? বোরকার আড়ালে কেন ইয়াবার ব্যবসা চলে? শার্ট-প্যান্ট পরা আধুনিক যুবকেরা কেন তাদের মতো আরেকজন যুবককে মেরে ফেলে? ধুতি ওয়ালারা কেন মসজিদ ভাঙ্গে কিংবা পাঞ্জাবী ওয়ালারা কেন মন্দির ভাঙ্গে? চীবর ওয়ালারা কেন সমাজতন্ত্রের আড়ালে পুঁজিবাদ পোষে? ক্রুশ আর ডেভিডরা মিলে কেন পারমাণবিক জুজুর ভয় দেখিয়ে গোটা বিশ্বকে নিজেদের করায়ত্তে আনার দিবাস্বপ্ন দেখছে? সুতরাং জোব্বা, টুপি, দাড়ি, শার্ট-প্যান্ট, কোট-টাই, ধুতি-সিঁদুর, চীবর, ক্রুশ, ডেভিড তারা ইত্যাদি পরিহিত কেউ যদি অনর্গল তোতা পাখির মতো মতবাদ নিয়ে, পবিত্র গ্রন্থ সমূহ নিয়ে, সৃষ্টিকর্তা বিষয়ে কথা বলে আপনি কি প্রমাণ ব্যতীত তাকে মেনে নেবেন? যদি নেন তবে ধরে নেব রহস্যলোকের অনন্ত জালে আপনি আটকে গেছেন! মনে রাখা উচিৎ ’সত্য’র কোন পোশাক নেই। কিন্তু প্রমাণ আছে, আছে অনুভূতিও।
মোসতাক্বিমের পথ কোনটি, নেয়ামত কী এবং যাঁদের উপর নেয়ামত দান করা হচ্ছে তাঁরা কারা- এসবের খোঁজে আমি অনেক জায়গায় গিয়েছি কিন্তু সর্বত্রই উপরে নজরকাড়া বিজ্ঞাপনফলক (সাইনবোর্ড), নিজেদের মহাগুরু কিংবা সত্যের একমাত্র ধারক-বাহক বলে দাবি কিন্তু ভেতরে অন্ধত্ব আর ভন্ডামি। অবশ্য দাবি অনেক কিছুই করা যায় কিন্তু সেই দাবির পেছনে যদি সত্যতা না থাকে তবে সে দাবি সর্বৈব মিথ্যা। কোরআনে আছে ফিরআউনও নিজেকে ’সবচেয়ে বড় রব’ বলে দাবি করেছিল (তাই বলে কি তাকে রব বলা যাবে?), মুসাইলিমা বিন হাবিব (আল কাযযাব) নিজেকে ’নবী’ বলে দাবি করেছিল (তাই বলে কি তাকে নবী বলা যাবে?), কিছু ভন্ড-প্রতারক-লুইচ্চা-ফাউল নিজেদের পীর/গুরু বলে দাবি করছে (তাই বলে কি তাদের পীর/গুরু বলা যাবে?) আর এখন দেখা যাচ্ছে বড় বড় মাদ্রাসার, বড় বড় মসজিদের এবং বড় বড় দলের কিছু মুরব্বী হঠাৎ করে বলা নেই কথা নেই নিজেদের ’পীর’ কিংবা ’গাওসুল আযম’ দাবি করে মুরীদও বানানো শুরু করে দিয়েছেন! শোনা আর পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে শ্রদ্ধেয় ইমাম গাজ্জালী, শ্রদ্ধেয় মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি, শ্রদ্ধেয় ইবনে তাইমিয়া, শ্রদ্ধেয় আশরাফ আলি থানবী, শ্রদ্ধেয় মুফতী শফী, শ্রদ্ধেয় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, শ্রদ্ধেয় সাইয়েদ কুতুব, শ্রদ্ধেয় ত্বকী উসমানি, শ্রদ্ধেয় আহমেদ দিদাত, শ্রদ্ধেয় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, শ্রদ্ধেয় স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রদ্ধেয় কনফুসিয়াস, শ্রদ্ধেয় আলবার্ট আইনস্টাইন সহ আরো যতো বিদ্বান পৃথিবী জুড়ে আছেন তাঁদের গ্রন্থ আর দর্শন সমূহ জানলে কিংবা পড়লেই হয়ে যেত। কিন্তু শোনা কিংবা পড়া এক জিনিস আর দেখা কিংবা অনুভব করা আরেক জিনিস।
