somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মা হওয়া।

২৯ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মাতৃত্ব নারী জীবনের পূর্ণতার সবচেয়ে বড় মিয়ামক। “মা” এই ছোট্ট কথাটা যেন পৃথিবীর সকল কথার মধুর নির্যাস। তাই মা হওয়ার স্বপ্ন সকল মেয়েরই থাকে।
আমারও হয়তো ছিল, কিন্তু আমি তেমন করে বুঝতাম না। বিয়ের পাঁচ বছর পার হয়ে গেল, কোন বাচ্চা হল না। আমার বিয়ের পর ভাই বিয়ে করল, তার ছেলে হেঁটে বেড়ায়, দেবর বিয়ে করল তার ছেলের বয়স এক বছর। আর আমি তখনও একা।
বিষয়টা নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। যার যত বাচ্চা আছে সব গুলোকেই আমি আদর করি, ওদের মায়েদের চেয়ে আমার কাছে থাকতে কেউ কম পছন্দ করে না। কিন্তু নিজের, একান্তই আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে কেউ আসুক এমন আকুতি আমার মধ্যে ছিল না।
আমরা তখন বরিশালে থাকি, অল্প কিছুদিন হল ওখানে একটা স্কুলে ঢুকেছি। আমার হাজব্যান্ড কোন দিনই আমার চাকরি করার পক্ষপাতী ছিল না। একা আমার সময় কাটে না, আবার স্কুলটা মেয়েদের তাই অনুমতি পেলাম। ছুটিতে বেড়াতে গেছি আগে শ্বশুর বাড়ি, তার পরে বাপের বাড়ি যাব। প্রতিবেশী এক মহিলা আমাকে দেখে আমার শাশুড়ি মাকে বললেন কিরে মাসুদের মা ছোট ছেলে সে দিন বিয়ে করালে তার ছেলে হয়ে গেল আর তোমার বড় বউয়ের এখনও কোল খালি! বউ কি বাঁঝা নাকি রে?
আমার শাশুড়ি একটু বিরক্তির সাথেই বললেন, বালাই সাট! বাঁঝা হতে যাবে কেন? লেখা-পড়া, চাকরি,কত ঝামেলা ওদের; আল্লহ দিলে বাচ্চা হবে।
পরে এক সময় আমাকে খুব কাছে নিয়ে আদর করে আমার শাশুড়ি আমায় বললেন, ও মা, এখন একটা বাচ্চা নাও, আর ওষুধ-টষুধ খেও না; এখন কোল জুড়ে বাচ্চা না থাকলে কি ভাল দেখা যায়? সব কিছুর একটা সময় আছে।
আমি বললাম, আমিতো কোন ওষুধ খাই না মা।
মায়ের মুখে উদ্বেগের ছাপ, ওষুধ খাও না মানে?
হ্যাঁ, মা, খাই না তো।
দুষ্টুমি করিস না মা, সত্যি করে বল তুই আর ওষুধ খাবি না।
আমি দুষ্টুমি করছি না, মা। সত্যি আমি কোন ওষুধ খাই না, কিচ্ছু করি না।
তাহলে এবার যেয়ে একটু ডাক্তার দেখাবা। তুমি তো আমারে চিন্তায় ফেলে দিলে, আমি ভাবি যে তোমার লেখা-পড়া,চাকরি এসব কারণে ইচ্ছে করে বাচ্চা নাও না। এক কবিরাজ আছে উনার তাবীযে খুব কাজ হয়। দাঁড়াও দেখি, আমি নিজে যেয়ে উনার কাছ থেকে তাবীয এনে দেব।
আমি বললাম, ওসব কিছু লাগবে না, মা, আমি যেয়ে আগে ডাক্তার দেখাই।
বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় শাশুড়ি মা বার বার করে একই কথা বলে দিলেন।
ওখান থেকে গেলাম আমার বাপের বাড়ি। সেখানেও দেখি একই অবস্থা; কেউ স্পষ্টে কেউ অস্পষ্টে আমার বাচ্চা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সাথে একটা আশংকা প্রকাশ করছে।
আমি একটু থমকে গেলাম। তাইতো সকলের দেখি বিয়ে হলেই বাচ্চা হয়; আমার হচ্ছে না কেন! আমার কি কোন সমস্যা!
