somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রতর্ক

০১ লা আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- আপা ওড়না ঠিক করেন!।
চমকে পাশ ফিরে তাকালো নীলা। হেলমেট উঁচিয়ে কথাটা বলে ভুশ করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন মোটর সাইকেল আরোহী মাঝবয়েসি লোকটা। নীলার রিক্সা তখন চেরাগী পাহাড় থেকে জামাল খানের দিকে ঢালু রাস্তাটা বেয়ে নামছিল। এক হাতে বাজারের ব্যাগ, অন্য হাতে রিক্সার হুড ধরা নীলার। এই ঢালু জায়গাটা বেয়ে রিক্সা খুব দ্রুত নেমে যায়। প্রতিদিন একটা দুর্ঘটনার ভয়ে নীলা বারবার রিক্সা আস্তে চালাতে বলে । আজ কেমন যেন অন্যমনস্ক। ধক করে উঠলো বুকটা, লোকটার কথা শুনে। চমকে উঠে বাজারের ব্যাগ ছেড়ে ওড়না টেনে তুলে । রিক্সার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে প্রচুর দুর্ঘটনা হয় মেয়েদের। মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময় একবার, সুপ্রিয়া ম্যাডামের ক্লাস পালিয়ে ওরা তিন বান্ধবী রিক্সা নিয়ে বেড়াচ্ছিলো। দু'জন সীটে আর একজন উপরে বসেছে। বেশ হাসি গল্প চলছে। হঠাৎ চিল চিৎকারে রিক্সা উলটে সবাই নীচে। মুহূর্তেই আশপাশ থেকে লোকজন এসে জড়ো হয়। মাঝে বসা শায়লার ওড়না চাকায় আটকে গেছে। সবাই বলছে, ওরা যদি উলটে নীচে না পড়তো তবে শায়লার ঘাড় ভেঙ্গে যেত। কি ভয়ঙ্কর ঘটনা! শায়লার গলা পেঁচিয়ে কালশিটে দাগটা অনেকদিন ছিলো। আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে ঐ ঘটনা মনে পড়লে। এইদিকে ওড়না টেনে তুলতে গিয়ে বাজারের ব্যাগ ছেড়ে দেয়া মাত্র ব্যাগ নীচে পড়ে মাছ তরকারি সব চাকার নীচে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। নীলার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে বাজার সেরে কিছু ভালো মন্দ রান্না করবে বলে। অফিস থেকে বাসায় যেতে প্রতিদিন আটটা সাড়ে আটটা বেজে যায়। এতো ক্লান্ত লাগে। ফ্রেস হয়ে আর কিচেনে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। তাই শেষ ভরসা ডিমের ওমলেট। খেতে খেতে কেমন ঘাসের মতো মনে হয় আজকাল। জামিল সবকিছুই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খায়। তারপরেও নীলার মন খারাপ হয়। জামিলকে নতুন কিছু রান্না করে খাওয়ানোর সাধ হয়। কিন্তু এখন আবার কোথাও নেমে কিছু বাজার করার শারীরিক বা মানসিক কোনও শক্তি অবশিষ্ট নাই। ......... গল্পটা এখানেই থেমে আছে আজ মাস দুয়েক। শাহেদ আহমেদ। ভালো লেখক হিসেবে জনপ্রিয় আজকাল প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতাগুলোতে। শৌখিন লেখকদের যা হয়। