somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"ক" তে কিশোর

০৪ ঠা আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলি। সে নামে তাঁকে এখন কেউ চেনে না। তাঁর কণ্ঠ এখনো অনেক বাঙালির মনকে নস্টালজিক করে। কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পীর নাম কিশোর কুমার। তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল অভিনয় দিয়ে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কণ্ঠে ছিল কৈশোরের ছোঁয়া।




গানে গানে নিজের গায়কীতে মনের আবেগকে সুরের মায়ায় বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি অভিনয়েও তিনি সবার মন ভরিয়ে দিয়েছেন রসিকতায়। তিনি এক ও অদ্বিতীয় কিশোর। চিরদিনের রসিক এ মানুষটি ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী। তিনি একাধারে গায়ক ও অভিনেতা। এ ছাড়া গীতিকার, সংগীত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং চিত্রপরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। এখনও তিনি সংগীতপিপাসুদের সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন! ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন ছিলেন প্রচন্ড খামখেয়ালী, তেমনি রসিক। রেকর্ডিংয়ে, আড্ডায়- সবখানে মেতে থাকতেন হৈ-হুল্লোড়।

কিশোর কুমার (আগস্ট ৪, ১৯২৯ – অক্টোবর ১৩, ১৯৮৭) ছিলেন ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক,চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক।সাধারণত তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে বিবেচিত হন। কিশোর কুমারের চার অদ্ভুত কাহিনী:-কিশোর কুমার ৪ই আগস্ট ৪টার সময় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৪র্থ সন্তান। তিনি জীবনে ৪ টি বিয়ে করেন, চলচ্চিত্র জীবনে ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।কিশোর কুমার বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালয়ালম, ওড়িয়া, এবং উর্দু। এছাড়াও তিনি তার ব্যক্তিগত গান সংকলনেও বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন, বিশেষত তার বাংলায় গাওয়া গানগুলি সর্বকালের ধ্রুপদী গান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তিনি ৮ বার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়কের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন এবং একই বিভাগে সর্বাধিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার বিজয়ের রেকর্ড করেছেন। তাকে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং তার নামে হিন্দি চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য কিশোর কুমার পুরস্কার প্রদান চালু করে।সাধারণত গায়ক হিসাবে তাকে দেখা হলেও তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতাও ছিলেন। তার অভিনীত বিখ্যাত কয়েকটি হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে বাপ রে বাপ (১৯৫৫), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), হাফ টিকিট (১৯৬২), পড়োশন (১৯৬৮), হাঙ্গামা (১৯৭১), পেয়ার দিবানা (১৯৭৩), বাড়তি কা নাম দাড়ি (১৯৭৪)। এছাড়া অন্যান্য চলচ্চিত্রের ভিতর রয়েছে নোকরি, বন্দী, দূর গগন কি ছাঁও মে, দূর কা রাহি প্রভৃতি।



কিশোর কুমার মধ্যপ্রদেশের খান্ডোবাতে বাঙালি গাঙ্গুলী (গঙ্গোপাধ্যায়) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী ছিলেন একজন উকিল। তার মার নাম ছিল গৌরী দেবী। কিশোর কুমারের জন্মনাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সবথেকে বড় ছিলেন অশোক কুমার তারপর সীতা দেবী। তারপর অনুপ কুমার আর অনুপ কুমারের থেকে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন কিশোর কুমার।কিশোরের শৈশবকালীন সময়েই তার বড়দা অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অশোক কুমার বোম্বেতে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে বড় সাফল্য পান। এই সফলতা ছোট্ট কিশোরের উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই কিশোর বিখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের একজন বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সায়গলের গানগুলো অনুকরণ করতেন বা নকল করে গাইতেন। এছাড়াও তার বাড়ির লোক তাকে দাদা অশোক কুমারের বিখ্যাত গান “মেঁ বন কে পঞ্ছী বন বন কে” বার বার গাইতে বলতেন। অশোক কুমারের সাফল্যের পর কিশোরের আরেক দাদা অনুপ কুমারও বোম্বের হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন।
পঞ্চাশের দশকের সাফল্যকিশোর কুমারের অভিনয় খুব একটা পছন্দ ছিল না। তিনি গান গাইতেই চাইতেন। কিন্তু তার গানের কোন ধরাবাঁধা শিক্ষা ছিল না। দাদা অশোক কুমারের ফিল্ম জগতে অনেক পরিচিতি থাকার ফলে কিশোর বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান কিন্তু সেগুলিতে দর্শকদের মনে তেমন সাড়া জাগাতে পারেননি। তবে এই চলচ্চিত্রগুলোয় তিনি গান গাইবার সুযোগ পেতেন। এই প্রাথমিক অবস্থায় তিনি কুন্দন লাল সায়গলের নকল করে গাইতেন। পরে শচীন দেব বর্মনের পরমর্শে তিনি নিজের গাইবার কায়দা পাল্টান এবং এমন এক গাইবার কায়দা উদ্ভাবন করেন যা সেই সময়ের অপর প্রধান দুই গায়ক মহম্মদ রফি এবং মুকেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল গলাকে ভেঙে গান গাওয়া যা আগে কখনও শোনা যায়নি। তবে এই কায়দা খুবই জনপ্রিয় হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কমেডি নায়ক হিসাবে জনপ্রিয় হন। তার অভিনয়ের কায়দা ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই সময়ের প্রবল জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাশালী তিন নায়ক - রাজ কাপুর, দেব আনন্দ এবং দিলীপ কুমার বলিউড শাসন করা সত্ত্বেও কিশোর কুমার নিজের এক পৃথক জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি ছিলেন এক প্রবল ব্যস্ত, সফল নায়ক এবং গায়ক। এছাড়াও তিনি সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করতে লাগেন। শচীনদেব বর্মন ছাড়াও আরেক সুরকার যিনি কিশোরের সঙ্গীত প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি হলেন খেমচাঁদ প্রকাশ। খেমচাঁদ প্রকাশের সুর জিদ্দি চলচ্চিত্রের গান গেয়ে কিশোর গায়ক হিসাবে পায়ের নিচে মাটি পান। এছাড়া অন্যান্য সুরকার যেমন রবি এবং দুই বিশিষ্ট গীতিকার - মজরু সুলতানপুরি ও শৈলেন্দ্র কিশোরের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এই সময়ের তার গায়ক হিসাবে অন্যতম চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে আছে পেয়িং গেস্ট (১৯৫৭), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), তিন দেবিয়াঁ।

ষাটের দশকের সময়কালে কিশোর কুমারের বেশকিছু চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে অসফল হয়ে পড়ে, এই সময় তিনি পাকাপাকিভাবে গানের জগতে নিজেকে যুক্ত করে ফেলেন মনে রাখার মত। মুনিমজি (১৯৬২), গাইড (১৯৬৫) এবং জুয়েল থিফ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রতিনটিতে তার গাওয়া গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।১৯৬৬ সালে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শচীন দেব বর্মনের পুত্র রাহুল দেব বর্মণের। তার প্রথম দর্শকপ্রিয়-ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র তিসরি মঞ্জিলে কিশোর কোন গান গাননি। কিন্তু ১৯৬৮ সালে 'পড়োশন' চলচ্চিত্রে রাহুল দেব বর্মণের সুরে কিশোর বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গান।

