আজ ২৩শে ভাদ্র,ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে গেছে সমস্ত চরাচর;সেই নদীর ঘাটে বট গাছের নীচে ঠিক রাত দুইটায় এসে বসেছে অনীম, দীর্ঘ বিশ বছর পরে।এই বিশটা বছর কিভাবে কেটে গেছে জানেনা সে।
আজও স্পষ্ট,আজও অম্লান সব, কোথাও কোন কিছু একটুও ম্লান হয় নাই, মুছে যায় নাই কোন স্মৃতি।এমনি ভাদরের জ্যোৎস্নায় এই ভরা নদীর ঘাটে,এই বট গাছের নীচে ভরাডুবি হয়েছিল তার। কত বয়স হবে তখন? বাইশ-তেইশ, অনার্স শেষ করে কেবল মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে।
রিমার সাথে সম্পর্ক তার স্কুল জীবন থেকে।অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিল রিমা। সুন্দরি বলা না গেলেও যথেষ্ট আকর্ষণীয় ছিল,ওকে দেখলেই অনীমের রক্তের মধ্যে ভাঙ্গনের খেলা শুরু হয়ে যেত।
তখন মোবাইল ফোন ছিল না,ছেলে-মেয়েদের মেলা-মেশার ও তেমন সুযোগ ছিল না। দূর থেকে দেখা, একটু হাসি, একটু কথা ব্যস; চিঠির আদান-প্রদান ই মনের কথা শেয়ার করার একমাত্র মাধ্যম। তাও যে কত মধুর ছিল, কত আনন্দের ছিল।
চমৎকার চিঠি লিখত রিমা; এক একটা চিঠি কতবার যে পড়ত অনীম তার ঠিক নাই; আর সবচেয়ে মজার বিষয় হল যতবার পড়ত ততবারই নতুন করে ভাল লাগত। সে চিঠির পরতে পরতে মেশানো থাকত প্রেম-ভালোবাসা,অভিমান, স্বপ্ন, প্রতি মুহূর্তের অনুভূতি; অনেক বড় চিঠি লিখত রিমা।
রিমার সাথে তার প্রেমের শুরু হয়েছিল নাটকীয় ভাবে, ওদের স্কুলে যাওয়ার পথে বেশ খানিকটা যায়গা পার হতে হত বাগানের মধ্যে দিয়ে, দুই পাশে ঘন গাছ-পালা,মাঝখানে আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ। ছুটির পরে স্কুল থেকে বেরোতে ওর ওইদিন একটু দেরি হয়েছিল।
বাগানের পথে ঢুকে একটু খানি হেঁটেছে অনীম,অমনি উল্টা দিক থেকে ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে রিমা তাকে জড়িয়ে ধরল।থর থর করে কাঁপছে সে; মনে হচ্ছে যেন ওর হৃদপিণ্ডটা ছিটকে এসে পড়ছে অনীমের বুকের উপরে।
সেই প্রথম রিমাকে ওর জড়িয়ে ধরা, প্রথম প্রেমের প্রথম শিহরণ; আজও মনে দোলা দিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে অনীমকে ছেড়ে দিয়ে লজ্জায় রাঙ্গা রিমা জানাল তাকে পাগলা কুকুরে তাড়া করেছে, এবং সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে সে জেনে গিয়েছিল যে, কুকুরটা কালও একজনকে কামড়েছে।
ওরা কেউ কারো দিকে আর তাকাতে পারে নাই। রিমার ফেলে আসা বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে একসাথে দুজন ফিরল অনীম দের বাড়ি পর্যন্ত; রিমাদের বাড়ি আরও একটু সামনে ছিল। সেই থেকে শুরু। অবশ্য রিমার প্রতি তার ভাল লাগা ছিল আরও আগে থেকে।
সেদিন রাতে অনীমের টেবিলের উপরে একটা চিরকুট রিমার দেয়া,শুধু লেখা "ঠিক রাত দুইটায় নদীর ঘাটে বট গাছের নীচে এস।"
বিস্মিত অনীম ভেবে পেল না কি হল রিমার, এমন দুঃসাহসের কথা তো সে কখনও বলে নাই! দশটা চিঠিতে অনুরোধ করলে হয়তো একবার দেখা মেলে। তাও দিনের বেলা কোন বন্ধুর বাড়িতে।আর আজ নিজে থেকে দেখা করতে চাইছে তাও রাতে! এ দেখি মেঘ না চাইতেই মুষল ধারায় বৃষ্টি! কি বলবে, কি করবে ও, রিমাকে একা অত কাছে পেয়ে ভাবতে পারছে না।
সেদিনের সেই উত্তেজনার কথে মনে পড়লে এখনো দম বন্ধ হয়ে আসে অনীমের। সময় আর কাটে না,রাত একটা পঁয়তাল্লিশেই পৌঁছে গেল ওখানে। কিছুক্ষণ পরে দেখতে পেল রিমা আসছে ধীর পায়ে, শাড়ি পরেছে সে, চাঁদের আলোয় অপরূপ লাগছিল রিমাকে।
চোখ ভরা মুগ্ধতা নিয়ে অনীম চেয়ে আছে রিমার পথের দিকে, যেন কোন মহাসাগরের ওপার থেকে ধীর পদ-বিক্ষেপে কোন অপ্সরী এগিয়ে আসছে তার দিকে। বিস্ময় ভরা দু চোখ জুড়ে যেন স্বপ্নের আবেশ।
রিমা কাছে আসলে দু জন বসল বট গাছের শিকড়ের উপরে,একটু দূরত্ব রেখে একটু এঙ্গেলে বসল রিমা; চোখে চোখ রাখতে সুবিধা হয় যাতে তাই হয়তো।
অনীম বলল কি ব্যাপার অত দূরে থাকার জন্য ই কি এমন যায়গায়, এমন সময় ডেকেছ আমায়?