আমি আশা ছেড়ে দিলাম। নামাযে অনিয়মিত হয়ে গেলাম। নামায কেনই বা পড়ব? কেন বেগার খাটবো? তবে কি বিজ্ঞানই সঠিক? সবকিছু কি এমনি এমনি হচ্ছে? সৃষ্টিকর্তা বলে কি তবে কিছুই নেই? আমি কি হতাশ হয়ে যাচ্ছি? মনোজগতে আবার আমার ঝড় বইতে শুরু করল। আমার মানসপটে সেই অপ্রকৃতিস্থ লোকটির অবয়ব ভেসে উঠল। আমার মধ্যে আবার জেগে উঠল যে আমাকে তো জানতে হবে ’আমি কে’। জায়নামাযে বসে আমি কাঁদতে থাকলাম। আর বললাম, ইয়া আল্লাহ, সবাই আপনাকে ডাকে কিন্তু আমি আপনাকে খুঁজছি। সবাই জান্নাত কামনা করে কিন্তু আমি আপনাকে কামনা করছি। সবাই জাহান্নাম থেকে মুক্তি চায় কিন্তু আমি আপনাকে না পাওয়ার কষ্ট থেকে মুক্তি চাই। সবাই আপনার কাছে ধন-সম্পদ চায় আর আমি শুধুই আপনার সান্নিধ্য চাই। আমাকে আর কত ঘোরাবেন? আর কত কষ্ট দেবেন? যদি দেখা-ই না দেবেন তবে কেন আমাকে পৃথিবীতে পাঠালেন? কেন আপনি আড়ালে? আপনার কোরআন পড়লাম, আপনার রসূলের হাদীস পড়লাম, বড় বড় বিদ্বানদের বইগুলোও পড়লাম, মতবাদসমূহ সম্পর্কেও ধারণা নিলাম কিন্তু আপনাকে তো পেলাম না। তবে কি আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে? পৃথিবীর কোলাহলময় ভূমিকে আমার মরুভূমি বলে মনে হতে লাগল আর আমি যেন সেখানে পথহারা এক পথিক। সম্বল বলতে শুধুই নিজের জীবনটি। এবং সেটিও যেন বিপন্ন!
পার হয়ে গেল প্রায় দু’শত চন্দ্র আর দু’শত রবি নয়নের অশ্রুজলে। আমি একাকীত্ব পছন্দ করতাম বলে আমার বন্ধু-বান্ধবও কম ছিল। নিজেকে সবার নিকট হতে আরো গুটিয়ে নিলাম। এরপরও একজন বন্ধু কেন জানি আমার খোঁজ-খবর নিত। নামটি নাই-বা বললাম। মহাবিদ্যালয়ে পড়ার সময় হতে তার সাথে আমার পরিচয়। তার বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। মূলত পড়ালেখা সংক্রান্ত ব্যাপারেই যেতে হত। তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে। সে ছিল অন্য বিভাগের। বন্ধুটি আবার তার বাসায় আমন্ত্রণ জানাল অধ্যয়ন চক্রের (আমরা সে সময় বলতাম গ্রুপ স্ট্যাডি)। তার কম্পিউটার ছিল। আমরা গান শুনে শুনে আলোচনা করতাম। সেদিন সে গান শুনতে মানা করল। কারণ জিজ্ঞেস করলে জানাল তাদের বাসায় নাকি আজ পীর সাহেব এসেছেন। ’পীর সাহেব’ নামটি শুনে আমি প্রচুর হাসলাম। কত রথী-মহারথীর দরবারে যেয়ে ধরা খেয়ে এলাম আর তুই এসেছিস অজপাড়া গাঁ’র গলি-গুপচি’র পীর সাহেবের গল্প বলতে, আমি বললাম। আমার তাচ্ছিল্য ভাব দেখে সে একটু অবাক হল। জানাল তার পরিবারের সবাই উনার মুরীদ। সে মুরীদ কিনা জিজ্ঞেস করলে বলল তাকে মুরীদ করেননি। পীর সাহেব মুরীদ করেননি? মানে? এ আবার কেমন পীর? হাতের কাছে তরতাজা শিকার পেয়েও পীর সাহেব মুরীদ করেননি! আমার অভিজ্ঞতার সাথে তো মিলছে না। যেখানেই গিয়েছি শুধু শুনতাম মুরীদ হয়ে যাও, দলে ভিড়ে যাও সেখানে ’পীর সাহেব মুরীদ করেননি’ আমাকে একটু অবাক