এক আকাশ ভরা ঔদাসীন্য সব সময় ওই মুখে বাসা বাঁধে। পাশাপাশি সঙ্গী হয় যত রাজ্যের নির্লিপ্তি। খুব মন দিয়ে খুঁজলে ওই উদাস মুখের সালোকসংশ্লেষে হয়তো এক চিলতে অসামান্য হাসিও পাওয়া যেতে পারে। হয়তো। ঠিক নিশ্চিত নই। এক রাখাল বালক যেন। সব সময় ওই অর্ন্তলীন দৃষ্টি একই রকম প্রশান্ত। আবার ভীত, হতচকিত। ‘কী করি, কী করি’ ভাব। একই সঙ্গে চার পাশে ঘুরছে কৌতূহলী দু’চোখ।
জার্মানি বিশ্বকাপে টিম স্পনসর আদিদাসের জন্মভূমি হার্জেগোনার্চ গ্রামে প্র্যাক্টিস করত আর্জেন্টিনা। সেখানে মাঠে আসার সময় মেসির ওই দৃষ্টি। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে প্রিটোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে প্র্যাক্টিস করাতেন মারাদোনা। ট্রেনিং সেরে বেরোনোর মূহূর্তে মেসির ওই দৃষ্টি। কলকাতার হায়াত রিজেন্সি হোটেলে লবির ডানদিকের লিফট থেকে হলের দিকে হাঁটার সময়ও। ভীত, হতচকিত। “কী করি, কী করি” ভাব। লিওনেল মেসিকে মাঠের বাইরে অনেক বার দেখে এ রকম লিখতে ইচ্ছে হলো।
আপনার-আমার মতোই তিনি যেন জানেন না, অচেনা লোকের সামনে পড়লে ঠিক কী করা উচিত। সঙ্কুচিত খুব। নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। তার বিপন্ন শৈশব, গ্রোথ হরমোনের অভাবে চারপাশের হতাশা, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার অসহায়ত্ব এখনও মনে হয় সারাক্ষণ ধাওয়া করে যায় মেসিকে। এই ছেলেটি মাঠের মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে মুখের অবয়বই পাল্টে যায়। দুটো বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্র্যাক্টিসের স্মৃতি উপুড় করে দেখি, মেসি মাঠের মধ্যে বিষণ্ণ ঔদাসীন্য পলকে মুছে পূর্ণাঙ্গ যুবক হয়ে যেতেন। বল পায়ে পড়লে বিশ্বের সব আলো ফিরে আসে চোখেমুখে। এটা তার নিজস্ব পৃথিবী। বল পায়ে তখন তার নড়াচড়ার মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব। আকাশের পাখির মধ্যে যা থাকে। মাঠের বাইরের রাখাল বালক মাঠের ভিতরে বিজ্ঞানী হয়ে যায় পলকে। সব সময় কিছু তৈরির চেষ্টা। সৃষ্টিতে অন্য সুখ। প্র্যাক্টিস শেষ হলেই তিনি আবার রাখাল বালকের জগতে। ঔদাসীন্য, নির্লিপ্তি, লজ্জা সমস্ত মিলিয়ে আবার একটা ঘোরে পাওয়া মুখ। এই দৃশ্যপটই হয়তো চূড়ান্ত ফোকাসে থাকার শর্ত!
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণে কোনো জায়গায় মেসি গত দেড় বছরে উসেইন বোল্টের মতো গতি বাড়িয়ে অন্যদের সবাইকে পিছনে ফেলে দিলেন? বা একটু ঘুরিয়ে- কী আছে মেসির, যার জন্য তার সঙ্গে পেলে-ম্যারাডোনা-দি’স্তেফানো-পুসকাসের সঙ্গে তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে?
