somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুন্য প্রান্তর ১ (ধারাবাহিক ওয়েস্টার্ন গল্প)

১১ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ ভোর ৪:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মরুভুমির পথ থেকে ওঠা ধুলো ওদের মুখের ওপর ধুসর এক আস্তর তৈরি করেছে ওদের মুখে এবং মুখ থেকে ঘামের স্রোত নেমে দাগ ফেলেছে , নীল দেখতে পাচ্ছে । নীলের নিজের অবস্থাও আশা করি তাই । রাইফেল হাতে ছয়জন কঠিন চেহারার অশ্বারোহী নীল, হার্ডিন, কিমেল, শর্ট, সাটার আর কেসনি ধাওয়া করছে একজন নিঃসঙ্গ আরোহীকে ।

এই কঠিন দেশের কঠিন, রুক্ষ প্রকৃতি গড়ে তুলেছে ওদের চরিত্র । দৃঢ় ন্যায়বিচারবোধ, অপরাধীকে শাস্তি প্রদানে কাঠিন্য, এবং অনুসরণে একগুঁয়ে । মরুভুমিতে গড়ে নিয়েছে ওদের বাড়ি, মরুভুমি থেকেই ওদের নৈতিকতাবোধের সৃষ্টি । এবং মরুভুমি সবসময়ই নির্দয় ।

'যাচ্ছে কোথায় লোকটা?"

'বাড়িতে, সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক । খাবার আর একটা রাইফেলের দরকার এখন ওর সবচেয়ে বেশি । বুড়ো সোরেনসোনের জায়গায় থাকে ও ।'

থুতু ফেলল কিমেল । 'সে চেষ্টা ও করে দেখতে পারে । ওখানে অন্তত চারজন লোক না খেয়ে মরেছে আমার জানামতে ।' বলে মাটিতে ঘোড়ার খুরের ছাপগুলোর দিকে চাইল সে । 'ভালো একটা ঘোড়ায় পেয়েছে সে ।'

'বড়সড় একটা বাকস্কিন ঘোড়া । তোমার মনে হয় আমরা ওকে ধরতে পারব হার্ডিন ?'

'নিশ্চয়ই । অবশ্য অনেকদুর দৌড়ুতে হবে আমাদের তাতে কোন সন্দেহ নেই । কারন শর্টকাট কোন রাস্তা ধরে ওর পথ আটকানোর কোন উপায় নেই আমাদের । আর একবারে সোজা বাড়ির পথে চলেছে সে ।'

'ট্রেইল লুকানোর কোন চেষ্টাই করছেনা ও ।'

'লাভ নেই ।' রোদের ঝাঁজ এড়াতে চোখ সরু করে চাইলো হার্ডিন । 'এ লোক জানে, আমরা বুঝে নেবো সোজা নিজের র্যাঞ্চের দিকে যাবে ও ।'

'আনাড়ি নয় লোকটা,' ওদের সবার মাথায় যে চিন্তাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সেটা মুখ ফুটে বলল কেসনি । 'ও জানে এরকম বন্ধুর রাস্তায় কীভাবে একটা ঘোড়াকে বাঁচিয়ে চলতে হয় ।'

প্রায় নিঃশব্দে পথ চলছে ওরা সবাই । দাড়ি না কামানো গাল চুলকাল হার্ডিন । ক্যাটক্ল আর মেসকিটের ঝোপের মাঝ দিয়ে চলছে ওরা, ঘোড়ার খুরের ঘায়ে ধুলোর মেঘ উঠছে । রোদে ঝলসানো, পানিশুন্য প্রান্তর এটা । রোদের তাপে ধুলির ঘুর্নি আর দূরের নীলাভ পর্বত শ্রেণী টেনে নিয়ে চলেছে ওদের । যে ট্রেইলটা ধরে চলেছে ওরা ওটা একদম সোজা চলে গেছে সামনের দিকে । কেবল নাবাল জমি বা পাথুরে কোন ছোট টিলার কাছে এসে পথটা বাঁক নিয়েছে ।