করল। কেন করেননি জিজ্ঞেস করলে সে জানাল উনার দরবারে পরীক্ষা ব্যতীত কাউকে মুরীদ করা হয় না আর হয়ত আমি পরীক্ষায় এখনো উত্তীর্ণ হতে পারিনি। আমি তাকে বললাম যে আমি একটা সমস্যা নিয়ে আজ অনেক দিন যাবৎ ঘুরছি, তোদের পীর সাহেবের সাথে আমি কি কথা বলতে পারব। বন্ধুটি আমাকে পীর সাহেবের কাছে যেয়ে সমস্যার কথা বলার অনুরোধ করলে আমিও সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। পীর সাহেব বসা ছিলেন তাদের অতিথি কক্ষে। বাড়িটি তাদের নিজস্ব, দোতলা। বন্ধুটি আমাকে তার সাথে নিচতলায় অতিথি কক্ষে নিয়ে গেল। অতিথি কক্ষে প্রবেশ করে আমি বিরাট একটা ঝাঁকুনি খেলাম। দেখি পীর সাহেব আরাম কেদারায় (সোফা) বসা আর আমার বন্ধুটির মাতা (নিজের ঘরের) মেঝেতে বসা! এত ভক্তি? আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার বন্ধুটিও দেখলাম মেঝেতে বসে গেল। কি আর করা, যেখানে বন্ধু আর বন্ধুমাতা নিজেরই ঘরের মেঝেতে বসা সেখানে আমিও অনেকটা বাধ্য হয়ে মেঝেতে বসে গেলাম এবং সেটিই প্রথম তাদের ঘরের মেঝেতে বসা। বন্ধুটি পীর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল, আমি শুধু মুখে সালাম দিলাম। তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আরো জিজ্ঞেস করলেন কী করি। আমার উত্তরের সাথে বন্ধুটি যোগ করে দিল আমার লেখালেখির ব্যাপারেও। আরো জানাল আমার সমস্যার কথাটিও যদিও আমি বন্ধুকে জানাইনি যে আমার সমস্যাটি কী। পীর সাহেব মুচকি হাসলেন আর জানালেন আমি যে সমস্যা নিয়ে ঘুরছি তার সমাধান ওনার কাছে আছে। আমি তো সমস্যার কথা উনাকে জানাইনি। উনি কি আসলেই আমার সমস্যা বুঝতে পেরেছেন? তবে শর্ত হল ওনার দরবারের সাপ্তাহিক মাহফিলে তিন দিন বসতে হবে। তিন দিন কেন প্রয়োজনে প্রতিদিন বসবো কিন্তু সমস্যার সমাধান না পেলে পত্রপাঠ বিদায়।
আমি নির্দিষ্ট দিনটির আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছি কারণ পীর সাহেবের দরবারের সাপ্তাহিক মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় শুধু ওইদিনই। মাগরীবের নামাজের পর হতে। সেদিন আমি বন্ধুর বাসায় আগেভাগেই চলে এলাম। সে আমাকে নিয়ে গেল দরবারে। তাদের বাড়ি থেকে একদম কাছে। কোরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস, ফিক্হ, শরীয়াহ্, তুলনামূলক মতবাদতত্ত্ব (ইসলাম, সনাতন, বৌদ্ধ, খিস্ট্র, ইহুদি ইত্যাদি), সাহিত্য, কবিতা, বিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানের অহংকারে আমার মাথা ভর্তি। তার উপর আবার দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ’আর কি শিখার আছে’ কিংবা ’আমাকে আবার জ্ঞান দেয় কে’ ভাব! দরবারে প্রবেশ করলাম। ইসলামি শরীয়াহ্-এর চর্চা দেখে ভাল লাগল তবে আমি তো শরীয়াহ্ শিখতে আসিনি। শরীয়াহ্ চর্চা করতে করতে