চারটে আকর্ষণীয় তথ্য বলতে ভুলে যাব। এখানেই সাজিয়ে দিই।
ক. একটা ফর্মুলা ওয়ানের গাড়ি যতবার টার্ন নেয়, দিক বদল করে, একটা ম্যাচে তার চেয়ে বেশি টার্ন নেন মেসি। হাজার থেকে দেড় হাজার বার।
খ. মেসি লাফানোর সময় যা শক্তি তৈরি করেন, তা একটা চিতার লাফানোর সমান।
গ. বিজ্ঞানের বিচারে মেসি সাতজন মানুষের সমান শক্তি তৈরি করতে পারেন।
ঘ. বার্সেলোনা থেকে রিয়াল মাদ্রিদের মাঠ পর্যন্ত দৌড়নোর জন্য যা স্ট্যামিনা দরকার, তা মেসির রয়েছে।
মেসি যখন খেলা শুরু করেছিলেন, তখন চারপাশে কত সমান আকর্ষণীয় মুখ ছিল। রোনাল্ডো, কাকা, রুনি, জাভি, দ্রোগবা, তোরেস, ইনিয়েস্তা, ফোরলান, স্নাইডার, ফান পার্সি, রবিনহো, নেইমার। পাণ্ডবদের স্বর্গযাত্রার মতো সবাই আস্তে আস্তে খসতে শুরু করেছেন। রোনাল্ডো বনাম মেসি, এই তর্কটা অনেক দিন পর্যন্ত হয়েছে। অনেক দিন পর্যন্ত, প্রাক্তন ফুটবলারদের ইন্টারভিউতে উঠে এসেছে একটা প্রশ্ন। মেসি বড়, না রোনাল্ডো?
খেয়াল করেছেন আর একটা ব্যাপার? মেসি বনাম রোনাল্ডো সংক্রান্ত প্রশ্নটাও আর বেশি ওঠে না। রোনাল্ডোর জন্য দুঃখ হয় মাঝেমাঝে। রিয়াল মাদ্রিদে অসংখ্য গোল করেও শেষ দু’বছরে ‘সি আর সেভেন’ কেমন চাপা পড়ে গেছেন ‘এল এম টেন’ এর কাছে। আধুনিক ফুটবলের যাত্রাপথে যুধিষ্ঠির হয়ে একা দাঁড়িয়ে লিওনেল আন্দ্রে মেসি।
কী তার অস্ত্রশস্ত্র? কবে আর্সেন ওয়েঙ্গার বলেছিলেন, “মেসি একেবারে প্লে স্টেশনের মতো।” কমপিউটার আর শিল্প মেশানো মেসির ফুটবল দেখলে সেটাই মনে পড়ে যায়। আজ যা করবেন, কাল তা করবেন না। তাই বিপক্ষ স্টপারদের ‘জান’ যায়। বল পায়ে পড়লে যে কোনও জায়গায় তিনি সৃষ্টিশীলতার উৎকর্ষে পৌঁছে যান। মেসি একটা নদীর নাম তখন। বাঁকে বাঁকে বৈচিত্র।
রোনাল্ডো নানা রকম ড্রিবলিং করতে পারেন। রোনাল্ডিনহো প্র্যাক্টিসে যা চেষ্টা করেন, ম্যাচে সেটা দেখাতে যান। মেসির ড্রিবলিং আবার স্বতঃস্ফুর্ত। লুই ফিগো এটাকেই বলতে চেয়েছেন, “মেসিকে দেখার আনন্দ সঙ্গম করার আনন্দের সমান।”
মেসি-নদীকে অন্য মহিমা দিয়েছে তার গোটা কুড়ি গুণ।
১. ছোট-বড় সব ম্যাচে সমান ধারাবাহিকতা।
২. বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠা।
৩. অকস্মাৎ গতি বাড়ানোর দক্ষতা।
৪. নিখুঁত থ্রু পাস
৫. চমৎকার ড্রিবলিং।
৬. শরীরের নিখুঁত ভারসাম্যে বিপক্ষের কড়া ট্যাকলেও পড়েন না। ডজ করে বেরিয়ে যান। সেন্টার অব গ্র্যাভিটি কম, কিন্তু শরীরের নীচের অংশ শক্তিশালী।
৭. টার্নিং, ছোট জায়গায় ঘুরতে পারা।
৮. চেকিং, এক দিকে যেতে গিয়ে অন্য দিকে চলে যাওয়া।
৯. পরের পদক্ষেপ ভেবে নেওয়া। প্রথম পাসিংয়ের সময়ই জানেন, তিন নম্বর পাসটা কোথায় যাবে।