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা সাহিত্য সমালোচনা কিছুই বাদ নাই। সবই লিখা হয়। আর তাই কিছুই বোধকরি মন থেকে করা হয় না। অন্তত ওর নিজের তাই মনে হয়। সব সময় কেমন একটা অতৃপ্তি। প্রতিটা লেখার পর। লেখাগুলো পত্রিকায় ছাপা হলে প্রায়শই কিছু বাহবা জোটে। কিন্তু তাতে কিইবা আসে যায়। ওর অতৃপ্তি কেবল বেড়েই চলে। এই নীলা আর জামিলের গল্পটা আসলে ঠিক গল্প বলা যায় না। ওটা ওদের জীবনকে ছোঁয়ার চেষ্টা। নীলা আর জামিল দু'জনই শাহেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। বেশ ঘনিষ্ঠই ছিল বলা চলে। জামিলভাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার তুখোড় ছাত্রনেতা। নীলা আর শাহেদ একই ছাত্র সংগঠন করতো। রাত দিন একসাথে মিছিল, মীটিং, পোস্টারিং, চিকা মারা। জামিলভাই ছিলেন ওদের নেতা। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের
সময়ে একবার ওদের মিছিলের উপর দিয়ে পুলিশ ট্রাক চালিয়ে দেয়। তিনজন ছাত্র মারা যায়। জামিলভাই পা হারান। নব্বই সালের গণ অভ্যুত্থানের সময়, অক্টোবরের দিকে, ছাত্র নেতারা সবাই যখন আত্মগোপনে, নীলা জামিল ভাইকে বিয়ে করে ফেলে। শাহেদ একটু কষ্ট পেয়েছে নীলা ওকে কিছুই বললো না বলে। দীর্ঘদিন বাম রাজনীতি করে শাহেদের মনটাও কেমন খানিকটা বস্তুবাদী হয়ে গেছে ততোদিনে। আবেগের লাগাম যুক্তির হাতে। নীলার এই সিদ্ধান্ত তাই মেনে নিতে পারে নি অন্য অনেকের মতো। ওদের এই রাজনীতিতে, এই সংগ্রামে নীলার আরও অনেক দেয়ার ছিল। অন্তত সেন্ট্রাল কমিটির তাই ধারণা।

নব্বইয়ের শেষে এরশাদ সরকারের পতনের পর, শাহেদও সক্রিয় রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসে। ক্লাসে যাওয়া শুরু করে। ওর বিষয় ছিল পরিসংখ্যান। আর ওর কাছে ঐ পরিসংখ্যান ছাড়া সবই ভালো লাগতো। তারপরও দাঁত কামড়ে ধরে ঐ নীরস বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে। কিছুদিন চাকরি করে এদিক সেদিক। মানিয়ে ওঠতে পারে না। ব্যবসা করার চেষ্টা করে। তা মানিয়ে ওঠা আরও কঠিন। মাঝখানে শক্তি ও অর্থের অপচয়। তাই সব ছেড়েছুঁড়ে একেবারে ঘরে এসে গেঁড়ে বসেছে। ছাত্র জীবন থেকেই টুকটাক লিখালিখি করতো। আপাতত সেটাই বেছে নিয়েছে। পত্রিকাগুলোতে তৃতীয় সারির লেখক হিসেবে কদর খারাপ না। কারণ প্রথম সারির লেখকদের আজকাল বিশেষ সংখ্যাগুলোতেও আগাম টাকা দিয়ে পাওয়া কঠিন। উনারা বই নিয়ে ব্যস্ত। দ্বিতীয় সারির লেখকরা ভীষণ ব্যস্ত হাজারো দৈনিক আর সাপ্তাহিকের বিশেষ সংখ্যা পুরনের জন্য। নিয়মিত সাহিত্য পাতাগুলোতে শাহেদদের মতো লেখকদের কদর বেশী। সম্পাদকদের কাছে এঁরা সদ্য পরীক্ষা উতরানো তাজা মেধা। এখনো নরম পলিমাটি। এঁদের দিয়ে পত্রিকার পাতা ভরার জন্য দরকারি সবই করানো যায়। ছোট গল্প, কবিতা, বিদেশী গল্পের অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা... সবই। এভাবেই শাহেদ জমে যায় সাহিত্যে বা ওর ভাষায় 'খৈ ভাজায়'। শাহেদের গল্প থাক। আজ আমরা নীলার গল্প শুনবো।

বৃহস্পতিবার। সপ্তাহের শেষ দিন। ব্যাংকে বেশ ভিড়। শাহেদ একটা চেক নিয়ে এসেছে।
- শাহেদ কেমন আছো?