১৯৬৯ সালে শক্তি সামন্ত'র আরাধনা শুভমুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রের নায়ক ছিলেন রাজেশ খান্না। রাজেশ খান্নার জন্য এই চলচ্চিত্রে কিশোর তিনটি গান গেয়েছিলেন - ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে -আর দুটি হোলো- রূপ তেরা মস্তানা এবং ‘মেরে সপনো কি রানী’। তিনটি গানই বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং কিশোর কুমারের সঙ্গীতজীবনকে আবার উপরে উঠিয়ে দেয়। এই চলচ্চিত্রে রূপ তেরা মস্তানা গানের জন্য কিশোর প্রথম বার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান।পরবর্তী বছরগুলোতে কিশোর গায়ক হিসাবে ব্যাপক সাফল্যতা লাভ করেন। সে সময়ে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত সব নায়ক যেমন রাজেশ খান্না, শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, রণধীর কাপুর, সঞ্জীব কুমার এবং দেব আনন্দের জন্য তিনি গান গেয়েছেন। এই সময়ে শচীন দেব বর্মণ এবং রাহুল দেব বর্মণের সুরে তিনি প্রচুর কালজয়ী গান গেয়েছেন। রাহুল দেব বর্মনের সুরে তিনি বোম্বে টু গোয়া চলচ্চিত্রতে প্রথমবারের জন্য অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের 'অভিমান' চলচ্চিত্রের জন্য তার গানগুলি জনপ্রিয় হয়। এরফলে পরবর্তী মেগাস্টার অমিতাভের নেপথ্য গায়ক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।কিশোরের এই সাফল্যের পরে বলিউডের অন্য সুরকারেরাও তাকে নিজেদের প্রধান গায়ক হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য করে। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল জুটি। গীতিকার আনন্দ বক্সী সুরকার লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল এবং কিশোরকুমার জুটি বেশ কিছু রাজেশ খান্নার চলচ্চিত্রের জন্য অনবদ্য সঙ্গীত উপহার দেন। যেমন দাগ, রোটি, হাথি মেরে সাথি। লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলালের সুরেই কিশোর ও মোহাম্মদ রফি একসাথে গান করেন এবং কিশোর ও লতা মঙ্গেশকরের বেশ কিছু ভাল দ্বৈত গান তৈরি হয়।কিশোর কুমার এবং সুরকার কল্যাণজী-আনন্দজী জুটিও বেশ কিছু হিট গান উপহার দেন। যেমন ধর্মাত্মা, লাওয়ারিস, কাবিলা, জনি মেরা নাম, ডন, কাগজ, সফর, মুকাদ্দর কা সিকন্দর প্রভৃতি চলচ্চিত্রের গান। সত্তর এবং আশির দশক জুড়ে কিশোরের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। নতুন অল্পবয়েসি নায়ক যেমন ঋষি কাপুর এবং সঞ্জয় দত্তের জন্যও তিনি সফল গান উপহার দেন। রাহুলদেব বর্মনের সুরেই যে তিনি সবথেকে বেশি জনপ্রিয় গান গেয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাহুল এবং কিশোর জুটির কিছু অনবদ্য চলচ্চিত্রের নাম হল শোলে, ওয়ারান্ট, হীরা পান্না, শরীফ বদমাশ, আঁধি, রকি, দ্য বার্নিং ট্রেন, আপকি কসম, আপনা দেশ, ধরম করম, টক্কর, সীতা অর গীতা, জোশিলা, কসমে বাদে, রামপুর কা লক্ষ্মণ, কালিয়া, গোলমাল প্রভৃতি। নতুন সুরকার যেমন রাজেশ রোশন এবং বাপ্পী লাহিড়ী'র সুরেও তিনি বেশ কিছু হিট গান গেয়েছেন। রাজেশ রোশনের সুরে দো অর দো পাঁচ, দুসর আদমি, মনপসন্দ, এবং বাপ্পী লাহিড়ী'র সুরে নমক হালাল এবং শরাবী চলচ্চিত্রের গান উল্লেখযোগ্য। তার পুরো কর্মজীবনে কিশোর আটবার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পুরস্কার পান।


হিন্দির পাশাপাশি তিনি প্রচুর জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র সহ বাংলা আধুনিক গানও গেয়েছেন। উত্তম কুমারের জন্য তার প্লেব্যাক করা উল্লেখযোগ্য ছবির ভিতর রয়েছে রাজকুমারী, অমানুষ, আনন্দ আশ্রম এবং ওগো বধূ সুন্দরী। একটি বাংলা ছবি লুকোচুরি তে তিনি নায়কের অভিনয় এবং গান করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের দু'টি চলচ্চিত্র চারুলতাএবং ঘরে বাইরের জন্য তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত দুই নায়ক প্রসেনজিৎ এবং তাপস পালের কেরিয়ারের দুই উল্লেখযোগ্য হিট যথাক্রমে অমর সঙ্গী এবং গুরুদক্ষিণার জন্যও তিনি প্লেব্যাক করেছিলেন। কেরিয়ারের শেষদিকে কিশোর কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম রেকর্ড করেন।প্লেব্যাক করা বাংলা ছবি অমরকন্টক , আশ্রিতা , অনিন্দিতা , অমর সঙ্গী , কবিতা , গুরুদক্ষিণা , জীবন মরণ , জ্যোতি , তুমি কত সুন্দর , দোলন চাঁপা , পাপ পুণ্য , বান্ধবী , মিলন তিথি , মোহনার দিকে ,সঙ্কল্প ,সুরের আকাশে ইতাদি।কিশোর কুমার সর্বমোট ২,৭০৩টি গান গেয়েছেন, যার মধ্যে ১১৮৮টি হিন্দি চলচ্চিত্রে, ১৫৬টি বাংলা এবং ৮টি তেলেগু ভা

জনপ্রিয় বাংলা গান 'নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে' শিরোনামীয় গানটি কিশোর নিজেই সুর করেছিলেন।

বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীতের উপর তার প্রভাব এখনও বিশাল ও ব্যাপক। বর্তমান কালের প্রতিষ্ঠিত অনেক গায়ক যেমন কুমার শানু, অভিজিৎ, বাবুল সুপ্রিয়, অমিত কুমার প্রায় সকলেই তাদের কেরিয়ারের প্রথম দিকে কিশোরের গানগুলোক অনুকরণ বা নকল করে গাইতেন। তার গানের এখনও খুব ভাল বাজার।




দাম্পত্য জীবন

কিশোর কুমার চারবার বিয়ে করেছেন। রুমা  গুহঠাকুরতা (১৯৫০-১৯৫৮), মধুবালা (১৯৬০-১৯৬৯), যোগিতা বালী (১৯৭৫-১৯৭৮) এবং লীনা চন্দাভারকর (১৯৮০-১৯৮৭)। কিশোরের প্রথম পুত্র (রুমা গুহ ঠাকুরতার সাথে) অমিত কুমার একজন বিখ্যাত গায়ক। যোগিতা বালি কে পরে মিঠুন চক্রবর্তী বিবাহ করেন। অমিত কুমার তার বাবার মত সাফল্য না পেলেও বেশ কিছু হিট গান উপহার দিয়েছেন। কিশোরের ছোট ছেলে সুমিত কুমার (লীনা চন্দাভারকরের সাথে) একজন গায়ক হবার চেষ্টা চালাচ্ছেন।


রুমা  গুহঠাকুরতা








কিশোর কুমার প্রথম বিয়ে করেন রুমা গুহ ঠাকুরতাকে। রুমাও কিশোরের মতো একাধারে অভিনয় ও সংগীতশিল্পী। তাঁকে শেষ দেখা গেছে হলিউড ছবি ‘নেমসেক’-এ (২০০৬)।১৯৫১ সালের মে মাসে মুম্বাইয়ে কিশোর কুমারের সঙ্গে রুমার বিয়ে হয়। পরের বছর জুলাইয়ে তাঁদের সন্তান অমিত কুমারের জন্ম হয়।রুমা দাবি করেন, কিশোর চেয়েছিলেন তিনি যেন তাঁদের সংসার সামলান। কিন্তু রুমা কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এ নিয়েই দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুজনের মধ্যে। অবশেষে ১৯৫৮ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়।রুমা এরপর চিত্রনাট্যকার অরূপ গুহ ঠাকুরতাকে বিয়ে করেন।সন্তান অমিত কুমারের সাথে  কুমার ও রুমা গুহঠাকুরতা।


মধুবালা



মধুবালাকে বলা হয় বলিউডের মেরিলিন মনরো। একটি দরিদ্র পাঠান পরিবারে তাঁর জন্ম। পারিবারিক নাম মমতাজ বেগম।মধুবালা ছিলেন কিশোর কুমারের দ্বিতীয় স্ত্রী। ভালোবাসতেন দিলীপ কুমারকে। দিলীপের প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে না পেরেই গ্রহণ করেন কিশোর কুমারের প্রস্তাব।মধুবালার পরিবারের শর্ত ছিল, বিয়ে করতে হলে কিশোর কুমারকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তাই ধর্মান্তরিত হয়ে করিম আবদুল নাম নেন কিশোর কুমার।অন্যদিকে কিশোরের পরিবার মধুবালাকে কখনোই মেনে নেয়নি। একে মধুবালা মুসলিম, তার ওপর মৃত্যুপথযাত্রী। তাঁর হৃৎপিণ্ড ও শ্বাসযন্ত্রে বাসা বেঁধেছিল অসুখ।বিয়ের এক মাসের মধ্যেই কিশোর কুমার বাড়ি ছেড়ে মুম্বাইয়ের বাংলোয় নিয়ে আসেন মধুবালাকে। সেখানেই নয় বছর অসুস্থ মধুবালার সঙ্গে সংসার করেন। ১৯৬৯ সালে মধুবালা মারা যান


যোগিতা বালি



কিশোর কুমারের তৃতীয় স্ত্রী বলিউড অভিনেত্রী যোগিতা বালি। ১৯৭৬ সালে বিয়ে, মাত্র দুই বছর সংসারের পর ১৯৭৮ সালে বিচ্ছেদ। ১৯৭৯ সালে অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে যোগিতা বিয়ে করেন। মিঠুন-যোগিতার বন্ধন এখনো অটুট আছে।বাপ্পি লাহিড়ীর সংগীতজীবনের শুরু হয়েছিল এই ত্রিভুজ সম্পর্কের কারণে। পর্দায় মিঠুনের জন্য কণ্ঠ দিতে কিশোর কুমার অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মিঠুনের প্রথম দিকের অনেকগুলো ছবিতে তাই বাপ্পি লাহিড়ী সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন ।

লীনা চন্দ্রভারকার





বলিউড অভিনেত্রী লীনা চন্দ্রভারকার প্রথম স্বামী মারা যান একটি দুর্ঘটনায়, বিয়ের কিছুদিন পরেই। মাত্র ২৫ বছর বয়সে বৈধব্য বরণ করেন লীনা।এরপর কিশোর কুমার ১৯৮০ সালে লীনাকে বিয়ে করেন। তাঁদের বয়সের ব্যবধান ছিল ২১ বছর। লীনার বাবার এ বিয়েতে মত ছিল না। লীনার বাবার সম্মতি পেতে কিশোর কুমার গেয়েছিলেন ‘জনি মেরা নাম’ ছবির গান—‘নফরত করনে ওয়ালো কে সিনে মে পেয়ার ভর দু’।১৯৮৭ সালে কিশোর কুমারের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লীনা চন্দ্রভারকারই ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী। সন্তান সুমিত কুমারের সাথে লীনা ও কিশোর কুমার ।

