আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদটা কোথায়? শিক্ষা ব্যবস্থা কেন
আপামর জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারছে না- এসব কথা
কেউ কখনো ভেবে দেখেছেন কি? পরিসংখ্যান বলে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার এই প্রকৃত অবস্থা কি একুশ শতাব্দীর পৃথিবীতে আমাদের জন্য মর্যাদাহানিকর নয়? বর্তমান যুগে পুরো বিশ্ব যখন দেশ, জাতি, ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে এক বিশ্বে রূপান্তরিত হওয়ার অপেক্ষায়, সেখানে আমরা পুরো জাতিকে শিক্ষার আলো দিতে পারছি না- এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু এই দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এখন দিন এসেছে জেগে ওঠার। জেগে উঠে বিশ্বকে গড়ার। ১৬ কোটি জনশক্তির এ দেশে বিশাল এক জনসম্পদ যে লুকিয়ে আছে তা দেখার মত নেতৃত্ব আমাদের মাঝে আছে। সে নেতৃত্ব এই বিশাল জনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্নে বিভোর। এখন দরকার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার।
কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা বিশ্ব থেকে আমাদের ক্রমেই পিছিয়ে দিচ্ছে। এদেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে যদি শিক্ষিত করে তোলা যেতো, তাহলে কি অবস্থাটাই না দাঁড়াতো। দেশের চেহারা আমূল বদলে যেতো। কিন্তু এটিও মানতে হবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা সবার জন্য শিক্ষাকে
'সুযোগ কিংবা অধিকার’ কোনটি হিসেবেই দাঁড় করাতে পারছি না।
রাষ্ট্রীয়ভাবেও আমাদের সম্পদ এত সীমিত যে, আমরা সবার জন্য শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে পারবো না। আবার দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের কারণে নিজেরাও শিক্ষার পেছনে অর্থ ব্যয় করবে সে সামর্থ্য নেই। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, সবার জন্য শিক্ষা, টিএলএম বা টোটাল লিটারেসি মুভমেন্ট, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা, অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা ইত্যাদি নানা নামে শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
শিক্ষার হার বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর পাঁচ ছয়টি প্রকল্পের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার হার প্রকৃতপক্ষে কতটুকু বেড়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। শিক্ষার হার বাড়ার এই ধীরগতি আমাদের ক্রমেই পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রটা ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, ঘরে বসেই একজন আমেরিকা, কানাডা ও বৃটেনের কোন ইউনিভার্সিটি থেকে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করবে। এখন আমরা প্রচুর পয়সা খরচ করে ডিগ্রি আনার জন্য বিদেশে ছুটে যাচ্ছি। দেশে বসেই এটি সম্ভব এবং তা তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে। তথ্য প্রযুক্তি দিন দিন বিশ্বব্যাপী এতটাই উন্নত হচ্ছে যে, পুরো বিশ্বই এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এ বিশ্ব থেকে যে যত বেশি তথ্য আহরণ করে রাখতে পারবে, বিশ্ব নেতৃত্বে সে ততো বেশি যোগ্যতার অধিকারী হবে। আজ সেরকমই আবহাওয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা সে আবহাওয়ার সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা সম্মিলিতভাবে চালাচ্ছি না। এটি আমরা ভুল করছি। তথ্য প্রযুক্তির এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
অগ্রগতি অর্জনের পাশাপাশি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজ থেকে আগে দারিদ্র্যকে নির্মূল করতে হবে। এটি এখন পরীক্ষিত সত্য। একজন লোক যখন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক সুবিধাগুলো পেয়ে যাবে স্বাভাবিকভাবেই সে লোকের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। দারিদ্র্যের হাত কর্মীর হাতে পরিণত হলে অপরাধের হাতে আর রূপান্তরিত হবে না। শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত শ্রেণী থেকেই যে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটে এটা অনস্বীকার্য। সমাজের গরীব শ্রেণীকে শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় দারিদ্র্য বিমোচনের নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে। ফলে সমাজে সন্ত্রাসের মাত্রা কমে আসবে। শান্তির আবহ বিরাজ করবে সমাজের সর্বত্র।