পাশ থেকে অনেক কাছের এক কণ্ঠস্বরে চমকে ফিরে তাকালো শাহেদ। নীলা দাঁড়িয়ে আছে। নীলচে রঙের শাড়ি, উঁচু করে বাঁধা চুল আর সেই আগের মতন পাতলা স্লিপার পায়ে। আগের চেয়ে একটু শুকিয়েছে। চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ কি? শাহেদের অবাক দৃষ্টির সামনে কেমন বিব্রত বোধ করে নীলা। এতদিন পর শাহেদকে দেখে খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচছে করছে। কত কথা, কত স্মৃতি ওদের!
- নীলা! তুমি এখানে? কবে থেকে? কোথায় থাকো? মানে বাসা কোথায়? জামিল ভাই? উনি কেমন আছেন?
হড়বড় করে কথার ট্রেন চালু করে যেন শাহেদ।
- আরে থামো! এখন এতো কথা বলা যাবে না। কাজের সময়। বাসার ঠিকানা রাখো। আগামী পরশু অফিস ছুটি। সকাল এগারোটা নাগাদ চলে এসো। অনেক কথা আছে।
কাগজ উল্টে ঠিকানাটা দেখলো শাহেদ। চন্দনপুরাতে একটা গলির ঠিকানা লেখা। শাহেদের বাসার কাছেই। কি অদ্ভুত!

এর পরের ঘটনাগুলো শাহেদকে ওর প্রাত্যহিক ধুসর জীবন থেকে ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিয়ে যেন রংধনুতে বসিয়ে দেয়। নীলার বাসায় জামিল ভাই আর নীলা সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে ফিরিয়ে আনে। জামিল ভাই হুইল চেয়ারে। অনেক পালটে গেছেন। সময়ে অসময়ে শাহেদ গিয়ে হাজির হয় নীলার অফিসে। অফিস ছুটির পরে এদিক সেদিক বসে পড়ে। চা কফি হয়। ওরা হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো নতুন করে সাজাতে থাকে। শাহেদ একাই থাকে। প্রায়শই ওকে রাতের খাবার নীলাদের বাসায় খেতে হয়। এর মধ্যে দুবার জামিল ভাইয়ের অনুরোধে নীলাকে নিয়ে সারাদিন বেড়িয়েছে এদিক সেদিক। ওরা কত কাছের ছিলো তা বোধকরি ওদের চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিলো ওদের অজান্তেই। জামিল চেয়ে চেয়ে দেখে নীলার বদলে যাওয়া।
- আজও কি বাসায় ফিরতে দেরি হবে?’
জামিলের প্রশ্নে চমকে উঠে নীলা। সকালে ঘুম থেকে ওঠতে দেরি হয়ে গেছে তাই একটু তড়াহুড়া করছিলো। ভাজাভুজি কিছু করার সময় ছিলো না, কোনোরকমে তিনটা রুটি সেঁকে একটা ডিম পোচ করে টেবিলে রেখেছে। জামিলের সকালের নাস্তা। গায়ের জামা নিয়ে বাথরুমে ছুটছিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই সিনিয়র কলিগ রাশেদা আপা চলে আসবে ওকে উঠিয়ে নিতে। রাশেদা আপাকে ফিরিয়ে দিলে একা একা অফিস যেতে অনেক হ্যাপা। অফিস সময়ে রিক্সা পাওয়া যায়না। আজকাল কি সব ব্যাটারি রিক্সা বেরিয়েছে, নীলার আতঙ্কে কাঠ হয়ে বসে থাকে ওসব রিক্সায় ওঠলে। ঠিক ঐ মুহূর্তে জামিলের প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না নীলা। না আর হা মাঝামাঝি একটা শব্দ করে বাথরুমে ঢুকে যায়। আজকাল ব্যাঙ্কেও দেরি হচ্ছে বের হতে আর হুটহাট করে শাহেদ চলে আসে। তারপর দুজনে কোথাও বসে পড়ে। শাহেদ এখনো আগের মতো তুখোড় আড্ডাবাজ, হাসিখুশি। ওর সাথে আড্ডায় কিছুক্ষন বসলে শারীরিক মানসিক অবসাদ ঝেড়ে ফেলে নতুন পাতা গজানোর মতো চনমনিয়ে ওঠে নীলা। মাঝে মাঝে বাজারটাও সারে একসাথে। শাহেদের বাজার করাটা দেখার মতো। তরকারি কিংবা মাছ টিপেটুপে দেখবে, জানতে চাইবে কোথাকার, হাইব্রিড না দেশী। এ যেন ঠিকুজি নেওয়া। দরদাম শেষ করে বেছে বেছে ওজন করতে দেয়। নীলা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ওর কাণ্ড। ওর সাথে কিছু সময় কাটানোর লোভে হলেও অফিস শেষে ওর জন্যে অপেক্ষা করে প্রতিদিন। বাথরুম থেকে বের হলে জামিল আবার প্রশ্নটা করে। এবার একটু বিরক্ত বোধ করে নীলা। বলে, ‘এখন বলা সম্ভব নয়।‘ ...