শুধু ললাটে দাগ পড়া বাকি ছিল। কাজের কাজ হয়েছে শুধু শরীরের ব্যায়াম আর ’ছোওয়াব’ তাও আবার বাকি, পাওয়া যাবে শুধু মৃত্যুর পর (অন্যভাবে নেবেন না, আমি কিন্তু এখনো ইসলামি শরীয়াহ্-এর অনুসারী, বুঝাবার জন্য বলা)! পীর সাহেব কুরসিতে বসলেন। আমরা সবাই দরবারের মেঝেতে বসা। লোকজন হাতে গোনা, মহিলারাও আছেন তবে পর্দার আড়ালে। পীর সাহেব বলে যাচ্ছেন আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছি। অনেক কথা শুনেছি, অনেক গ্রন্থ পড়েছি, অনেক জায়গায় গিয়েছি কিন্তু আজ আমি কোথায় এলাম? আমি কেন এখানে আরো আগে আসলাম না? ছয়টি কোরআনের তাফসীর আমার পড়া কিন্তু এভাবে কোরআন ব্যাখ্যা কারো নিকট থেকে তো পেলাম না। ’শূন্য’ আর ’গায়েব’ তথা অদৃশ্য এক বিষয় নয়। গায়েব তথা অদৃশ্য মানে যা দৃশ্যমান নয় কিন্তু শূন্য নয়। শূন্য মানে কিছু নেই কিন্তু গায়েব আছে তবে পর্দার অন্তরালে। ওই পর্দার অন্তরালের বিষয়টিকে দৃশ্যমান করতে শক্তির প্রয়োজন আর সেই শক্তির নাম হল ’ঈমান’ যেভাবে অদৃশ্য ভাইরাস দেখার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র নামক শক্তির আশ্রয় নিতে হয়েছে। আর এই ’ঈমান’ শুধু মুখে উচ্চারণের বিষয় নয়, এই ’ঈমান’-এর ওজন আছে এবং এটা শরীরে জায়গাও দখল করে। এই ’ঈমান’ অর্জন করলেই জানা যাবে সূরা ফাতিহার মোসতাক্বিমের পথ কোনটি এবং নেয়ামত কী। আর এই ’ঈমান’ দিতে পারে শুধু তাঁরাই যাঁদের উপর নেয়ামত দান করা হচ্ছে। আর যাঁদের উপর নেয়ামত দান করা হচ্ছে তাঁদের সর্বত্র পাওয়া যাবে না, তাঁদের খুঁজে নিতে হয় নিজেকে আলোকিত করার জন্য কারণ এটা বিশেষ পথ, সবাই এখানে স্থান পাবে না। ভিআইপিরা কিন্তু সংখ্যায় নগণ্যই হয় এবং সবাই ভিআইপি হতে পারে না। পরিশ্রমীরাই শুধুমাত্র ভিআইপি হয়। আর কুলিরাই শুধু মাথায় করে পুস্তকের বোঝা বয়ে বেড়ায়। এখন সিদ্ধান্ত তোমার - আজীবন কুলিই থাকবে নাকি কৌশলী পরিশ্রম করে ভিআইপি হবে। শয়তান শয়তানি করার জন্য কিন্তু মহান আল্লাহ থেকেই শক্তি নিয়ে রেখেছিল কারণ সেও একসময় বড় ইবাদতি ছিল। তাই তার মোকাবিলা করতে হলে আমাদেরও মহান আল্লাহর নিকট হতে শক্তি অর্জন করতে হবে। এ শয়তানের শয়তানির জালে অনেক বড় বড় আরবি, ইংরেজি, বাংলা ইত্যাদি শিক্ষিতরা যে আটকে আছেন তা তারা নিজেরাও জানেন না। প্রায় ঘন্টা তিনেক তিনি মূল্যবান বক্তব্য দিলেন এবং আমাকে ধুয়ে ফেললেন। অনলের স্পর্শে মোম যেভাবে গলতে শুরু করে আমিও সেভাবে গলতে লাগলাম। এ প্রথম জ্ঞানের বিষয়ে আমি কারো কাছে নত হলাম যেভাবে ফিরআউনের ভাড়াটে জাদুকরেরা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম’র কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম পীর সাহেবের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে। সে