সকলের না না রকম আলোচনায় আমার মধ্যেও দেখি মাতৃত্ব জেগে উঠল। হঠাৎ করেই যেন সাগর সম তৃষ্ণা। আমি মা হওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলাম।
বাসায় ফিরে এসে স্কুলে গেছি সেখানেও ওসব নিয়ে কথা; আসলে কথাগুলো আমি আগেও হয়তো শুনেছি, তখন অমন করে মনে লাগে নি এখন যেমন লাগছে।
আমার দুই সহকর্মী, স্বাতী আপা আর রওশন আপা দুজন নিঃসন্তান ছিলেন। রওশন আপার বিয়ে হয়েছে আঠার বছর আর স্বাতী আপার তিন চার বছর। স্বাতি আপার সমস্যা, সে প্রেগন্যান্ট হয় আর এবরশন হয়ে যায়, আর রওশন আপার হয়ই না।
স্বাতী আপা খুব কান্না-কাটি করত পাগলের মত মাঝে মাঝে বলত, আমি কি আমার ওসব বাচ্চাদের জন্য মিলাদ দিতে পারি? এ জীবনে তো আমি ওদেরকে পেলাম না, পর জীবনে কি পাব? এমন আকুলতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করত, যে সবার মন ভারী হয়ে যেত।
আর রওশন আপার মুখটা মলিন হত, অন্য কোন প্রকাশ ছিল না।
একদিন আমি বাসায় ফিরছি হেঁটে হেঁটে সাথে রওশন আপা। গল্প করতে করতে হাঁটছি দুজন; আমি একবার আপাকে বললাম, আপা, স্বাতী আপা তো অনেক পাগলামি করে, সব রকম চেষ্টা করে। আপনাকে যে কিছু বলতে শুনি না, আপনি কি চেষ্টা করেন না?
আপা আমার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, স্বাতি প্রকাশ করতে পারে, আমি পারি না, চেষ্টা কি কম করেছি রে দেশে-বিদেশে কোন খানেই ডাক্তার দেখাতে বাদ রাখি নি। ডাক্তার আমার শরীরটাকে ফেঁড়ে চিরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে, আমার জন্য একটা বাচ্চা পায় নাই। তবেই না হাল ছেড়েছি। তার কষ্টের যে কি তীব্রতা তা তার কথা এবং হাতের স্পর্শে আমার সমস্ত অস্তিত্বে ছড়িয়ে গেল।
আমার বরাবরই একটা অভ্যাস আছে, আমার যা কিছু চাই তার জন্য চেষ্টা তদবির যে টুকুই করি বা না করি সবচেয়ে বেশি যা করি তা হল প্রার্থনা। আমার বদ্ধমূল ধারণা যা করার আল্লাই করবেন, আর তিনি যখন চাইবেন উপায়ও তিনিই বের করে দেবেন।
আমি একদিন খুব মন দিয়ে প্রার্থনা করছি, আল্লাহর কাছে বাচ্চা চাচ্ছি; হঠাৎ মনে হল কল্যাণ-অকল্যাণ তো একমাত্র আল্লাই জানেন। সন্তান লাভে আমার মঙ্গল না হয়ে অমঙ্গলও তো হতে পারে।তখন আবার মুনির-খুকির সেই বহুল আলোচিত মামলা চলছিল, মনে পড়ল মনিরের মা ডাক্তার মেহেরুন নেসার কথা।
সন্তানের জন্য তার কষ্ট, তার ব্যর্থতা মনে নাড়া দিয়ে গেল। মনে হল আহারে! মনির তো তার একমাত্র সন্তান, পাহাড় সম প্রাচুর্য দিয়েও তাকে বাঁচাতে পারল না, বরং সন্তানের কারণে সকল অর্জন আজ ব্যর্থ হয়ে গেল। এই মায়েরও হয় তো তাকে পাওয়ার জন্য একদিন আমারই মত এমন ব্যকুলতা ছিল; থমকে গেল আমার চাওয়া।
আল্লাহকে বললাম, হে আল্লাহ, হে বিশ্ব-জগতে্র একচ্ছত্র অধিপতি,সর্ব শক্তিমান, দয়ার সাগর, কল্যাণ- অকল্যাণের মালিক, সর্ব জানা, ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক, আমার মনের সকল অবস্থাই আপনি জ্ঞাত আছেন। আমায় আপনি একটা সন্তান দেন আল্লাহ, তার মধ্যে যদি কোন অকল্যাণ থাকে আপনি তা দূর করে, তাকে আমার দীন-দুনিয়া দো জাহানের শান্তির উপাদান করে আমায় দেন।