একমাত্র তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এ মাধ্যমটিকে সহজলভ্য করে শিক্ষিত করে তোলা যায় দেশের সব মানুষকে। আজ অনেকের ঘরে টেলিভিশন, ডিভিডি শোভা পায়। এটুকু অর্থ ব্যয়ে তথ্য প্রযুক্তির অন্যতম মাধ্যম একটি কম্পিউটার যদি ইন্টারনেট সংযোগসহ মানুষের হাতে হাতে তুলে দেয়া যেতো, তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কি বিপ্লবটাই না ঘটানো যেতো। রেডিও হল সবচেয়ে কম দামী এবং সহজলভ্য একটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি যা দরিদ্র মানুষের নাগালের মধ্যে রয়েছে। Life Long Education -কে সামনে রেখে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেও আমরা পুরো জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলার প্রচেষ্টা হাতে নিতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশের অদূরদর্শী নেতৃত্বের হাতে পড়ে তথ্য প্রযুক্তি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা দিনদিন পিছিয়ে পড়ছি।
শিক্ষা ও কর্মসংস্থানঃ
দারিদ্র্য দূর হওয়ার সঙ্গে শান্তির যে একটা সহানুগমন আছে তা বোধকরি সবাই স্বীকার করবেন। দারিদ্র্য দূর করার অনেক উপায়ের মধ্যে একটি যে শিক্ষা- একথাও সবাই মেনে নেবেন। কিন্তু আমাদের দেশে দরিদ্র লোকেরা শিক্ষার সুযোগ পায় না। দারিদ্র্যের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে যুদ্ধ
করতে করতেই তাদের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা, শিক্ষা নেবে কখন? এই যখন অবস্থা পুরো দেশের সেখানে শিক্ষার মধ্যেই কর্মসংস্থানের উপায় বের করে নিতে হবে।
বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে ‘ব্যবসায় উদ্যোগ ও ব্যবহারিক ব্যবস্থাপনা’ নামে একটি পাঠ্য বই আছে। বিশ্ব বাণিজ্যের এ যুগে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এখন বাণিজ্য পাঠের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু এ বিষয়ের তাত্ত্বিক পাঠ অংশ কিংবা ব্যবহারিক পাঠ অংশ শিক্ষার্থীদের মনে কোনো ব্যবসায়ের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা জাগিয়ে তুলছে না। কেননা সে পুঁজি পাবে কোথায়? আর কি ব্যবসাই বা সে করবে? কিন্তু লোকাল কারিকুলাম পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে একজন শিক্ষার্থী নিজস্ব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের উদ্যোক্তা হবে এবং আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ হবে।
এখন প্রশ্ন হল শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা কি আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ এটি সম্ভব। সেন্ট্রাল কারিকুলামের আওতায় লোকাল কারিকুলাম অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের এক একটি মাইক্রো বিজনেসের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সরকার বছর বছর উপবৃত্তি প্রদানের নামে ছাত্রীদের খয়রাতি সাহায্য প্রদান করছে। এ অর্থ ব্যয় জব মার্কেটে কি প্রভাব ফেলছে তা খতিয়ে দেখছে না। হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করে নারী শিক্ষার হার কিঞ্চিত বাড়িয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেও পুরো জনগোষ্ঠীর কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে না পারলে আমরা বিশ্ব
থেকে ক্রমেই পিছিয়ে যেতে থাকবো।
লোকাল কারিকুলাম পদ্ধতি শিক্ষা ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে দারিদ্র্যের মূলোৎপাটনে সহায়তা করবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানমূলক শিক্ষা প্রয়োগ করে আমরা দারিদ্র্য বিমোচন ত্বরান্বিত করতে পারি। দ্রুততার সঙ্গে এই প্রচেষ্টা হাতে নিতে না পারলে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্ব নেতৃত্ব দিয়ে শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। তখন আমাদের হা-হুতাশ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১০ রাত ১১:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



