(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
[টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা]
বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলা হতে বেরিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির মোড়ে চলে আসি। দুপুরের তপ্ত রোদ। তবে তেমন গরম অনুভূত হচ্ছে না। এর মধ্যে জানতে পারি মিম নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েট করছে টেক্সাসের রাইস বিশ্ববিদ্যালয় হতে। খন্ডকালীন কাজে জড়িত আছে একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থার সাথে। অধ্যয়ন এবং পেশাগত, দুটো কারণেই তার বাংলাদেশে আসা। উঠেছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকায়। এতটুকু একটি মেয়ে এতগুলো কাজের সাথে জড়িত! আবার একা একাই দেশ বিভূঁইয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে আমি কী করছি? কুনোব্যাঙের মতো ঘরের কোণে বসে বসে বাবার হোটেলের অন্ন নষ্ট করছি! নিজের উপর কেন জানি বেশ রাগ হচ্ছে। আমি কি ঈর্ষান্বিত?
- বইটির ব্যাপারে বলতে হলে আরো অনেক কিছু অর্থাৎ প্রেক্ষাপটটাও তোমাকে জানতে হবে। আমার অধ্যয়ন ও গবেষণার একটি অংশের জন্যও বইটি জরুরী।
- তুমি গবেষণাও করো?
- না না, কোন একাডেমিক গবেষণা নয়, এটা আমি করি নিজের জানার জন্য। নেশাও বলতে পারো।
- বাহ, চমৎকার। তা তোমার গবেষণার বিষয় কী?
- এই, আমার দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। আমার সাথে হোটেলে চলো। একসাথে লাঞ্চ করব।
- মোটে বারোটা বেজে দশ।
- তো? আর কখন খাবে?
- না, মানে আমরা আরো দেরীতে দুপুরের আহার করি। আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমার অতিথি। আজ আমি তোমাকে খাওয়াবো।
- না না, নিজেকে অতিথি দাবী করে আমি কোন প্রকার সুবিধা নিতে অনিচ্ছুক। যেখানে তুমি নিজেই বলেছ তুমি বেকার সেখানে আমাকে কীভাবে খাওয়াবে?
আমার প্রচন্ড হাসি পেল। রীতিমতো অট্টহাসি। আমরা উভয়ে হাসলাম।
- বেকার মানে এই নয় যে আমার থেকে কানাকড়িও নেই। খাওয়াবো যখন বলেছি, দায়িত্ব নিয়েই বলেছি। এখন বলো, কাচ্চি চলবে?
- কাচ্চি? এটা আবার কী?
- ও, আমি তো ভুলেই গেছি যে তুমি পরদেশী।
আমি কাচ্চি বিষয়ে ছোটখাটো একটি বর্ণনা দিলাম। সে খেতে রাজি হল।
- খাবার দোকানটি কি আশপাশেই?
- না, সামান্য দূরত্ব। রিকশায় গেলে বিশ মিনিট আর গাড়িতে দশ।
মুখ ফসকে রিকশা বলে আমি নিজেই আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। এখন যদি মিম রিকশায় যেতে চায় তবেই সেরেছে। ঢাকা শহরে অপরিচিত মেয়ে নিয়ে রিকশায় চড়া মানেই বিপদ। এ সময় মিম আমাকে আমাদের সম্মুখ দিয়ে যাওয়া একটি রিকশার দিকে দেখিয়ে বলল,
- রিকশঅ বলতে কি এটাকেই বুজাচ্ছো?
- হ্যাঁ। দাঁড়াও, আমি উবার কল দিচ্ছি।
- না না, আমরা রিকশঅ করেই যাবো। আমার খুব ইচ্ছা এটাতে চড়ার। একা একা ভয় লাগে।
- আসলে, দেখতেই পাচ্ছো, রিকশার আসনটি খুব বেশি চওড়া নয়। দুজন বসলে ..
- কেন, ঐ যে দেখ, দুজন তো অনায়াসেই যাচ্ছে। তুমি কি সংকোচ করছো? তাও আবার অতিথির সাথে?
- ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা একটি বিশ্বমানের হোটেল যার রেটিং ফাইভ স্টার। সেই হোটেলের একজন বাসিন্দাকে ..
- আমার রেটিং তো আর ফাইভ স্টার নয়। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। হ্যালো রিকশঅ ..
আমি আর মিম রিকশায়। গন্তব্য বেইলি রোডস্থ ‘কাচ্চি খাই’ রেস্টুরেন্ট। আমি যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে বসেছি কিন্তু রিকশায় কি আর দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব? মিম খুব খুশি রিকশা চড়তে পেরে। তবে একটু সন্তপ্ত রিকশাচালকের কায়িক পরিশ্রম দেখে। ঘামে রিকশাচালকের পরনের কাপড় ভিজে পৃষ্ঠদেশের সাথে লেপ্টে আছে। আমি মুখে মাস্ক আর চোখে রোদচশমা লাগিয়ে নিলাম। পরচর্চা আর পরশ্রীকাতরতা এদেশের অধিকাংশ মানুষের একটা বাজে বৈশিষ্ট্য। সেটাকে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। এসব এলাকায় আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক বন্ধু-বান্ধবীর বসবাস। কেউ একজন দেখলেই হবে, সোজা মা’র কর্ণে চলে যাবে। সবাই আমাকে নিপট ভদ্রছেলে বলেই জানে। মেয়ে-ছেলে নিয়ে ঘুরোঘুরি আমার ক্ষেত্রে বলা যায় অকল্পনীয়।
- তোমার দেশে এত মানুষ এত কোলাহল, এখানে নিশ্চিন্তে বাস করাই তো দায়। অবশ্য আমি আগেই জেনেছি তোমার দেশ যে ঘনবসতিপূর্ণ। আমাদের দেশে এ সময়টাতে পথে-ঘাটে মানুষের দেখা পাওয়াই দায়।
- এটা শুধু আমাদের রাজধানী ঢাকা আর আরেকটা শহর চট্টগ্রামেই দেখবে। বাকি অংশ মরুভূমি।
- তুমি এভাবে বসেছ কেন, পড়ে যাবে তো। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব কেন থাকবে? তুমি কি আমাকে এখনো যুবতীই মনে করছো?
- না না, আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তুমি আরামে বসতে পেরেছ তো, হাজার হোক আমার দেশের অতিথি।
- বাহ! অতিথির কী সমাদর। আচ্ছা, তোমার সম্বন্ধে তো বললে না। তুমি কি আসলেই কিছু করো না?
(চলবে) ১ম পর্ব