এর মধ্যে আমার শ্বশুরের ক্যান্সার ধরা পড়লে উনাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হল চিকিৎসার জন্য, আমরাও গেলাম, কয়েকদিন থাকলাম সেখানে। বাসার সবাই আমায় গাইনীর ডাক্তারের কাছে পাঠাল।ডাক্তার দেখে বললেন, তেমন কোন সমস্যা নাই, অল্প কিছু ওষুধ দিলেন, আমরা কয়েক দিন পরে বাসায় ফিরে এলাম।
একদিন রাতে স্বপ্নে দেখি, আমার আব্বা যিনি আমার বিয়ের আগেই মারা গেছেন, আমাদের ঘরের সামনে উঠানে একটা চেয়ারে বসে আছেন, আর আমি তার গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি; যেমন আব্বা বেঁচে থাকতে অনেক থাকতাম।
আব্বা আমাকে বলছেন মা, তোমার বাচ্চা নাই? আমি বলছি, না, আব্বা হয় না তো। আব্বা আমাকে সুরা কাহাফের কিছু অংশ তেলাওয়াত করে শুনায়ে বললেন, তুমি এটা পড়, তোমার বাচ্চা হবে।
সকালে জাগার পরে আব্বা যে অংশটুকু তেলাওয়াত করেছিলেন তা আমার মনে ছিল না; আর কোরানে ওরকম কোন সুরার নাম শুনেছি কি না তাও মনে করতে পারছিলাম না।
আমি দ্রুত ওযু করে এসে কোরান শরীফ খুলে সুরা টা পেয়ে গেলাম, এবং নির্ধারিত অংশটুকু মনে না থাকায় পুরোটাই পড়লাম। আমার হাজব্যান্ড ছাড়া আর কাউকে স্বপ্নের কথা বললাম না।
তার কিছু দিন পরে আমি আবার স্বপ্নে দেখলাম, আমি সেই যায়গায় যেখানে আব্বার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু সেখানে আব্বা ছাড়া বাড়ির অন্য সবাই আছে। হঠাৎ একটা সাপ এসে আমাকে কামড়ে দিল, আমার পায়ের পাতা সঙ্গে সঙ্গে ফুলে উঠল আর সাপটা চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ উদ্বিগ্নও হচ্ছে না সাপ টা কে মারারও চেষ্টা করছে না।
সকালে আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল, শুনেছি সাপ নাকি শত্রুর প্রতীক। আমার ছোট ননদ থাকত আমার সাথে, ওকে স্বপ্নের কথা বললাম।
ও শুনেই হাত তালি দিয়ে হেসে উঠল; এই তো মণি হবে, ও ওর ব্যাখ্যার সপক্ষে বেশ কিছু ঘটনা বলল; আমি চিন্তা মুক্ত হলাম।
ওই মাসেই আমার মধ্যে মা হওয়ার লক্ষণ এলো, ডাক্তারের কাছে গেলাম, টেস্ট করালাম, রেজাল্ট পজিটিভ আসল।
দুই বাড়ির লোকজনের সাথে আমার কলীগ রাও খুব খুশি হলেন। আমার প্রতি সকলের সেই সময়ের আন্তরিকতা মনে পড়লে আজও আমার হৃদয় সিক্ত হয়ে যায়।
হেড-মিস্ট্রেস আপা আমাকে ডেকে হাজার রকম পরামর্শের সাথে বললেন, আমার রিক্সায় আসা-যাওয়া করা চলবে না, স্কুলে যেতে যদি দেরি হয়, ভাল না লাগলে না যাই সব মাফ। আমি সবার অতি যত্নের পাত্রী হয়ে উঠলাম।
আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া, যে আমার কখনও স্কুল থেকে কোন বাড়তি সুযোগ নিতে হয় নাই, পুরোটা সময় আমি সুস্থ ছিলাম।প্রতি মাসেই ডাক্তার দেখাতাম, ডাক্তার আয়রণ ট্যাবলেট আর ভিটামিন ছাড়া অন্য কোন ওষুধ দিতেন না।