মুচকি হেসে বলল রিমা, হ্যাঁ। তোমায় কাছ থেকে দেখতে খুব খুব ইচ্ছে করছিল।
বসার সময় হাত ধরতে গেলাম, বেশ কৌশলে সরিয়ে নিলে; এ সবের মানে কি?
মানে তো আছেই।
কি?
শোন তুমি আমায় ভালোবাসো, আমিও তোমায় ভালোবাসি তাই আমাদের দুজনের মনের উপরে দুজনের পূর্ণ অধিকার আছে, কিন্তু শরীরের উপরে নাই। ওটা পেতে হলে সামাজিক স্বীকৃতি লাগে,যার নাম বিয়ে; আর আমাদের এখনও বিয়ে হয় নাই।
এই শোন, এই সব ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ কর। আমার কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। কার জন্য এত সতী পনা শুনি! তুমি কি আমি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবা?
উহু কক্ষনও না। এই জীবনে তো না ই অন্য কোন জীবনেও না। তুমি ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতেই পারি না অনীম।
আচ্ছা তোমার কি মনে হয়, আমি তোমারে কোন দিন অস্বীকার করব?
না।
মনে হয় আমাদের বিয়ে হবে না?
তাও না।
তাহলে?
তাহলে আছে, দেখ আমি আল্লারে ভয় পাই আর ধৈর্যে বিশ্বাস করি,; মনে কর আজকের রাতটা আমাদের সংযমের পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাস করলে হয় তো আল্লা খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি তোমার একটা ভাল চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে।
দেখ অনীম আমি তোমারে নিয়ে শুধু এই জীবনেই সুখী হতে চাই না, পর জীবনেও হতে চাই। পেপারে কি পড়েছি জান?
কি?
যারা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়, তারা দাম্পত্য জীবনে সুখী হয় না, এবং ঘর ভেঙ্গে যায়। আমার মনে হয় আল্লাই ওদের প্রতি অখুশি হয়ে ওদের সুখ কেড়ে নেয়। আরও মনে হয় জীবনে সুখী হতে গেলে যে ধৈর্য, সংযম, যে ত্যাগ আর নিজের প্রতি যে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, ওদের তা থাকে না তাই সংসার টেকে না।
মানলাম, বুঝলাম, এবং পণ করলাম, বাসর ঘরেই এ সবের শোধ তুলব।
সে তো আমি জানি। তোমারে চিনি না! আচ্ছা অনিম তুমি বেহুলার কাহিনী জান?
হুম।
ইস বেহুলার কী কষ্ট গো! বাসর রাতেই স্বামীটারে সাপে কাটল। আর বেহুলা সেই মরা স্বামী নিয়ে কত কি করল! আচ্ছা,কোন পুরুষ এমন করত? তোমার কি মনে হয় বল, করত?
অন্য পুরুষ কি করত জানি না, তবে আমি করতাম, নাউজু বিল্লাহ; আমার রিমাকে আমি কখনই হারাব না। জন্ম জন্মান্তরে না।
রিমা খেয়াল করল অনীম ওর সাথে কথা বলছে আর অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে আছে রিমার মুখের দিকে।
লজ্জা পেয়ে বলল রিমা কি দেখছ অমন করে?
তোমাকে। তুমি কি জান রিমা তুমি কত বেশি সুন্দর?
যাহ! সুন্দর না ছাই। তুমি ভালোবাসো তাই তোমার কাছে অমন মনে হয়। আমি সুন্দর এ কথা অন্য কারো সামনে বল না যেন, লোকে তোমায় পাগল বলবে।
ওহ ভাল কথা তোমার জন্য একটা জিনিস আছে তো, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
এক গাল হেসে রিমা বলল কই কি জিনিস দেখাও।
অনিম পকেট থেকে একজোড়া নূপুর বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল, সেদিন মেলা থেকে এনেছি। আমার কাছে বেশি টাকা ছিল না। ভাবছি সস্তায় তোমায় দেবার মত কি পাওয়া যায়, তখন দেখলাম একজন নূপুর বিক্রি করছে।
এর চেয়ে ভাল জিনিস আর কি হতে পারত বল, তোমার দুই পা জড়িয়ে ধরে ছন্দে ছন্দে বেজে বেজে ওরা আমার হয়ে তোমায় বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসো ভালবাসি-------------------
একদম ঠিক বলছ। তুমি কি জান নূপুর আমার কত পছন্দ?ইচ্ছে করছে এখনি তোমায় পরিয়ে দিতে বলি।
ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল রিমা, অনিম ওঠ আর সময় নাই, সকাল হয়ে এলো।
সকালের অনেক দেরি, আর একটু থাক না; ইস! রাতটা যদি আর শেষ না হত!
উঃ অনিম!----- হঠাৎ রিমার আর্ত চিৎকার।
কি হল রিমা? অনিম দেখতে পেল একটা সাপ এঁকে বেঁকে চলে যাচ্ছে, আর রিমার পায়ে দুটো রক্ত বিন্দু।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




