somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জোটের ‘জটে’ আদর্শিক ব্যবধান বিলীন

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এবারের একাদশ জাতীয় নির্বাচন মূলত জোটগত নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো উপ-উপজোটের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে দু’টি বৃহত্তর জোট যারা মুখোমুখি ভোটের লড়াইয়ে নামছে। এর একটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও অপরটি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এর আগে পর্যন্ত মোটামোটি জোট দুটি ১৪ দলীয় ও ২০ দলীয় জোট হিসেবে পরিচিত থাকলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বর্তমানে সেগুলোর সাথে আরো অনেক দল ও উপজোট জোটবদ্ধ হয়েছে। ফলে একেকটি জোটে প্রকৃত দলের পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সাথে থাকা ৫৮টি দলের ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’ ছাড়াও একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা যুক্ত হয়েছে। এরশাদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটে ২টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও ২টি জোটসহ মোট ৪টি শরীক দল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয় ইসলামী মহাজোট এবং বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)। এর মধ্যে ইসলামী মহাজোটে রয়েছে ৩৪ ইসলামী দল এবং বিএনএতে আছে ২২টি দল। এ জোট-উপজোটসহ আওয়ামী লীগের সাথে আছে অরাজনৈতিক দল হেফাজতে ইসলামীর সমর্থন এবং ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমানের তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে ১৪ দলের সমন্বয়ে গঠিত ধর্মভিত্তিক নতুন জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স। আর পূর্ব থেকেই রয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী)সহ বেশকিছু বামপন্থী রাজনৈতিক দল, যাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোট নামে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসে।

অন্যদিকে আরেকটি জোট হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও নতুন করে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এতে বিএনপির ২০ দলীয় জোট ছাড়াও উল্লেখযোগ্য দলগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসু-চাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, আ স ম আব্দুর রব এর জেএসডি, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ।

এবারে নজর দেওয়া যাক দুটি বৃহত্তর জোটে জোটবদ্ধ হওয়া দলগুলোর বৈশিষ্ট্যের দিকে। আওয়ামী লীগ মূলত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল। তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী বলে বিশ্বাস করে। দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন স্বাধীনতার ঘোষক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বাধীন দল হিসেবে দলটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিনিধিত্বের দাবি অনেকাংশেই স্বীকৃত। তবে ঐ জোটের সাথেই আবার রয়েছে রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তক সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং সেই জোটেই আছে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বামপন্থী কয়েকটি দল। এরা হচ্ছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশে ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী)। অন্যদিকে অরাজনৈতিক দল হলেও হেফাজতে ইসলামী আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রসংশা করেছে। এর মধ্যে কওমী সনদের স্বীকৃতি প্রদানের কারণে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনাও দিয়েছে। শোকরানা মাহফিল নামে হেফাজতের ঐ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে ‘কওমী জননী’ খেতাব পাওয়ার পাশাপাশি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন আছে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমানের তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে ১৪ দলের সমন্বয়ে ধর্মভিত্তিক নতুন জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স।

অন্যদিকে বিএনপি মূলত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, যারা উদার ও মধ্যমপন্থী হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করে। দলটির সাথে রয়েছে ধর্মীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী বতর্মানে আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানো বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী। দলটি আদর্শিকভাবে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সাথে জড়িত ছিল। দলটি রাজাকার, আলবদর ও আল শামস নামে বিভিন্ন সামরিক-আধা সামরিক দল গঠন করে সারাদেশে এসব অপর্কম করে বেড়ায়। ফলে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেক নেতাই বিগত কয়েক বছরে সে সময়ের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের কারণে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকর্তৃক ফাঁসি ও বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।

আওয়ামী জোটকে মোকাবেলা করতে ঐক্যফ্রন্টের সাথে যুক্ত আছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমর নায়ক ও কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী। আছেন বঙ্গবন্ধুর আমলে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। আরো রয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী ও বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ উপাধি প্রদানকারী বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা আ স ম আব্দুর রব। ঐক্যফ্রন্টে ‘নাগরিক ঐক্য’ নিয়ে থাকা মাহমুদুর রহমানও এক সময় আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ গণফোরামের হয়ে ঐক্যফ্রন্টে যোগদানকারী ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এমএস কিবরিয়ার পুত্র ড. রেজা কিবরিয়াও ধানের শীষ প্রতীকে লড়তে নেমেছেন।

সবকিছু বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, উভয় জোটেই ধর্মপন্থী, মুক্তিযুদ্ধপন্থী ও একই সাথে বামপন্থী দলের মতো বিপরীত আদর্শের অবস্থান রয়েছে। সুতরাং বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যের দিক থেকে কোনো দলই স্বতন্ত্র হিসেবে দাবি করার যোগ্যতা রাখে না। বরং দেখতে পাই আদর্শ ত্যাগ করে বিপরীত আদর্শের সাথে যুক্ত হওয়ার সাংঘাতিক প্রবণতা। এমনকি একটি আদর্শের সাথে দীর্ঘদিন মোয়ামেলাত ও জোটে যোগ দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ঠিক নির্বাচনের আগেই সেই আদর্শের বিপরীত আদর্শের সাথে জোট করতে দেখা গেছে। এর জ্বলন্ত নজীর হচ্ছেন একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া, যিনি এক সময় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও এক সময়ে বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং বিএনপি থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন।

এই যে আদর্শ ত্যাগ করা বা বিপরীত আদর্শের সাথে জোটবদ্ধ হওয়া- এটা বর্তমান রাজনীতিতে আদর্শের বিলীন হয়ে যাওয়াকেই প্রমাণ করে। এ অবস্থা প্রমাণ করে আদর্শ নয়, দলগুলোর প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে কেবল ক্ষমতায় যাওয়া। এমতাবস্থায় সাধারণ ভোটারদেকে পছন্দের দল বাছাই করতে খুবই মুশকিলে পড়তে হবে। আর এই আদর্শের বিলুপ্তির সুযোগটা নেবে মূলত অর্থের দাপট ও পেশিশক্তি এবং দলের প্রতি বাছ-বিচারহীন অন্ধভক্তি। কারণ, তলিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে আদর্শিক বৈশিষ্ট্যে উভয় দলই আত্মসমর্পণ করে নিজেদেরকে এক কাতারে নামিয়ে ফেলেছেন। এছাড়াও উভয় জোটের প্রার্থীদের দিকে তাকালে দেখা যাবে ব্যবসায়ী, নব্য ধনীদের আনাগোনা প্রকট। আদর্শের বাছবিছার না করে বিপরীত আদর্শের ‘জট’ বাধিয়ে সৃষ্ট এ দুটো মেরু সবকিছু প্রবলভাবে গিলে নিয়েছে, যে কারণে আর প্রধান সারিতে তৃতীয় কোনো কোনো বিকল্প পক্ষ রইল না। আদর্শহীন বা আদর্শের সাথে আপসকারী, যেন-তেনভাবে ক্ষমতায় যেতে লালায়িত লোকে ভারাক্রান্ত লোক নিয়ে গড়ে ওঠা যে জোটই ক্ষমতায় যাক না কেন, ক্ষমতায় গিয়ে এসব রাজনীতিকগণ কতটা সৎ ও নৈতিকতাধারণকারী হবেন সেটা নিয়ে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিবর্গের মনে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×