আল্লাহর রহমতের আরও একটা বিস্ময়কর ঘটনা, আমি আমার বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে ঠিক মত খাওয়া শিখলাম, যেখানে অন্যদের খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হয়। খাওয়া শিখলাম বলছি এই জন্য যে, ছোটবেলা থেকেই আমার খাবারে খুবই অনীহা ছিল; কোন একদিন আমি তিন বেলা ঠিকমত খেতাম না।
আমি মনে করি আমার এত সুস্থ থাকার কারণ শুধু মাত্র আমার আল্লাহর উপরে নির্ভরতা।
যাহোক আমার মা অসুস্থ ছিলেন, তাঁর পক্ষে আমার কাছে এসে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বাচ্চা হওয়ার সময় বাড়িতে থাকব। হেড মিস্ট্রেস কিছুতেই ছাড়বেন না, গ্রাম থেকে মানুষ এমন সময় শহরে আসে আর আমি শহর থেকে গ্রামে যাব, এটা কিছুতেই হবে না। অনেক অনেক কথা বললেন, কত রকম বিপদ হতে পারে সব বুঝালেন। আমি নাছোড় বান্দা, মায়ের কাছেই থাকব। আমাকে বুঝিয়ে না পেরে, অনেক দোয়া করে সকলে আমায় বিদায় দিল।
আমার বাবা নাই, বাড়িতে মা, বড় ভাই-ভাবী আর তাদের বাচ্চারা। আমি আমার বাচ্চার জন্য কয়েকটা কাঁথা বাসা থেকে সেলাই করে নিয়ে আসছিলাম। বড় ভাবী কাঁথা সেলাই করবে বলে কাপড় বের করছে, দেখি তার মধ্যে কিছু কাপড় কাঁথার সাইজে ছেঁড়া, আবার দুইটাতে খানিক খানিক সেলাইও করা, কি ব্যাপার?
জানলাম,আমার ছোট ভাবী দিয়ে গেছে। তারা কিছুদিন আগে আমেরিকায় গেছে, ভাবীর অফিস, দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি, কত ঝামেলা, কিন্তু আমার ছোট ভাই নাছোড় বান্দা তার আদরের ছোট বোনের বাচ্চার জন্য ভাবীর কাঁথা সেলাই করতেই হবে। ভাবী করব করব করে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেও পারে নাই। সে দেখতে চায়, কাপড় কেমন ছেড়া হল, কতটুকু সেলাই হল। ছোট ভাবী বাধ্য হয়ে অতটুকু করে বড় ভাবীর কাছে দিয়ে গেছে বাকিটা শেষ করে দিতে।
আমি বড় ভাবীকে বললাম, তোমার করা লাগবে না, আমিই বাকী সেলাইটা করে নেব। ওই কাপড় গুলো তখন আমার কাছে কাপড় না, আমার ভাইয়ের জমাট বাধা ভালবাসা হয়ে উঠল।চোখের জলে মমতায় সিক্ত সুতায় গেঁথে গেঁথে আমি নিজেই বাকি সেলাই শেষ করলাম।
বাড়িতে অসুস্থ মা, আমার এ অবস্থা, সংসার সামলিয়ে ভাবীর যাতে অতিরিক্ত কষ্ট না হয়ে যায় আমি সে দিকে খেয়াল রাখতাম। যতটা সম্ভব ভাবীকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম, অন্য দিকে ভাবীও মা অসুস্থ বলে আমার যাতে মনে কষ্ট না হয় তাই তার যথাসাধ্য আমার জন্য করত।
একদিন বিকেলে ঘরে ঢুকে দেখি মায়ের মুখ মলিন, কি হয়েছে জিগ্যেস করতে ছল ছল চোখে মা বললেন, তোমার মত এমন সময়ে এ পাড়ার এমন কোন মেয়ে নাই, যাকে আমি কিছু খাওয়াই নাই, যত্ন করিনাই, আমার এমনি ভাগ্য, যার জন্য সবচেয়ে বেশি করতে ইচ্ছে করে, তার জন্য আমি কিছুই করতে পারি না।
আমি বললাম আচ্ছা মা, তুমি না বল আল্লাহর মমতা মায়ের মমতার চেয়ে সত্তর গুণ বেশি? তুমি আমার জন্য যেটা করতে পারছ না সেটা কিন্তু আল্লাহ ঠিক ই করে দিচ্ছে, তাই আমি এমন সুস্থ রয়েছি। আমি যদি অসুস্থ থাকতাম আর তুমি আমার সেবা যত্ন করতে সে কি এর চেয়ে ভাল হত?