কিশোর কুমারের জীবনে যতটা ওঠা পড়ার গল্প রয়েছে, ঠিক ততটাই বর্ণময় তাঁর মজার মজার কাহিনি। কখনও বাড়ির সামনে লিখে রাখতেন কিশোর হইতে সাবধান, কখনও আবার চুল কেটে হাজির হতে শ্যুটে, তবে খাওয়ার বিষয় তাঁর মন ছিল বরাবরই দুর্বল।  কিশোর কুমার খেতে ও খাওয়াতে ভিষণ পছন্দ করতেন। পাত পেড়ে খাওয়াটা যেমন ছিল পছন্দের তেমনি মাঝে মধ্যেই সকলকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন তিনি। তবে খাবারের নিমন্ত্রণে থাকত কেবল খাবরই। মদ্যপানের কোনও ব্যবস্থাই করতেন না তিনি। কিশোর কুমার মদ্যপান পছন্দ করতেন না তিনি। বাড়িতে আয়োজন করতেন বাঙালি খাবার। লুচি মাংস, আলুরদম, বেগুন ভাজা, মেনু ভরে কেবল থাকত সুস্বাদু বাঙালি পদ।   তবে কিশোর কুমার যে মাছের প্রতি দুর্বল ছিলেন তা সকলেরই ছিল জানা। কেউ যদি কলকাতায় আসতেন, তবে ফেরার পথে কিশোর কুমারের জন্য নিয়ে যেতেন মাছ।   ইলিশ মাছ ছিল কিশোর কুমারের খুব পছন্দের। তাই মাঝে মধ্যেই শচীনদেব বর্মন, শক্তি সামন্তরা ইলিশ নিয়ে যেতেন তাঁর জন্য।   ধূমপান ও মদ্যপান নিয়ে ভক্তদের শতর্ক করতেন তিনি। নিজেও খাওয়া পছন্দ করতেন না। তবে ভোজন রসিক কিশোর কুমার দুটি খাবরকে বেশ ভয়ে পেতেন।   বিরিয়ানি ও সিঙ্গারা। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কিশোর কুমার, তারপর থেকেই ছেড়েদেন সিঙ্গারা। আর বিরিয়ানির সঙ্গে সম্পর্ক সুরের।   রেকর্ডিং-এর কয়েকদিন আগে আর বিরিয়ানি খেতেন না কিশোর কুমার, তিনি মনে করতেন বিরিয়ানি খেলেই গলা থেকে বেড়বে না সুর। কিশোর কুমারকে সকলেই ভিষণ পছন্দ করতেন, শ্রদ্ধার পাশাপাশি ভয় পেতেন অনেকে। তাই রেকর্ডিং-এর জন্য তাঁকে রাজি করাতে রীতিমত দিতেন ঘুষ। তবে কিশোর কুমারের কাছে একটাই ঘুষ কাজ করত, তা হল মাছ। কেউ যদি তাঁর কাছে ভেট হিসেবে মাছ পাঠাতেন তাহলেই মুহূর্তে রাজি হয়ে যেতেন কিশোরকুমার।




দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীর কলাম ,  আনন্দবাজার পত্রিকা  (অনলাইন সংস্করণ  ২ অগস্ট, ২০১৮ )

রেকর্ডিং মানেই এক অন্যরকম কিশোর কুমার। ইয়ার্কি, হই-হুল্লোড়। সবচেয়ে মজা হতো, দ্বৈত গানের সময়। রেকর্ডিংয়ের সময় সবাইকে হেডফোন পরতে হয়। এমনই একদিন কানে হেডফোন লাগিয়ে সবাই বসে আছেন স্টুডিওতে। কিশোর কুমারের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের দ্বৈত গান। কিশোর কুমারের অংশ গাওয়া হয়ে গেছে। এবার লতা মঙ্গেশকরের পালা। কিন্তু কিশোর কুমার নাচের এমন সব ভঙ্গি করছেন যে, লতা মঙ্গেশকর গান গাইবেন কি, কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারছেন না। হঠাৎ কিশোর কুমারের মজা করা থেমে গেলো। লতা মঙ্গেশকরকে গাইতে দিতে হবে তো! রেকর্ডিংয়ে এসে লতা মঙ্গেশকর খুব মনোযোগী থাকতেন। কিন্তু কিশোর কুমারের সামনে পড়লে কি আর সে উপায় আছে? লতা মঙ্গেশকর গান তুলছেন, কিশোর কুমার তার পেছনে লাগা শুরু করে দিলেন। নানান রকম হাসির কথা বলে লতা মঙ্গেশকরকে একটানা হাসিয়েই যাচ্ছেন। লতা মঙ্গেশকরকে কিশোর কুমার বোনের মতো ভালোবাসতেন।

মজার মজার গান গাইতেন বলে অনেকের মনে হতে পারে যে, কিশোর কুমার হয়তো কখনো চিন্তায় থাকতেন না। এমন ভাবাটা ভুল। আগে যতই মজা করেন না কেন, রেকর্ডিং শুরুর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ বদলে যেতেন কিশোর কুমার। শুধু তাই নয়। বাড়িতে নিজে গানটা তুলেই ফোন করতেন শচীন দেব বর্মন অথবা পঞ্চমকে। বারবার শোনাতেন। গানের ব্যাপারে যতক্ষণ সাড়া না পেতেন, ততক্ষণ টেনশনে থাকতেন তিনি। বারবার জিজ্ঞাসা করতেন, ঠিক হচ্ছে তো? কিশোর কুমার যদিও বুঝতে দিতে চাইতেন না, তিনি গান নিয়ে কতটা টেনশনে ভুগছেন। তাই রেকর্ডিং শেষ করেই দ্রুত বাড়ি চলে যেতেন। শুনতেনও না। বলতেন, ‘গানটা এখন আর শুনবো না। আপনারাই বলবেন কেমন হয়েছে। ’

‘শোলে’ ছবির ‘মেহবুবা ও মেহবুবা’ গানটি কিন্তু কিশোর কুমারেরই গাওয়ার কথা ছিলো। তার বাড়িতে গানটি তৈরি হচ্ছে। গানটি পঞ্চম যেভাবে গাইছিলেন তিনি সেভাবে তুলতে পারছিলেন না। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর হঠাৎ কিশোর কুমার বলে উঠলেন, ‘পঞ্চম, যাই বলো, এই গানটা আমার থেকে তোমার গলায় অনেক ভালো লাগছে। এটা তুমিই গেয়ে দাও। ’ এমনই আর একটি গান ‘ক্যারাভান’ ছবির ‘পিয়া তু অব তো আ যা’। আশা ভোঁসলে ও পঞ্চমের দ্বৈত গান। হওয়ার কথা ছিলো কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলের। কিন্তু এই গানের মাঝে একটা শ্বাসের অংশ আছে। সেটি কিছুতেই আসছে না কিশোরের। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে পঞ্চমকে বললেন, ‘বুঝলে, এটা তুমিই গেয়ে দাও’। আর একটা গান ছিলো ‘দিল সে দে’। এই গানটাও কিশোর কুমারের অনুরোধে গেয়েছিলেন পঞ্চম। এখনকার দিনে কেউ এভাবে নিজের গান ছেড়ে দেবে!  

কিশোর কুমার কোনো কনসার্টে গান করার আগে মঞ্চের মাপ জেনে নিতেন। বলতেন, ‘আমার বড় স্টেজ চাই। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি গাইতে পারবো না। আমি নেচে-কুঁদে গাইবো। ’ আর মঞ্চে তিনি এমন সব কাণ্ড-কারখানা করতেন যে, বাদকরাও বাজনা থামিয়ে হাঁ হয়ে দেখতেন।

কিশোর কুমার হারমোনিয়াম ভালো বাজাতে পারতেন না। বাজাতে গিয়ে ভুল হলে হাল ছেড়ে দিয়ে খালি গলায় গেয়ে দিতেন। সিঙ্কোপ্যাটেড নোটস থাকলে তো তার যেন দম আটকে আসতো!