যা জানাল তাতে আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। সূরা কাহাফে আমরা যে ’আবদুহু’ নামক মহামানবের সাক্ষাৎ পাই কোরআন কিন্তু তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কিছু বলেননি বরঞ্চ বলা হয়েছে তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান দান করা হয় এবং এভাবে যাঁদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান দান করা হয় তাঁদের কোন প্রথাগত শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকারই নেই। তো আমি এত বছর এত এত কষ্ট স্বীকার করে যে জ্ঞান অর্জন করলাম তা তো দেখছি যাঁদেরকে ’আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান দান করা হয়’ তাঁদের জ্ঞানের কাছে নস্যি। তবে আমাকে কিংবা সবাইকে কেন আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান দান করা হয় না? কারণ-
”তিনি হিকমত দান করেন যাকে তিনি ইচ্ছা করেন এবং যাকে দান করা হয় হিকমত নিশ্চয় তাকে দেয়া হয় প্রভূত কল্যাণ” (সূরা বাক্বারা, আয়াত ২৬৯)।
সুতরাং গায়ের জোরে গুন্ডা হওয়া যায় কিন্তু ’গুরু’ হওয়া যায় না। গায়ের জোরে, মাথার জোরে, টাকার জোরে, প্রতিভার জোরে অনেক কিছু চাইলে হওয়া যায় যেমন- শিক্ষক, মুফতী, মাওলানা, শায়খ, পীর, কবি, সাহিত্যিক, ধনী, মন্ত্রী, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ সহ আরো অনেক কিছু কিন্তু ’গুরু’ হওয়া যায় না। কারণ ’গুরু’ একমাত্র মহান আল্লাহর নির্বাচিত।
আবার চিন্তা করলাম তিনি হয়ত উনার গুরু থেকে শিখে শিখে সুন্দর সুন্দর যুক্তির কথাগুলো বলছেন। ঈমানী শক্তি যে অর্জনের বিষয় তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কোন বিশ্বাস নেই। তাই তিনবারের পর আমি একদিন সাহস করে গুরুকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলাম আমাকে যেন ঈমানী শক্তি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আমাকে নিরাশ করলেন আর বললেন পরীক্ষায় বসতে হবে। কিছু কাজ দিলেন আর সেগুলো করতে হবে ফযর আর এশার নামাযের পর। কাজগুলো হচ্ছে কোরআনের আয়াত আর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর প্রশস্তি (দরূদ শরীফ)। বললেন, কাজগুলো করা অবস্থায় যেদিন রহস্যলোকের কিছু দেখতে পাবে বুঝে নিও মহান আল্লাহ তোমাকে ’সত্য’ পথের পথিক করতে চাচ্ছেন এবং আমিও সেদিন ঈমানী শক্তি দান করব।
একরাশ হতাশা নিয়ে আমি চলে এলাম। বন্ধুর কথা মনে পড়ল, সে এখনো পরীক্ষায় আছে। আল্লাহকে পাওয়ার পথে এত পরীক্ষা! অথচ শয়তানের পথ কত মধুর আর মসৃণ! তাহলে যারা ওয়াজে, লেকচারে, মিডিয়ায়, লেখায়, চটকদার বক্তৃতায় আল্লাহকে পাওয়ার যেসব সস্তা আর হ্রস্বতর (শর্টকাট) পথের কথা বলেন সেগুলো কি আসলেই আল্লাহকে পাওয়ার পথ নাকি অন্যকিছু?