মা আমার কথায় প্রচণ্ড খুশি হয়ে বললেন, তাইতো আমি আর মন খারাপ করব না। আল্লাহ তোমায় এত ভাল রাখছে তার পরেও যদি আমি মন খারাপ করলে তিনি অখুশি হবেন।
বাবু যেদিন হল, ওই দিন সকাল বেলা আমার একটু একটু খারাপ লাগছে, ভাবি রান্না ঘরে রান্না করছিল, আমি দুয়ারের কাছে যেয়ে বললাম, ভাবি আমার কেমন যেন লাগছে, আজ কিছু একটা হবে। আমার যত কষ্ট হোক দেখ আমি কোন চিল্লা-চিল্লি করব না। আমার কষ্ট হচ্ছে জানলে মা সইতে পারবে না। আমি তখনও বুঝি নাই, আমার জন্য কি কঠিন কষ্ট অপেক্ষা করে আছে।
ভাবি তটস্থ হয়ে উঠে বলল, তুই ঘরে যা, আমি ভাত নিয়ে আসছি, যা রান্না হয়েছে তাই দিয়েএকটু খেয়ে নে, পরে আর খেতে পারবি না।
ঘরের মধ্যে এক খাটে মা শোয়া, অন্য খাটে আমি। খুব যখন ব্যথা ওঠে, খাটের বাতা শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে থাকি, আবার একটু ভাল লাগলে মায়ের সাথে কথা বলি। মা কিছুই বুঝতে পারছে না, ভাবি ওদিকে তার মত সব গুছিয়ে নিয়েছে।
আস্তে আস্তে আমার কষ্ট বাড়তে থাকল, বাড়িতে লোকও বাড়তে থাকল। সারাটা দিন কষ্ট পেলাম, কি নিদারুণ তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ এ কষ্ট সকলেরই জানা। তবে আমি আমার পণ রেখেছিলাম, মাকে আমার কষ্ট বুঝতে দেই নি।
গ্রামের ডাক্তার আগা-গোঁড়াই আমাদের বাড়িতে ছিলেন, ধাত্রী ছিল একজন ট্রেইন্ড নার্স। রাত পৌনে এগার টায় আমার ছেলে জন্মাল। সেই মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না,শুধুই অনুভবের। বাড়িতে আনন্দের ধুম লেগে গেল।
আমি সুস্থই ছিলাম, চেতনে অচেতনে রাতটা কাটল। পর দিন সকালে প্রথম ভাল করে ছেলের মুখ দেখলাম।
ওরে কোলে নিয়ে আমি অপলকে মুখের দিকে তাকিয়ে আছি; আমার সামনে এক অপার বিস্ময়। আল্লাহর ক্ষমতা, মহিমা আর একবার মনের মধ্যে প্রকটিত হল, ইহকাল পরকালের সকল ভাবনা মনে এলো।
শেষ বিচারে সন্তানের জন্য মাকে যে জবাবদিহি করতে হবে আমি তার যৌক্তিকতা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করলাম। আমার কোলে মানব সন্তান রূপি এই যে মাংসের টুকরা এ পৃথিবীর কিছুই জানে না, বোঝে না। এরে আমি হারাম-হালাল যা খাওয়াব তাই সে খাবে, যা শেখাব তাই সে শিখবে, তাহলে তার ভাল-মন্দের জন্য কেন আমার জবাবদিহিতা থাকবে না!