‘কটি পতঙ্গ’ ছবির ‘ইয়ে যো মহব্বত হ্যায়’ গানটি কিশোর কুমার প্রথম ফোনে শোনেন। শুণেই দারুণ খুশি। গানের দৃশ্যে নায়ক মাতাল হয়ে গানটি করবেন। সেই অভিব্যক্তি তিনি অনায়সে গানে তুলে আনলেন। অথচ জীবনে কখনো মদ ছুঁয়েও দেখেননি তিনি। শুধু চা খেতেন। কোনদিন মদ না খেয়েও এভাবে গানের মধ্যে নেশা ফুটিয়ে তোলা যায়, সেটা কিশোর কুমার ছাড়া আর আরো পক্ষে সম্ভব নয়।

ইমোশনাল গান, দুঃখের গান, রোমান্টিক গান তো তিনি অসাধারণ গাইতেনই। আর আনন্দের গান? তাহলে আর কথাই থাকতো না। গানের মাঝে কিছু কিছু কথা কিশোর কুমার নিজে থেকেই জুড়ে দিতেন। গাওয়ার আগে কার লিপে গানটা থাকবে, ছবিতে তার চরিত্র কেমন, পরিস্থিতি কী, অথবা গানে কোন ধরণের ঘটনা দেখা যাবে- সব কিছু মাথায় রাখতেন তিনি।  


সুমিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের কলাম , আনন্দবাজার পত্রিকা  (অনলাইন সংস্করণ  ২৯ জুলাই, ২০১৮ )

প্রথম ঘটনাটা ১৯৭৭ সালের। তখন আমি কলেজে পড়ি। থাকতাম উত্তর বিহারের সমস্তিপুরে। শীতকাল এলেই আমাদের ওখানে জলসা হত। আমরা বলতাম শীতের জলসা। মূলত ‘মাচা শিল্পী’রাই আসর জমাতেন। মাঝেসাঝে নামকরা শিল্পীরাও আসতেন কলকাতা থেকে। এক দিন আমার জেঠতুতো দাদার চিঠি পেলাম। সংক্ষিপ্ত চিঠি। ‘চলে আয়, তোর জন্য কিশোরকুমার নাইটের টিকিট কেটেছি। সঙ্গে রফি সাবও আছেন।’ দাদা জানত আমি কিশোরের বিরাট ফ্যান। আমার তো তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। নামী শিল্পী বলতে বহু কাল আগে এক বার বনশ্রী সেনগুপ্ত এসেছিলেন। তখন তিনি সবে নাম করছেন। তাই অন্য শিল্পীর গানই বেশি গেয়েছিলেন। ওঁর কণ্ঠেই প্রথম শুনি ‘জনি মেরা নাম’ ছবির গান, ‘ও মেরে রাজা’। একটা বাংলা গানের কথাও মনে পড়ছে, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ একী কাণ্ড করেছি’। বনশ্রীর পর সোজা কিশোরকুমার! ভাবাই যায় না। তড়িঘড়ি টিকিট কেটে সুদূর বিহার থেকে কলকাতা পাড়ি দিলাম।আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। দিনটা ছিল ১০ ডিসেম্বর। দাদার সঙ্গে গেলাম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। অত বিশাল স্টেডিয়াম আগে দেখিনি। স্টেডিয়ামে আমার ছোট মামার সঙ্গে দেখা। মামা থাকতেন শিবপুরে।মঞ্চটি স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে। মঞ্চের মাঝখানে বিশাল একটা ব্যানারে লেখা ‘একই মঞ্চে প্রথম বার রফি-কিশোর’। অনুষ্ঠানের শুরুতে এলেন শাকিল আনসারি। তিনি রফি সাবের ঘোষক। এসেই উর্দু-মিশ্রিত হিন্দিতে ঘোষণা করলেন, ‘দোস্তো জ্যায়সা কি আপ জানতে হ্যায় আজ রফি সাহাব কে সাথ অউর এক মশহুর গুলোকার (গায়ক) মওজুদ হ্যায় অউর জিনকা নাম হ্যায় কিশোরকুমার। এমন একটা সময় ছিল যখন মহম্মদ রফিকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইতে হত কিশোরকুমারের জন্য। সেই গানগুলির মধ্যে একটা গান কিশোর অভিনীত ‘কল্পনা’ ছবির ‘মন মোরা বাওরা’। এই গান দিয়ে রফি সাহেব তাঁর সে দিনের অনুষ্ঠান শুরু করলেন। দর্শকদের কাছে এ এক আলাদা চমক। রফি সাহেব সাধারণত ফাংশন শুরু করেন, ‘বড়ি দূর সে আয়ে হ্যায় প্যার কা তোফা লায়ে হ্যায়’ অথবা ‘মধুবন মে রাধিকা নাচে রে’ দিয়ে, সেখানে তিনি কিনা কিশোরকুমারের গলায় লিপ দেওয়া গান গাইবেন!মহম্মদ রফি মূলত এক জায়গায় দাড়িয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। কিন্তু তাঁর অনন্য গায়কি এবং অনবদ্য গানের নির্বাচনের জন্য ফাংশন জমে যেত। সেই সময় সবে দেশে জরুরি অবস্থা শেষ হয়েছে। ইমার্জেন্সি চলাকালীন কিশোরকুমারের গান নিষিদ্ধ ছিল। আমার মতো অনেক কিশোর-ভক্ত ভাবতেন, এই সুযোগেই বুঝি রফি সাবের অনেক গান হিট করে। একই ছবি ‘হাম কিসিসে কম নেহি’-তে রফির ‘চাঁদ মেরা দিল’ গানটা ব্যাপক হিট, অথচ তার পরের গান, কিশোরের কণ্ঠে ‘আ দিল কেয়া মেহফিল হ্যায় তেরে’-র সম্প্রচার বন্ধ থাকায় গানটি তেমন প্রচার পায়নি।সে দিন রফি যেমন ‘মধুবন মে রাধিকা’ গাইছেন, তেমনই ‘পর্দা হ্যায় পর্দা’ও গাইছেন। একটু থেমে পর পর দুটি বাংলা গান, ‘তোমাদের আশীর্বাদে এই শতদল মাথায় রাখি’ এবং তাঁর আরও একটি  বিখ্যাত গান ‘তার চোখে নেমে আসা রঙে রঙে ভালবাসা’ গাইলেন। এর পর ‘লায়লা মজনু’ ছবির গান ‘তেরে দর পে আয়া হু’ গাওয়ার পরেই ধরলেন সুপারহিট গান ‘মস্ত বাহারো কা ম্যায় আশিক’। পরের পর গান গেয়ে ফাংশন জমিয়ে দিলেন। জনতা তখন ‘গুরু গুরু’ রব তুলেছে। দর্শক যখন রফির মাদকতাময় কণ্ঠে বুঁদ হয়ে আছেন, তখনই তিনি শুরু করলেন ‘পিতে পিতে কভি কভি ইউ জাম বদল যাতে হ্যায়’। দর্শক তত ক্ষণে সত্যিই রফিসাবের গানের নেশায় বুঁদ।এত আনন্দ-উন্মাদনার মধ্যেও আমার উৎকণ্ঠা কিছুমাত্র কমেনি। তার কারণ, মঞ্চ থেকে মহম্মদ রফির প্রস্থানের পর আমি তখন কিশোরকুমারকে দেখার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ঝলমলে নীল শাড়িতে উজ্জ্বল রুনা লায়লা উপস্থিত হলেন। তখন ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’ গানটি বিরাট হিট। এই গান শুরু হতেই উপস্থিত অধিকাংশ দর্শক নাচতে লাগলেন। পরের দুটি গান ‘দমাদম মস্ত কলন্দর’ ও ‘তুম হো না হো মুঝকো তো’ গেয়ে আসর জমিয়ে দিলেন রুনা। তত ক্ষণে গায়ক ভুপিন্দর সিংহ মঞ্চে উঠে পরেছেন। রুনা লায়লার সঙ্গে তাঁদের হিট গান— ‘ঘরোন্দা’ ছবির ‘দো দিওয়ানে শহর মে’— পরিবেশন করলেন। এর পর দুজনে মিলে গাইলেন ‘পরিচয়’ ছবির ‘বিতি না বিতায়ে রৈনা’ ও ‘মৌসম’ ছবির বিখ্যাত গান ‘দিল ঢুঁঢতা হ্যায় ফির ওহি’। প্রমাণ হয়ে গেল, ফাংশন জমাতে এঁরাও কিছু কম যান না!ভুপিন্দর ও রুনা লায়লা মঞ্চ থেকে নেমে যাবার পর বোঝা গেল এ বার সত্যিই কিশোরকুমার আসছেন। গুরু এলেন একটু অন্য মেজাজে, ঘোড়ায় চেপে! এবং তখন তাঁর কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে তাঁর বহুশ্রুত জনপ্রিয় শব্দগুলো, ‘‘পেয়ারে বন্ধুয়ো, সঙ্গীতকে প্রেমিয়ো, মেরে চাচা চাচিয়ো, মেরে মামা মামিয়ো আপ সবকো কিশোরকুমার কা সপ্রেম নমস্কার।’’ গান শুরুর আগেই তিনি আসর জমিয়ে দিলেন।আমি তখন উত্তেজনায় থরথর। মঞ্চে উঠে কিশোর নিজেই ঘোষকের কাজ শুরু করে দিলেন। ‘প্রেম পুজারী’ ছবির ‘ফুলো কে রং সে দিল কি কলম সে’ গান দিয়ে শুরু করলেন অনুষ্ঠান। একের পর এক তাঁর অজস্র হিট গানের ডালি মেলে ধরলেন। পরের গান, ‘মুসাফির হু ইয়ারোঁ’, পাবলিক তখন আবেগে ভাসছে। ঘোষক কিশোরকুমারের কথা বলার ভঙ্গিও যে অন্যদের চেয়ে আলাদা। মাইক হাতে নিয়ে বললেন, ‘‘পেয়ারে সাথিয়ো অব পেশে খিদমত হ্যায় ফিল্ম ‘জহরিলা ইনসান’ কা ওহ হসিন নগমা ‘ও হন্‌সিনি মেরে হন্‌সিনি’।’’সারা স্টেডিয়াম ওঁর ভরাট গলার সুরে গমগম করতে লাগল। এর পর একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে ধরলেন একটা বাংলা গান। ‘এই যে নদী’, তার পর ‘আমার মনের এই ময়ূরমহলে’। একটু জল খেয়ে এ বার আবার হিন্দি গান, ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’। গান শুনে প্রেক্ষাগৃহ স্তব্ধ। একটু হেসে বললেন, ‘‘কী সবাই এত চুপচাপ কেন? এ বার একটু শচীনকত্তার গান হয়ে যাক!’’ তার পরই ধরলেন, ‘ধীরে সে জানা খটিয়ন মে ও খটমল ধীরে সে জানা খটিয়ন মে’। সে সময় রুনাজি হয়তো মগ্ন হয়ে মাথা নিচু করে গান শুনছিলেন ভিআইপি বক্সে বসে। কিশোর তখন গেয়ে চলেছেন ‘সোই হ্যায় রাজকুমারী দেখ রহি মিঠি স্বপ্নে’। তখনই লাইটম্যান রুনাকে ফোকাস করতে, সবাই প্রবল উৎসাহে রুনাকে এমন ভাবে দেখতে লাগলেন যেন রুনা সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওই হুল্লোড়ের মধ্যেই গুরু গাইছেন ‘যা যা ছুপ যা শরিয়ন মে ও খটমল’, রুনাজি তখন সত্যিই ব্যস্তসমস্ত। এই দেখে পাশে বসা এক দর্শক বলতে লাগলেন, এই না হলে কিশোর! গানের সঙ্গে কী ভাবে বিনোদন আর মনোরঞ্জনকে মেশাতে হয়, একমাত্র গুরুই জানেন। সে দিন শেষ গান ছিল ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখ না’।তখন ফাংশন শেষ হতে বেশ রাত হত। সবাই ঘরমুখী, এ দিকে কোনও যানবাহন নেই। থাকবে কি করে, সে দিন রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল। মামা বললেন, চল এই ভিড় থেকে একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়াই। একটু দূরে দাঁড়াতেই হঠাৎ শিবপুর যাওয়ার একটা মিনিবাস দেখে আমরা লাফিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। বসার জায়গাও পেলাম। ইতিমধ্যে ফাংশন-ফেরত কিছু লোক ওই বাসে চড়লেন। বেশির ভাগই সালকিয়ার প্যসেঞ্জার, তাঁরা সবাই ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরকে চাপ দিতে লাগলেন সালকিয়া যাওয়ার জন্য। এই নিয়ে শিবপুরের যাত্রীদের সঙ্গে বচসা। পুলিশ পেট্রলিং-এর গাড়ি দেখে ড্রাইভার বাস দাঁড় করিয়ে দিল। পুলিশ আমাদের বাস নিয়ে গেল শিবপুর থানায়। সেই রাতে শেষ পর্যন্ত আমাদের শিবপুরের যাত্রীদের পুলিশ ভ্যানে করে বাড়ি পৌঁছে দেয়। জীবনে প্রথম একটা জমজমাট জলসা দেখা, স্বচক্ষে কিশোরকুমারকে দেখা, শেষে বাড়ি ফেরার ওই অভিজ্ঞতা।

