এই কঠিন দেশের কঠিন, রুক্ষ প্রকৃতি গড়ে তুলেছে ওদের চরিত্র । দৃঢ় ন্যায়বিচারবোধ, অপরাধীকে শাস্তি প্রদানে কাঠিন্য, এবং অনুসরণে একগুঁয়ে । মরুভুমিতে গড়ে নিয়েছে ওদের বাড়ি, মরুভুমি থেকেই ওদের নৈতিকতাবোধের সৃষ্টি । এবং মরুভুমি সবসময়ই নির্দয় ।
'যাচ্ছে কোথায় লোকটা?"
'বাড়িতে, সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক । খাবার আর একটা রাইফেলের দরকার এখন ওর সবচেয়ে বেশি । বুড়ো সোরেনসোনের জায়গায় থাকে ও ।'
থুতু ফেলল কিমেল । 'সে চেষ্টা ও করে দেখতে পারে । ওখানে অন্তত চারজন লোক না খেয়ে মরেছে আমার জানামতে ।' বলে মাটিতে ঘোড়ার খুরের ছাপগুলোর দিকে চাইল সে । 'ভালো একটা ঘোড়ায় পেয়েছে সে ।'
'বড়সড় একটা বাকস্কিন ঘোড়া । তোমার মনে হয় আমরা ওকে ধরতে পারব হার্ডিন ?'
'নিশ্চয়ই । অবশ্য অনেকদুর দৌড়ুতে হবে আমাদের তাতে কোন সন্দেহ নেই । কারন শর্টকাট কোন রাস্তা ধরে ওর পথ আটকানোর কোন উপায় নেই আমাদের । আর একবারে সোজা বাড়ির পথে চলেছে সে ।'
'ট্রেইল লুকানোর কোন চেষ্টাই করছেনা ও ।'
'লাভ নেই ।' রোদের ঝাঁজ এড়াতে চোখ সরু করে চাইলো হার্ডিন । 'এ লোক জানে, আমরা বুঝে নেবো সোজা নিজের র্যাঞ্চের দিকে যাবে ও ।'
'আনাড়ি নয় লোকটা,' ওদের সবার মাথায় যে চিন্তাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সেটা মুখ ফুটে বলল কেসনি । 'ও জানে এরকম বন্ধুর রাস্তায় কীভাবে একটা ঘোড়াকে বাঁচিয়ে চলতে হয় ।'
প্রায় নিঃশব্দে পথ চলছে ওরা সবাই । দাড়ি না কামানো গাল চুলকাল হার্ডিন । ক্যাটক্ল আর মেসকিটের ঝোপের মাঝ দিয়ে চলছে ওরা, ঘোড়ার খুরের ঘায়ে ধুলোর মেঘ উঠছে । রোদে ঝলসানো, পানিশুন্য প্রান্তর এটা । রোদের তাপে ধুলির ঘুর্নি আর দূরের নীলাভ পর্বত শ্রেণী টেনে নিয়ে চলেছে ওদের । যে ট্রেইলটা ধরে চলেছে ওরা ওটা একদম সোজা চলে গেছে সামনের দিকে । কেবল নাবাল জমি বা পাথুরে কোন ছোট টিলার কাছে এসে পথটা বাঁক নিয়েছে ।
কাকে অনুসরণ করে চলছে, সে কেমন মানুষ তা চোখে দেখার সবসময় প্রয়োজন নেই, তার চলার পথচিহ্নই যথেষ্ট অনেক ক্ষেত্রে তা বলে দেয়ার জন্য । সে কী বিবেচনাশীল না নিষ্ঠুর, অজ্ঞতা বা ধুর্ততা, শক্তি ও দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার রেখে যাওয়া ট্রেইলে । ফ্রিডম শহর থেকে বেরিয়ে ঘন্টাদুয়েক ঘোড়া দাবড়ানোর পর লোকটা সম্বন্ধে অনেক কিছুই বুঝে ফেলল ধাওয়া করে আসা ছয়জন লোক । আরও অনেক কিছু জানবে ওরা চলার পথে ।
'কীসে শুরু হয়েছিল এটা ?'