আমার উপরে আল্লাহর দেয়া কত বড় গুরু দায়িত্ব অর্পিত হল বুঝে আমার আনন্দ রূপান্তরিত হল ভয়ে।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, “মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত,” বুঝে আসছি এর অর্থ হল মায়ের সেবা করে যে সন্তান মাকে খুশি রাখতে পারবে, সে বেহেশতের প্রবেশাধিকার পাবে। আমার কাছে কথাটা তখন অন্য অর্থে প্রস্ফুটিত হল।
মনে হল মা যদি সন্তানকে দীন চেনান, সুশিক্ষা দেন, ভাল মন্দের পার্থক্য বুঝান তবেই তো সন্তান বেহেশতের পথ চিনবে। মায়ের প্রতি খোদার প্রতি তার দায়িত্ব পালন করতে শিখবে, তাই হয়তো বলা হয়েছে যে, মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত।
ভাবনার গভীরে তলিয়ে গেলাম আমি, দেখলাম আমার তো এ দায়িত্ব যথোপযুক্ত ভাবে পালন করার কোন ক্ষমতা নাই, আবার এ দায়িত্ব এভয়েড করারও কোন উপায় নাই। তখন আমি আবার সেই সর্ব শক্তিমানের কাছেই সাহায্য চাইলাম, প্রার্থনা করলাম।
হে আল্লাহ, মানুষ আমি, আপনার অধম, অসহায় সৃষ্টি, আপনি যে দায়িত্ব দিয়েছেন তাতে আমি আপনার প্রতি সন্তুষ্ট মওলা। কিন্তু, আপনি জানেন, আমার অপারগতা, আমার অক্ষমতা, এই সম্মানিত কঠিন দায়িত্ব পালনে আমার অনুপযুক্ততা।
দয়া করেন আল্লাহ, আমার জন্য আমার এ কাজকে আপনি সহজ করে দেন, আপনি আমার সাথে থাকেন।আমি নবী-রাসুল না, যে আপনি আমায় ওহী পাঠাবেন, মুসা নবীর মায়ের মনে যেমন আপনি উপযুক্ত ইচ্ছে দিয়েছিলেন, আমার জন্য সেটুকু অন্তত করেন।
একে যেন আমি আপনার পছন্দের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।তাকে যেন বেহেশতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারি এ তৌফিক আপনি আমারে দেন। এই সন্তানকে আমার ইহকাল-পরকালের শান্তি এবং গর্বের উপাদান করে দেন। পর জীবনের জবাবদিহিতা থেকে আপনি আমাকে মুক্ত রাখেন; আমীন।





সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ২:২৩
৩৯টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারো বলছি দেশে জঙ্গী নেই উহা ছিল আম্লিগ ও ভারতের তৈরী

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:০৮


আওয়ামী নস্টালজিয়ায় যারা অন্তরের ভিতর পুলকিত বোধ করে তাদের কাছে বাংলাদেশ মানেই হলো জঙ্গী, অকার্যকর অথবা পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্র। ৩৬ জুলাই পরবর্তী মহা-গণবিস্ফােরনকে কোনাভাবেই মানতে পারেনি তারা ভয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী-লীগের ছায়া দায়িত্ব নিয়ে তারেক জিয়া এখন দেশে

লিখেছেন অপলক , ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৬



সংবাদের টাইটেল অনেক কিছু বলে দেয়। ভেতরেটা না পড়লেও চলে। বস্তুত: এতদিন ধরে ভারতের গ্রীন সিগনাল পাচ্ছিলেন না, তাই তারেক জিয়া দেশে আসার সময় বারবার পিছাচ্ছিলেন। এখন চুক্তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভোটের পর, আমরা পাকীদের বুটের নীচে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩২



পাকীরা অমানুষ, অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহক; ওরা ২টি জাতিকে ঘৃণা করে, ভারতীয় ও বাংগালীদের; ওরা মনে করে যে, বাংগালীদের কারণেই পাকিরা হিন্দুদের কাছে পরাজিত হয়েছে ১৯৭১... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফুড ফর থট!!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৩৫



একটা বিশাল আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত আকার দেয়া খুবই কঠিন, বিশেষ করে আমার জন্যে। তারপরেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবলাম কিছু কথা বলা উচিত। দেশের আভ্যন্তরীন বা আঞ্চলিক রাজনীতিতে ক্রমাগত বড় বড় ভূমিকম্প... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক রহমান আসবে, বাংলাদেশ হাসবে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৮


আমি যখন স্কুলে পড়তাম, দুপুরের শিফটে ক্লাস ছিল। একদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি ছোটো মামা সংসদ টিভিতে অধিবেশন দেখছেন। কৌতূহল হলো, মামা এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছেন। আমিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×