১৯৮২ সালে আবার একটা জম্পেশ জলসা দেখার সুযোগ এসে গেল। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে লতা আর কিশোর নাইট। টিকিটের দাম ১০০ টাকা। তবু ঠিক করলাম, দেখতে যাব। এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। প্রথমে লতা শুরু করলেন গীতার শ্লোক দিয়ে। পরের গান শচীনকত্তার সুরে ‘মেঘা ছায়ে আঁধি রাত’। একের পর এক গান— আর ডি’র সুরে ‘রয়না বিতি যায়ে’, তার পরেই লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের সুরে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, তার পর ‘যশোমতী মাঈয়া সে বোলে নন্দলালা’। এখানেই শেষ নয়। সলিল চৌধুরীর সুরে ‘বাঁশি কেন গায়’ আর ‘আ যা রে পরদেশি’ গান দুটি শেষ হতে না হতেই আবার ‘সাত ভাই চম্পা’। শ্রোতারা তখন ‘লতা লতা’ রব তুলেছেন। আর আমার চিন্তা, সব হাততালি যদি লতাই নিয়ে যান, কিশোরকুমার এলে তো তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হবে!আমার এই চরম টেনশনের মধ্যেই হঠাৎ গুঞ্জন, কিশোর আসছেন। তত ক্ষণে লতা নিজে ঘোষণা করে দিয়েছেন কিশোরের আগমনবার্তা। নিজের কিছু অভিজ্ঞতাও বললেন মাইকে— কী ভাবে তিনি আর কিশোরকুমার স্টুডিয়োপাড়ায় যেতেন গান রেকর্ড করতে। তিনি কিশোর কুমারের থেকে দু মাসের ছোট, তাই ওঁকে ‘কিশোরদা’ বলেন।স্টেডিয়ামের প্রায় সব আলো নেভানো। শুধু একটা স্পটলাইট কিশোরকুমারের উপরে। হালকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিশোর তাঁর বিখ্যাত গান ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ গাইতে গাইতে স্টেজে উঠছেন। লতা এক ধাপ নেমে কিশোরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। কিশোর গান গাওয়ার ফাঁকে বললেন, ‘জিতি রহো লতা।’ অসাধারণ এক দৃশ্য, নিজের আবেগ ধরে রাখা কঠিন। সারা স্টেডিয়াম তখন আপ্লুত। লতার অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন হরিশ ভিমানি। কিশোরকুমার মঞ্চে এসেই তাঁকে বাংলায় বললেন, ‘‘বাবা হরিশ তুমি এ বার এস, এটা কলকাতা, আমার বাড়ি, আর দর্শকরা সবাই আমার বাড়ির লোক।’’ হরিশ ভিমানি হেসে শুধু বললেন, ‘‘জি কিশোরদা।’’ উপস্থিত সব দর্শককে প্রথমেই ঘরের লোক করে নিতেন কিশোর, তার পর একাই উপস্থাপনার কাজটি সামলাতেন।একের পর এক দুজনের কালজয়ী ডুয়েট! কখনও ‘হম দোনো দো প্রেমী দুনিয়া ছোড় চলে’ তো পরক্ষণেই ‘ওয়াদা করো নহী ছোড়োগে তুম মেরা সাথ’, শচীনকত্তার সুরে ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে রয়না’, আর ডি’র সুরে ‘অব কে সাবন মে জী ডরে’। একটু পরেই যখন গাইছেন ‘তুম আ গয়ে হো, নুর আ গয়া হ্যায়’, সবার সামনে তখন যেন ‘আঁধি’ সিনেমা, সূর্যাস্তের দৃশ্যে সঞ্জীবকুমার-সুচিত্রা সেনের প্রেম।লতাজি মঞ্চ থেকে নেমে গেলে শুরু হল কিশোরকুমারের একক অনুষ্ঠান। শুরু করলেন ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’ দিয়ে। পরের দুটি গান তো ওঁর গলায় ইতিহাস হয়ে আছে— ‘আনেওয়ালা পল জানেওয়ালা হ্যায়’ আর ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। গান শেষে দর্শক চুপ, কিশোর তখন যন্ত্রীদের সঙ্গে নিচু স্বরে কী কথা বলছেন। হটাৎ আমার কী মনে হল, চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘‘নমকহলাল!’’ উনি শুনতে পেলেন, বললেন, ‘‘লাইটম্যান, উস তরফ ফোকাস করো।’’ তার পর বললেন, ‘‘কে বলল?’’ সবাই মিলে প্রায় পাঁজাকোলা করে আমাকে তুলে ধরল। তখন যদিও বলেছিলেন, ‘‘এত বড় গান গাইতে পারব না’’, তবু অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে এসে ধরলেন, ‘কে পগ ঘুঙরু বাঁধ মিরা নাচি থি’। আমার, আমার চারপাশের দর্শক-শ্রোতাদের উল্লাস তখন দেখার মতো। মনে আছে, সে বার একটা টেপ রেকর্ডারে কিছু গান রেকর্ড করেছিলাম।ফাংশন শেষে কোনও রকমে হাওড়া স্টেশনে এসে দেখি, লাস্ট ট্রেন চলে গেছে। তাতে কী, স্টেশনেই খবরের কাগজ পেতে বসে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে ফাংশনের গান শুনেই রাত কেটে গিয়েছিল।১৯৮৬ সালে আবার একটা দারুণ জলসা দেখার সুযোগ এসেছিল। সেই নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম। এ বার আশা, আর ডি আর কিশোর নাইট। অনুষ্ঠান শুরু করলেন আশা ভোঁসলে। বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে ‘রাত বাকি বাত বাকি’ গেয়ে আসর জমিয়ে দেন। আশাও অনেকটা কিশোরকুমারের মতো নিজের অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা নিজেই করেন। পর পর দুটো বাংলা গান করলেন— ‘সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি বসে আছি দুজনে’ আর ‘কথা দিয়ে এলে না’। আবার হিন্দি গানে ফিরলেন, ‘উমরাওজান’ ছবির ‘দিল চিজ কেয়া হ্যায় আপ মেরি জান লিজিয়ে’, ‘ইয়ে লেড়কা হায় আল্লা’, ‘ইয়ে মেরা দিল ইয়ার কা দিওয়ানা’ ইত্যাদি সুপারহিট গান। শ্রোতারা তখন আনন্দে নাচছে। এই হইচইয়ের মধ্যেই হঠাৎ গান থামিয়ে মাইক হাতে ঘোষণা করলেন, পার্ক স্ট্রিটে রাহুলকে ট্র্যাফিক পুলিশ ধরেছে। তাই তিনি আসতে পারছেন না। এই বলে একটু কাঁদো কাঁদো গলায় গান ধরলেন, ‘স্বপ্না মেরা টুট গয়া তু না রহা কুছ না রহা’। আমরা তখন সত্যিই ভাবছি, আর ডি এখন কোথায়! ও মা, তখনই স্পট লাইটে দেখা গেল আপাদমস্তক সাদা পোশাক রাহুল দেববর্মণ মাইক হাতে গাইছেন ‘আজা মেরি বাহো মে আ পেয়ার ভরি রাহো মে আ’। পরে বুঝেছিলাম, এ সব ওঁদের আসর জমানোর টেকনিক। জলসা এর পর জমে গেল, জ্বলে উঠল স্টেডিয়ামের সব কটা আলো। রাহুল ও আশাজি বেশ কয়েকটি ডুয়েট গাইলেন। ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’, ‘পিয়া তু অব তু আজা’ আজও কানে লেগে আছে। আর ডি একা গেয়েছিলেন ‘শোলে’ ছবির ‘মেহবুবা মেহবুবা’, ‘কিতাব’ ছবির ‘ধন্নো কি আঁখো মে’। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গেয়ে আসর মাতিয়ে দিলেন। সবাই তখন ‘আর ডি, আর ডি’ আওয়াজ তুলেছে।শেষ বেলায় এলেন কিশোরকুমার। এসেই আশাজির সঙ্গে প্রথম গান ‘এক ম্যায় অউর এক তু’, আর ‘লে কর হম দিওয়ানা দিল’। গলা মেলালেন আর ডি’ও। কিশোর-আশার অসামান্য রসায়নের কথা শুনেছিলাম, সে দিন নিজের চোখে দেখলাম। দুর্দান্ত বোঝাপড়া ছাড়া এই সব অসাধারণ ডুয়েট গাওয়া যায় না।১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছিল অনুষ্ঠান ‘পুলিশ হোপ’। কিশোরের সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ী। কিশোরকুমার সে দিন বাপ্পি লাহিড়ীর সুরের গানই বেশি গেয়েছিলেন। স্থানীয় শিল্পীর সঙ্গে ‘জলতা হ্যায় জিয়া মেরা ভিগি ভিগি রাতো মে’, ‘নয়নো মে স্বপ্না’, ‘তাকি ও তাকি’ গেয়ে জমিয়ে দিলেন। বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে জমিয়ে গাইলেন ‘দে দে পেয়ার দে’, আবার ‘গুরু, গুরু’ রব স্টেডিয়াম জুড়ে। গেয়েছিলেন ‘এই তো জীবন, যাক না যে দিকে যেতে চায় প্রাণ’।সে দিন অনুষ্ঠান শেষে বলেছিলেন, ‘‘যদি বেঁচে থাকি, আবার আসব। আপনাদের গান শোনাব।’’ তা আর হয়নি। সেটাই ছিল কিশোরকুমারের শেষ কলকাতা সফর। ইউটিউব ঘাঁটলে আজকাল স্মার্টফোনেই দেখা যায় তাঁর গান। কিন্তু জলসায় কিশোরকুমারকে দেখার রোমাঞ্চ সেখানে কোথায়!