কথাগুলো এই বিশাল নিস্তব্ধ শূন্যতার মাঝে ফাঁপা আর নিঃসঙ্গ শোনাল ।
হার্ডিন মাথা সামান্য ঘোরাল যাতে পেছনের লোক শুনতে পায় তার কথা । বৃষ্টি আর রোদের মধ্যে অনেক ঘোড়া চালিয়েছে যে লোক, এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে । রাইফেলটা বাঁহাতে চালান দিয়ে, ঘেমে যাওয়া ডানহাতের তালু প্যান্টের কর্কশ কাপড়ের ওপর ঘষল সে ।
'কানকথা । বনটনে এসেছিল লোকটা সওদাপাতি কিনতে । একটা কিছু বলেছিল তাকে জনি, তাতে ওর আঁতে ঘা লাগে । কিছু কথা কাটাকাটি হয় । জনির কাছে পিস্তল ছিল, কিন্তু এই লক লোকটা ছিল নিরস্ত্র । তো একটা পিস্তল যোগার করে লংহর্নে হাজির হল লক । দরজা ঠেলে ঢুকেই জনিকে সোজা দুবার পিঠে গুলি করল লক ।' থুতু ছেটাল হার্ডিন । 'তিননম্বর গুলিটা জনিকে মিস করে একটা হুইস্কির বোতল গুঁড়িয়ে দিল ।'
কথাগুলো হজম করতে ওরা কয়েকমুহুর্ত সময় নিল, তারপর মুখ খুলল নীল ।
'আমরা কী ওকে মানুষ খুনের দায় না কী হুইস্কির বোতল ভাঙ্গার জন্য ঝোলাতে যাচ্ছি ?'
ভালো প্রশ্ন, কিন্তু কোন উত্তর এলনা । কৌতুক জিনিসটা বাকি পাঁচ আরোহীর সন্মানের ওপর প্রশ্ন তুলতে পারেনা । একটা মিশনে বেরিয়েছে ওরা । ধুসর তামাটে মরুভুমির ওপর চোখ বোলাল নীল, কোন মানুষকেই লিঞ্চ করার ইচ্ছা নেই তার । এবং কেন সোরেনসন প্লেসের এই স্কোয়াটারকে ঝোলাতে সে চলেছে সে নিজেই জানেনা । ওরকম জায়গায় থাকাটাই তো একটা শাস্তি বিশেষ ।
'ও নাম কী বললে ? লক ?' জানতে চাইল নীল । কারো নাম না জেনেই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়াটা বেশ আজব ব্যাপার । দূরের নাচতে থাকা মরীচিকা হ্রদগুলোর দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে, জিনের ওপর দেহের ওজন পরিবর্তন করল নীল ।
'তাতে কী হয়েছে? ওর নাম লক, চ্যাট লক ।'
'অদ্ভুত নাম ।'
মন্তব্যটার জবাব দিলনা কেউ । ধুলো আরো গাঢ় হয়ে উঠছে, নীল ব্যান্ডানা রুমালটা নাক-মুখের ওপর টেনে নিল । তার চোখ আবার দূরের নীল হ্রদের দিকে চলে যাচ্ছে । ভারী ঠান্ডা আর লোভনীয় দেখাচ্ছে ওগুলোকে । সামনে ডানদিকে বেসিনের শেষ মাথায় এদের অবস্থান । মরীচিকা ওরা, অনেক মানুষকে টেনে নিয়ে গেছে পথ থেকে, ক্রম অপসৃয়মান তটরেখার দিকে । যতই এগোয়ে পথিক ততই পিছিয়ে যায় মরীচিকা ।