কাকে অনুসরণ করে চলছে, সে কেমন মানুষ তা চোখে দেখার সবসময় প্রয়োজন নেই, তার চলার পথচিহ্নই যথেষ্ট অনেক ক্ষেত্রে তা বলে দেয়ার জন্য । সে কী বিবেচনাশীল না নিষ্ঠুর, অজ্ঞতা বা ধুর্ততা, শক্তি ও দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার রেখে যাওয়া ট্রেইলে । ফ্রিডম শহর থেকে বেরিয়ে ঘন্টাদুয়েক ঘোড়া দাবড়ানোর পর লোকটা সম্বন্ধে অনেক কিছুই বুঝে ফেলল ধাওয়া করে আসা ছয়জন লোক । আরও অনেক কিছু জানবে ওরা চলার পথে ।

'কীসে শুরু হয়েছিল এটা ?'

কথাগুলো এই বিশাল নিস্তব্ধ শূন্যতার মাঝে ফাঁপা আর নিঃসঙ্গ শোনাল ।

হার্ডিন মাথা সামান্য ঘোরাল যাতে পেছনের লোক শুনতে পায় তার কথা । বৃষ্টি আর রোদের মধ্যে অনেক ঘোড়া চালিয়েছে যে লোক, এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে । রাইফেলটা বাঁহাতে চালান দিয়ে, ঘেমে যাওয়া ডানহাতের তালু প্যান্টের কর্কশ কাপড়ের ওপর ঘষল সে ।

'কানকথা । বনটনে এসেছিল লোকটা সওদাপাতি কিনতে । একটা কিছু বলেছিল তাকে জনি, তাতে ওর আঁতে ঘা লাগে । কিছু কথা কাটাকাটি হয় । জনির কাছে পিস্তল ছিল, কিন্তু এই লক লোকটা ছিল নিরস্ত্র । তো একটা পিস্তল যোগার করে লংহর্নে হাজির হল লক । দরজা ঠেলে ঢুকেই জনিকে সোজা দুবার পিঠে গুলি করল লক ।' থুতু ছেটাল হার্ডিন । 'তিননম্বর গুলিটা জনিকে মিস করে একটা হুইস্কির বোতল গুঁড়িয়ে দিল ।'

কথাগুলো হজম করতে ওরা কয়েকমুহুর্ত সময় নিল, তারপর মুখ খুলল নীল ।

'আমরা কী ওকে মানুষ খুনের দায় না কী হুইস্কির বোতল ভাঙ্গার জন্য ঝোলাতে যাচ্ছি ?'

ভালো প্রশ্ন, কিন্তু কোন উত্তর এলনা । কৌতুক জিনিসটা বাকি পাঁচ আরোহীর সন্মানের ওপর প্রশ্ন তুলতে পারেনা । একটা মিশনে বেরিয়েছে ওরা । ধুসর তামাটে মরুভুমির ওপর চোখ বোলাল নীল, কোন মানুষকেই লিঞ্চ করার ইচ্ছা নেই তার । এবং কেন সোরেনসন প্লেসের এই স্কোয়াটারকে ঝোলাতে সে চলেছে সে নিজেই জানেনা । ওরকম জায়গায় থাকাটাই তো একটা শাস্তি বিশেষ ।

'ও নাম কী বললে ? লক ?' জানতে চাইল নীল । কারো নাম না জেনেই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়াটা বেশ আজব ব্যাপার । দূরের নাচতে থাকা মরীচিকা হ্রদগুলোর দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে, জিনের ওপর দেহের ওজন পরিবর্তন করল নীল ।

'তাতে কী হয়েছে? ওর নাম লক, চ্যাট লক ।'

'অদ্ভুত নাম ।'

মন্তব্যটার জবাব দিলনা কেউ । ধুলো আরো গাঢ় হয়ে উঠছে, নীল ব্যান্ডানা রুমালটা নাক-মুখের ওপর টেনে নিল । তার চোখ আবার দূরের নীল হ্রদের দিকে চলে যাচ্ছে । ভারী ঠান্ডা আর লোভনীয় দেখাচ্ছে ওগুলোকে । সামনে ডানদিকে বেসিনের শেষ মাথায় এদের অবস্থান । মরীচিকা ওরা, অনেক মানুষকে টেনে নিয়ে গেছে পথ থেকে, ক্রম অপসৃয়মান তটরেখার দিকে । যতই এগোয়ে পথিক ততই পিছিয়ে যায় মরীচিকা ।

