"তাইলে এখন কি করা যায় বলোতো!ডাক্তারের কাছে যামু?"বলার পর বনানী আমার দিকে তাকাইলো হয়তো।আমি কিছু শুনি নাই এতক্ষণ এইরকম ভাবে বললাম,"ক্যাপাস্টেন সিগারেট টানা মানেই হুদাহুদি পয়সা গচ্চা দেয়া।কোন স্বাদ নাই,খালি ছাই ওড়ে।"
বনানীর জায়গায় অন্য কোন প্রেমিকা হইলে ঠিকই রাগ করতো আমার উত্তরে।বনানী সেই প্রেমিকাদের বাইরের জগতের প্রেমিকা যারা কথায় কথায় গালে চাল ভিজায় আর ভরা কলস উল্টায় দেয়।
সে আমারে আবারো বললো,"বলো না কি করমু?"
বনানীর পরামর্শ চাওয়ার ভঙ্গিতে আমি একটু গম্ভীর হইলাম।মেয়েটার জন্য খারাপ লাগা শুরু হইছে আমার মধ্যে।গত সপ্তাহেই সে আমারে বলছিলো তার পেটে দাউদ হইছে।সারাক্ষণ চুলকায়।গোসলের সময় সাবান লাগলে আরও বেশি জ্বলে।
ডাক্তার ডাক্তার মুখ কইরা বললাম,"তুমি একটা কাজ করতে পারো কিন্তু!রিংডন নামে খুব ভালো একটা মলম আছে,লাল রঙা।ওইটা একসপ্তাহ ঠিকমতো লাগাইলে দাউদের বাপও তোমার পেটে থাকবো না।"
"মলম!"
"হ মলম।আমারও দাউদ উঠছিলো ক্লাস এইটে পড়ার সময়।তখন রিংডন দিয়াই সারাইছিলাম।ফুটপাতে হকাররা ক্যানভাস কইরা বেচতো।তবে এখন ওইটা পাবা কি না সন্দেহ আছে।"
সত্য সত্য মুখ কইরা আমার এমন মিথ্যা কথা বনানী বিশ্বাসই করলো বোধহয়!রিংডন মলম না পাওয়ার আশঙ্কায় তার মুখ কালো হইয়া গেল।আমি কোন মতেই ভেবে পাইনা আমার সকল গাঁজাখুরী কথা সে এমন বিশ্বাস করে ক্যান!বনানীর কালো করা মুখের দিকে তাকাইয়া আমার খুব মায়া লাগলো।এরকম কজন মেয়ে আছে যারা প্রেমিকের কাছে অসুখের সমাধান চায়।তাও আবার দাউদ বিষয়ক!
রিংডনের কথা একদমই যে মিথ্যা তা না।মহাখালীতে আমি একদিন এই মলম বেচতে দেখছিলাম ফুটপাতের এক হকাররে।
"শোন বনানী!তোমার টেনশন নেওনের কিছু নাই।আমি মলমের ব্যবস্থা করুমনে।এখন চলো কিছু খাই।তোমার পেটে দাউদ আর আমার পেটে খিদা।"
বনানী আমার কথা শুইনা হাসলো।এই মেয়েটার হাসিতে কিছু একটা আছে।পাশের মহল্লার পিংকি আপা এইরকম হাসতো।সাইকেল নিয়া দোকানে যাওয়ার পথে রোজ বিকালে দেখতাম পিংকি আপা বারান্দায় দাঁড়ায় থাকতো হাসি হাসি মুখ কইরা।যেদিন আমার দোকানে যাওয়া লাগতো না সেদিনও আমি সাইকেলে চেপে ওই রাস্তায় যাইতাম।তারপর একদিন কি যেন হইলো,শুনলাম পিংকি আপা গলায় শাড়ি পেঁচাইয়া সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুইলা পড়ছে।সেই ঝোলার পরদিন থেইকা আমি আর ওই বারান্দায় হাসি হাসি মুখ কইরা দাঁড়ায় থাকা পিংকি আপারে দেখি নাই।একদিন আমি বুঝলাম আমার খুব খারাপ লাগতাছে এই ভেবে যে হাসিটা আমি আর দেখতে পাবো না।
ভাতের উপর ডিম আর আলুর ঝোল দেইখা আমার খিদা যেন আরও বাইড়া গেল।অনেকদিন ভাত খাই না এইরকম ভাবে আমরা দুইজন খাইতে খাইতে চার প্লেট ভাত শেষ কইরা ফেললাম।তারপর ষাট টাকা বিল দিয়া হোটেল থেকে বাইর হইয়া কই যাবো এমন জায়গা না পাইয়া বললাম,"বনানী,ভরপেটে হাঁটতে ভালো লাগেনা।তুমি কি বাসায় চইলা যাবা?"
বনানী আবারও হাসলো।ঠিক সেই হাসিটা,পিংকি আপা শাড়িতে ঝোলার আগে রোজ বিকেলে বারান্দায় যে হাসিটা ফেলে যেত।
"বনানী,তোমার বাসায় যেতে হবে না।চলো কোথাও গিয়া বসি।সিগারেটের তেষ্টা পাইছে।সিগারেট টানতে টানতে তোমার সাথে গল্প করবো।আচ্ছা তুমি কি একটা পান খাবা?"
"খাওয়া যায়।"
বনানী খুব আয়েশ করে পান চিবাইতেছে।দেখতে ভালো লাগে।ছোটবেলায় নানীকে দেখতাম আয়োজন করে পানের বাটা নিয়া বসতো।আমরা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবো তখন বনানীকেও পানের অভ্যাস করাবো।ও পান খাবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো।
"বনানী,তোমার হাসিটা খুব সুন্দর।"
"হ!তোমাদের পাশের মহল্লার পিংকি আপার মতো।এই গল্প তুমি আমার কাছে একহাজার বার করছো।"
"তোমার খারাপ লাগে নাই কখনো?"
"কোন কারণে?"
"পিংকি আপার কথা বলায়!"
"নাহ্!তুমিতো আর আমার মাঝে অন্য কোন মেয়েরে খোঁজ না।এমন একজনরে খোঁজ যে তোমার জীবনের প্রথম ভালবাসার কথা জানার আগেই হারায় গেছে।"
আমি মাথা নিচের দিকে যথাসম্ভব ঝুলাইয়া বসলাম।একজন মানুষের মাঝে আরেকজনকে খোঁজা কতটা কষ্টের সেটা বনানী জানেনা।ও শুধু জানে পেটে দাউদ হইলে সেখানে সাবান লাগলে জ্বলে।অথচ আমি একটা ক্ষত সারাইতে কোনদিন মলম লাগাই নাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:০৬