”যাকে আল্লাহ হেদায়েত করেন সুতরাং সে-ই হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং যাকে বিভ্রান্ত করেন তুমি তার জন্য কখনোই পাবে না কোন ওলি কোন মুর্শিদ” (সূরা কাহাফ, আয়াত ১৭)।
আয়াতটি পড়ে আমি আরো শংকিত বোধ করতে লাগলাম। যদি মহান আল্লাহ আমাকে হেদায়েত না করেন তবে তো আমি রহস্যলোকের কিছুই দেখতে পাবো না আর দেখতে না পেলে ঈমানী শক্তি অর্জন হতে বঞ্চিত হবো আর ঈমানী শক্তি অর্জন হতে বঞ্চিত হলে আমি তো জীবনভর অন্ধই থেকে যাব আর দশটা মানুষের মত। এ তো বিরাট একটা পরীক্ষা। ঘণ্টা যায়, দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় কিন্তু আমি রহস্যলোকের কিছু দেখতে পাই না। মানুষের সাথে রাগ, অভিমান, ঝগড়া করা যায় কিন্তু আল্লাহর সাথে নয়। অথচ আমার ইচ্ছা করছে আল্লাহর সাথে ঝগড়া করি! কাজ করে যদি ফলাফল না পাই তখন কি আর কাজ করতে ইচ্ছে করে? তবুও কাজ করে যাচ্ছি, আশা, যদি ’রহমান’ একটু দয়া করেন।
”নিশ্চয় আমরা ইহাকে নাযিল করি ক্বদর রাত্রির মধ্যে” (সূরা ক্বদর, আয়াত ১)।
তবে কি সেই রাত্রিটিই আমার জন্য ক্বদরের রাত ছিল? সেই রাতের স্বপ্নটির কথা আমি কখনো ভুলবো না। আমার প্রথম পরিচয়। রহস্যলোকে প্রবেশের প্রথম ধাপ। আমার পুরো জীবনটিই যেন কেঁপে উঠল! জীবনভর নামায পড়ে গেলাম, জ্ঞান সাধনা করে গেলাম, কত জনের কত কথা শুনলাম কিন্তু এরকম একটি স্বপ্ন কখনো দেখলাম না। কোরআন আবার বলছেন ক্বদর রাত্রি হাজার মাস হতে উত্তম। হাজার মাস পার করতে আমার বয়স হতে হবে ৮৪ অথচ আমি ৮৪-এর অর্ধেকেরও কম। আমার মনে হতে লাগল পৃথিবীতে আগমন যেন আজ আমার সার্থক হল। আমার মত এত বড় একজন অপদার্থ, অথর্ব আর পাপীকে মহান আল্লাহ এত উঁচুতে নিয়ে যাবেন - এ যে আমার স্বপ্নেরও অতীত। আমার মানসপটে ভেসে উঠল গুরুর পবিত্র মুখাবয়ব। মস্তকে সাদা কাপড়ের টুপি, কায়ায় সফেদ পোশাক, চেহারা গুরুগম্ভীর। শরীয়তের চাদরে মোড়া কিন্তু রহস্যময়। এত এত জায়গায় গেলাম, এত এত লোকের সাথে সাক্ষাৎ করলাম কিন্তু কেউই প্রমাণের কথা কিংবা পরীক্ষার কথা বললো না (বলবেই বা কীভাবে, কোন অন্ধ কি কাউকে পথ দেখাতে পারে?)। অথচ গুরুই বললেন প্রমাণের কথা এবং পরীক্ষার বিষয়েও। আবার মনে পড়ল সেই কিশোর বয়সের অপ্রকৃতিস্থ লোকটির কথা। আমার রহস্যলোকের সূচনা তো তিনিই। কিন্তু শরীয়তের লেশমাত্র তাঁর মধ্যে নেই। গুরুর সাথে দেখা করার জন্য আমার মনটা অস্থির হয়ে উঠল আবার ভয়ও পাচ্ছি যে তিনি আমাকে গ্রহণ করবেন তো।

