তুমি আজ চলে গেলে বাবা, আমায় বড় একা করে। আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে কষ্ট কে আচ্ছাদিত করে রাখছে অনাবিল এক সুখ। আজ তোমার মহা মিলনের দিন, অনন্ত মিলনের দিন; প্রতিটা মুহূর্ত যে দিনের জন্য তুমি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে।
বুকটা আমার শূন্য হয়ে আছে কিন্তু আমি কাঁদি নি। মধু মিলনের মধুর ক্ষণ যে তোমায় কি গভীর ভাবে টানছিল, তোমার সমস্ত অবয়বে তা ফুটে উঠছিল; সে মধুর হাসিটাও তুমি সাথে করে নিয়ে গেছ বাবা। মা নিশ্চয় খুব খুশি হয়েছে; মায়ের সাথে কি তোমার দেখা হয়েছে বাবা? মা কি সাজে সেজেছে বাবা? কেমন করে আলো ঠিকরে পড়ছিল মায়ের চোখ দিয়ে? ইস! যদি দেখতে পেতাম!
জীবন –মরণের সীমান্তেই আমার কাজ, অনেক মৃত্যু দেখেছি আমি; কিন্তু তোমার মৃত্যু এ তো মরে যাওয়া নয় বাবা; এ তোমার মায়ের কাছে যাওয়া। তোমাদের সংসার আমার ভাল মনে নাই, মায়ের চেহারাটাও আমার কাছে অস্পষ্ট। মায়ের মৃত্যুটা কেন যেন মনে করতে পারি না, মনে করার বয়স তো তখন ছিল আমার!
মায়ের অভাবে আমায় তুমি কখনই কষ্ট পেতে দাও নাই; মায়ের জন্য কষ্ট পাওয়াটা যেন ছিল তোমার নিতান্তই ব্যক্তিগত, যেখানে আমাকেও তুমি ঢুকতে দিতে না।
ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরে তোমার সাথে যখন আমি কি বিষয়ে পড়া-শুনা করব তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল; ফাইনালি তুমি আমার হাতে মায়ের ডায়েরীটা ধরিয়ে দিয়ে গেলে; দুষ্টু একটা হাসির ঝলক ছিল তোমার চোখে-মুখে। সেই প্রথম আমি মায়ের ডায়েরী পড়ার সুযোগ পেলাম। দেখতে পেলাম, সে এক আলোকিত পথ নির্দেশ।
আর আমার কখনও ভাবতে হয় নাই, আমি কি করব। আমার আজকের জীবন পুরোটাই মায়ের রূপ-কল্প। সেদিনই প্রথম মাকে আমি বিশেষভাবে অনুভব করলাম; খুব ইচ্ছে করছিল তাঁকে ছুঁয়ে দেখতে। সারারাত আমি ঘুমাতে পারি নি।
ফজরের নামাজ পড়ে তোমার একটু ঘুমানোর অভ্যাস ছিল, নামাজ পড়ে তুমি যখন শুয়ে পড়লে, আমি আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না। সারা রাতের কান্না আমার বাঁধ-ভাঙ্গা জোয়ারের মত বেরিয়ে এলো। আছড়ে পড়লাম তোমার বুকের উপরে, দু’জনে এক সাথে কাঁদলাম। তার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম, এখান থেকে পাস করার পরে, আমার কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না তোমায় ছেড়ে যেতে। তুমি শুনলে না। অবশ্য আমি দেশে থাকতেই তুমি মায়ের রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে ছোট আকারে গড়ে তুলেছিলে তোমার অনাথাশ্রম।যাতে আমার অবর্তমানে তোমার কষ্ট না হয় এটুকু ব্যবস্থা ছিল। তাছাড়া তোমার চাওয়া, মায়ের স্বপ্ন আমায় বাধ্য করল দেশ ছেড়ে যেতে।
মায়ের স্বপ্ন পূরণ হল বাবা, আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তারদের একজন হয়ে ফিরে এলাম দেশে। গড়ে তুললাম এই বিশাল হাসপাতাল, তোমার অনাথাশ্রমকে পূর্ণতা দিলাম তোমার চাওয়ার মত করে। সেখানে ঠাঁই পেল অসংখ্য পতিতার সন্তান, অবৈধ সন্তানও, যাদের পচে গলে আস্তা কুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কথা ছিল, তাদেরও তুমি তুলে এনে পরম মমতায় লালন করেছ, শুধু বড় কর নি, তারা সবাই এখান থেকে বের হয়ে যায় প্রতিষ্ঠিত ভাল মানুষ হয়ে।
তোমার আশ্রমে পতিতার সন্তানে রা ও কেন ঠাঁই পেত, তা তুমি আমায় বল নি বাবা, আমি মায়ের ডায়েরি পড়ে জেনেছি। তোমার পরিচয় ছিল কয়েকজন পতিতার সাথে, সে কথা শুনে মা তোমার সাথে গিয়েছিল সেখানে, ওদের জীবন কেমন দেখতে। আর ওদের কষ্ট ওদের অনুভূতিই মায়ের মনে এমন স্বপ্ন জাগিয়েছিল।
প্রতিমাসে বিলের হিসেবটা নিয়ে নত মুখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে তুমি এসে আমায় বলতে এ মাসে খরচটা একটু বেশী হয়ে গেল মা, রাগ করিস না; সামনে মাস থেকে আর এমন হবে না দেখিস।
সারাদিনের ব্যস্ততার মধ্যেও তুমি আযান হলেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে; শুধু এশার নামাজটা পড়তে তুমি ঘরে বসে, দীর্ঘ সময় নিয়ে, গভীর একাগ্রতার সাথে।আমার মনে হত ওই সময় তুমি শুধু তোমার স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে না, আমার মায়ের সাথেও কথা বলতে।
আমার আর কিছু চাইবার নাই বাবা। শুধু দোয়া কর তোমার মত করে যেন তোমার প্রতিষ্ঠান গুলো চালাতে পারি, আর তোমাদের মত যেন আমিও সু সন্তান রেখে যেতে পারি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