হয়তো সত্যিই পানি আছে এই দাবদাহ আক্রান্ত প্রান্তরে । একজন মানুষ যদি তার খোঁজ পায় তো পান করতে পারে । কথাটা মাথায় আসতেই হাত চলে গেল পানি রাখার ক্যান্টিনে । কিন্তু পানি না খেয়েই সরিয়ে নিল হাতটা । পাত্রের পানি গরম, নোনা আর অতৃপ্তিকর ।

'তুমি ওকে চেনো কিমেল?' কেসনি জানতে চাইল । মানুষটা ছোটখাটো কিন্তু চাবুকের মত মজবুত, ইস্পাতের মত কঠিন চোখ আর বাদামী পাকানো পেশীবহুল বাহু । 'দেখলে চিনবোনা আমি ওকে ।'

'অবশ্যই আমি ওকে চিনি । বিশালদেহী, পেটানো গড়ন, লালচে চুল, বছর চল্লিশেক হবে বয়স । বেশ দিলদরিয়া চেহারা, শুনেছি বেশ আমুদে বন্ধুবৎসল মানুষ সে । সোরেনসন প্লেসে বিনা অনুমতিতে বসবাস করছে, যদিও ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক । রোদে শুকানো হাড্ডির মত উষর জায়গাটা, ওখানে কেউ কিছু করে খেতে পারবেনা । মানুষ বা পশু কেউই বেঁচে থাকতে পারেনা ওরকম একটা জায়গায় । সবার ধারনা ওরকম একটা জায়গায় কোন সৎ লোক থাকতে পারেনা ।'

সত্যি একটা লোককে না দেখে তাকে খুঁজতে বেরোনো অদ্ভুত । অবশ্য ওরা সবাই জনি ওয়েবকে চেনে । সুদর্শন, জনপ্রিয়, দুঃসাহসী এক তরুন । সবাই তাকে চিনতো ও পছন্দ করত । ওদের ধারনা, নবাগত লোকটা অন্যায় করেছিল, কারন শুধু পিঠৈই গুলি খায়নি ওয়েব, আসলে সে পিস্তল ড্র করায়ও খুব ক্ষিপ্র ছিল । গোটা স্প্রিং ভ্যালি এলাকাতেই ওর মতো এতো ক্ষিপ্র পিস্তলবাজ আর দুটো ছিলনা । ক্ষিপ্র ও অব্যর্থ নিশানা ।

জনি ওয়েব ওদের সাথে কাজ করেছে । ওরা ওকে চেনে, ওরা ভালো মানুষ, যদিও রুক্ষ ও কঠিন স্বভাবের । কিমেল, হার্ডিন, কেসনি নিজেদের র্যাঞ্চ গড়ে তুলেছে, অন্যরা অতটা উঠতে পারেনি যদিও । ওরা পশ্চিমে এসেছিল যখন, পশ্চিমের জীবন ছিল কঠিন । ইন্ডিয়ান, গরুচোর, খরা আর গরম লু হাওয়র সাথে লড়ে টিকে থাকতে হয়েছে ওদের । এখানে টিকে থাকতে হলে কঠিন হতে হবে, এবং ওরা তাই । নীলই ওদের মধ্যে সবচেয়ে অল্পবয়সী, ওকে পুরো বিশ্বাস করতে পারেনা তাই অন্যরা সবসময় । মাত্র পাঁচবছর হয় নীল এখানে এসেছে ।

বাকস্কিন ঘোড়াটার ট্র্যাক দেখতে পাচ্ছে নীল । ভাবতে আজব লাগছে তার, এই ঘোড়ার সওয়ার কিছুক্ষন পরেই মারা যাবে, কেসনি বা হার্ডিনের স্যাডলহর্নে বাঁধা একটা দড়ির অন্য প্রান্তের ফাঁসে ঝুলবে ওর দেহ । কাউকে হত্যা করেনি নীল, দেখেওনি কোন হত্যা-দৃশ্য, তাই চিন্তাটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×