রিহার্সালের দিন কিশোর কুমারের কোনও পাত্তা নেই! মান্না দে, মহম্মদ রফি চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ রকম করলে রেকর্ডিংয়ের কী হবে? তখন তো আর স্ট্রাক রেকর্ডিংয়ের সিস্টেম ছিল না। যা হবে প্রথম থেকে শেষ একেবারে লাইভ। খুব ভাল রিহার্সাল না থাকলে যেটা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে এই গানটি গাইছেন হিন্দি গানের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। মান্না দে, মহম্মদ রফি এবং কিশোর কুমার। খুবই বিরল ঘটনা। ছবির নাম ‘চলতি কা নাম জিন্দেগি’। খুব খটোমটো গান। মান্না দে এবং মহম্মদ রফি নিয়মিত প্র্যাকটিস করছেন। রফিসাব একসময় বিরক্ত হয়ে বললেন, “কিশোর গানটা ঝুলিয়ে দেবে। গট আপ ছাড়া এ গান হয় নাকি?” মিউজিক ডিরেক্টরকে কমপ্লেন করে কোন লাভ নেই, কারণ সুরকারের নামও কিশোর কুমার। রেকর্ডিংয়ের দিন যথাসময়ে কিশোর কুমার উপস্থিত। কোনও টেনশন নেই। হাসি মজা করছেন। যত টেনশন বাকি দু’জনের। ভাল ভাবে রেকর্ডিং হয়ে গেল ‘বন্ধ মুঠি লাখ কি।’ মান্না দে ও মহম্মদ রফি মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন, কি গানটাই না গাইল কিশোর কুমার! মনে মনে একটা কথাই ভাবছেন, বিনা রিহার্সালে এমন গান গাওয়া কেবল কিশোরের পক্ষেই সম্ভব!

খানিকটা এমন ঘটনা ঘটেছিল ‘পড়োশন’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘এক চতুর নার করকে শৃঙ্গার’-এর রেকর্ডিং যখন হয়। সব কিছু ঠিকঠাক। রেকর্ডিংয়ের আগের দিন কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন, এই গান তিনি কিছুতেই গাইবেন না। মান্না দে-র সঙ্গে ডুয়েট গান। খুব চেপে ধরতে বললেন, “কী করে গাইব বলুন তো? আমি কি আপনার মতো ক্ল্যাসিকাল জানি? পঞ্চম ঢেলে সব কাজকর্ম করে দিয়েছে!” আরও জোরাজুরি করতে বললেন, “তা ছাড়া কেমন যেন  শুনছিলাম, কম্পিটিশনে আমি হেরে যাব!” কিশোরদা জিভ কেটে বললেন, “আপনার কাছে হারতে আমার আপত্তি নেই মান্নাদা!” এই গানের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, “কি গানটাই না গাইল কিশোর! এমন ইম্প্রোভাইস করল ভাবাই যায় না!”

এই হলেন কিশোর কুমার। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ৮৯ বছর। চলে গেছেন আজ থেকে প্রায় ৩১ বছর আগে। এখনও সমান চুম্বক কিশোর কুমারের গানে। এখনও আগের মতো সমান জনপ্রিয় তিনি। তাঁর নামে ভারতবর্ষের যে কোনও প্রান্তে অনুষ্ঠান হোক না কেন, সিট ফাঁকা পড়ে থাকে না! যত মাধ্যম আছে সব জায়গায় তাঁর গান হিট।

মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে মান্নাদার পুজোর গান তৈরি করলেন। ‘‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যে দিন যাবে।’’ গান শুনে মান্না দে বললেন, ‘‘কী করেছেন মশাই! আমার মরণযাত্রা করিয়ে দিয়েছেন! এই গান আপনাদের বৌদি গাইতে দেবে না!” দু’জনেই খুব ভেঙে পড়লেন! কিন্তু মান্না দে-কে কিছুতেই রাজি করানো গেল না! কিছু দিন বাদে পরিচালক মনোজ ঘোষ তৈরি করলেন, ‘তুমি কত সুন্দর’। ছবিটিতে মৃণাল পুলক গান তৈরি করলেন। ‘তোমার বাড়ি...’ গানটা শুনে পরিচালকের পছন্দ হয়ে গেল। বললেন, এই ছবির জন্য গানটা তাঁর চাই। মান্নাদার জন্য তৈরি গান কে গাইবে? সকলেই একমত, এই গান গাওয়ার মতো এক জনই আছেন, তিনি কিশোর কুমার।