ওর মুখের কাঠিন্য জামিলের নজর এড়ায় না। জামিল চুপচাপ রুটিতে ডিম ভেঙ্গে মুখে দেয়।
সেদিনও বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। অফিসের এক সিনিয়র কলিগের মেয়ের বিয়ে। সবাই যাচ্ছে তাই ও আর এড়াতে পারলো না। বাসায় এসে দেখে ঠিকে বুয়া’র রান্না করা খাবার টেবিলে পড়ে আছে। জামিল টিভিতে খবর দেখছে। খায়নি এখনো। নীলা কাপড় পালটাতে পালটাতে বললো,
- শোন, আমার একটা বিয়েতে যেতে হয়েছিল, খেয়ে এসেছি, তোমার খাওয়া কি রেডি করবো?’
- নাহ, বুয়া বলেছিলো খেয়ে নিতে, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বরং খাবারগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে শুয়ে পড়ো।‘
জামিলের চোখ দুটো বিষণ্ণ। কথা বাড়াল না নীলা। জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখে বেশ করে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে নিল। গোসল করতে পারলে ভালো হতো। ওর আবার এলার্জির ধাত। এই রাতে গোসল করলেই হাঁচি শুরু হয়ে যাবে। শোবার ঘরের বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ে নীলা।

কি অদ্ভুত সব বাঁক মানুষের জীবনে। নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারে বেড় ওঠা নীলার জীবনে আবেগের জায়গা কমই ছিল। অনটনের নিষ্ঠুরতা, আকাঙ্খার নিত্য অপহরণের কষ্ট ওকে কঠিন করে তুলেছিলো। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ও বাম রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মিটিং মিছিলের পাশাপাশি স্টাডি সার্কেলগুলোতে ওর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। পার্টি রাজনীতি করতে এসে জামিল ভাইয়ের সাথে নীলার সম্পর্ক ঠিক সেই অর্থে ঘনিষ্ঠ ছিলো না। নীলার পোটেনশিয়ালিটি পার্টির নেতৃত্বকে ওর প্রতি বিশেষ সচেতন করে তুলেছিলো তা অবশ্য পার্টির রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ সবার জানা ছিলো। পার্টির কেন্দ্রীয় স্টাডি সার্কেলগুলোতে সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নীলাকে প্রশ্ন, যুক্তি-তর্ক কিংবা আলোচনার সুযোগ করে দিয়ে ওর একটা বিশেষায়িত রূপ দলের তৃণমূল পর্যায়ে তুলে ধরা হয়েছিলো। জামিল ওকে স্নেহের চোখেই দেখতো। সেইদিনের সেই দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে জামিলের হাত ধরে নীলা যখন ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, জামিল শুনেই না করে দিয়েছিলো। জামিল জানতো পার্টির প্রতি, রাজনীতির প্রতি কিংবা এর সাথে জড়ানো মানুষদের প্রতি নীলার কমিটমেন্টই নীলাকে এটা করতে বলছে। ও একটা ভুল করতে যাচ্ছে। এই ভুলের খেসারত হয়তোবা ওকে সারাজীবন টেনে যেতে হবে। নীলার দৃঢ়তার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলেও জামিলের মনের কোথাও একটা কাঁটা খচখচ করছিলো নীলা কি ওকে করুনা করছে?