হয়তো সত্যিই পানি আছে এই দাবদাহ আক্রান্ত প্রান্তরে । একজন মানুষ যদি তার খোঁজ পায় তো পান করতে পারে । কথাটা মাথায় আসতেই হাত চলে গেল পানি রাখার ক্যান্টিনে । কিন্তু পানি না খেয়েই সরিয়ে নিল হাতটা । পাত্রের পানি গরম, নোনা আর অতৃপ্তিকর ।
'তুমি ওকে চেনো কিমেল?' কেসনি জানতে চাইল । মানুষটা ছোটখাটো কিন্তু চাবুকের মত মজবুত, ইস্পাতের মত কঠিন চোখ আর বাদামী পাকানো পেশীবহুল বাহু । 'দেখলে চিনবোনা আমি ওকে ।'
'অবশ্যই আমি ওকে চিনি । বিশালদেহী, পেটানো গড়ন, লালচে চুল, বছর চল্লিশেক হবে বয়স । বেশ দিলদরিয়া চেহারা, শুনেছি বেশ আমুদে বন্ধুবৎসল মানুষ সে । সোরেনসন প্লেসে বিনা অনুমতিতে বসবাস করছে, যদিও ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক । রোদে শুকানো হাড্ডির মত উষর জায়গাটা, ওখানে কেউ কিছু করে খেতে পারবেনা । মানুষ বা পশু কেউই বেঁচে থাকতে পারেনা ওরকম একটা জায়গায় । সবার ধারনা ওরকম একটা জায়গায় কোন সৎ লোক থাকতে পারেনা ।'
সত্যি একটা লোককে না দেখে তাকে খুঁজতে বেরোনো অদ্ভুত । অবশ্য ওরা সবাই জনি ওয়েবকে চেনে । সুদর্শন, জনপ্রিয়, দুঃসাহসী এক তরুন । সবাই তাকে চিনতো ও পছন্দ করত । ওদের ধারনা, নবাগত লোকটা অন্যায় করেছিল, কারন শুধু পিঠৈই গুলি খায়নি ওয়েব, আসলে সে পিস্তল ড্র করায়ও খুব ক্ষিপ্র ছিল । গোটা স্প্রিং ভ্যালি এলাকাতেই ওর মতো এতো ক্ষিপ্র পিস্তলবাজ আর দুটো ছিলনা । ক্ষিপ্র ও অব্যর্থ নিশানা ।
জনি ওয়েব ওদের সাথে কাজ করেছে । ওরা ওকে চেনে, ওরা ভালো মানুষ, যদিও রুক্ষ ও কঠিন স্বভাবের । কিমেল, হার্ডিন, কেসনি নিজেদের র্যাঞ্চ গড়ে তুলেছে, অন্যরা অতটা উঠতে পারেনি যদিও । ওরা পশ্চিমে এসেছিল যখন, পশ্চিমের জীবন ছিল কঠিন । ইন্ডিয়ান, গরুচোর, খরা আর গরম লু হাওয়র সাথে লড়ে টিকে থাকতে হয়েছে ওদের । এখানে টিকে থাকতে হলে কঠিন হতে হবে, এবং ওরা তাই । নীলই ওদের মধ্যে সবচেয়ে অল্পবয়সী, ওকে পুরো বিশ্বাস করতে পারেনা তাই অন্যরা সবসময় । মাত্র পাঁচবছর হয় নীল এখানে এসেছে ।
বাকস্কিন ঘোড়াটার ট্র্যাক দেখতে পাচ্ছে নীল । ভাবতে আজব লাগছে তার, এই ঘোড়ার সওয়ার কিছুক্ষন পরেই মারা যাবে, কেসনি বা হার্ডিনের স্যাডলহর্নে বাঁধা একটা দড়ির অন্য প্রান্তের ফাঁসে ঝুলবে ওর দেহ । কাউকে হত্যা করেনি নীল, দেখেওনি কোন হত্যা-দৃশ্য, তাই চিন্তাটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