মনোজ ঘোষ ও মৃণালদা রওনা দিলেন মুম্বই। গান কিশোরকুমারের খুব পছন্দ হল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। মুখরাতে একটা লাইন ছিল, ‘তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকো...।’ কিশোরদা বেঁকে বসলেন। গানের মধ্যে বারান্দা চলবে না। “পুলকবাবুকে বলে ওটাকে ‘আঙিনা’ করে দাও।” দু’জন পড়লেন মহা বিপদে। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। পুলকদাকে কিছুতেই ধরা গেল না। আর তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে শব্দ বদল করার সাহস কারও নেই! এ দিকে আবার কথা না বদলালে কিশোরদা গাইবেন না! শাখের করাত। রেকর্ডিংয়ের দিন কিশোরদা এলেন। সিরিয়াস গান। কিশোরদা ডুবে গেলেন গানের মধ্যে। গান শুরুর আগে ডাকলেন মৃণালকে। মৃণাল তো নিশ্চিত, এ বার কিশোরদা বলবেন, “কথা চেঞ্জ হল?” আর তার পরই রেকর্ডিং বন্ধ! কিন্তু কী কাণ্ড! কিশোরদা বললেন, “বড় ভাল সুর করেছ মৃণাল।” তারপর ‘বারান্দা’ শব্দ সমেত গাইলেন গানটা। আর ওই প্রসঙ্গে গেলেন না। তৈরি হল কালজয়ী এক বাংলা গান। 
২০১৪-তে মুম্বই গিয়েছিলাম। লতা মঙ্গেশকরের পুজোর গান লেখার জন্য। চার বাংলায় এল এম স্টুডিওতে রেকর্ডিং। স্টুডিওর অনেক কিছুই লতাজি নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁদের ছবির ভিন্ন ভিন্ন গ্যালারি। গীতিকার, সুরকার, গায়ক, সঙ্গীত আয়োজক বিভিন্ন জন। যাঁরা আজ আর নেই। গ্যালারিতে একটা লক্ষ করার মতো বিষয় হল, যে বিভাগে যিনি তাঁর সব থেকে প্রিয়, তাঁর ছবিটি মাঝখানে খুব বড় করে রাখা। সুরকারদের জন্য দু’টি গ্যালারি। সব থেকে প্রিয় দু’জন সুরকার কে কে জানেন? মদনমোহন এবং সলিল চৌধুরী। প্রিয়তম গীতিকার হসরত জয়পুরী। আর লতাজির সবথেকে প্রিয় শিল্পী হিসেবে গ্যালারির মাঝখানে জ্বলজ্বল করছেন কিশোর কুমার।

কথা হচ্ছিল মুম্বইতে কিশোর সোধার সঙ্গে। ভারতবর্ষের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্রাম্পেট প্লেয়ার। দীর্ঘ ১৫ বছর বাজিয়েছেন। কিশোর কুমারের সঙ্গে প্রথম কাজ ‘মুকাদ্দর কা সিকান্দার’। ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘রোতে হুয়ে আতে হে সব...’। কিশোরদার ফাংশনের কথা বলতে বলতে সোধাজীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, অনুষ্ঠানে ২৭-২৮ টা গান আরামসে গাইতেন। দর্শকদের অনুরোধকে খুব গুরুত্ব দিতেন। নিজের পছন্দ ছাড়া সেই সব গান গাওয়ার চেষ্টা করতেন। তরতাজা ভয়েস। সব সময় এক রকম। গানের উঁচু পর্দা নিচু পর্দা, সকাল হোক বিকেল, সব সময়ই এক রকম। অমন শিল্পী খুব কমই আছে।সোধাজী খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “আর একটা বিষয়ে কিশোরদার কোন তুলনা নেই! এমন সুরেলা গায়ক, জীবনে কোনও দিন এক সেকেন্ডও বেসুরো গাননি।” এ যেন মান্নাদার কথারই প্রতিধ্বনি। মান্নাদা অনেক বার বলেছেন, “এমন সুরেলা গায়ক আমি কখনও দেখিনি। আমরা নিজের অজান্তে একটু-আধটু বেসুরো ফেলেছি, কিশোর কখনও নয়।” কিশোর সোধা বলছিলেন, “মানুষ হিসেবেও কিশোরদার কোনও তুলনা নেই! এক বার হয়েছে কি, আমার বিদেশ যাওয়া খুব দরকার, কিন্তু কিছুতেই পাসপোর্ট পাচ্ছি না। বড় বিপদে পড়লাম! কথাটা কী করে যেন কিশোরদার কানে গেল। বললেন, ‘চিন্তা কোর না, আমি দেখছি।’ কয়েক দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হয়ে গেল। তিনি ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক, অথচ তাঁর এক জন মিউজিসিয়ানের জন্য এই সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত বেশি নেই!”  মান্নাদা হিন্দি গানের ট্রেন্ড এবং কিশোর কুমার খুব ভাল কথা বলতেন। মহম্মদ রফি, মান্না দে, তালাত মাহমুদ— এঁরা মূলত হিন্দি গানের একটা ঘরানা তৈরি করেছিলেন এবং গায়কীতে হরকত থাকত। তাতেই শিল্পীদের শিক্ষার পরিচয় পাওয়া যেত। গানটিও খুব সমৃদ্ধ হত। সিনেমার হিন্দি গান বলতে গেলে তখন সব মহম্মদ রফির দখলে। কিন্তু কিশোর কুমারের উত্থানে রফির গান খুবই কমে আসতে লাগল। এই ব্যাপারটা রফি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না! মান্না দে-কে প্রায় দুঃখ করে বলতেন, “গানে কোনও হরকত নেই শুধু চিৎকার করে! এ সব কী হচ্ছে মান্নাদা?” প্র্যাক্টিক্যাল মানুষ মান্না দে বোঝাতেন, “সবাই এমন গায়কি পছন্দ করে। এটাই স্ট্রেট সিঙ্গিং। তোমাকে সেটা মানতে হবে। তুমি তো শুধু নিজের জন্য গাইছো না। গাইছো অডিয়েন্সের জন্য। তাদের কথা ভাববে না? ওঁদের যে ভাল লাগছে কিশোরকে, সে ক্রেডিট দিতেই হবে।” মান্না দে বলতেন, “অনেক বুঝিয়েছি। রফি মিঞা কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না! শেষ পর্যন্ত গুমরে গুমরে মারা গেল! ভেরি স্যাড!”
কিশোর কুমারের গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কুটুনদার নাম। কলকাতার রাসবিহারী থেকে মুম্বই যাত্রা প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল। গুণী তবলাবাদক ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘কুটুন’ নামে অধিক  পরিচিত। মান্না দে-র সুদীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে রেকর্ডিং, ফাংশনে সব থেকে বেশি বাজিয়েছেন কুটুনদা। সঙ্গীত পরিবারের ছেলে। দাদা গৌতম মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত কন্যা রানু মুখোপাধ্যায়ের স্বামী)। মুম্বইয়ের খুবই নামকরা ভয়েস ট্রেনার। শিল্পীদের সৌজন্য তখন কেমন ছিল বলছিলেন কুটুনদা। কিশোর কুমারের রেকর্ডিং চলছে, কিন্তু শেষ গানটা কিছুতেই বাজাতে পারবেন না। মান্না দে-র একটা ফাংশন আছে, যেতে হবে। অ্যারেঞ্জার বাবলু চক্রবর্তীকে আগেই বলে রেখেছিলেন। শেষ একটা গানের জন্য তখনকার বিখ্যাত তবলচি ইকবালজিকে বলেও রাখা হয়েছিল। যথাসময়ে মান্না দে’র ফোন, সব গোছানো হয়ে গেছে। যেতে যতটুকু সময় লাগে। কখন যে কিশোরদা এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন। সব কথা শুনতে পেয়েছেন। গম্ভীর ভাবে বললেন, “সব গান না বাজিয়ে কোথাও যেতে পারবে না!” এ তো মহাবিপদ! এক দিকে কিশোরদা, অন্য দিকে মান্নাদা! যাই কোথায়? কিশোরদা বললেন, আমাকে মান্নাদার ফোনটা দাও, “হ্যাঁ, মান্নাদা এখন যেতে পারবে না। আমার তো একটা গান এখনও বাকি!” মান্নাদা কী বললেন শোনা গেল না। কিশোরদা হো হো করে হাসছেন। এর মধ্যে স্টুডিও বয় এসে খবর দিল, ট্যাক্সি এসে গেছে। কে বলল ট্যাক্সির কথা? ফোনের আগেই কিশোরদা বলেছেন ট্যাক্সি ডাকতে, কুটুনদার জন্য। ভাবা যায় না! ভাবলে চোখে জল আসে।
কুটুনদা বলেছিলেন আর ডি এবং কিশোর কুমারের সুন্দর রসায়নের কথা। বাজাচ্ছেন ‘সাগর’ ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘সাগর জ্যায়সি...’। কে কী চাইছেন যেন ইঙ্গিতেই বুঝে নিচ্ছেন দু’জনে। অধিক কথার প্রয়োজন নেই! পারস্পরিক বোঝাপড়া এমন যে একটা ভাল গান সৃষ্টি হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা!