পরদিন অফিসে এসেই হাতে চিঠি পায় নীলা। ঢাকায় হেড অফিসে ‘এসেট লাইয়েবিলিটি ম্যানেজমেন্টে’র উপর দু’দিনের একটা ট্রেনিং। চট্টগ্রাম অফিস থেকে ও আর রাশেদা আপা যাচ্ছে। জামিলকে নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন নীলা। ঠিক এই সময় জামিলের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায় না ও। কিন্তু এই ট্রেনিংটা এড়ানো সম্ভব না। শাহেদকে ফোনে আসতে বলে কাজে মন দেয় নীলা। অফিস ছুটির পর শাহেদকে নিয়ে সেই পরিচিত কফি শপে। জামিলের সাম্প্রতিক আচরণ, ওকে নিয়ে নীলার উদ্বেগ, ঢাকার ট্রেনিং সব শাহেদকে বলে নীলা। সব শুনে শাহেদ হেসেই উড়িয়ে দেয় নীলার উদ্বেগ। বলে,’ তুমি ঢাকায় ট্রেনিং সেরে আসো। জামিল ভাইকে নিয়ে চিন্তা করো না। ওনার ব্যাপারটা আমি দেখছি। আমার কিছু প্ল্যান আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।‘ রাতে শোবার সময় জামিলকে ট্রেনিং এর কথাটা বলে নীলা। জামিল ‘হু’ বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

ঢাকায় যাবার দিন ভোরে উঠেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেলে নীলা। বুয়াকে ডেকে সব বুঝিয়ে দেয়। শাহেদকে ফোন করে। শাহেদের ফোন বাজছে, শাহেদ ধরছে না। লেখকদের মধ্যে শাহেদ ব্যতিক্রম। ও কখনোই রাত জাগে না। খুব ভোরে উঠে। ফোন হয়তো বালিশের নিচে চাপা পড়ে আছে কিংবা সাইলেন্ট করা আছে। আজকে অফিস করে বিকালে ঊর্মি গোধূলিতে চাপবে ওরা। ঢাকায় রাশেদা আপার বড় মেয়ের বাসায় থাকবে, মোহাম্মদপুরে। জামিলকে ডেকে দিয়ে বাথরুমে ঢোকে নীলা। আজ একসাথে সকালের নাশতা করার ইচ্ছা। নাশতার টেবিলে জামিল চুপচাপ। কি যেন ভাবছে। হু হা ছাড়া উত্তর দিচ্ছে না। কিছু একটা হয়েছে। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বেরোয় নীলা।

সেদিনই শাহেদ ওর দু’জন সাংবাদিক বন্ধুকে নিয়ে নীলার বাসায় আসে। একটা জাতীয় দৈনিকে আগামী ৪ঠা ডিসেম্বর, স্বৈরাচার পতন দিবসে জামিল ভাইয়ের একটা লেখা যাবে, সাথে জামিল ভাইকে নিয়ে একটা ফিচার করবে। জামিল ভাই ওদের সাথে বেশ হাসিখুশি জমিয়ে আড্ডা দেয়, কিন্তু ওনাকে নিয়ে ফিচার করার ব্যাপারে মোটেই রাজি নন। অনেক কষ্টে ওনাকে আপাতত একটা লেখা দেয়ার ব্যাপারে রাজি করানো যায়। লেখার সঙ্গে ওনার ফিচারটা পত্রিকার কাটতি অনেক বাড়াবে তাই সাংবাদিক দু’জন এখনই হাল ছাড়তে রাজি নন। নীলা আগেই বলেছিলো জামিল ভাইয়ের অনেক লেখা পড়ে আছে। জামিল ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে শাহেদ লেখাগুলোতে চোখ বোলাতে থাকে। অনেক অনেক লেখা। কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, গল্পের খসড়া, প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রস্তাবনা, কি নেই! এই লেখাগুলোকে আরেকটু পালিশ করতে পারলে হৈ হৈ পড়ে যাবে। সারাদিন জামিল ভাইয়ের সাথে থেকে রাতে ফেরে শাহেদ। পরদিন একটা অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক সাথে নিয়ে জামিল ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওদের মন্তব্য পেজের দায়িত্ব নেবে বলে রাজি হয় জামিল ভাই। ওরা একা হলে আবার জামিল ভাইয়ের লেখা নিয়ে পড়ে শাহেদ। সন্ধ্যায় কয়েকজন বন্ধুসহ জমিয়ে আড্ডা দেয় জামিল ভাইয়ের সাথে। সবাই চলে গেলে জামিল ভাইকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা নিয়ে লেখাটা আরও একটু গোছাতে বলে শাহেদও বেরিয়ে আসে। একা হলে সমস্ত ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে জামিল। একটা অপরাধবোধ ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। বিয়ের পর থেকেই নীলাকে দেখছে কেমন ঘাড় গুঁজে সংসার করে যাচ্ছে। ওর আনন্দগুলোর উপর যেন ছাই ছিটিয়ে দিয়েছে ওর কর্তব্যবোধ। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে কর্তব্যবোধ ছাড়াও তৃপ্তি আর আনন্দের অনুভূতিগুলো সম্পর্ক আরও সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা দেয়। ওদের সম্পর্ক থেকে কি আনন্দ আর তৃপ্তি চলে গেছে? শাহেদের সাথে দেখা হবার পর থেকে নীলার পরিবর্তন জামিলকে ভাবিয়ে তুলেছে। পার্টির রাজনীতি করাকালীন শাহেদের সাথে নীলার সম্পর্ক কেমন ছিলো তা জামিল জানতো না। নীলাও কখনো এ ব্যাপারে কিছু বলে নি। নীলা আর শাহেদ যখন একসাথে থাকে ওদের আচরণ, খুনসুটি, বন্ধুত্ব যতটা না ওদের আনন্দ দেয়, জামিলকে পোড়ায় বেশি। জামিল কি ওদের সম্পর্কের মাঝখানে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে?

ঢাকা থেকে আসার সময় ট্রেন লেট করে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। নীলার হাতে ব্যাগ ছাড়াও বেশ কিছু বই জামিলের জন্যে। ঢাকায় গেলেই শাহবাগে আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে একবার ঢুঁ মারে নীলা। তালা খুলে বাসায় ঢুকেই চমকে যায়। পুরো বাসা অন্ধকার করে বেডরুমে জানালার পাশে বসে আছে জামিল। নীলা পাশে দাঁড়াতেই চমকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকায়। জামিলের চোখে চোখ পড়তেই নিজের ভেতরে প্রচণ্ড ঝাঁকি খায় নীলা। যেন মৃত মানুষের চোখ দেখছে। কি হয়েছে জামিলের? ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নীলা, আলতো করে ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে। হুইল চেয়ারে বসেই দুহাতে নীলাকে যেন আঁকড়ে ধরে জামিল। একটা অব্যক্ত বোবা কষ্টে থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। চুপচাপ জামিলকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে নীলা। আর তখনই হঠাৎ উপলব্ধি করে ওর ভালোবাসাটা আসলে জামিল কখনো বুঝতেই পারেনি। ওর জীবনে জামিলের অস্তিত্বের ভিত কত গভীরে তা বোধ করি জানেই না জামিল। শাহেদকে দেখে, শাহেদের ছটফটে তারণ্যকে জামিল হয়তো নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পরাজয় মেনে নিয়ে অসহায় নিঃসঙ্গ জামিল যেন নিজেই নিজের শব বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নীলাও...
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×