১০. দ্রুত স্টাইল বদলানো।
১১. গোল করার পাশে গোল করানোর দক্ষতা।
১২. ডিফেন্ডারের ভুলের জন্য অপেক্ষা করেন। তার পরে তাঁকে আরও বড় ভুল করতে বাধ্য করেন।
১৩. দারুণ ইনসাইড কাট।
১৪ . সেট পিসে প্রতিদিন উন্নতি।
১৫. শান্ত মানসিকতা, রেফারির সঙ্গে তর্ক করে খেলাটা ভোলেন কম।
১৬. কোচের প্লেয়ার।
১৭. দৃষ্টিভঙ্গি।
১৮. অ্যাটাকিং থার্ডে সব জায়গায় সমান স্বচ্ছন্দ।
১৯. বাঁ পা-টা তীক্ষ্ম হলেও ডান পা’টা খুব খারাপ নয়।
২০. স্ট্যামিনা আর দায়িত্ববোধ। কলকাতায় দশ ঘন্টা বিমানযাত্রা করে ভোর চারটেয় শহরে ঢুকে বিকেল ছ’টায় ট্রেনিংয়ে। তার আগের দিন আবার বার্সেলোনার হয়ে খেলেছেন ‘এল এম টেন’।
এ তো বললাম, ‘সব আছে’! অনেক ‘নেই’ও মেসিকে অসাধারণত্বের পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছে। রোনাল্ডোর মতো গোলের মুখে ডাইভ নেই। রোনাল্ডিনহোর মতো নৈশ জীবন নেই। দ্রোগবার মতো কোচের সঙ্গে ঝামেলা নেই। রাইকার্ড বা মারাদোনা, সাবেয়া বা গুয়ার্দিওলা, যিনিই কোচ হোন, মেসি বাধ্য ছাত্র। রুনির মতো মাঝেমাঝেই বিতর্কিত কথাবার্তা নেই। স্নাইডার বা তোরেসের মতো চূড়ান্ত উত্থান-পতন নেই।
শো অফ না করে, বিতর্কিত কথা না বলেও যে দারুণ খেলোয়াড় হওয়া যায়, সাম্প্রতিক বিশ্বক্রীড়ায় উদাহরণ অনেক। টাইগার উডস, সচিন তেন্ডুলকর, রজার ফেডেরার, নোভাক জকোভিচ, জাক কালিস, ইলিনা ইসিনবায়েভা, রাহুল দ্রাবিড়। মেসিও এই দলে পড়বেন। তার আর্জেন্তেনীয় প্রেমিকা আন্তনেলা রোকুজো পর্যন্ত আড়ালেই থাকেন। লক্ষ্য করছেন কি, এই চুপচাপ, অ-বিতর্কিত সফল ক্রীড়াবিদদের সংখ্যাটা আরও বাড়ছে?
মেসির আর একটা কৃতিত্ব সম্ভবত সমসাময়িকদের সম্মান অর্জন। যা সাধারণত জোটে না। একবার শুধু জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ তেড়ে গালাগাল দিয়েছিলেন মেসিকে। “ওর জন্যই বার্সেলোনায় আমি থাকতে পারিনি। ও জোরাজুরি করার জন্যই গুয়ার্দিওলা ছক পাল্টে ৪-৩-৩ থেকে ৪-৫-১ ছকে চলে যায়। আমার কপাল পোড়ে।” কিন্তু এখন আর কে ভাবছে ইব্রাহিমোভিচের আক্ষেপ নিয়ে? গুয়ার্দিওলা বলে দিয়েছেন, মেসি এখন ফুটবলের মাইকেল জর্ডন। সেটাই মেনে নিয়েছে সবাই।
খুব মনে করে, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখছি, মেসি ইদানীং একটা ম্যাচই খুব খারাপ খেলেছেন। দেশের হয়ে তিনি খারাপ খেলেন, এই সার সত্যটাও আস্তে আস্তে মুছতে শুরু করেছে। মাস ছয়েক আগেও মেসির সমালোচনায় একটা কথা বলা হত। বার্সেলোনায় আসল খেলা খেলেন জাভি আর ইনিয়েস্তা। এদের জন্যই মেসিকে নদী মনে হত। আর্জেন্টিনায় জাভি-ইনিয়েস্তা-ফাব্রেগাস পাশে নেই বলে মেসি সাধারণ। এখন সেই সমালোচনার ঝাঁঝও কমে এসেছে।