বাংলা গানের চিরকালীন জনপ্রিয় যত অ্যালবাম আছে তার মধ্যে অন্যতম কিশোর কুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। যন্ত্রসঙ্গীত আয়োজনে আর এক কৃতি বাঙালি বাবলু চক্রবর্তী। তবলায় কুটুনদা। স্টুডিও মুম্বইয়ের ওয়ার্লির রেডিও জেমস। ট্রেনার হিসেবে কলকাতা থেকে এসেছেন সমরেশ রায়। কিশোরদা খুব সিরিয়াস। বার বার বলে দিয়েছেন, স্টুডিয়োতে কেউ যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না আসে। সমরেশবাবুর কথা খুব মন দিয়ে শুনছেন। তাঁকে ডাকতেন ‘সমরেশদা মাস্টারমশাই’ বলে।  


সত্যিকারের মানুষ ও শিল্পী কোনও শিল্পীকে ছোট না করেই একটা কথা বলতে পারি, কিশোর কুমার এক জনই। আর জন্মাবেন না। আসলে গান তো ঠাকুর গড়ার মতো। মিউজিক ডিরেক্টর কাঠামো তৈরি করে দেন। তাতে রং দিয়ে সম্পূর্ণ করাটা তো শিল্পীর কাজ। একটা ঘটনা বলি। সুজিত গুহ একটা ছবি করেছিলেন, আশা-ভালবাসা। সেখানে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আর বাপ্পি লাহিড়ির সুরে একটা গান গেয়েছিলেন কিশোর কুমার, ‘নটবর নাগর তুমি করো না মস্করা’। গানের আগে পুলক বাবুকে ডেকে স্যর জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই নটবরটা কে? পুলকবাবু বলেছিলেন ভিলেন। তখন কিশোর কুমার বলেছিলেন, ‘নটবর কে জানেন? এ তো শ্রীকৃষ্ণের নাম। এমন অসাধু একটা লোকের নাম নটবর হল কেন? হঠাত্ করে গানটা শুরু হলে জমবে কি না আমার সন্দেহ আছে। আমি একটু জমিয়ে দেব?’ আপনারা লক্ষ করবেন, ওই গানটা শুরুর আগে উইদআউট মিউজিক একটা ডায়লগ আছে, ‘যা যা যা যা গোপাল, যা ব্যাটা গরু চড়া’— ওটাই স্যরের জমিয়ে দেওয়া। এমন অজস্র গল্প রয়েছে। গল্প তো নয়, এ সব সত্যি ঘটনা।



কিশোর কুমারের৭ সিক্রেট

১.অশোক কুমারের কাছে এক ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলেন গায়ক-সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ। সেখানে কিশোর কুমারকে গাইতে শুনে সে দিনই ছবিতে গান গাওয়ার জন্য রাজি করান তাকে।

২.৭০ দশকের মাঝামাঝিতে তার প্রযোজনায় একটি ছবিতে অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয়ে অস্বীকৃতি জানালে অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান না গাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কিশোর কুমার।

৩. ১৯৭৫-৭৭ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করে রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠান ও মাধ্যম থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। রেডিওতে তার গান প্রচার বন্ধ করা হয়, এমনকি দ্বৈত সংগীতগুলো থেকে তার গাওয়া অংশগুলো কেটে দেওয়া হয়।

৪. মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম নেন করিম আবদুল।

৫. যত বড় পরিচালকই হোক না কেন, সম্পূর্ণ পারিশ্রমিক না পাওয়া পর্যন্ত গান রেকর্ডিং করতেন না।

৬.লতা মুঙ্গেশকরের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন। তার সম্মানে সব সময় পারিশ্রমিক নিতেন লতার চেয়ে এক টাকা কম।

৭. তার অভিনয়ে পাগলামির ছাপ ছিল স্পষ্ট, যা তিনি ইচ্ছা করেই তৈরি করেছিলেন। এমনকি খান্ডোয়ায় তার বাড়ির সামনে নিজেই ‘মেন্টাল হসপিটাল’ লেখা সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন।


কিশোরকুমারের সঙ্গে  লীনা চন্দ্রভারকারের দাম্পত্য ছিল স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল ১৯৮৭ সালের, দীপাবলির কাছাকাছি একদিন। তার আগেও দীপাবলিতে অন্ধকার হয়েছে লীনার জীবন। এক দীপাবলিতে আত্মঘাতী হয়েছিলেন তাঁর ভাই। সুমিতের জন্মের পরেই দীপাবলিতে চিরতরে চলে গিয়েছিলেন লীনার মা।  জীবন যেন বার বার দীপাবলিকেই বেছে নিয়েছে লীনার জীবনকে আঁধারে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য। দিনটা ছিল ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর। সকাল থেকেই কিশোরকুমার বলছিলেন, তাঁর দুর্বল লাগছে। উদ্বিগ্ন লীনা ডাক্তারকে খবর দিতে চান। এর পরেও মজা করে কিশোরকুমার বলেন, “তুমি যদি ডাক্তারকে খবর দাও, আমার কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হবে!”  এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। এর পর বিছানায় শুয়ে পড়েন তিনি। তখনও লীনা ভেবেছেন, কিশোর বোধহয় মজা করছেন। যেমন তিনি সবসময় করতেন। ভুল ভাঙল কিছু ক্ষণের মধ্যেই। লীনা বুঝলেন, তিনি আরও একবার নির্বান্ধব হলেন। তখন ছেলে সুমিতের বয়স মাত্র পাঁচ বছর।  জীবনের এই কঠিন পরীক্ষার সময় লীনার পাশে ছিলেন অমিতকুমার। তিনি-ই ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন ভাই, সুমিতকে। বৈমাত্রেয় নয়, তাঁদের দু’জনের বন্ধন হার মানিয়ে দেয় নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানকেও।  লীনা মনে করেন, জীবন যে ভাবে এসেছে, সে ভাবে তার মুখোমুখি হওয়ার নামই বেঁচে থাকা। কিশোরকুমার তাঁকে বলতেন, ভালবাসার কথা মুখে বলে বোঝানো যায় না, বরং সেটা উপলব্ধি করতে হয়। এই অনুভবটুকু দিয়েই বন্ধুর জীবনকে মসৃণ করে নিয়েছেন লীনা।    

ভারতীয় সঙ্গীত জগতের শ্রেষ্ঠ সব গায়কদের মধ্যে বাঙলীর গর্ব কিশোর কুমার ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ | তাঁর মতো দূর্দান্ত প্রতিভাশীল গায়ক আর হয়তো ভারতের বুকে কেউ জন্মাবে না | তিনি ছিলেন একধারে যেমন গায়ক তেমনই অন্যদিকে ছিলেন একজন গীতিকার, সুরকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার, রেকর্ড প্রযোজক এবং পরিচালকও | তাঁকে আজও ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এবং সফল প্লেব্যাক গায়ক হিসাবে মনে করা হয় |



সংগীতশিল্পী, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকারসহ বহুগুণে বিশেষায়িত ছিলেন কিশোর কুমার গাঙ্গুলি। যার কণ্ঠস্বর শ্রোতাদের মন জয় করেছে বারবার। জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পীর জীবনী লিখতে প্রস্তুতি নিয়েছেন ছেলে অমিত কুমার গাঙ্গুলি। এরইমধ্যে অমিত তার বাবার সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ করেছেন, তা এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। তাই দর্শক, শ্রোতা, ভক্ত ও সাধারণ মনুষদের মাঝে নতুন করে আগ্রহের জন্ম দিয়েছে এই উদ্যোগ।  একটি ব্যবসায়িক সূত্র বলছে, কিশোর কুমার একজন গায়ক ছাড়াও মানুষ হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও দয়ালু। তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সম্পর্কে অবগত তার বড় ছেলে কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা অমিত কুমার। তাই কিশোর কুমারের জীবনী সম্পর্কে অমিত কুমারই একমাত্র উত্তম ব্যক্তি, যিনি এই কাজটি সবচেয়ে ভালো করতে পারবেন।  অমিত কুমারের সৎ ভাই সুমিত কুমার (লীনা চন্দাবরকরের ছেলে) ও সংগীত পরিচালক-গায়ক বাপ্পি লাহিড়ীও জীবনী লেখার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অমিত কুমার।অমিত কুমার এ বিষয়ে জানিয়েছেন, বইটি হবে কিশোর কুমারের জীবনীর ওপর গবেষণার ভিত্তিত্তে। তাই জীবনী প্রকাশের কোন তাড়াহুড়া নেই বরং নিজেই কয়েকছর ধরে গবেষণা করতে চান অমিত। যার মাধ্যমে কিশোর কুমারের যথাযথ সম্মান ও আবেগকে সংরক্ষণ করা যায়।একইসঙ্গে এই বইয়ের মাধ্যমে কলঙ্কজনক অধ্যায়গুলো যেন সবার সামনে পরিস্কার হয়, সেই চেষ্টা করা হবে। তাই কিশোর কুমারের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সঙ্গে কথা বলে একটি তথ্য ভিত্তিক এবং সূক্ষ্ম গবেষণার ওপর নির্ভর করেই প্রকাশ হবে বইটি।অমিত কুমার নিজে তার বাবা পরিচালিত ও অভিনীত অনেক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘দূর গাগান কি চাও মে (১৯৬৪), দূর কি রাহি (১৯৭১), বাধিতা ক্য নাম দাধি (১৯৭৮), সাব্বাস ড্যাডি (১৯৭৯) এবং চলতি কা নাম জিন্দেগি ( ১৯৮২)।এছাড়াও কিশোর কুমারের মৃত্যুর পর অমিত কুমার পরিচালক হিসেবে ‘মমতা কি চাও মে’ চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ করেছিলেন ।

তথ্যসুত্র ঃ  উইকিপিডিয়া , আনন্দবাজার পত্রিকা ( কলকাতা ,  ভারত ) , প্রথম-আলো ( ঢাকা, বাংলাদেশ ), কিশোরকুমারের ভক্তদের বিভিন্ন লিখা এবং পত্রিকা ও ম্যাগাজিন ।

আজ  আমার খুব পছন্দের একজন শিল্পী কিশোর কুমারের জন্মদিন তাই আমার এই লিখা । বুঝ হবার পর থেকেই তাঁর গান শুনেই বেড়ে উঠা, এখনো ভালোলাগা বিদ্যমান । জানি লিখাটি অনেক বড় হয়ে গেছে ।  বড় মানুষের বনাঢ্য জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে লিখা সম্ভব হয় না ।  আশাকরি সময় নিয়ে ধৈর্য্য সহকারে পড়বেন ।

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ৯:১৩
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×