সেই দিনটির সাথে আমার জীবনের অন্য কোন দিনের তুলনাই চলে না কারণ সেদিন পৃথিবীতে আমার যেন দ্বিতীয় জন্ম হয়েছিল। আমাকে সবকিছু নতুন করে ভাবতে হয়েছে সেই দিনটির পর হতে। আমি যেন এক অদৃশ্য সংযোগের আওতায় প্রবেশ করলাম। নিজে অনুভব করছি কিন্তু কাউকে বুঝাতে পারছি না যেভাবে পিপীলিকার কামড়ের ব্যথা কাউকে বুঝানো যায় না। তাহলে খুলেই বলি। স্বপ্নের ব্যাপারটি বলার জন্য দুরুদুরু মনে গুরুর দরবারে উপস্থিত হলাম। গুরু আসনে বসা আর আমি মেঝেতে। কী বিষয় জিজ্ঞেস করতেই আমি সাহস করে স্বপ্নের কথাটি বলতে যাবো অমনিই গুরু বললেন নামাযে যেভাবে বসে আমি যেন সেভাবে বসি। আমি বসলাম। আবার জিজ্ঞেস করলেন উনার কাছে আসার ব্যাপারে কিংবা উনার নিকট থেকে ঈমানী শক্তি নেওয়ার জন্য কেউ আমাকে প্ররোচিত করেছে কিনা। আমি না সূচক উত্তর দিয়ে বললাম যে আমি প্রমাণ পেয়ে এসেছি।
- কী সেই প্রমাণ? গুরুর প্রশ্ন।
- গত দু’দিন আগে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি …
- তুমি যে জিনিসটি চাচ্ছো সেটি আমার নিকট থেকে পাওয়ার ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ আছে?
- আমার কাছে সব এখন স্পষ্ট। কোন সন্দেহ নেই।
- আলহামদুলিল্লাহ। চোখ বন্ধ করো আর কল্বের (হৃৎপিন্ড) দিকে মনকে নিবিষ্ট করো। তোমার ভেতর ঈমানের আলো প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছি। চাইলে তুমি এ আলোকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করতে পারো অথবা নিভিয়ে ফেলতে পারো। যত উজ্জ্বল করবে ততই তোমার ইলমে লাদুন্নী (আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান) বৃদ্ধি পাবে এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হবে আর নিভিয়ে ফেললে আবার সেই শয়তানের আড়তে ঢুকে যাবে এতোদিন যেখানে ছিলে। আমি কি তোমাকে বুঝাতে পেরেছি?
আমি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। গুরু কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন এবং আমাকেও সাথে সাথে পাঠ করতে বললেন। আমি পাঠ করলাম। এরপর আবার বললেন কল্বের (হৃৎপিন্ড) দিকে মনকে নিবিষ্ট করতে। গুরু মন্ত্র পাঠ করছেন। আমি চুপ থেকে চোখ বন্ধ করে নিজের অন্তরের দিকে ধ্যানে নিবিষ্ট হলাম। হঠাৎ কী যেন হল, আমার পুরো হৃৎপিন্ড কেঁপে উঠল! আমি একটু ভয় পেলাম। গুরু আর আমার মধ্যে দু’মিটারের মতো দূরত্ব। মাঝে কোন কিছু নেই, ফাঁকা। কিন্তু তিনি মন্ত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে কী এমন নিক্ষেপ করলেন যে আমার পুরো অন্তর নড়ে উঠল! এবং সেখানে কী যেন পুনঃপুন ধ্বনিত হচ্ছে! আরো আশ্চর্যের বিষয় হল ওই কম্পন বন্ধ হচ্ছে না (এখনো চলছে)। তবে কি আল্লাহর জিকির এটাই?