জার্মানি বা দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছিলাম। মেসির চেয়ে তেভেজের সমর্থক বেশি আর্জেন্টেনীয় ফ্যানদের মধ্যে। প্রিটোরিয়ার রাস্তায় এক ঝাঁক আর্জেন্টেনীয় তরুণ তরুণী ইংরেজিতে আমায় বুঝিয়েছিল, তেভেজ হচ্ছে গরিবদের প্রতিনিধি। ম্যারাডোনার মতো দারিদ্র্য জয় করে উঠে এসেছে। মেসির পরিবারের ভালো অর্থ ছিল। এবং দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় অত জনপ্রিয় নন। মেসি দেশের হয়ে ভালো খেলতে না পারায় এই প্রশ্নগুলো আরও বেশি করে উঠত।
গত সেপ্টেম্বরে মেসিরা কলকাতা আসার সময়, বুয়েনস আইরেসের সাংবাদিকরা বললেন, “ছবিটা পাল্টাচ্ছে। মেসির সাফল্য, তেভেজের ব্যর্থতায় এখন জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে মেসি।” স্পেনে থেকেও আর্জেন্টিনার তরুণীর সঙ্গে প্রেম করার ঘটনা সে দেশে ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিয়েছে এল এম টেনের।
মেসিকে দেখার আনন্দ আর একটা ধাঁধার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তিনি আসলে ঠিক কী পজিশনের ফুটবলার? তিনি যখন খেলা শুরু করেছিলেন, মেসিকে তখন বলা হতো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। আর এখন দেখুন, গোলের পরে গোল করে যাচ্ছেন। এত গোল, টিপিকাল স্ট্রাইকাররাও করেন না। গুয়ার্দিওলার ৪-৩-৩ ছকে তিনি ফরোয়ার্ড। গোল করার পাশে উইং ধরে খেলা ছড়িয়ে, গোল করানোর ক্ষেত্রেও ওস্তাদো কি ওস্তাদ। মানে গোল করার পেলে আর গোল করানোর মারাদোনার চমৎকার মিশেল দাঁড়াচ্ছেন তিনি। তা হলে মেসিকে ঠিক কী বলা উচিত? অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার? ফরোয়ার্ড? উইঙ্গার? না, খাঁটি স্ট্রাইকার? প্লেয়িং ইন দ্য হোল?
ফুটবল বিশ্বের আদর্শ ফুটবলার কেমন হওয়া উচিত? গত বিশ্বকাপের ঠিক আগে এই প্রশ্ন নিয়ে গবেষণার পরে উঠে এসেছিল নানা তথ্য। মা দুর্গাকে দেবতাদের নানা অস্ত্র দিয়ে সাজানোর ব্যাপারটা মনে পড়বে এটা দেখলে। কোন ফুটবলারের কী নিয়ে আদর্শ ফুটবলার হওয়া উচিত?
উচ্চতা: পিটার ক্রাউচ। চুল: কার্লোস পুওল। চোখ: জাভি। চিবুক: পাওলো মালদিনি। বুক: মাইকেল বালাক। বাহু: রবি ডেলাপ। হাত: জুলিও সিজার। জোড়া পা: ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো। ডান পা: থিয়েরি অঁরি। বাঁ পা: লিওনেল মেসি।
শুধু বাঁ পা? পরের বিশ্বকাপের সময় ‘আদর্শ ফুটবলার’ নিয়ে গবেষণা হতে দিন না! সব প্রশ্নেই তখন রোজারিও শহরের ওই সরল রাখাল বালকের নাম বলতে হবে। নদীর মতো বাঁকে বাঁকে যার বৈচিত্র।
বিঃদ্রঃ মেসিকে নিয়ে লিখাটা বেশ ভালো লেগেছে। তাই শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১২ দুপুর ১:৩০