১.
ঢাকাই সিনেমার সাথে আমার সম্পর্ক ২০০০ সাল থেকে।খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় আমার বাবার একটি শুটিং স্পট ছিল।প্রতি মাসেই দুই একটি শুটিং ইউনিট আমাদের এখানে আসতো শুটিং করতে।সেই সুবাদে ঢাকাই সিনেমার সাথে কিছুটা হলেও ভালভাবে জানাশোনা ছিল।এক সময় ঢাকাই সিনেমার যে আবেদন ছিল,এখন তার চার ভাগের এক ভাগও নেই,হারিয়ে গেছে সময়ের পরিক্রমায়।মূলত ১/১১ এর পর থেকে দেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতি বা অবনতি যা হয়েছে,সে বিতর্ক অন্যরা করবেন।কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে,বিশেষ করে চলচ্চিত্র অংগনে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে,যদিও একনকার দিনগুলিতে সেই ক্ষতি অনেক টাই পূরন পুষিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।
মধ্যবিত্তররা সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখে না।মধ্যবিত্তরা একটু বেশিই ঘরকুনো।আর ডিভিডি,ডিশ আর ইন্টারনেটের এই যুগে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম।উচ্চবিত্ত দের কথা না হয় বাদই দিলাম।কারন কিছু কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া উচ্চবিত্তরা ইংলিশ আর হিন্দী ছবি দেখে।ঢাকার সস্তা বাংলা ছবি দেখার সময় তাদের নাই।তাহলে বাংলা ছবির দর্শক কারা?উত্তর অবশ্যই নিম্নবিত্ত প্রান্তিক শ্রেনির লোকজন।এখন এই নিম্নবিত্ত শ্রেনির লোকজন সিনেমা হলে যায়,পকেটের টাকা খরচ করে টিকিট কিনে ছবি দেখে আর্ট ফিল্ম দেখার জন্য নয়, সহজ ভাষায় বলতে গেলে নিম্নবিত্ত শ্রেনির লোকজন সিনেমা হলে যায় সেক্স ফ্যান্টাসি করার জন্য,নায়িকার দেহের ভাজে ভাজে তারা যৌন সুড়সুড়ি পায় বলেই তারা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে,অন্যথায় কখনোই তাদের হলমুখি করা সম্ভব না,বর্তমান সময়ে আমরা তার প্রমান দেখতে পাচ্ছি।
ঢাকার শ্যামলী সিনেমার কথাই ধরা যাক।সারাদেশে যখন মনপুরা ছবির জয়জয়কার,তখন শ্যামলী সিনেমা হলে আলেকজান্ডার,ময়ূরী,মুনমুন অভিনীত পুরাতন মশলাদার ছবি চালিয়ে দর্শক টানা হয়েছে।কারন শ্যামলী সিনেমা হলের সব দর্শক কারওয়ান বাজারের শ্রমিক।মনপুরার মত ভালো ছবি গুলো তাদেরকে বিনোদন দিতে পারে না।তারা ময়ূরী, মুনমুন, পলির মত নায়িকাদের আবেদনময়ী দেহ দেখেই নিজেদের কল্পনার জগত সাজায়।
২.
চলচিত্রে অশ্লীলতা নিয়ে সবচেয়ে সরব থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেনী,আর যাত্রাপালার বিরুদ্ধে থাকে মৌলবাদি শ্রেনির লোকজন।মধ্যবিত্ত শ্রেনির লোকজন কে কখনোই সেভাবে হলমুখী করা যায় নি।সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ভালো ভালো ছবি নির্মিত হচ্ছে।কিন্তু ফলাফল শূন্য।ভালো ছবি বানালে সেই ছবির খরচ ওঠে আসবে কিনা,সেটা নিয়েই চিন্তায় থাকতে হয়,মুনাফার কথা বাদই দিলাম।
চলচিত্রের সাথে যারা জড়িত,তাদের সবাই যে চলচিত্রকে ভালোবেসে এটার সাথে জড়িত এমনটা নয়।মুনাফা করতে না পেড়ে বেশিরভাগ হল মালিক হল বন্ধ করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মান করেছেন,মার্কেট করেছেন।২০০৫ সালের দিকে সারাদেশে সিনেমা হল ছিল প্রায় সাড়ে সাতশোর কাছাকাছি।সেখানে আজকে ১৫০ এর বেশি হল আছে কিনা সন্দেহ।আমার জন্মস্থান খাগড়াছড়ি, তার পাশের জেলা রাংগামাটি সহ আরো বেশ কিছু জেলায় একটিও সিনেমা হল নেই।কারন অশ্লীলতা বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালানোর সময়ে এই সব অঞ্চলের হল গুলো আর্ট ফিল্ম টাইপের ছবি দিয়ে দর্শক টানতে পারে নি।তাই একরকম বাধ্য হয়েই হল গুলো বন্ধ করে দিয়েছেন।
চলচিত্র জগতের সাথে জড়িত থাকার সুবাধেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।এই সময়ের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে,বাংলা চলচিত্রের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত কে দাড় করিয়েছে মিডিয়া।আমাদের ঢাকাই ছবির কোন নায়িকা যদি নায়কের সাথে অন্তরঙ্গ বা ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করে তখন সেটা অশ্লীলতা,আর বলিউড এর ইমরান হাশমি আর মল্লিকা শেরওয়াতের সাথে বিছানার সিনে অভিনয় করে,সেটা হয়ে যায় আর্ট। আমাদের ময়ূরী কিংবা মুনমুন হোক,কিংবা বর্তমান সময়ের ববি,পরী এরা একটু শর্ট পোশাক পড়লেই এরা অশ্লীল,আর বলিউডের কারিনা,ক্যাটরিনারা বিকিনি পরলে তারা সাহসী।
৫০ বছরের ও বেশি সময় অতিক্রম করে এসেছে আমাদের চলচিত্র শিল্প।৫০ বছর কম সময় নয়।কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও আমাদের চলচিত্র মাথা উচু করে দাড়াতে পারেনি।এখনো সময় আছে চলচিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।অন্যথায় ক্রমেই এই ধ্বংসপ্রায় শিল্প একদিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে,সেদিন আর বেশি দূরে নয়।