”নিশ্চয় আমরা জিকির নাযিল করি” (সূরা হিজর, আয়াত ৯),
”এবং এই জিকির বরকতময় যা আমরা নাযিল করি” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৫০)।
গুরু আমাকে চোখ খুলতে বললেন। আমি চোখ খুললাম, বাহ্যিক চোখ অথচ আমার ভেতরে যে হাজারো চোখ আছে সেসব খুলে গেল। জিজ্ঞেস করলেন আমি কিছু অনুভব করেছি কিনা। আমি পরম কৃতজ্ঞতায় হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। গুরু খুশি হলেন আর বললেন আগে যে কাজগুলো দিয়েছেন সেসবের সাথে আরো একটি যোগ হবে আর তাহল মাগরীবের নামাযের পর ফাতেহা পাঠান্তে মোরাক্বাবা তথা ধ্যান করা। আরো বললেন যে উনার এ আধ্যাত্মিক সাধনায় মোট শ্রেণীর সংখ্যা বিয়াল্লিশটি আর আমি মাত্র প্রথম সোপানে। যত সাধনা তত উন্নতি।
এর পরের ইতিহাস আশ্চর্য আর অলৌকিকতায় ভরপুর। সাধারণ্যে এসব বর্ণনার ব্যাপারে গুরুর কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে তাই আমাকে সমাপ্তি টানতে হচ্ছে। তারপরও অনেক গোপন কথা বলে ফেললাম যারা বুঝার বুঝে নিন। বিজ্ঞান এখনো কাছের গ্রহেও যেতে পারেনি অথচ ’ইসলাম’ আমাকে এমন স্থানে নিয়ে গিয়েছে যেখানে বিজ্ঞান আদৌ যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। আর হ্যাঁ, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি আমি এখন মোসতাক্বিমের পথে আছি। কোন সন্দেহ নেই আমার অন্তর ঈমানী শক্তিতে ভরপুর, বেশি টের পাই নামাযে দাঁড়ালে, মোরাক্বাবা তথা ধ্যানে আর কোন কামেল ওলীআল্লাহ’র মাযারে গেলে। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে করে মহান আল্লাহর রহমতে আধ্যাত্মিক সাধনার বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে এসেছি, আলহামদুলিল্লাহ। প্রত্যেক ধাপেই শত্রু হিসেবে পেয়েছি প্রথমে জ্বীনকে, তারপর শয়তান এবং শেষে নিজের নফসকে। অদম্য সাহস, শক্ত মনোবল এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহর রহমত না থাকলে এ পথে থাকা এবং এগিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ’ইসলাম’র ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে দেখবেন অপার সব রহস্য, পবিত্র সৌন্দর্য আর প্রশান্তি। আছে আরো অনেক বিষয় যেগুলো বলতে গেলে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মত আমার কণ্ঠদেশ কর্তিত হবে।
সুতরাং মানুষের প্রশংসা কিংবা ঘৃণা কিংবা ভয় কোন কিছুরই আর পরোয়া করি না। পরোয়া করি না বেঁচে আছি না মরে গেছি। পরোয়া করি না দিনের আলো কিংবা রাত্রির তমসা। যেদিকেই তাকাই শুধুই একজনকেই দেখি। আল্লাহ।
বিশাল এ পৃথিবীতে রহস্যলোকের জ্ঞান মানুষদের অন্তরে দেয়ার জন্য সবসময় কিছু মহামানব থাকবেন তবে তাঁরা সংখ্যায় খুব অল্প আর আপনার কাজ হল তাঁদের খুঁজে নেয়া। খুঁজে পেলে তো ভাল (যদিও খোঁজার লোক খুব কম) আর না পেলে আমি অধম তো আছিই। প্রেমিকদের জন্য গুরুর দরবার সবসময় খোলা।
’সত্য’ অর্জন করার পর হতে আমি আমার লেখার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছি। আমার প্রতিভা ছিল কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, গানে আর জ্ঞানে। কিন্তু মহান আল্লাহ আমায় যা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন তার কোন তুলনা নেই। অন্ধত্ব আর ভন্ডামোর পৃথিবীতে মানুষ ’সত্য’ হতে অনেক দূরে পড়ে আছে। আমি দায়িত্ব নিয়েছি ’সত্য’টা জানিয়ে দেয়ার। গ্রহণ করা না করা যার যার ইচ্ছা আর নিয়তির ব্যাপার!
আমি কৃতজ্ঞ মহান আল্লাহর কাছে, কৃতজ্ঞ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর কাছে এবং কৃতজ্ঞ প্রাণপ্রিয় গুরু তথা মুর্শিদের কাছে।
”হে আমানুগণ, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার উলিল আমরগণকে” (সূরা নিসা, আয়াত ৫৯)।
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×